পাকিস্তানিদের সবথেকে বেশি আক্রোশ ছিল বুদ্ধিজীবীদের প্রতি। এই আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ মুক্তিযুদ্ধে পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড।
Published : 14 Dec 2022, 12:10 PM
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। পাকিস্তানের দুঃশাসনের দিনগুলোতে আমাদের শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, কবিসহ সকল বুদ্ধিজীবী সোচ্চার ছিলেন অসাম্যের বিরুদ্ধে। নানাভাবে এই অসাম্যের প্রতিবাদও তারা জানিয়েছিলেন, সচেতন করেছিলেন সাধারণ মানুষদের। এসব কারণে পাকিস্তানিদের সবথেকে বেশি আক্রোশ ছিল বুদ্ধিজীবীদের প্রতি। এই আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ মুক্তিযুদ্ধে পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড।
কিন্তু স্বাধীনতার পর আমরা বিস্মৃত হয়েছি আমাদের এই আত্মত্যাগের ইতিহাস। মিলান কুন্ডেরা লিখেছেন– the struggle of man against power is the struggle of man against forgetting. পাঁচ দশকে আমরা বিস্মৃত হয়েছি আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মত্যাগের করুণ ইতিহাস। সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যায়। দেরিতে হলেও বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির একটি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা নির্ধারণ, তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন শহীদ বুদ্ধিজীবীরা– যে জ্যোতিস্মান মানুষেরা ৫০ বছর আগে আমাদের চিন্তা ও কল্পনায় নতুন পথ দেখিয়েছিলেন। জনগণকে শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মন্ত্রটা বুদ্ধিজীবীরা গেঁথে দিয়েছিলেন দেশপ্রেমিকদের হৃদয়ে।
বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা
বুদ্ধিজীবী কথাটির আক্ষরিক অর্থ দিয়ে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যিনি বা যারা বুদ্ধি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। একভাবে বলা যায় যে কায়িক অথবা মানসিক শ্রমের আপেক্ষিক গুরুত্ব দিয়ে এক-একটি নামকরণ করা হয়। কিন্তু সেভাবেও বুদ্ধিজীবী কথার অর্থ ঠিক হয় না। একজন উদ্যোক্তা, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী বুদ্ধি বা মানসিক শ্রম দিয়েই কাজ করেন, কিন্তু তাদেরকে বুদ্ধিজীবী বলা হয় না। বুদ্ধিজীবী বলতে বোঝানো হয় ওইসব মানুষকে যারা বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেন। লেখক, শিল্পী, গবেষক, শিক্ষক সবাইকে সাধারণত এই কথিত বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়। কিন্তু এরকম পেশায় থাকলেই কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে যুক্ত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আবার এইসব পেশায় যুক্ত না হয়েও কেউ সৃজনশীল বা মননশীল কাজে যুক্ত থাকতে পারেন। তাই বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা, মত গঠন, মতাদর্শ গঠন বা ভাঙন, শিল্পচর্চা এসব কাজ যে সবসময় জীবিকা তা নয়।
মূল প্রশ্নটা তাই শুধু বুদ্ধির না শুভবুদ্ধির, শুধু ব্যক্তির জীবিকার না, তার সঙ্গে সামাজিক অঙ্গীকারের। মানবিক সংবেদনশীলতার সামাজিক অগ্রগতির ধারাকে চলমান রাখার প্রক্রিয়ায় যার বুদ্ধি নিয়োজিত তিনি বুদ্ধিজীবী। সমাজের সমবেত বা ব্যক্তিক সৃষ্টিতে নতুন মাত্রা যিনি যোগ করেন তিনি বুদ্ধিজীবী।
গ্রামসির মতে আজকের দিনে জ্ঞানচর্চার কাজে জড়িত যেকোনো ব্যক্তিমাত্রই বুদ্ধিজীবী। তিনি বুদ্ধিজীবীকে দু-ভাবে ভাগ করেন: প্রথমত, ঐতিহ্যগত বুদ্ধিজীবী এবং জৈবিক বুদ্ধিজীবী।
ঐতিহ্যগত বুদ্ধিজীবী শ্রেণিতে রয়েছে শিক্ষক, ধর্মপ্রচারক এবং প্রশাসক; তারা বংশপরম্পরায় একই ধরনের কাজ করে যান।
জৈবিক বুদ্ধিজীবীরা পুজিবাদী উদ্যোক্তা, শিল্প প্রযুক্তিবিদ, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ, নতুন সংস্কৃতি ও নতুন বৈধ ব্যবস্থা ইত্যাদির সংগঠক তৈরি করেন।
পেশাজীবী এবং বুদ্ধিজীবীর মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সীমারেখা রয়েছে। রাজা স্বদেশে পূজিত হন, বিদ্ধান সর্বত্র-চানক্যের উদ্ধৃতি দিয়েই বিনয় ঘোষের বাংলার বিদ্বৎসমাজ গ্রন্থের সূচনা। যেখানে বিনয় ঘোষ বলার চেষ্টা করেছেন বিদ্বান হলেই বুদ্ধিজীবী হওয়া যায় না। বুদ্ধিজীবীতার প্রধান শর্তই হলো সামাজিক দায়ভারে সক্রিয় থাকা।
বুদ্ধিজীবীরা মূলত পেশাজীবী। কিন্তু সকল পেশাজীবীদের মধ্যে থেকে বুদ্ধিজীবীর আলাদা হয়ে থাকেন নিজেদের সত্যসাধনা দিয়ে। এই সত্য সাধনা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রথমটি হলো জ্ঞানের চর্চা, দ্বিতীয়টি হলো ওই জ্ঞানকে সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া।
