পাহাড়ে টেকসই সামাজিক সেবা নিশ্চিতে পাড়াকেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হোক

পাহাড়ের উন্নয়ন বলতে রাস্তাঘাট নির্মাণ, পর্যটনের সুব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনা করার মতো লোকের অভাব হয় না। অভাব আছে, পাহাড়ের কান্না শুনতে পাওয়ার মতো পাহাড়বান্ধব কানওয়ালা মানুষের।

ঞ্যোহ্লা মংঞ্যোহ্লা মং
Published : 5 March 2024, 02:21 PM
Updated : 5 March 2024, 02:21 PM

আজকাল সমতলের শিক্ষিত সমাজের অনেকে বলে থাকেন, “পাহাড়িরা এগিয়েছে বেশ, তাদের জন্য আর কোটার দরকার নেই।” এটি রাষ্ট্রেরও ধারণা। তাই বিসিএসের মতো বেশিরভাগ চাকরিতে পাহাড়ি কোটা আর নেই। সেই সঙ্গে পাহাড়ের উন্নয়ন বলতে রাস্তাঘাট নির্মাণ, পর্যটনের সুব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনা করার মতো লোকের অভাব হয় না। অভাব আছে, পাহাড়ের কান্না শুনতে পাওয়ার মতো পাহাড়বান্ধব কানওয়ালা মানুষের।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি ইউনিয়নের রেংয় ম্রো পাড়া, একটি দুর্গম বসতি। উপজেলা সদরে আসতে সময় লাগে ৪-৫ ঘণ্টা। ওই তুলনায় আলীকদম উপজেলা সদর কিছুটা কাছে, তাও ৩-৪ ঘণ্টা হাঁটার পথ। সংথম ম্রো এই পাড়ার বাসিন্দা। আশেপাশে স্কুলের অভাব থাকায় তিনি কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার এক বাঙালি বৌদ্ধ পরিবারে তাদের দ্বিতীয় সন্তানকে পাঠিয়েছিলেন পড়ালেখার জন্য। পরে ছেলেটি মায়ের কাছে ফিরে আসার বদলে পরিচয় পাল্টে ম্রো থেকে বড়ুয়া হয়ে যায় বা হয়ে যেতে বাধ্য হয়। সংথম ম্রোর ছেলে হারানোর একটি বাস্তব গল্প এটি।

গল্পটি আরও একটু লম্বা করি। সংথম ম্রোর ৬ ছেলেমেয়ে। স্বামী পুংক্লাইং ম্রো, তার বড় ছেলেকে সঙ্গে করে একদিন ঝিঁরিতে মাছ-কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলেন। অসাবধানতায় ছেলেটি গভীর খাদে পড়ে যায়। ছেলেকে বাঁচাতে নিজেই গভীর খাদে ঝাপ দিয়ে সন্তানকে বাঁচাতে পারলেও মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যান নিজেই। ম্রো সমাজে পিতার মৃত্যুতে সন্তানদের উপস্থিতি থাকার বাধ্যবাধকতা প্রথা থাকলেও সংথক ম্রো তা করতে পারেননি। দ্বিতীয় সন্তানকে বড়ুয়া পরিবার থেকে ফেরাতে পারেননি (দেখুন; উসিথোয়াই, ‘আশা-হফনুং: সন্তান হারানোর বেদনা থেকে পাহাড়ের এক স্কুল’, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২৪ জুলাই ২৩)।

