মন্দ মুদ্রা বনাম মন্দ সমাজ

কোনো মুদ্রা দুই ভাবে ‘মন্দ’ হতে পারে। ধাতুমুদ্রার ক্ষেত্রে ধাতুতে ভেজাল দিয়ে এবং কাগজের মুদ্রার ক্ষেত্রে কাম্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশি টাকা ছাপিয়ে।

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 3 Jan 2023, 02:42 PM
Updated : 3 Jan 2023, 02:42 PM

এক। মুদ্রার উত্তম-মধ্যম

আমেরিকার ডলার, ইউরোপের ইউরো, বাংলাদেশের টাকা– প্রত্যেকটি মন্দমুদ্রা। এই সব মন্দমুদ্রার কারণে মন্দ হচ্ছে বাজার, মন্দ হচ্ছে সমাজ, মন্দ হচ্ছে প্রজন্ম। প্রশ্ন হতে পারে, ‘মুদ্রার উত্তম বা অধম হওয়ার সঙ্গে সমাজ বা প্রজন্মের ভালো-মন্দের কী সম্পর্ক?’ উত্তরে বলব, উভয়ের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী এবং গভীর বটে।

মুদ্রা বা টাকা চার ধরনের হতে পারে: উত্তম, মধ্যম, মন্দ ও জঘন্য। বাজারে প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণ মুদ্রার উত্তম-মধ্যমের একটা নিয়ামক। মুদ্রার পরিমাণের সঙ্গে আবার বাজারের আকারের একটা সম্পর্ক আছে। ‘বাজারের আকার’ বলতেই বা আমরা কী বোঝাচ্ছি? ধরা যাক, কোনো বাজারে কী পরিমাণ লেনদেন হয়, তার ওপর নির্ভর করে ওই বিশেষ বাজারের আকার। একটি গ্রাম ও একটি শহরের বাজারের আকার সমান নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের তুলনায় বড় বাজার। সব বাজারের মুদ্রার প্রয়োজন সমান নয় এবং প্রতিটি বাজারের জন্যে প্রয়োজনীয় মুদ্রার একটি কাম্য পরিমাণ নিশ্চয়ই আছে।

অর্থনীতির গত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস থেকে আমরা জানি, মুদ্রার পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে গেলে পণ্যের মূল্যও বেড়ে যায়, যার মানে হচ্ছে, মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। মুদ্রার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে কিংবা মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা অটুট রাখতে হলে মুদ্রাটি এমন একটি বস্তু দিয়ে তৈরি হবে হবে, প্রথমত, যার সরবরাহ বাড়ানো যায় না এবং দ্বিতীয়ত, সেই বস্তু যদি ধাতু হয়ে থাকে, তবে ক্ষয় হয়েও ওই ধাতুর পরিমাণ হ্রাস পায় না।

এই বিচারে মুদ্রা হবার জন্যে স্বর্ণ সর্বশ্রেষ্ঠ ধাতু এবং স্বর্ণমুদ্রা উত্তম মুদ্রা। একটাই সমস্যা, ওজন আছে বলে স্বর্ণ সহজে বহন বা স্থানান্তরযোগ্য নয়। স্বর্ণ বা স্বর্ণের অনুরূপ অন্য কোনো ধাতু বা সরবরাহ সীমিত এমন কোনো সত্তার বিপরীতে (অন্য কথায় ‘রিজার্ভ বা জমা রেখে’) কাগজ বা প্লাস্টিকের মতো সহজে বহনযোগ্য কোনো বস্তু দিয়ে মুদ্রা তৈরি করা গেলে সে ধরনের মুদ্রাও উত্তম মুদ্রা হবে।

স্বর্ণমুদ্রার যুগে রাজা বা সরকার ঘোষণা দিত, কী পরিমাণ স্বর্ণ প্রতিটি মুদ্রায় আছে। মুদ্রায় ঘোষিত পরিমাণমতো স্বর্ণ যদি না থাকত কিংবা কমদামি কোনো ধাতুর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ভেজাল যদি দেওয়া হতো মুদ্রায়, তবে সেই স্বর্ণমুদ্রাও হতো মন্দমুদ্রা। কাগজ বা প্লাস্টিকের মতো সহজলভ্য বস্তু দিয়ে তৈরি মুদ্রার পেছনে যদি স্বর্ণ কিংবা সরবরাহ বাড়ানো যায় না এমন কোনো সত্তার রিজার্ভ না থাকে, কোনো সংস্থার (সাধারণত সরকার) মুখের কথায় বা ইচ্ছামতো যদি কাগজ বা প্লাস্টিকের মুদ্রা বাজারে ছাড়া হয়, তবে সেই মুদ্রাও মন্দমুদ্রা হবে।

হিসাববিজ্ঞানে ঋণকে দুই ভাবে ভাগ করা হয়, ‘সুঋণ’ ও ‘কুঋণ’। যে ঋণ নির্দিষ্ট সময়ে ফেরৎ পাওয়া যায়, সেটা সুঋণ। যে ঋণ কদাপি বা সহজে ফেরৎ পাওয়া যায় না সেটা কুঋণ। কুঋণ যদি না চান, তবে কোনো কিছু বন্ধক রেখে ঋণ দিলে ভালো হয়। পরিশোধের নিশ্চয়তার ব্যবস্থা না রেখে যে ঋণ দেওয়া হয়, সেই ঋণ যেকোনো মুহূর্তে কুঋণে পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশে এত যে ঋণখেলাপী, তার প্রধান কারণ, ব্যাংক ও খদ্দেরের যোগসাজসে, সরকারের কোনো মহলের অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে এখানে জেনেশুনে একের পর এক কুঋণ দেওয়া হয়।

