সম্মেলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তেমন পরিবর্তন কেন আসলো না- তার বিশ্লেষণ করে নিজের মতামত তুলে ধরেছেন লেখক।
Published : 25 Dec 2022, 08:48 PM
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে আছে একটি বছর। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ২২ তম জাতীয় সম্মেলন নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ হয়েছে। দলটির সভাপতি যে শেখ হাসিনা হবেন তা আগে থেকে জানতেন নেতারা। সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে কিছুটা কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছিল। তবে ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে সেই কৌতুহলেও ভাটা পড়ে যায়। সম্মেলেনের আগে থেকে নেতাকর্মীরা নিশ্চিত ছিলেন- আওয়ামী লীগের সভাপতি হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর সাধারণ সম্পাদক হবেন ওবায়দুল কাদের। জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে সেটিই ঘোষণা করা হলো।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মোট পদের সংখ্যা ৮১। এবারের নতুন কমিটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন নেই। তবে সভাপতিমণ্ডলীর তিনজন সদস্য বাদ পড়েছেন। এর মধ্যে নুরুল ইসলাম নাহিদ গত সম্মেলনে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হয়েছিলেন। বাদ পড়েছেন আবদুল মান্নান খান। তিনি দুই মেয়াদে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। শ্রী রমেশ চন্দ্র সেনও এবার সভাপতিমণ্ডলীতে জায়গা পাননি।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সভাপতিমণ্ডলীতে পদ আছে ১৯টি। আগে থেকেই একটি পদ ফাঁকা ছিল। এবার তিনজন বাদ পড়লেন। এ কারণে চারটি পদ ফাঁকা হয়। এর মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে নতুন করে সভাপতিমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাকি তিনটি ফাঁকা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর পদের সংখ্যা ৩৪। এর মধ্যে শ্রমবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ এবং যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশীদ বাদ পড়েছেন। ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দীকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ হারিয়েছেন সাখাওয়াত হোসেন শফিক। অন্যদিকে, সুজিত রায় নন্দীর পদে এবার জায়গা পেয়েছেন উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম। উপপ্রচার সম্পাদকের পদটি ফাঁকা আছে। সব মিলিয়ে সম্পাদকমণ্ডলীর তিনটি পদ ফাঁকা আছে।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকে কোনো পরিবর্তন নেই। সাংগঠনিক সম্পাদক পদে শুধু একটিই পরিবর্তন। আর ২৮ সদস্যের নির্বাহী সদস্যের কারও নাম ঘোষণা করা হয়নি। আওয়ামী লীগের ২২তম ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের সমাপনী পর্বে দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নামও ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে আগের কমিটির কেউ বাদ যাননি। সভাপতিমণ্ডলী থেকে বাদ পড়া নুরুল ইসলাম নাহিদ, আব্দুল মান্নান খান ও রমেশ চন্দ্র সেনকে উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হয়েছে।
জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে পুরোনো নেতার জায়গায় নতুন নেতৃত্ব আসে। সেই সাথে সংগঠনের পদ-পদবী নিয়ে নতুনভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে সহযোগিতা করে। আবার কখনো কখনো বিবাদেও জড়ায়। ইতিবাচক হলে ভালো ফল যেমন আসে, তেমনি নেতিবাচক প্রভাব ভয়ংকর পরিস্থির সৃষ্টি হয় দলের ভিতরে। তাই আওয়ামী লীগের এবারের নতুন কমিটি নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সামনে জাতীয় নির্বাচন। দলের পদ-পদবী নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হলে এর প্রভাব পড়তে পারে জাতীয় নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের ইতিহাসেও এর নজির আছে।
১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হোসাইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর দলটি ভাঙনের শিকার হয়, একটি অংশ নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের এবং অপরটি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর নেতৃত্বের সংকটে পড়েছিল আওয়ামী লীগ। মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, আব্দুর রাজ্জাক বিভিন্ন নামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের পর দলটিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব সুদৃঢ় হয়।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সামনে আগামী নির্বাচন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সাথে আছে দেশি এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বিএনপি-জামায়াত জোট ১০ ডিসেম্বর বর্তমান সরকারকে বিদায়ের দিন হিসেবে ঘোষণাও দিয়েছিল। বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর সবকিছু চলবে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে। যে বিএনপি গেল ১৪ বছরে কোনো ইস্যুতে সরকারবিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, তারাই এমনি এমনি সরকারকে হুঁশিয়ারি দেয়নি। পর্দার আড়ালে কূটকৌশল চালিয়েছিল।
যদিও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির এই হুমকি কঠোরভাবেই দমন করেছিল। নয়াপল্টনে বিএনপি সমাবেশ করতে পারেনি। পাশাপাশি বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে থেকে বোমা উদ্ধার করে আন্তর্জাতিক মহলকে বিশেষ বার্তা দেয় সরকার। যদিও এর ডালপালা ছাড়ায় বিভিন্ন দেশের দূতাবাস পর্যন্ত।
ঢাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশ সংঘর্ষে নিহত ও আহতদের পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সহিংসতা, হয়রানি ও ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকতে সবার প্রতি আহ্বান জানায় দেশটি। এরপর রাশিয়া দূতাবাস তাদের ফেইসবুক পেজে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বিষয়ে বিবৃতি প্রচার করে। এক দিন পর ওই বিবৃতি নিয়ে পাল্টা একটি টুইট করে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। রাশিয়া দূতাবাস টুইটারে একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে।
এ পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন নিয়ে চিন্তিত আওয়ামী লীগ। দেশ ও বিদেশের সমালোচনা কিংবা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে আওয়ামী লীগের ঐক্য খুবই জরুরী। পাশাপাশি নেতৃত্বের প্রতি অগাধ বিশ্বাস প্রয়োজন। কারণ আওয়ামী লীগের আছে ১৯৭৫ সালের দগদগে ইতিহাস। ১৫ অগাস্টে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আওয়ামী তৎকালীন প্রধান নেতৃবৃন্দের একটি বড় অংশই ছিলেন নিরব।
গত ১৬ অগাস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “কত স্লোগান- বঙ্গবন্ধু তুমি আছো যেখানে, আমরা আছি সেখানে। অনেক স্লোগান তো হচ্ছিল। কোথায় ছিল সেই মানুষগুলি? একটি মানুষ ছিল না সাহস করে এগিয়ে আসার? একটি মানুষ ছিল না প্রতিবাদ করার? কেন করতে পারেনি?” দলের নেতাকর্মীদের নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, “এত বড় সংগঠন, এত লোক, কেউ তো একটা কথা বলার সাহস পায়নি। ১৫ অগাস্টে, ১৬ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুর লাশ ওই ধানমণ্ডিতে পড়ে ছিল।”
সেই দিনের ভয়ংকর দিনগুলোর কথা ভুলে যাননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতা-গ্রহণযোগ্যতা আছে বলেই নেতাকর্মীদের এতো ভিড়-স্লোগান। তাই আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্র না হয় সেজন্য প্রায় একই কমিটি করেছেন তিনি। যাতে নির্বাচনের আগে অন্তত দলের মধ্যে কোনো বিবাদ সৃষ্টি না হয়। আর বাইরের কেউ এর ফায়দা লুটতে না পারে। পাশাপাশি পুরোনো নেতারাও আওয়ামী লীগের ফিরছেন। এরইমধ্যে বিভিন্ন কারণে যেসব নেতাকর্মীর বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। সামনে নির্বাচনে শেখ হাসিনার দুটি লক্ষ্য- আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং জনগণের সমর্থন।