পাহাড়ে চার হাজার ৮০০টি পাড়াকেন্দ্র আছে। তারপরও অনেক এলাকা পাওয়া যাবে যেখানে পাড়াকেন্দ্রও নেই। স্কুল তো অনেক দূরের কথা। পাহাড়ে হাজার হাজার গ্রামের শিশুদের জন্য স্কুল যাওয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলার কাজটি করে এই সব পাড়াকেন্দ্র। সংথম ম্রোদের এলাকায় কোনো পাড়াকেন্দ্রও ছিল না বলে শিক্ষার ক্ষুধায় ছেলেকে দূরে অন্য জাতিগোষ্ঠীর বাড়িতে থেকে হলেও পড়াতে পাঠিয়েছিলেন। ওই সুযোগে বড়ুয়া পরিবারটি ছেলেটিকে বড়ুয়া বানিয়ে পারিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। শিশুদের স্কুল যাওয়ার উপযোগী করার জন্য গড়া পাড়াকেন্দ্রগুলো আজ বন্ধ হওয়ার হুমকিতে পড়েছে। অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চার হাজারতম পাড়া কেন্দ্র উদ্বোধন করলেও গত বছর জুলাই মাস থেকে পাড়াকর্মীদের বেতন নেই। পাড়াকেন্দ্রগুলো প্রাক-প্রাথমিক কার্যক্রম ছাড়াও স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট ইপিআই কার্যক্রম, কিশোরী ও গর্ভবতীদের আয়রন ট্যাবলেট বিতরণ, গর্ভবতীদের চেকআপ, স্যাটেলাইট ক্লিনিক, মায়েদের সঙ্গে উঠান বৈঠক আর কৃষি বিভাগের উঠানে শাক-সবজি চাষে উদ্বুদ্ধকরণ ইত্যাদি কাজ করে থাকে। বেতন না পেলেও শিক্ষা ছাড়া বাকি কাজগুলো বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেই চলেছেন পাড়াকর্মীরা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সম্পর্কে যারা জানেন বা পাহাড়ের উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে যারা খোঁজ-খবর রাখেন, তাদের কাছে পাড়াকেন্দ্র নতুন কিছু নয়। পাড়াকেন্দ্রটি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের একটি সফল, প্রদর্শনযোগ্য তথা মাঠপর্যায়ে কাজের একটি সুন্দরতম উদাহরণ যা ‘টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্প’ নামে বাস্তবায়িত হলেও স্থানীয়ভাবে পাড়াকেন্দ্র নামেই অধিক পরিচিত এবং জনপ্রিয়। ১৯৮৫ সাল থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ধাপে ধাপে প্রকল্পটি চলমান ছিল। প্রকল্পটির নতুন পর্যায় নেওয়ার কথা থাকলেও জুলাই থেকে হাজার হাজার কর্মী অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। তাদের অপেক্ষা যেন আর শেষ হতে চায় না।

পাহাড়ে গেলে সরকারি-বেসরকারি অফিসার, জনপ্রতিনিধিদের নাচে-গানে, ফুলের মালায় যে শিশুরা আনন্দ দেয়, সেই শিশুদের জন্য ওই সকল অফিসার, জনপ্রতিনিধিদের তেমন কোনো উদ্যোগ বা আক্ষেপ চোখে পড়েনি। পাহাড়ে কত শত উন্নয়নকর্মী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাড়াকেন্দ্র দ্বারা নানাভাবে উপকৃত হন, ব্যবহার করার সুযোগ পান, তাদের মধ্য থেকেও কাউকে আওয়াজ ছড়াতে দেখি না।

এই প্রকল্পের অধীনে চারটি আবাসিক বিদ্যালয় রয়েছে। যে বিদ্যালয়গুলোতে দুর্গম এবং আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা পড়ালেখা করার সুযোগ পান। বান্দরবান সদরে ম্রো আবাসিক বিদ্যালয়টি একেবারে ব্যতিক্রমী একটি বিদ্যালয়। এখানে শুধু ম্রো ও খুমী পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা আবাসিক সুবিধাদি পেয়ে থাকেন। এটি বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা জাতিগোষ্ঠীদের তুলে আনার ক্ষেত্রে একটি সুন্দর উদাহরণ। এই প্রকল্প তার বৈচিত্র্য এবং প্রয়োজনীয়তার কারণে বিভিন্ন সময়ে শুধু পুরস্কৃতই হয়নি, ১৯৮৫ সালের পর থেকে এখনো সমান জনপ্রিয়। পাহাড়ে এই একটি প্রকল্প নিয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য শোনা যায় না। তারপরও প্রকল্পের মেয়াদ শেষে কর্মীদেরকে প্রকল্পটির নতুন পর্যায় আসার প্রত্যাশায়-অপেক্ষায় দিনাতিপাত করতে হয়। এটি সকল উন্নয়নকর্মী, পরিকল্পনাবিদদের জন্য ভাববার বিষয় হয়ে উঠতে পারে।

একটি সফল জনমুখী প্রকল্প, শিশু, কিশোরী ও নারীদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালিত হলেও উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্পটিকে স্থায়ী রূপ দিতে পারেনি। এটি একটি সম্মিলিত দুর্ভাগ্য।

পাড়াকেন্দ্র নিয়ে গুগল করলে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়, প্রকাশিত সবকটি প্রতিবেদনের শিরোনামগুলো প্রশংসায় পরিপূর্ণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে এযাবৎকালে যত উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছেন, পাড়াকেন্দ্র প্রকল্পের মতো কোনো প্রকল্প এত পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা পায়নি।