ঠিক একইভাবে স্বর্ণ জমা না রেখে যে টাকা ছাপানো হয়, সেটা এক ধরনের কুঋণ বৈকি। এই ঋণ পরিশোধের সম্ভাবনা যেকোনো মুহূর্তে বাতিল হয়ে যেতে পারে সরকার বাহাদুরের ইচ্ছায়। ভারত সরকার এটা করেছে মাত্র কদিন আগে, ২০১৪ সালে। বাংলাদেশ সরকারও এটা করেছে ১৯৭৩ সালে। ছিল টাকা, রাতারাতি হয়ে গেল কাগজ! জনগণের সঙ্গে এটা এক ধরনের প্রতারণা বটে, যদিও সরকার দাবি করে, টাকার নকল এবং মুদ্রাস্ফীতি রুখতে নোটবন্দির প্রতারণা অপরিহার্য। কিন্তু নোটবন্দির পর ভারতে মুদ্রাস্ফীতি কিংবা টাকার নকলবাজি কমেছে, এমন দাবি সরকারও করে না।

সমসাময়িক বাজারদরে প্রাপ্ত স্বর্ণ জমা রেখে যদি টাকা ছাপানো হয়, তবে তাকে বলা হবে ‘উত্তম মুদ্রা’। স্বর্ণের পরিমাণের চেয়ে মুদ্রিত টাকার পরিমাণ যদি বেশি হয়, তবে তাকে বলা যেতে পারে ‘মধ্যম মুদ্রা’। কোনো প্রকার স্বর্ণ জমা না রেখে মুদ্রিত হয় যে মুদ্রা, সেটি ‘মন্দ বা অধম মুদ্রা’। বাজারে মুদ্রার চাহিদাকে বিবেচনায় না নিয়ে খেয়ালখুশি মতো ছাপানো মুদ্রাকে বলা যেতে পারে ‘জঘন্য মুদ্রা’।

আমরা দেখলাম, কোনো মুদ্রা দুই ভাবে ‘মন্দ’ হতে পারে। ধাতুমুদ্রার ক্ষেত্রে ধাতুতে ভেজাল দিয়ে এবং কাগজের মুদ্রার ক্ষেত্রে কাম্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশি টাকা ছাপিয়ে। স্বর্ণের পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রা জমা রেখে টাকা ছাপানো যেতে পারে, কিন্তু দেখতে হবে, সেই বৈদেশিক মুদ্রাটি নিজে উত্তম মুদ্রা কিনা। তা যদি হয়, তবে আপনার দেশের মুদ্রাটি হবে (কমবেশি) মধ্যম মুদ্রা। সেই রিজার্ভ মুদ্রাটি নিজেই যদি হয় মন্দ-মুদ্রা, তবে আপনার দেশের মুদ্রাটি হবে জঘন্য মুদ্রা। এই বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর টাকা কিংবা রুপি জঘন্য মুদ্রা বটে।

দুই। মন্দমুদ্রায় সর্বনাশ!

সর্বশেষ রোমান স্বৈরাচারী শাসক জুলিয়াস সিজারের স্বর্ণমুদ্রার নাম ছিল ‘অরেয়াস’। এতে ৮ গ্রাম স্বর্ণ থাকত। সেকালের পৃথিবীতে, ইউরোপে, পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অরেয়াস গ্রহণযোগ্য মুদ্রা ছিল। জুলিয়াস সিজার, সম্রাট অগাস্টাস এবং তার পরবর্তী শাসকদের ৭৫ বছরের শাসনকালে ব্যবসাপাতি থেকে শুরু করে বহুবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নতি হয়েছিল।

ইতিহাসে একাধিক জাতির মতো আরবরাও লুটপাট কম করেনি। তবে একটা অপকর্ম তারা কখনও করেনি– মুদ্রায় কোনোপ্রকার ভেজাল দেয়নি তারা কিংবা মুদ্রা নিয়ে কোনো প্রকার দুই নম্বরী করেনি। উমাইয়া আমলে চালু হয়েছিল আরবি দিনার, যার নাম ছিল ‘শাহাদা’ কারণ এর উপর কলেমা শাহাদাত (‘আল্লাহ অদ্বিতীয় এবং মুহম্মদ (স.) তার প্রেরিত রসুল’) মুদ্রিত ছিল। শাহাদা দিনারে স্বর্ণের পরিমাণ সবসময় স্থির ছিল বলে উমাইয়া আমলের একাধিক শতক পরেও এই মুদ্রা বাজারে চলমান ছিল।

নকল করা বা ভেজাল দেওয়া মুদ্রা অবশ্যই মন্দমুদ্রা। টাকা নকল করা বা টাকায় ভেজাল দেয়া গর্হিত অপরাধ বলে বিবেচিত হয়েছে সব সভ্যতাতেই। চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে ‘রূপদর্শক’ নামে একটি পেশার উল্লেখ আছে। রূপদর্শক হিরণ্য অর্থাৎ (স্বর্ণ)মুদ্রার শুদ্ধতা পরীক্ষা করতেন। অশুদ্ধ বা কূটমূদ্রা তিনি ‘ছেদন’ করিয়ে (গলিয়ে?) ফেলতেন যাতে অন্য কেউ সেই মুদ্রা ব্যবহার করতে না পারে। কূটমুদ্রা ব্যবহারকারীর জরিমানা ছিল সে যুগে ১০০০ পণ। ইউরোপেও চরম শাস্তি দেওয়া হতো এই অপরাধে। ফরাসি বিপ্লবের সময়ে ফ্রান্সে মুদ্রা নকলকারীকে সর্বসমক্ষে গরম তেলে সিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো।

কোনো স্বর্ণমুদ্রায় যতটুকু স্বর্ণ আছে বলে লিখিতভাবে দাবি করা হয়, স্বর্ণের সেই পরিমাণ যদি স্থির থাকে, তবে সেই বিশেষ স্বর্ণমুদ্রাটি নকল করতে জালিয়াতেরা সাধারণত আগ্রহী হতো না, কারণ আর্কিমিডিসের সূত্র প্রয়োগ করেই ধরে ফেলা সম্ভব ছিল, মুদ্রায় কতটুকু স্বর্ণ আছে বা নেই। এত শত ঝুঁকি নিয়ে স্বর্ণমুদ্রায় জালিয়াতি কারা করত? স্বর্ণমুদ্রায় ভেজাল দেবার কাজটা করতেন, যাদের করার কথা নয়, তারাই, অর্থাৎ রাজা বা সম্রাটেরা।

