মানুষ এখন শর্টকাট পথে খ্যাতিমান হতে চায়। অনেকে হয়েও যাচ্ছে। তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে অমর একুশে বইমেলাতেও।
Published : 27 Feb 2024, 06:03 PM
ডা. সাবরিনার বই ‘বন্দিনী’ স্টক আউট। একটি সংবাদপত্রে খবরটি প্রকাশিত হয় গত ১১ ফেব্রুয়ারি। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলমান অমর একুশে বইমেলার ১১তম দিনে।
প্রশ্ন হলো, ডা. সাবরিনা কি এতই খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় লেখক যে মাত্র ১১দিনেই তার বই স্টক আউট হয়ে গেল? তার বইয়ের কনটেন্ট বা বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ নাকি তিনি নিজে? তিনি কে? তিনি করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণার মামলায় একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
অভিযোগ, জেকেজি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক ডা. সাবরিনা শারমিন হোসেন এবং তার স্বামী আরিফুল চৌধুরী মিলে করোনা টেস্টের ভুয়া সনদ বিক্রি করেছেন। প্রতিটি টেস্টের জন্য জনপ্রতি নিয়েছেন সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। আর বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি তারা নিতেন ১০০ ডলার। অর্থাৎ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত একজন আসামি জেল থেকে বেরিয়ে একটি বই লিখলেন আর সেটি ১১ দিনের মধ্যে স্টক আউট হয়ে গেলো— এটি সমাজে এবং পাঠকসমাজে কী বার্তা দেয়?
এবারের বইমেলার আরও দুটি আলোচিত চরিত্র মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সাবেক সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ এবং একই কলেজের শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলাম তিশা। এই দম্পতির দুটি বই নিয়েও এবারের বইমেলায় তোলপাড় হয়েছে। বই দুটির নাম ‘তিশা অ্যান্ড মুশতাক’ এবং ‘তিশার ভালোবাসা’।
অসম প্রেম, বিয়ে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনায় থাকা এই দম্পতিকে বইমেলা থেকে ধাওয়া দিয়ে বের করে দেয়ার ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে নেটিজেনরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এই দম্পতির বই দুটিও প্রচুর বিক্রি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। অথচ তাদের কেউই পেশাদার বা জনপ্রিয় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ লেখক নন। তাদের বইয়ের যে কনটেন্ট, সেখানেও এমন কিছু নেই যা পাঠককে সহজে আকৃষ্ট করবে। কিন্তু তারপরেও তাদের বই দুটি প্রচুর বিক্রি হলো কেন? এখানেও যে বইয়ের নাম ও কনটেন্টের চেয়ে মুশতাক ও তিশার ব্যক্তি পরিচয়ই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। এসব কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, ইউটিউব বা ফেসবুক তথা সোশ্যাল মিডিয়ায় তারকা কিংবা কথিত তারকা হওয়ার পরে তিনি যা লিখবেন, পাঠকরা সেটির ওপরেই হামলে পড়বে? অথচ অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সৃজনশীল ও মননশীল বইয়ের বিক্রি নিয়েও প্রকাশকরা হতাশা ব্যক্ত করেন। তার মানে কি এই যে, লেখক হওয়ার আগে সেলিব্রিটি হতে হবে? যেমন করে সম্ভব, ‘যেনতেন প্রকারেণ কার্যসিদ্ধি গরিয়সী’।
কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল অমর একুশে বইমেলার ২৫ তম দিনে ফেসবুকে লিখেছেন: ‘বইমেলার বাকি আছে মাত্র পাঁচদিন। ঘোষণা দিয়ে যদি মেলায় যাই তাহলে এই পাঁচ দিনে হাজার পাঁচেক বই বিক্রি হবে না? কী মনে হয় আপনাদের? কারো কারো কিন্তু হয়। তিন দিনে দু-আড়াই হাজার বই একেবারে উড়ে যায়, পাঁচদিনে অন্তত তিনটা এডিশন শেষ হয় ইত্যাদি। ভুলে যাবেন না সেসব কথা।’
এই বক্তব্যের রসিকতা ধরতে না পারার কারণ নেই। তবে এটি যতটা না রসিকতা, তার চেয়ে বেশি পরিহাস। আসলেই কি কারো বই একদিনে এক হাজার কপি বিক্রি হয়? কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন একসঙ্গে অনেক বই কিনলে সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু পাঠক প্রতি হিসাব করলে একদিনে, অর্থাৎ বইমেলা চলাকালীন ৪-৫ ঘণ্টায় কি এক হাজার কপি বই বিক্রি হতে পারে? তাতে একটি বই বিক্রিতে গড়ে কত সময় লাগে? আর একটি স্টলে কি বিক্রয়কর্মীরা শুধু একটি বই বিক্রি করেন? সুতরাং যারা বিভিন্ন সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বলে আওয়াজ দিয়েছেন বা এখনও দেন যে, তিন দিনে তাদের পাঁচ হাজার বই শেষ,সেই তথ্যগুলো নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এটি হচ্ছে মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিঠ হলো, যদি সত্যিই কোনো লেখকের বই তিনদিনে পাঁচ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়, সেটি বইয়ের প্রকাশক এবং লেখকদের জন্য আনন্দের খবর। তাতে দুটি জিনিস প্রমাণিত হয়; ১. মানুষ বই পড়ছে এবং ২. বই লিখেও ভালো রোজগার করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, খুব জনপ্রিয় লেখক যেমন হুমায়ূন আহমেদ বা এরকম কোনো লেখক ছাড়া আর কারো বই কি এরকম বিক্রি হয়? এরকম আর কতজন লেখকের নাম এই মুহূর্তে বলা সম্ভব? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং নানাবিধ বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ কনটেন্টের কারণে ভাইরাল হয়ে অথবা বিবিধরকমের ক্রিয়াকলাপ করে ‘ইউটিউব সেলিব্রিটি’ হওয়ার এইকালে কাদের বই বেশি বিক্রি হচ্ছে?