পাড়াকেন্দ্র প্রকল্পই গ্রামবাসীর সঙ্গে উন্নয়ন বোর্ডের সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। অন্য সকল প্রকল্প, কার্যক্রম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। ফলে ওইসব প্রকল্প দ্বারা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই সুবিধাদি পেয়ে থাকে। তারপরও উন্নয়ন বোর্ডের এই প্রকল্পটি প্রতি ৫ বছর অন্তর অন্তর বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তায় পড়ে। এই প্রকল্পটি উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমনির্ভর বলে অবকাঠামো নির্মাণ, টেন্ডারের ন্যায় কাজ নেই, ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আকৃষ্ট করানো যায়নি বলেই মনে হয়েছে। শহরে এলাকাভেদে শিশুপার্ক হয়, খেলাধুলার মাঠ নির্মাণ হয়, কিন্তু পাহাড়ে সেসব নেই। পাহাড়ি শিশুদের জন্য পাড়াকেন্দ্রটিই এক টুকরো খেলার কেন্দ্র, কেন্দ্রটি শিশুবান্ধব কর্মীর পাশাপাশি পাড়ার যাবতীয় তথ্যের উৎস হলেও উন্নয়নকর্মী, পরিকল্পনাবিদ, নীতিনির্ধারকগণ প্রকল্পটিকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারেননি।

এই প্রকল্পটি অন্য দশটি প্রকল্প থেকে একেবারে ভিন্ন। প্রকল্পটি দেশীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দারুণ সুনাম, প্রশংসা কুড়িয়েছে, ইতোমধ্যেই কয়েকজন পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন, এই প্রকল্পটিতে গবেষণা করে। প্রকল্পটি শুধু পাহাড়ে সীমাবদ্ধ না রেখে, সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রাম, চরাঞ্চলে মডেল পাড়াকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা গেলে শিশুদের স্কুলগমন উপযোগী করার পাশাপাশি নারী-শিশু, কিশোরদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার একটি চমৎকার মডেল হতে পারে। সরকারকে বা স্বাস্থ্যকর্মীকে বা কমিউনিটি ক্লিনিককে বাড়ি বাড়ি গিয়ে, জন্মনিবন্ধন, বুকের দুধ, আয়রন ট্যাবলেট, শিশুদের শেখার সাথী তৈরি করে দেওয়া, অক্ষর পরিচিতি, ভাষা-শব্দ শেখার যত্ন নেওয়া সম্ভব নয়।

পাহাড়ে এই প্রকল্পটি আছে বলে ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ, উপজেলা-জেলা প্রশাসন, উন্নয়ন সংস্থাগুলো কত কতভাবে উপকৃত হচ্ছে তা একটি বিরাট গবেষণার ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। পাড়াকেন্দ্র থাকায় দুর্গম পাড়ার শিশুরা কী পরিমাণে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন সেটা নিয়ে একটি সুন্দর গবেষণা হতে পারে। পাড়াকেন্দ্রের কিশোরী ক্লাব থেকে কিশোরীরা কীভাবে উপকৃত হচ্ছেন, সে সম্পর্কে সমতলের কিশোরীদের জানার আছে।

গত পাঁচ বছরে পাহাড়ে এনজিও কর্মকাণ্ড অনেক কমেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রমের অভাবে গুটিয়ে গেছে। এখনো যে কয়েকটি এনজিও রয়েছে তাতে খুব সীমিত পরিসরে কাজ রয়েছে বলে জানি। ওই অর্থে গ্রামীণ মানুষদের কাছে শিশুদের জীবন রক্ষাকারী স্বাস্থ্যভ্যাস নিয়ে কাজ করার তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। আমাদের নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি, পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যদি এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয় তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের মতো কার্যক্রমগুলোকে চালু রাখা আবশ্যক। দুর্গম অঞ্চলে বসবাসকারী বলে পাহাড়িদের সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে বঞ্চিত করা হবে অন্যায়। বরং দুর্গম অঞ্চলে বসবাসকারীদের সেবাপ্রাপ্তিতে সরকারসহ উন্নয়নকর্মীদের সজাগ দৃষ্টি থাকাটি হবে সরকারের জন্য গর্বের এবং পৃথিবীর জন্য দৃষ্টান্ত। যে প্রকল্প অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে, প্রতিষ্ঠানকে বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল করেছে, সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ করছে, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অবদান রাখছে, ওই প্রকল্পটি আশু চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, এটিই কাম্য। পাহাড়ের পাড়াকেন্দ্রগুলোকে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিবেদিত কেন্দ্র বলেই মনে করি। দুর্গম পাড়ায়, পাড়াকেন্দ্রই শিশুদের খেলার, জানার, শেখার জায়গা। শিশুদের কথা চিন্তা করে পাড়াকেন্দ্রগুলো দ্রুত খুলে দেওয়া হোক।