রোম জ্বলার সময় বাঁশি বাজাচ্ছিলেন যে সম্রাট নিরো, তিনি মুদ্রা জালিয়াতির ওস্তাদ ছিলেন। বাজার থেকে সিজারের স্বর্ণ ও রোপৗমুদ্রা তুলে নিয়ে উভয় মুদ্রায় প্রচুর ভেজাল দিয়ে নতুন করে তিনি মুদ্রা ঢালাই করলেন। ১,০০০ স্বর্ণমুদ্রাকে ভেজাল দিয়ে তিনি, ধরা যাক, ৪,০০০ স্বর্ণমুদ্রায় পরিণত করলেন, কিন্তু মুদ্রার উপর লিখে রাখলেন আগের মূল্যমান। এই দুই নম্বরী করে কম স্বর্ণ দিয়ে বেশি সংখ্যক সৈন্যের বেতন দেওয়া সম্ভব হয়েছিল সম্রাটের পক্ষে। সরকারের খরচ কমে চার ভাগের এক ভাগ হয়ে গিয়েছিল, যদিও টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়েছিল চারগুণ। যে জিনিসের দাম ছিল এক দিনার, বিক্রেতা সেই জিনিষের দাম চারগুণ বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হলো, কারণ সে জানে, যে এক দিনারের মুদ্রা তাকে দেওয়া হচ্ছে, সেটি আসলে সিকি দিনার। এদিকে সৈন্যদের বেতন যেহেতু আগের মতোই ছিল, তারা চারগুণ বেশি দামে রুটি কিনতে গিয়ে হিমসিম খেতে লাগলো। রোম থেকে লোকজন পালিয়ে যেতে শুরু করল গ্রামে, যেখানে জমিতে শষ্য ফলিয়ে কোনোমতে জীবন ধারণ সম্ভব ছিল। শহর ছেড়ে যাওয়া যাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। যেকোনো ‘ছাপাবাজ’ (এবং চাপাবাজ) সরকারের মতোই রোমান সম্রাটেরা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলেন।

তৃতীয় ও চতুর্থ শতকের রোমান সম্রাটেরা অনেক চেষ্টা করলেন জনগণকে বিশ্বাস করাতে যে মুদ্রাস্ফীতি বলে কিছু নেই। বিনামূল্যে রুটি বিলানো হলো এবং সার্কাস দেখানোর আয়োজন হলো। সেতু, রাস্তা ইত্যাদি বানিয়ে-টানিয়ে জনগণকে তারা বোঝাতে চেষ্টা করলেন, সাম্রাজ্য চমৎকার চলছে। মেট্রো কিংবা পদ্মাসেতু বানানোর প্রযুক্তি থাকলে রোমান সম্রাটেরা তাও বানাতে ছাড়তেন না নিশ্চয়ই। সমস্যা হচ্ছে, নির্মাণকাজের জন্য যে রৌপ্য দিনার তারা ঢাললেন বাজারে, সেগুলো ডি জ্যুরো বা কাগজে কলমে দিনার হলেও ডি ফ্যাক্টো বা বাস্তবে সেগুলো ছিল সিকিরও অধম। সম্রাট ডিওক্লেটিয়ান (২৮৪-৩০৫) লিখেছেন, স্বল্প ব্যবহারেই দিনারের রূপার প্রলেপ উঠে গিয়ে ভিতরের ব্রোঞ্জ বেরিয়ে পড়ত। এর মানে হচ্ছে, বেহুদা বিনির্মাণ কাজের অজুহাতে যদি সবল মুদ্রা বাজারে ছাড়া যায়, সেক্ষেত্রে অর্থনীতি গতি পেলেও পেতে পারে, কিন্তু এ ধরনের কাজে দুর্বল মুদ্রা বিনিয়োগ করলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। এর প্রমাণ, রোমান অর্থনীতির দুর্বলতা বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যায়নি। শুরু হয়েছিল অরাজকতা এবং এরপর আক্রমণ করে রোম দখল করতে বর্বরদের একেবারেই বেগ পেতে হয়নি।

চতুর্থ শতকের শুরুতে পশ্চিম এবং পূর্ব– এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল রোমান সাম্রাজ্য। যার রাজধানী ছিল রোম, সেই পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল পঞ্চম শতকের শেষে। যার রাজধানী ছিল কনস্ট্যান্টিনোপল বা আজকের ইস্তাম্বুল এবং যার প্রথম সম্রাট ছিলেন কনস্ট্যান্টিন, সেই পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তার যাবতীয় সমৃদ্ধি নিয়ে টিকে ছিল আরও হাজার বছর– চতুর্দশ শতকে এই সাম্রাজ্যের পতন হয় তুর্কিদের হাতে।

কেন রোমের পতন হয়েছিল এবং কনস্ট্যান্টিনোপল টিকেছিল আরও এক সহস্র বছর? অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এর মূলে আছে ‘উত্তম মুদ্রা’ ও ‘মন্দ-মুদ্রা’ অর্থাৎ ভালো এবং খারাপ টাকার পার্থক্য। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটেরা, আগেই বলেছি, দিনার ও স্বর্ণমুদ্রায় ক্রমাগত ভেজাল দিয়ে সেগুলোর ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে ফেলেছিল। পক্ষান্তরে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের মুদ্রা ‘সলিডাস’ বা ‘বিজ্যান্ট’-এ এমন কোনো দুই নম্বরী করেননি সেখানকার সম্রাটেরা। উত্তম মুদ্রা সভ্যতা বা সাম্রাজ্য স্থায়ী হবার একমাত্র কারণ অবশ্যই নয়, কিন্তু অন্যতম কারণ তো বটেই।

পতনশীল পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটেরা যে কাজটি করেছিলেন, সেই একই কাজ করে চলেছে পৃথিবীর সবগুলো সরকার, বেসামাল ফিয়াট মানি ছাপিয়ে। পণ্ডিতেরা বলছেন, কোনো ফিয়াট মানি কোনোকালে দীর্ঘজীবী হয়নি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অরণ্যে রোদন। ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে মুরগি একই ডিম পাড়ছে। ব্রিটিশ আমলে একটি ডিম কিনতে লাগতো ধরা যাক, এক পয়সা, পাকিস্তান আমলে দশ পয়সা এবং বাংলাদেশ আমলে দশ টাকা। এই তিন আমলে বাজারে কাগজের টাকার পরিমাণের তুলনা করলেই দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার ছুটে চলার কারণটা আপনারা কমবেশি ধরতে পারবেন।

ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে পুনর্জাগরণের পর গুরুত্বপূর্ণতম ঘটনা ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব এবং তার পর ঊনবিংশ শতকের শুরুতে প্রায় এক যুগব্যাপী (১৮০৩-১৮১৫) সম্রাট নেপোলিয়নের ইউরোপ বিজয়ের ব্যর্থ চেষ্টা এবং পরিণামে পরাজয়। নেপোলিয়নের ‘যুদ্ধংদেহী’ হয়ে ওঠার কারণও মূলত অর্থনৈতিক। ইংল্যান্ডের পণ্যের মানের সঙ্গে ফরাসি পণ্য প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছিল না। নেপোলিয়ন স্বদেশের পণ্যের মান উন্নয়নের চেষ্টা করেননি। যেকোনো অবিমৃষ্যকারী শাসকের মতো দেশের টেকসই উন্নয়ন তার মাথাব্যথা ছিল না। সবই ছিল ওনার দেখনদারি। তিনি জানতেন শুধু যুদ্ধ এবং লুটপাট করতে এবং সারাজীবন ধরে তাই তিনি করে গেছেন।

ইংল্যান্ডের পণ্যের সঙ্গে সুস্থ প্রতিযোগিতার পথে গেলেন না নেপোলিয়ন। তিনি চেষ্টা করলেন, ইংল্যান্ড যাতে কোনোক্রমেই নিজের পণ্য ফ্রান্সে এবং বিদেশে রপ্তানি করতে না পারে। বাংলা প্রবাদ আছে: ‘নেপোয় মারে দৈ!’ নেপোলিয়নের যুদ্ধগুলোর লক্ষ্য ছিল হয় অন্যের সম্পদ লুট করা কিংবা ফ্রান্সে ইংল্যান্ডের পণ্য-রপ্তানি থামিয়ে দেয়া। অষ্টাদশ শতকে ফরাসিদের রাজনীতির ধরনটাই অবশ্য এমন ছিল। নেপোলিয়ন ক্ষমতা দখলের আগেও তাকে মিশর দখলে পাঠানো হয়েছিল, যাতে ভারতবর্ষের সঙ্গে ইংল্যান্ডের নৌ-যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া যায়।

ইংল্যান্ডের পণ্যের মান এত ভালো হবার কারণ কী? এত দেশ থাকতে ইংল্যান্ডেই বা কেন শিল্পবিপ্লব হয়েছিল? এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে, তবে এটাও তো ঠিক যে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইংল্যান্ডই প্রথম স্বর্ণমুদ্রামান বা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড গ্রহণ করেছিল, ১৭১৭ সালে, ফরাসি বিপ্লবেরও ৮০ বছর আগে। ফ্রান্সে স্বর্ণমুদ্রামান ছিল না, মুদ্রাব্যবস্থা দুর্বল ছিল। ইউরোপের অন্য দেশের তুলনায় ইংল্যান্ডের কারখানার মাল উন্নততর হবার একটা কারণ ছিল ইংল্যান্ডের উন্নততর অর্থনীতি। ইংল্যান্ডের উন্নততর অর্থনীতির ভিত্তি ছিল সে দেশের গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড বা স্বর্ণমান– এমন দাবি অমূলক নাও হতে পারে। ইংল্যান্ডের তুলনায় ফ্রান্স অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়া কিংবা ফ্রান্সের পণ্য ইংল্যান্ডের তুলনায় নিকৃষ্ট হবার এটাও একটা কারণ হতে পারে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কারণ ফ্রান্সের জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং এই দুর্দশার পিছনে আছে ফ্রান্সের দুর্বল অর্থব্যবস্থা– এমন দাবি অমূলক মনে হয় না।

১৭৯৭ থেকে ১৮২১, নেপোলিয়নের যুদ্ধের এই চব্বিশ বছর, ইংল্যান্ড নিজের স্বর্ণমুদ্রামান স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছিল। এর কারণ, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সরকারের প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয়। স্বর্ণের সরবরাহ সীমিত হবার কারণে স্বর্ণমুদ্রার পরিমাণ ইচ্ছা করলেই বাড়ানো যায় না। কিন্তু কাগজের মুদ্রা বা রূপা-দস্তার মুদ্রার বিপরীতে স্বর্ণমুদ্রা রিজার্ভ রাখার বাধ্যবাধকতা যদি মানতে না হয়, তবে ইচ্ছেমতো টাকা ছাপানো যায় এবং তাই সম্ভবত করা হয়েছিল উপরোক্ত চব্বিশ বছরে।

নেপোলিয়নের যুদ্ধ শেষ হবার পর ইউরোপের জাতিরাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যগুলো একের পর এক স্বর্ণমুদ্রামান গ্রহণ করতে থাকে। ইতোমধ্যে ঊনবিংশ শতকের শুরুতে টেলিগ্রাফ (১৮৩৭) এবং এরও আগে রেল যোগাযোগ (১৮০৪) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে স্বর্ণমুদ্রামানের ব্যবহার সহজতর হয়ে উঠেছিল। ধরা যাক, লন্ডন থেকে কেউ নিউ ইয়র্ক যাবে– তখন থেকে আর জাহাজে করে স্বর্ণমুদ্রা বহন করে নিয়ে যাবার কোনো প্রয়োজন পড়ত না। লন্ডনের ব্যাংকে স্বর্ণমুদ্রা জমা দিয়ে যে রশিদটি আপনি পাবেন, নিউ ইয়র্কের ব্যাংকে গিয়ে সেই রশিদটি জমা দিলে সমপরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা আপনি পেয়ে যাবেন। আপনি যাবার আগেই খবর পৌঁছে যাবে টেলিগ্রাফে। রেলের মাধ্যমে মুদ্রা পাঠানো এবং ডাকে খবর পাঠানো সহজতর হয়ে উঠেছিল।

