“সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কোনো মহল বিচার বিভাগ ও বিচারকবৃন্দকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে সংবিধান, আইন, মামলার রায় ও আদেশ সম্পর্কে মনগড়া বিবৃতি দিয়ে জনসাধারণের কাছে বিচার বিভাগ এবং বিচারকদের সম্পর্কে নেতিবাচক বিদ্বেষপ্রসূত ধারণা দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত।”
Published : 20 Dec 2023, 06:13 PM
১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধন করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক বছর ধরে ১৮ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছরের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সংবর্ধনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা অত্যন্ত গুরুত্ব বহনকারী। ভাষণে তিনি সেসব তথাকথিত সবজান্তাদের প্রতি সতর্কতা উচ্চারণ করে তাদের নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী সংবিধানের অপব্যাখ্যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেছেন, “সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কোনো মহল বিচার বিভাগ ও বিচারকবৃন্দকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে সংবিধান, আইন, মামলার রায় ও আদেশ সম্পর্কে মনগড়া বিবৃতি দিয়ে জনসাধারণের কাছে বিচার বিভাগ এবং বিচারকদের সম্পর্কে নেতিবাচক বিদ্বেষপ্রসূত ধারণা দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই সংবিধান অনুযায়ী সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যা করার একমাত্র অধিকার রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের এবং সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যা, রায় ও আদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১১ ও ১১২ অনুসারে সকলের জন্য শিরোধার্য ও অবশ্যই পালনীয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন করে, সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতা রাখে সেই জাতীয় সংসদেরও সংবিধান ও আইন ব্যাখ্যা করার এখতিয়ার নেই। সুতরাং বিভিন্ন মহল বক্তব্য, বিবৃতি, টকশো, সামাজিক মাধ্যমে আইন ও সংবিধান বিষয়ে অহরহ মনগড়া ব্যাখ্যা বিবৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকবেন বলে আশা করি যাতে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থায় চিড় না ধরে। আদালতের রায় ও আদেশের সমালোচনা গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য ও প্রত্যাশিত। কিন্তু কোনো রায় ও আদেশের কারণে বিচারক বা বিচার বিভাগকে দলীয় রাজনীতির ইস্যু বানাবেন না। বিচার বিভাগকে দুর্বল করার ফাঁদে কেউ যাতে পা না ফেলেন সে সম্পর্কে সকলকে সজাগ, সংযত ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বিচার বিভাগ দুর্বল হলে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত দুরূহ হয়ে পড়বে। অশুভ শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।”
একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, যাদের পরিচয় কারো অজানা নয়, সুপ্রিম কোর্টকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেশে অশুভ শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠায় একাট্টা হয়েছে বিধায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের সুচিহ্নিত বার্তা তাদের উপর কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারবে সেটিই বড় প্রশ্ন। প্রবাদ আছে “চোরে না শোনে ধর্মের কথা।” দেশে অশুভ শক্তির আগমনই যাদের কাম্য, তাদের কাছে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, তথা সকল গণতন্ত্রমনা মানুষের বার্তা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো। তাদের শায়েস্তা করতে হবে প্রয়োজনীয় কঠোরতার মাধ্যমে যে ক্ষমতা সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগকে দিয়েছে, দিয়েছে রাষ্ট্রের প্রশাসন অঙ্গকেও। এই মহলটি সংবিধানের অপব্যাখ্যা করে বলে চলছে যে এখনো নাকি রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙ্গে দিলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে এবং বর্ধিত সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা সম্ভব।
সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদে লেখা আছে “রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বছর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।” এই অনুচ্ছেদ মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে ঐচ্ছিক (ডিসক্রেশনারি) ক্ষমতা প্রদান করেছে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে সংসদ ভেঙ্গে দিতে। তবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সে ক্ষমতা শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেশক্রমেই করতে পারেন। ৭২(৩) অনুচ্ছেদে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সংসদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেঙ্গে যাওয়াটাই হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়ম। আর স্বাভাবিক নিয়মে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার বিধানটি স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে একটি ব্যতিক্রম। সংবিধানে কেনো এই ব্যতিক্রমী বিধান রাখা হলো তার কারণ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর নয়। সংবিধান প্রণেতাগণ এই ব্যতিক্রমী বিধানটি এ কারণেই সন্নিবিষ্ট করেছিলেন যাতে অযাচিত কোনো পরিস্থিতিতে সংসদ স্বাভাবিক নিয়মে মেয়াদ শেষের আগে অকার্যকর হয়ে গেলে কিংবা সংসদে অচলাবস্থা তৈরি হলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছরের আগেই যেন সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচনের পথ তৈরি করতে পারেন, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। সাধারণত অগ্রিমভাবে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার প্রয়োজন তখনই দেখা দেয় যখন প্রধানমন্ত্রী সংসদের অধিকাংশ সদস্যের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন এবং এমন কোনো সদস্য পাওয়া যায় না যিনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম। এমন পরিস্থিতি বা অন্য কোন পরিস্থিতিতে সংসদ অকার্যকর হয়ে গেলে সেটি ভেঙ্গে দেয়া ছাড়া মহামান্যের আর কোনো বিকল্প থাকে না বলেই সংবিধান তাকে এই ব্যতিক্রমী বিকল্প ক্ষমতা প্রদান করেছে। অবশ্য সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার ব্যাপারেও রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সাংবিধানিক আইনসহ সকল আইনের ব্যাখ্যা করা হয় সংশ্লিষ্ট আইনের প্রণেতাগণের কি ইচ্ছা ছিল তা নির্ধারণ করে এবং সেটি নির্ধারণ করার ক্ষমতা একান্তই সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের, যার উপর রয়েছে সংবিধানের অভিভাবকত্ব। ব্যতিক্রমী বিধানটি রাখার ব্যাপারে গণপরিষদ সদস্যদের ইচ্ছা নির্ধারণ করতে গেলে এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে তারা মহামান্য রাষ্ট্রপতির হাতে এমন ক্ষমতা প্রদান করতে চেয়েছিলেন যাতে সংসদ অকার্যকর হয়ে গেলে বা প্রধানমন্ত্রী সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থা হারিয়ে ফেললে তিনি যেন মেয়াদ শেষের আগেই সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেন। এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে প্রধানমন্ত্রীও মহামান্যকে অকালে সংসদ ভাঙ্গার পরামর্শ দিতে পারেন না এবং মহামান্যও তা করতে পারেন না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার সুযোগ করে দেয়ার জন্য মহামান্য অসময়ে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, কেননা গণপরিষদ সে উদ্দেশ্যে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তটি লিপিবদ্ধ করেনি। যেহেতু সংসদ অকার্যকর হয়নি এবং প্রধানমন্ত্রী সংসদের আস্থা হারাননি, তাই অসময়ে সংসদ ভেঙ্গে দেয়া মহামান্য রাষ্ট্রপতির পক্ষে সম্ভব নয়। আরো উল্লেখ্য যে, মহামান্য কর্তৃক অগ্রিম সংসদ ভেঙ্গে দেয়া যেমন একটি সাংবিধানিক বিধান, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক চলতি সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণের ৯০ দিন পূর্ব সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দিন ঘোষণাও তেমনি একটি সাংবিধানিক আজ্ঞা। সে অবস্থায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার অর্থ হচ্ছে সংবিধান বর্ণিত স্বাভাবিকভাবে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন ঘোষণার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা, যে সিদ্ধান্ত দ্বারা নির্বাচন কমিশন স্বাভাবিক নিয়মে পাঁচ বছর অতিক্রান্তের পর স্বাভাবিকভাবে সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার বিধানকে তালাবদ্ধ করে দিয়েছেন, (আইনের ভাষায় যাকে acted upon বলা হয়) বিধায় সেটি থেকে সরে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আগাম সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার সুযোগও শেষ হয়ে গেছে। এ সময় মহামান্য সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করলে সংবিধানের দুটি নির্দেশনার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিবে বিধায় তফসিল ঘোষণার পরে মহামান্য ব্যতিক্রমী বিধান মতে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না এবং প্রধানমন্ত্রীও এমন পরামর্শ দিতে পারেন না।
সেই ১৩ শতকেই বিখ্যাত বৃটিশ আইনি পন্ডিত এবং রাজা তৃতীয় হেনরি নিযুক্ত রাজকীয় উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য হেনরি ব্রেকটন এই মর্মে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে রাজা কোনো মানুষের অধঃস্তন না হলেও তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং আইনের অধীন কেননা তিনি আইনেরই সৃষ্টি এবং তাই তিনি আইন মেনে চলতে বাধ্য বটে। ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা ঘোষণায়ও সে কথা ছিল। একইভাবে আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতির পদটিও সংবিধানের সৃষ্টি বিধায় ব্রেকটন বৃটিশ রাজার ব্যাপারে যে কথা বলেছিলেন আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে সেটি প্রযোজ্য, অর্থাৎ সাংবিধানিক নির্দেশনার বাইরে তিনি কিছু করতে পারেন না। আজ যে সকল ব্যক্তি সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার উদ্ভট দাবি করছেন তাদের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য উদঘাটন করা কষ্টকর নয়। তফসিল ঘোষণার অনেক আগে থেকেই বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির অবাধ সুযোগ ছিল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করার। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং এমনকি নির্বাচন কমিশনও বিএনপি নেতৃবৃন্দকে পৌনঃপুনিকভাবে অনুরোধ করেছিলেন আলোচনায় অংশ নিতে। তারা সে প্রস্তাবে রাজি না হয়ে তথাকথিত নিরপেক্ষ সরকারের এমন অবান্তর এবং সংবিধান বিরোধী দাবি তুললেন যা মেনে নেয়ার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি কারোরই নেই, কেননা সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন যে এই ধরনের সরকার থাকতে পারে না। এখানেই মাননীয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের কথা এদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে হয় যে সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদের নির্দেশনার কারণে প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য। আইনের কথা বাদ দিলেও ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় ও পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গোটা দেশে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তা ভুলে যাবার নয়। ২০০৭ সালে সে সময়ের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন সংবিধানের বিধান সমূহকে পদদলিত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার পর তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা দেশে মূলত সামরিক স্বৈরশাসন জারি করে দু’বছর দেশে অসাংবিধানিক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত, অত্যাচারীদের শাসন ছিল। সেই বিভীষিকাময় ঘটনার কথাও তো ভুলে যাবার নয়! তাদের ইচ্ছা ছিল চিরস্থায়ী আসন গড়ার। তবে জনরোষের কারণে তারা সেটি করতে পারেননি।
সর্বোচ্চ আদালতের অবিচল নির্দেশনা ছাড়াও বাস্তবে যা ঘটেছিল, তার পুনরাবৃত্তি হোক দেশের মানুষ সেটি চায় না, আর তাই এই কুচক্রী মহলের হরতাল-অবরোধের ডাকে কেউ সাড়া দিচ্ছেন না, সকলেই নির্বাচনী উল্লাসে মেতে উঠেছেন। আশাতীত সংখ্যক মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম দেশে অশুভ শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন, এই অশুভ শক্তি সেটিই করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তা কখনো হতে দেবে না।