আহমাদ মোস্তফা কামাল যেদিন ফেসবুকে ওই পোস্টটি দিলেন, সেদিনই ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের একটি খবরের শিরোনাম: ‘প্রতিষ্ঠিত লেখকের চেয়ে সেলিব্রিটিদের বইয়ে আগ্রহী পাঠকরা।’ খবরে বলা হয়, একুশের বইমেলা তার পুরোনো চেহারা হারিয়েছে। মূলধারার সাহিত্যকে সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া তথা পাঠক সৃষ্টির লক্ষ্যে ভাষা আন্দোলনের চেতনায় এই বইমেলা শুরু হলেও এখন সৃজহনশীল ও মননশীল বই নয়, বরং ‘সেলিব্রিটিদের’ বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। যেমন সংগীত, অভিনয়সহ শিল্প-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে খ্যাতিমান বা পরিচিত এবং নানা কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচিত চরিত্রদের বইয়ের বিক্রি অনেক বেশি। বিশেষ করে তরুণ পাঠকদের আগ্রহের কেন্দ্রে এইসব বই।
একজন পাঠক কী পড়বেন বা পড়বেন না— সেই স্বাধীনতা তার নিজের। অনেক ভালো কনটেন্ট, সমাজ ও দেশের জন্য প্রয়োজনীয় কিংবা জাতির মেধা ও মনন গঠন ভূমিকা রাখতে পারে, এমন বইও ভালো বিক্রি নাও হতে পারে। এটি নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। বিশেষ করে একটা সমাজ ও রাষ্ট্র কী ধরনের পরিস্থিতি বা বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, সেটি অনেকখানি বোঝা যায় ওই সময়ে কোন ধরনের বইয়ের চাহিদা বেশি, সেটি দেখে। যেমন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান তার একটি লেখায় বলেছেন, ‘আমার এক ভারতীয় বন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে একবার জানতে চেয়েছিলেন, পরেরবার যখন আসবেন, তখন কী নিয়ে আসবেন তাদের জন্য? তারা বহু দ্বিধার পরে উত্তর দিয়েছিল। জামাকাপড় নয়, খাদ্যদ্রব্য নয়, ‘রূপসী বাংলা’র একটি কপি। হয়তো এ বিচার নন্দনতাত্ত্বিক নয়, তবে একজন কবির পক্ষে এর চেয়ে বড় পাওয়া কী হতে পারে, আমার তা জানা নেই।’ (জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবার্ষিক স্মারকগ্রন্থ, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবুল হাসনাত সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ২৭)।
এই ঘটনার সঙ্গে তুলনা করে আমরা যদি এই সময়ের বাংলাদেশকে দেখি তাহলে দেখা যাবে সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে মানুষের রুচি, বোধ, চিন্তা ও দর্শনেও দারুণ পরিবর্তন এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়া এখন মানুষকে এতটাই প্রভাবিত করছে যে, তার প্রতিদিনকার জীবনচর্চা, তার মূল্যবোধ, তার হাজার বছরের চিন্তায় বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন।
বলা হয় এখন ভিডিও কনটেন্টের যুগ। ভাইরাল হওয়ার যুগ। মানুষ ছোট ছোট ভিডিওর মধ্য দিয়ে দেশ ও বিশ্বকে দেখে। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন পুরো বিশ্বকে মানুষের করতলবন্দি করেছে। ফলে মানুষের জানাবোঝার জানালা দিয়ে দখিন হাওয়া যেমন ঢুকছে তেমনি ঢুকে পড়েছে প্রচুর দুর্গন্ধ। মুশকিল হলো, সেই দখিন হাওয়া আর দুর্গন্ধের লড়াইয়ে কে জিতে যাচ্ছে? এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ কোন ধরনের কনটেন্ট বেশি দেখছে? কারা এখন তারকা হয়ে যাচ্ছে? কোন প্রক্রিয়ায়?
মানুষ এখন শর্টকাট পথে খ্যাতিমান হতে চায়। অনেকে হয়েও যাচ্ছে। তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে অমর একুশে বইমেলাতেও। সুতরাং ডা. সাবরিনা, মুশতাক-তিশা কিংবা হিরো আলমরা যা লিখছেন, মানুষ সেখানে হামলে পড়ছে প্রথমত কৌতূহলে, দ্বিতীয়ত হুজুগে। আর এই কৌতূহল ও হুজুগের পাল্লায় পড়ে মেলার ১০-১১ দিনের মধ্যে তাদের বই স্টক আউট হয়ে যায়। অথচ অনেক গবেষণাধর্মী, সৃজনশীল ও মননশীল বই হয়তো পুরো এক মাসের মেলায় তিনশো কপিও বিক্রি হয় না। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে মানুষের চিন্তা-বোধ ও ভাবনার জগতে যে বড় ধরনের নাড়া দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া—বই ও বইমেলায় তার প্রভাব খুবই স্পষ্ট।