যেসব দেশে রৌপ্যমুদ্রামান চালু ছিল, যেমন জার্মানি, ভারত বা চীন, সেখানে অর্থনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল। ১৮৭০-৭১ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধে প্রুশিয়ার (এখনকার জার্মানি) সম্রাট বিসমার্ক সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নকে বন্দি করে প্যারিস দখল করলেন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ফ্রান্স থেকে ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি পাউন্ড স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যাওয়া হলো বার্লিনে, প্রুশিয়া স্বর্ণমুদ্রামানে যোগ দেবার প্রয়োজনে। স্বর্ণমুদ্রামানে যোগ দেবার অব্যবহিত পরে জার্মানির আর্থসামাজিক কাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল। ১৮২০ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সূচনাকাল পর্যন্ত প্রায় চার দশক ইউরোপে স্বর্ণমুদ্রামান বহাল ছিল।

ইংল্যান্ডে স্বর্ণমুদ্রা চালু থাকলেও ইংরেজ উপনিবেশগুলোতে ব্যবহৃত হতো রৌপ্যমুদ্রা। ইংল্যান্ড প্রচুর রৌপ্যমুদ্রা খোদাই করে চালু করে ভারতবর্ষে। এই রানিমার্কা টাকা এখনও হয়তো দুর্লভ নয়। ১৮৯৮ সালে ভারতবর্ষেও স্বর্ণমুদ্রামান চালু হয়। কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। ১৮৭১ থেকে ১৮৯৮– এই ২৭ বছরে ভারতে রানিমার্কা রুপি ৫৬% ভাগ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছিল। ঠিক যেভাবে বিনিময়ের মাধ্যম রাইপাথর, পুঁতি এবং ঝিনুক দিয়ে যথাক্রমে প্রশান্ত মহাসাগরের য়াপ দ্বীপ, আফ্রিকা এবং আমেরিকার আদিবাসীদের শোষণ করেছিল ইউরোপের সাদা মানুষেরা, ঠিক একই ভাবে স্বর্ণমুদ্রামান ব্যবহার না করার কারণে ভারতের সম্পদ গিয়ে জমা হচ্ছিল ইংল্যান্ডে। চীন ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত রৌপ্য মুদ্রামান ব্যবহার করেছে এবং এর ফলে চীনের সম্পদও গিয়ে জমা হয়েছে উপনিবেশক জাতিগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে। গত শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতের তুলনায় চীন আর্থসামাজিকভাবে দুর্বল থাকার পিছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে।

নিজেদের ক্ষতি সম্পর্কে ভারতবাসীরা একেবারে যে ওয়াকেবহাল ছিল তা কিন্তু নয়। শোষণ হচ্ছিল, বুঝতে পারছিল মানুষ, কিন্তু শোষণের কারণ হয়তো জানা ছিল না। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ সংঘঠিত হবার পিছনে মন্দমুদ্রাজনিত অর্থনৈতিক শোষণও একটা কারণ ছিল না কি? প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ শুরু করার জন্যে একটা অজুহাতের প্রয়োজন ছিল এবং এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে শুয়োর এবং গরুর চর্বির গুজব ছিল সেই অজুহাত। আমি বলছি না, মুদ্রাস্ফীতি বা রুপির ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস সিপাহী বিদ্রোহের একমাত্র কারণ, কিন্তু বিনা মেঘে কখনও বজ্রপাত হয় না। বজ্রপাত হতে হলে আকাশে যেমন দৃশ্য বা অদৃশ্য মেঘ জমতেই হয়, প্রতিটি যুদ্ধ বা বিদ্রোহের পিছনে অর্থনৈতিক অস্থিরতা অবশ্যই অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি রবার্ট ক্লাইভ বলেছিলেন, মুর্শিদাবাদে যত ধনী আছে, তত ধনী এবং সেই পরিমাণ সম্পদের অধিকারী ব্যক্তি লন্ডন শহরে নেই। সেই সময়ের একাধিক ইংরেজ লেখক মুর্শিদাবাদের তুলনায় লন্ডনের দুরবস্থার কথা লিখেছেন। কীভাবে শ তিনেক বছরে মুর্শিদাবাদ লন্ডনের এতটা পিছনে পড়ে গেল যে আজ ২০২২ সালে মুর্শিদাবাদের কোনো অধিবাসী লন্ডনে যেতে পারলে স্বর্গে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে বলে মনে করে? অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতির আধুনিক ধারক ও বাহক লেবাননের অর্থনীতিবিদ সাইফুদ্দিন আম্মুস দাবি করেন, বিংশ শতকে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর তুলনায় ভারত ও চীনের পিছিয়ে থাকার পিছনে আছে ঊনবিংশ শতকে এই দুটি দেশ স্বর্ণমুদ্রামান গ্রহণ না করা কিংবা দেশদুটিকে স্বর্ণমুদ্রামান গ্রহণ করতে না দেওয়া।

প্রতি মুহূর্তে দাম কমছে, এমন সব মুদ্রা যেমন ডলার, ইউরো, টাকার ওপর ভরসা করে দেশে দেশে লোকজন নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে, কারণ শৈশব থেকে তাদের শেখানো হয়েছে: ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর!’ এটা অনেকটা স্বর্গে যাবার প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে গায়ে টাইমবোম্ব বেঁধে কোনো আত্মঘাতী জঙ্গির মেলার নাগরদোলায় চুপচাপ বসে থাকার মতো।

ব্রিটিশ আমলে আমার মাতামহ সাধারণ পোস্টমাস্টারের বেতন দিয়ে চট্টগ্রামের কুমিরা গ্রামে নিজের বাড়ি করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশ আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও আমার নিজের বাড়ি নেই। এ একান্তই আমার দোষে, ত্রুটিপূর্ণ অর্থব্যবস্থা এর জন্যে কোনো ক্রমেই দায়ী নয়– এ কথা আমি মানতে পারব না। স্বর্ণমুদ্রামানের আমলে আমেরিকায় যে বাড়ির দাম ছিল মাত্র চার হাজার ডলার, আজ ২০২২ সালে ওই বাড়ির দাম চার মিলিয়ন ডলার। এই ঘটনা কি স্বাভাবিক মনে হয়? অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বাড়ির দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার পেছনে আছে ফিয়াট মানির ভানুমতির খেল।

