৭ই মার্চের ‘দ্য ভাষণ’

ভাষণে স্বাধীনতার ‘সরাসরি ঘোষণা না দিয়েও, ঘোষণা দেওয়ার’ বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক কৌশল মাত্র, সেটা কিসিঞ্জারও উপলব্ধি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যে এমন একটা কিছু বলবেন তা অবশ্য তিনি ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ কয়েকজন বিদেশী সংবাদদাতার সাথে সাক্ষাৎকারে তাদের পীড়াপীড়িতে আভাস দিয়েছিলেন, যা ২০১৭ সালে সিআইএ-এর বাংলাদেশের ওপর ‘ডি-ক্লাসিফাইড’ দলিলে প্রকাশিত হয়েছে।

শামস্ রহমানশামস্ রহমান
Published : 26 March 2023, 12:09 PM
Updated : 26 March 2023, 12:09 PM

৭ই মার্চের ভাষণের মাঝে বঙ্গবন্ধু রূপান্তরিত হন একজন conscious competent নেতা থেকে একজন unconscious competent নেতা রূপে। আর তার ‘অফ-দ্য-কাফ’ ভাষণে সেই জটিল সময়ের রাজনীতির অত্যন্ত দুরূহ বিষয়বস্তুর অভিব্যক্তি ও ব্যাখ্যা ধ্বনিত হয় অত্যন্ত সহজ, সরল কথায় এবং কথোপকথনের ভঙ্গিতে, যা রূপান্তরিত হয় বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের অনন্য সম্পদে। তাই, এ ভাষণ শুধুই ৭ই মার্চের ভাষণ নয়, এ ভাষণ বঙ্গবন্ধুর ‘দ্য ভাষণ’। যথার্থ অর্থে এ ভাষণ অনুধাবনের জন্য পাকিস্তানের ২৩ বছরের (১৯৪৭-৭১) রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাস এবং সে যুগের উপমহাদেশকে ঘিরে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির রূঢ় বাস্তবতাকে বোঝা অপরিহার্য। এ পাঠে আমি স্বাগত জানাই আমার দেশের নতুন প্রজন্মকে।

বিংশ শতাব্দীতে বহু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত হয়, যা অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। যারা এসব আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তারা ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক নেতা। তারা তাদের মানবিক এবং রাজনৈতিক গুণাবলি, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সহজ কথায় সাজানো বক্তৃতায় জনগণকে অনুপ্রাণিত করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের একজন।

১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সমগ্র পাকিস্তানের সরকার গঠনের দাবিদার হয়। তথাপি, তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ না জানিয়ে নানা ছলচাতুরিতে কালক্ষেপন করে আর নিরস্ত্র বাঙালির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং ন্যায়সঙ্গত দাবি নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে সামরিক প্রস্তুতি নেয়। এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু অসীম ধৈর‌্য এবং প্রজ্ঞার সাথে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রমনা রেসকোর্স (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে ভাষণ প্রদান ছিল তেমনি এক পদক্ষেপ।

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি হিসেবে। এ বিষয়টি আজ আর কারও অজানা নেই। ২০১৩ সালে প্রকাশিত We Shall Fight on the Beaches নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে এ ভাষণটি। ভাষণের শিরোনাম– The Struggle this Time is the Struggle for Independence। সেই সাথে ২০১৭ সালে বিশ্বের ৭৭টি প্রামাণ্য দলিলের সাথে এই ভাষণ ইউনেসকো ‘Documentary Heritage’ হিসেবে ‘Memory of the World Register-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। ইউনেসকো তার ভূমিকায় লিখেছে, ‘The speech effectively declared the independence of Bangladesh. The speech constitutes faithful documentation of how the failure of post-colonial nation-states to develop inclusive, democratic society alienates their population belonging to different ethnic, cultural, linguistic or religious groups’ (UNESCO, 2017)। ভাষণটি যে কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা ইউনেসকোর পর্যালোচনায় এটা পরিষ্কার। হেনরি কিসিঞ্জার যিনি মার্কিন প্রশাসনের হয়ে বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকারকে অস্বীকার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তিনি ৭ই মার্চের ভাষণের পর মন্তব্য করেন ‘[Mujib] Rahman has embarked on a Gandhian-type non-violent non-cooperation campaign which makes it harder to justify repression’ (Gary Bass, The Blood Telegram, p.31)। ইয়াহিয়া সরকার যে বাঙালির ন্যায়সঙ্গত দাবি বলপ্রয়োগে নস্যাৎ করতে পারে তা মার্কিন প্রশাসন ভালো করেই জানত– এই মন্তব্য সেই ধারণাই দেয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকা অহিংস অসহযোগ অভিযান যে দমনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে সেটাও কিসিঞ্জার অনুধাবন করেন।