তিন। মন্দ মুদ্রা বনাম মন্দ সমাজ

মন্দ মুদ্রা আগে পরে কোনো অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রমাণিত হয় না। ধরা যাক, পাশাপাশি দুটি দেশ যার একটিতে আছে মন্দ মুদ্রা এবং অন্যটিতে উত্তম মুদ্রা। প্রথম দেশটিতে সরকার অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে কিংবা ঘোষণা দিয়ে কৃত্রিমভাবে নিজের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে রেখেছে। এর ফলে সেই দেশে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কম হবে এবং একই মানের পণ্যের দাম পাশের দেশের তুলনায় বেশি ‘মনে হবে’। এর ফলে সেই দেশের পণ্য হয়তো পাশের দেশে পাচার হবে না, যদিও পাশের দেশের পণ্য মন্দমুদ্রার দেশে পাচার হয়ে আসতে পারে।

ধরা যাক, উত্তম মুদ্রার একটি দেশ পণ্য কিনতে চায়। যখন সেই দেশের ব্যবসায়ীরা দেখবে, পাশাপাশি দুই সম্ভাব্য বিক্রেতা দেশের একটিতে তাদের নিজের দেশের টাকা ভাঙিয়ে বেশি টাকা পাওয়া যায়, তখন তাদের মনে হতে পারে, সেই দেশে তুলনামূলকভাবে কম দামে পণ্য পাওয়া যায়। তখন সে ভাবতে পারে, মন্দমুদ্রার দেশ থেকে পণ্য কেনাই তার জন্য লাভজনক। কোরিয়া বা জাপানের পণ্যের তুলনায় চীনের পণ্য বেশি বিক্রি হবার একটি কারণ এটা হতে পারে।

চীনা পণ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওই দুই দেশের পণ্যের তুলনায় নিম্নমানের, কদিন পরেই নষ্ট হয়ে যায়– এ সমস্যা তো আছেই। কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে, চীনের যাতে লাভ, তাতে তার ক্রেতাদের অবশ্যই ক্ষতি হওয়ার কথা, বিশেষ করে যখন পণ্যের মূল্য এক্ষেত্রে পণ্যের প্রবাহের ভিত্তিতে চাহিদা ও সরবরাহ রেখার ছেদবিন্দুতে স্বাভাবিকভাবে নির্ধারিত হচ্ছে না বরং ধূর্ততার সঙ্গে কৃত্রিমভাবে নির্ধারিত হচ্ছে। এটা কোনোমতেই যাকে বলে ‘উইন-উইন’ বা সমমুনাফা পরিস্থিতি নয়। এই লেনদেনে এক পক্ষ নিশ্চয়ই ঠকছে এবং এই ঠকাটা আখেরে উভয় পক্ষের জন্যেই খারাপ হওয়ার কথা। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা লিখেছেন, ‘তুমি যারে নিচে ফেলো সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে। পশ্চাতে ফেলিছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে!’

মুদ্রার কৃত্রিম অবমূল্যায়নের কারণে বিভিন্ন দেশ চীন বা বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে গিয়ে ঠকছে। ঠকা মানে তাদের অর্থনীতিরও ক্ষতি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদে। বাংলাদেশও নিশ্চয়ই অবমূল্যায়িত মুদ্রা আছে, এমন কোনো দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে গিয়ে ঠকছে, যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিরও ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতির প্রভাব বিশ্বঅর্থনীতিতেও না পড়ে পারে না। মন্দ মুদ্রা দিয়ে লাভজনক বিশ্বায়ন বা প্রকৃত গোলোকায়ন কখনই সম্ভব নয়।

মন্দ মুদ্রা যুদ্ধপ্রসূ, যুদ্ধের আকর। লক্ষ্য করা গিয়েছে, যেসব দেশে কিংবা যে কালে বা যুগে উত্তম মুদ্রা বাজারে থাকে, মানুষ সেই সব দেশে বা সেই কালে সঞ্চয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যারা সঞ্চয় করে, তারা যুদ্ধবিগ্রহে কম আগ্রহী হয়, কারণ যুদ্ধে সঞ্চিত সম্পদ নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে। গত পাঁচ শতকের মধ্যে বিংশ শতকে মানবমৃত্যুর সংখ্যা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে, যার অন্যতম কারণ, অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদদের মতে, এই শতকে সরকারগুলোর হাতে যথেচ্ছ টাকা ছাপানোর ক্ষমতা ছিল এবং ইচ্ছেমতো টাকা ছাপিয়ে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পেরেছে। ঊনবিংশ শতকে যুদ্ধ কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস স্থায়ী হতো, কারণ এর বেশি সময় ধরে যুদ্ধ করার মতো অর্থ সাধারণত সরকারের হাতে থাকত না। আফগানিস্তান কিংবা ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দশকব্যাপী যুদ্ধ জারি রাখতে পেরেছে, তার হাতে ডলার ছাপানোর মেশিন ছিল বলেই। যুগে যুগে রোবেসপিয়ের, স্ট্যালিন, মাও সে তুং, হিটলার, কিম জং, বাইদেন পুতিনসহ বহু শাসকের কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে যথেচ্ছ ছাপানো চলে এমন মন্দমুদ্রা।

‘পরের জায়গা, পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই, আমিতো সেই ঘরের মালিক নই!’ ‘দুনিয়া দুই দিনের’। ‘হরি দিন যে গেল সন্ধ্যা হলো, পার করো আমারে!’ এসব চিরায়ত বাংলা লোকগানে জীবনের জয়গান নেই, আছে মৃত্যুর অসুস্থ, তীব্র এক আকাঙ্ক্ষা। এসব মৃত্যুবাদী গান সম্ভবত ভারতের পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলে পরিমাণে বেশি লেখা হয়েছে। এর কারণ, সুজলা-সুফলা হবার কারণে এই অঞ্চল সব সময় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের হাভাতে এবং জঙ্গি জাতিদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত এখানে, জনগণের না ছিল সঞ্চয়ের সামর্থ্য, না ছিল সঞ্চয়ের উপায়। ভারতের যেসব অঞ্চলে অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত ও স্থিতিশীল ছিল, সেখানে সম্ভবত এত বেশি পরিমাণে জীবন-বিমুখ গীত লেখা হয়নি। দেশ বা অঞ্চলের অর্থব্যবস্থা একটি জাতির মনন ও সাহিত্যকে প্রভাবিত করা অসম্ভব নয়।

মন্দ মুদ্রা পাল্টে দেয় মানুষের মানসিকতা। এখনকার মানুষ কম পয়সায় ঠুনকো জিনিস পছন্দ করে। এক-দুই বার ব্যবহার করলাম, তার পর ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, সে পণ্যই হোক কিংবা মানুষ। অসুখ হলে মানুষ এখন এক দিনও ভুগতে চায় না, সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হতে চায়। কোনোমতে দুই বড়ি অ্যান্টিবায়োটিক গিলে নিয়ে সুস্থ হয়ে গেলে বাকি বড়িগুলো ফেলে দেয় আস্তাকুঁড়ে। সময় আর ধৈর্য্য কোথায় ডাক্তারের নিদান মোতাবেক অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স কমপ্লিট করার? এর ফলে একদিকে বাড়ছে দূষণ, অন্যদিকে কমছে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। সমুদ্র-নদী-পুকুরের মাছের পেটে গিয়ে জমছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, যথেচ্ছ ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক। অনতিকাল পরেই সেই প্লাস্টিক-অ্যান্টিবায়োটিক কণা মৎস্যবাহীত হয়ে মৌরুশী পাট্টা গাড়ছে আমাদের প্রত্যেকের রক্তে ও অন্ত্রে। এর ফলে আমাদের এবং আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের শরীর-মনে কী কী এপিজেনেটিক পরিবর্তন হচ্ছে, সেটা ভবিষ্যতই শুধু বলতে পারে। কী বলব, শক্ত-পোক্ত জিনিসের কোনো কদরই যেন নেই আজকাল। এখনকার একটা ফ্রিজ বা ইস্ত্রির সঙ্গে আগেকার দিনেরগুলোর তুলনা করে দেখুন, পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। আগেকার দিনের জিনিসপত্র তো বটেই, সংসার, স্বামী-স্ত্রীও যেন এখনকারগুলোর তুলনায় শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তপোক্ত ছিল।

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! ঊনবিংশ শতকের সঙ্গে যদি আপনি তুলনা করেন, তবে দেখবেন, আজকাল ছেলেরা বাপ-মায়ের কথা খুব একটা শোনে না বা শুনলেও কম শোনে। এর কারণ, মন্দমুদ্রার কারণে তাদের বর্তমান অস্থির এবং ভবিষ্যৎও যে অচিরেই সুস্থির হবে, এমন কোনো আশা তারা দেখতে পাচ্ছে না। ‘সদা সত্য কথা বলিবে!’-র মতো অতি ব্যবহৃত উপদেশও ডাহা মিথ্যা কথায় পরিণত হতে যাচ্ছে। যেসব বুনিয়াদি চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে ছেলেমেয়ে মানুষ করা বা যুগান্তরের প্যারেন্টিং পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল, মন্দমুদ্রার কারণে সমাজের সঞ্চয় ও মূলধন ধসে পড়াতে সেই চিন্তাগুলো দিন দিন অসাড় প্রতীয়মান হচ্ছে। গড় মার্কিন পরিবার আজ দেউলিয়া, ঋণ নিয়ে নিয়ে কোনোমতে টিকে আছে। একটি ঋণনির্ভর ও সঞ্চয়-বিমুখ সমাজে কীভাবে মূলধন কিংবা মূল্যবোধ গড়ে উঠবে?

আরেকটি অভিযোগ আজকাল ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে প্রায়ই শোনা যায়। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শিল্পী আজম খান বলেছেন, ‘আমরাতো সিঁড়ি বাইয়া উঠতাম, এরা লিফট দিয়া তাড়াতাড়ি উইঠ্যা যাইবার চায়!’ সাধনার কোনো বালাই নেই, কোনো কাজ না শিখেই সেই কাজে নিজেকে এক্সপার্ট দাবি করতে চায় বর্তমান প্রজন্ম। গান না শিখেও আজকাল গায়ক হওয়া যায়। ছবি আঁকা না জেনে হওয়া যায় শিল্পী। ‘সার্টিফাইড, নট প্রফেশনাল’ অর্থাৎ কাজ জানার ডিগ্রি আছে দিস্তা দিস্তা, কিন্তু আসলে কোনো কাজ জানে না, এমন লোক গিজ গিজ করছে চারপাশে। এমএ, পিএইচডি করে ফেলেছে, কিন্তু ‘বেসিক’ লেখাপড়া জানে না, ‘আমি খাই’ লিখতে ‘আমি খায়’ লেখে, এমন লোকের সংখ্যা, আমি নিশ্চিত, ঊনবিংশ শতকে বা তারও আগে তুলনামূলকভাবে কম ছিল। সবাই এখন ডিগ্রি চায়, জ্ঞান বা দক্ষতা চায় না, কারণ সমাজ (কিংবা মেয়ের বাপ) ডিগ্রি দেখতে চায়, (পাণিগ্রাহীর) জ্ঞান বা দক্ষতার কোনোই দাম দেয় না। মানুষ দুই নম্বরী করছে, কারণ সমাজ দুই নম্বরীর পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে শুধু নয়, দুই নম্বরীর উচ্চ মূল্যায়নও করছে।

অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে অর্থব্যবস্থার একটা সম্পর্ক আছে। মন্দ মুদ্রার কারণে সমাজের টাইম প্রেফারেন্স বা ভোগবাসনা অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। বিলম্বিত ভোগে কেউ আর বিশ্বাস করতে চায় না। এখনই খাবো এবং অনেক খাবো! প্রতি মুহূর্তে টাকার দাম কমছে, সুতরাং সবাই এখন খৈয়ামপন্থী: ‘নগদ যা পাও, হাতে পেতে নাও, বাকির খাতা শূন্য থাক। দূরের বাদ্য শুনে কী লাভ, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক!’ সঞ্চয় করে কোনো লাভ নেই। টাকা লাগলে ক্রেডিট কার্ড ঘসে দাও, ব্যাংক থেকে ঋণ নাও। সুদ দিতে থাকো। এক ঋণের কিস্তি পরিশোধ হয়ে গেলে কিংবা ঋণ পরিশোধ হবার আগেই পুরনো ঋণ রিশিডিউল করে নতুন ঋণ নাও। ‘পকেটপুরে ঋণ করো আর পেটপুরে ঘি খাও’!