কিসিঞ্জার আরও বলেন, “While East Pakistani leader Mujibur Rahman has stepped back a bit from a declaration of independence, the full text of his March 7 speech conveys a harsher tone than the initial summary reports, and it seems apparent that his retreat was tactical,”।

ভাষণে স্বাধীনতার ‘সরাসরি ঘোষণা না দিয়েও, ঘোষণা দেওয়ার’ বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক কৌশল মাত্র, সেটাও কিসিঞ্জার উপলব্ধি করেন। বঙ্গবন্ধু যে এমন একটা কিছু বলবেন তা অবশ্য তিনি ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ কয়েকজন বিদেশী সংবাদদাতার সাথে সাক্ষাৎকারে তাদের পীড়াপীড়িতে আভাস দিয়েছিলেন, যা ২০১৭ সালে সিআইএ-এর বাংলাদেশের ওপর ‘ডি-ক্লাসিফাইড’ দলিলে প্রকাশিত হয়েছে। সিআইএ-এর দলিলে খবরটি এভাবে ছাপা হয়–

In an interview last night (4th March 1971) with several foreign correspondents, Mujib was evasive about his plans but eventually admitted "off the record" that at the rally he has scheduled for 7 March he will announce the equivalent of independence for East Pakistan (10 March 2017, Daily Star) [গত রাতে (৪ঠা মার্চ ১৯৭১) বেশ কয়েকজন বিদেশী সংবাদদাতার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে, মুজিব তার পরিকল্পনা সম্পর্কে এড়িয়ে যেতে চান কিন্তু অবশেষে "অফ দ্য রেকর্ড" স্বীকার করেন যে ৭ মার্চের সমাবেশে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতার সমতুল্য ঘোষণা করবেন]।

বঙ্গবন্ধু সেদিনের ভাষণে কেন ‘স্বাধীনতার সমতুল্য ঘোষণা’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন? বুঝতে হবে আইনগতভাবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম তখনও পরিচালিত হচ্ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে এবং বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন, তার যেকোনো একটি ভুল পদক্ষেপ পূর্ব বাংলার জনগণের বৈধ এবং ন্যায়সংগত আন্দোলনকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করবে। ‘স্বাধীনতার সমতুল্য ঘোষণা’ দেওয়ার মাঝে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিকটিই উঠে আসে।

বঙ্গবন্ধু যখন ৭ মার্চের মঞ্চে উঠে আসেন তখন তিনি একজন conscious competent নেতা। তার মানে এটা তার নেতৃত্বের এমন এক পর্যায়, যেখানে নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলি তিনি অর্জন করেন দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে। উল্লেখ্য, ভাষণের মাঝেই আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধু রূপান্তরিত হন একজন conscious competent নেতা থেকে একজন unconscious competent নেতা রূপে। যার মানে তার নেতৃত্ব এমন এক পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়, যেখানে নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলি বঙ্গবন্ধুর কাছে উদয় হয় অত্যন্ত সাবলীলভাবে। তাই তো সেই অত্যন্ত জটিল সময়ের রাজনীতির অতি দুরূহ বিষয়বস্তুর অভিব্যক্তি ও ব্যাখ্যা ধ্বনিত হয় অত্যন্ত সহজ, সরল কথায় এবং যা ছিল সরাসরি সাড়ে সাত কোটি বাঙালির উদ্দেশে কথোপকথনের ভঙ্গিতে। সে কারণেই, ৭ মার্চের ‘অফ-দ্য-কাফ’ ভাষণ মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে গভীরভাবে আর যা হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের অনন্য সম্পদ।

ছোটবেলা মা থেকেই প্রথম জেনেছি ‘ইন্‌শাআল্লাহ’ বলার গুরুত্ব। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ পর্যন্ত শব্দটি উচ্চারণ করেছি শত সহস্রবার– কখনো মনে মনে, কখনো প্রকাশ্যে। তবে ‘ইন্‌শাআল্লাহ’ উচ্চারণে হৃদয়ে কতটা সাহস সঞ্চারিত হতে পারে, দেহে কতটা শক্তি জোগান দিতে পারে, তা প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করি ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত ‘ইন্‌শাআল্লাহ’ থেকে– ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ‘ইন্‌শাআল্লাহ’।