চার। ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার...’

মুদ্রাস্ফীতির এই যুগে ঋণখেলাপী আর দুর্নীতিবাজেরাই সঠিক পথে আছে, কারণ কিনসীয় অর্থনীতির গতিসূত্র তারাই ঠিকঠাকমতো ধরতে পেরেছে এবং সেই অনুসারে কাজ করে প্রকৃতই তারা লাভবান হচ্ছে। বাকি সব বোকার হদ্দ, অর্থনীতির নীতির দিকটা শুধু বোঝে, অর্থের দিকটা একদম বোঝে না। খেলাপী ঋণের টাকা দুইভাবে নিরাপদ। প্রথমত, ফেরৎ-অযোগ্য ঋণ নিয়ে টাকাটা তারা পাচার করছে এমন কোনো দেশে যেখানে মুদ্রাস্ফীতি কম। দ্বিতীয়ত, ঋণই যেহেতু খেলাপী, সেহেতু ঋণের সুদও তাদের গুণতে হচ্ছে না। যে ঋণখেলাপীরা ঋণের টাকা পাচার করছে না, দেশেই কোনোভাবে হজম করছে, তারা সুদ দেওয়া থেকে বেঁচে গেলেও টাকার অবমূল্যায়নজাত ক্ষতি তাদেরও বইতে, সইতে হচ্ছে, অন্য সবার মতোই।

আমাদের দেশে ঋণখেলাপীর সংখ্যা বাড়ছে, বিদেশে বাড়ছে দেউলিয়ার সংখ্যা। ব্যাংক থেকে বউয়ের নামে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে বিরাট একট ব্যবসা দাও, ব্যবসা কয়েক বছর নামকাওয়াস্তে চালিয়ে লালবাতি জ্বালিয়ে দাও, বৌকে মানসিক অসুস্থ প্রমাণ করো ডাক্তারকে পয়সা খাইয়ে কিংবা তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করো। ঋণের টাকাটা সরিয়ে ফেলো সুইস ব্যাংক বা অন্য কোথাও। ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজসে আবার ঋণ নাও এবং নতুন ব্যবসা দাও ছেলে বা মেয়ের নামে।

সরকারি-বেসরকারি অনেক লোক দীর্ঘদিন ধরে দুই-তিন-চার নম্বরী করার পর যখন অবশেষে পাপের ভারা পূর্ণ হয়, তখন মন্দা আসে কিংবা তুচ্ছ অজুহাতে লাগিয়ে দেওয়া হয় যুদ্ধ। ‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে।’ জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতার পঙতি। কোনো এক সন্ধ্যায় ডিরেক্টরদের সম্মানী পাইপয়সাটুকু পর্যন্ত মিটিয়ে দিয়ে সাধারণ খদ্দেরদের নাকের ওপর ব্যাংকের দরজা বন্ধ করতে করতে বলা হয়: ‘দুঃখিত, পরে আসুন, দেখি কী করা যায়।’

আবারও টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়া হয় সরকারের পছন্দের খেলাপীদেরকে, যাতে তারা পুরনো ঋণ পরিশোধ করতে পারে। (কখনও) তাদের ঋণ বা ঋণের সুদ মওকুফ করে দেয়া হয়, কিংবা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন করা হয়) ঋণগুলোকে শ্রেফ মুছে দেয়া হয় হিসাবের খাতা থেকে। ‘ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।’ এবারের মন্দায় অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাঋণ মওকুফ করা হয়েছে, কিন্তু এমন ঘটনাকে ব্যতিক্রমের কাতারেই ফেলতে হবে। জনগণের বাড়ির ঋণ কখনই মওকুফ করা হয় না।

এমন পরিস্থিতিতে মিস্টার পুঁজি স্বদেশে নিরাপদ বোধ করেন না। উচ্চতর আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে তিনি বিদেশ চলে যান, কিন্তু জীবনে আর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন না। ‘স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্যান সর্বত্র পূজ্যতে।’ অর্থাৎ রাজার স্বদেশে পূজা হয়, বিদ্যানের সর্বত্র পূজা হয়। একই ভাবে পুঁজিও ‘সর্বত্র পূজ্যতে’, সব জায়গায় এর আদর। বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ডহোম শতভাগ বাংলাদেশ ও পৃথিবীর অর্থ-অব্যবস্থার ফলশ্রুতি। অফশোর একাউন্ট, পানামা প্যাপার্স, সুইস ব্যাংক ইত্যাদি অনেকটাই ১৯৭১ সালের ১৫ অগাস্টে শুরু হওয়া ফিয়াট-পরবর্তী যুগের বদভ্যাস। কিনসীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এটাই মানব জাতির ভবিতব্য, এ রকমটাই নাকি হওয়ার কথা ছিল। এর চেয়ে ভালো অবস্থা নাকি হতেই পারে না, হওয়া অসম্ভব।

‘সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন।’ তারপর ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, বনলতা সেন।’ এত শত দুই নম্বরী করে, মানুষের জীবনে আনন্দের পরিবর্তে গুচ্ছের অন্ধকার ধরিয়ে দিয়ে, মুখোমুখি বসার সাহস যার আছে, সেই নির্লজ্জ বনলতা ‘সেয়ানা’ না হয়ে পারে?