‘ইন্‌শাআল্লাহ’, শুধুই কথার কথা নয়। ‘ইন্‌শাআল্লাহ’ বললেই সব কিছু অর্জিত হয় না। তার জন্য চাই লক্ষ্যের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস এবং সেই সাথে চাই অর্জনের প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধু পাঠে জানা যায় যে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস স্থাপন করেন স্বাধীনতা লাভের অনেক আগে থেকেই। ষাটের দশকের শুরুতে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ ও খোকা রায়ের সাথে এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘…গণতন্ত্র-স্বায়ত্তশাসন এসব কিছুই পাঞ্জাবিরা দেবে না। কাজেই স্বাধীনতা ছাড়া বাংলার মুক্তি নেই। … স্বাধীনতাই আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য’ (সাপ্তাহিক একতা, ১৯ অগাস্ট ১৯৮৮)। একই উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সালে আশারামবাড়ী হয়ে আগরতলা যান। সেখানে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সচিন্দ্রলাল সিনহার সাথে সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু যা বলেন, তা মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায়– ‘Mujib made it clear that ‘Bengalis could no longer live with honour and hope with Pakistan and therefore he was seeking help for the liberation of his people’ (Bhaumik, 2016, p. 14: The Agartala Doctrine, Oxford University press)। বিষয়টি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর কাছে পৌঁছলেও সেই সময় ভারত-চীন সীমান্তে বিরাজমান উত্তেজনার কারণে বেশি দূর এগোয়নি। প্রয়োজনে ভারতের সহযোগিতার আশ্বাস নিশ্চিত করার জন্য ষাটের দশকের শেষ দিকে বরিশালের আওয়ামী লীগ নেতা চিত্তরঞ্জন সূতারকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারতের প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার (S A Karim, Sheikh Mujib – Triumph and tragedy, p. 206, 2005)।

১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনে স্বাধীনতার উদ্দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে নিউক্লিয়াস বা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠিত হয় যা ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ নামে পুনর্গঠিত হয় (Rohena Alam Khan, Making the first flag of Bangladesh, Dhaka Tribune, 16 December 2021)।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরাধীনতা থেকে মুক্তির প্রয়াসে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করে এবং বাস্তবায়নের দাবি করেন। এটি একটি সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট দাবি, যার মাঝে অন্তর্নিহিত ছিল সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, যা ছিল বাঙালি জাতির আত্ননিয়ন্ত্রণের পথে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। ছয় দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু রচনা করেন সত্তরের নির্বাচনের ইশতেহার। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সমগ্র পাকিস্তানের সরকার গঠনের দাবিদার হয়, যা ওই সময়কার পাকিস্তান সরকার পারেনি গ্রহণ করতে, পারেনি প্রত্যাখ্যান করতে। তাই, বাঙালি জাতির উপর চাপিয়ে দিয়েছে যুদ্ধ।

এ থেকে প্রতীয়মান যে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর ছিল অপরিমেয় বিশ্বাস আর বিশ্বাস বাস্তবায়নে প্রস্তুতি নিয়েছেন সাংগঠিকভাবে, সেই সাথে সমগ্র জাতিকে অনুপ্রাণিত করেন স্বাধীনতার পক্ষে। আবেগ ও ভালবাসা দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন বটে, তবে যুক্তি-তর্ক ও তথ্যের মাঝে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যান অভিষ্ঠ লক্ষ্যে। কেবল তারপরই ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন ‘ইন্‌শাআল্লাহ’– এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ‘ইন্‌শাআল্লাহ’।

এ ভাষণের মাঝে বঙ্গবন্ধু রূপান্তরিত হন একজন conscious competent নেতা থেকে একজন unconscious competent নেতারূপে। আর তার ‘অফ-দ্য-কাফ’ ভাষণে সেই জটিল সময়ের রাজনীতির অত্যন্ত দুরূহ বিষয়বস্তুর অভিব্যক্তি ও ব্যাখ্যা ধ্বনিত হয় অত্যন্ত সহজ, সরল কথায়, যা রূপান্তরিত হয় বাঙালি জাতির মুক্তি সনদে। তাই, এ ভাষণ শুধুই ৭ মার্চের ভাষণ নয়, এ ভাষণ বঙ্গবন্ধুর ‘দ্য ভাষণ’।