এডওয়ার্ড সাঈদ বলছেন, বুদ্ধিজীবীর প্রকাশ ঘটে সরাসরি কাজের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে জাতীয় দিবস পালন করে। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও বাংলাদেশে নির্ধারণ করা যায়নি একাত্তরে কারা শহীদ বুদ্ধিজীবী ছিলেন। ছিল না রাষ্ট্রীয় কোনো তালিকা। একাত্তরে পাকিস্তানিরা যাদেরকে হত্যা করেছিল তারা নিজেদের কখনো বুদ্ধিজীবী দাবি করেননি। কিন্তু সত্যিকার বুদ্ধিজীবীর মতো আমাদের চিন্তা ও কল্পনা করেছেন। দেখিয়েছেন নতুন পথ, সংস্কৃতির সংগ্রমে, সংস্কৃতিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে শাসকের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছেন।
১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’-এ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি সংজ্ঞা বা মাপকাঠি বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক মনজুরে মওলা উল্লেখ করেছিলেন।
“১. ‘শহীদ’ অর্থ ২৫-৩-১৯৭১ থেকে ৩১-০১-১৯৭২ এই সময়কালে যাঁরা দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিম্বা তাদের সহযোগীদের হাতে নিহত কিম্বা ওই সময়ে নিখোঁজ হন এবং
২. বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী।”
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়াতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে তালিকা প্রদান করা হয়েছে সেখানে বুদ্ধিজীবী হিসাবে যাদেরকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তারা হলেন: শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদগণ। এশিয়াটিক মুক্তিযুদ্ধের জ্ঞানকোষ প্রকাশ করেছে সেখানে বৃদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বা দিবস নিয়ে কোনো ভুক্তি রাখা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ‘১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা’ শিরোনামে এম ফিল গবেষণা করেছেন অধ্যাপক ড. খোদেজা খাতুন। তিনি তার গবেষণার শুরুতে বুদ্ধিজীবী কারা তা সংজ্ঞায়িত করেছেন। “সাধারণ অর্থে বুদ্ধিজীবী বলতে অধ্যাপক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক স্লাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র সমাজকে বোঝানো হয়।”
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য গঠিত জাতীয় কমিটি একটি নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছে। নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী।
বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা
একাত্তরে ঠিক কতজন বুদ্ধিজীবীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর গত পাঁচ দশক শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা নিয়ে বেশ কিছু ভ্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। যেসব তথ্য উপাত্তের কোনো ভিত্তি নাই। সব শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিচয় দূরের কথা তাদের প্রকৃত সংখ্যাই অদ্যবধি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এই ঘাটতি স্বীকারের পরও বাংলাপিডিয়া কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র উল্লেখ না করে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ১১১১ বলে তথ্য দেয়। তথ্যসূত্র থেকে শহীদদের মোটামুটি একটা সংখ্যা দাঁড় করানো যায়। তাদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি মুক্তিযুদ্ধের জ্ঞানকোষ প্রকাশ করেছে। অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদের সম্পাদনায় প্রকাশিত এই গ্রন্থে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, সংখ্যা ও সংজ্ঞার বিষয়ে কোনো আলাপ করা হয়নি।
বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবস উপলক্ষে সৈয়দ আলী আহসানের সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি স্মরণিকা বের করা হয়। স্মরণিকায় নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী ‘বাঙ্গালী বুদ্ধিবৃত্তি ও বুদ্ধিজীবী দলন’ শীর্ষক প্রবন্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা প্রকাশ করেন। তিনি প্রবন্ধে লেখেন, “এ ব্যাপারে বিভিন্ন শ্রেণীর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত সংখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সূত্র থেকে এ যাবৎ মোটামুটি যে সংখ্যা পাওয়া গেছে নিম্মে পৃথকভাবে তার তালিকা প্রদত্ত হল।”
তালিকায় ৯৬৮ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ২৭০ জন মাধ্যমিক শিক্ষক, ৫৯ জন কলেজ শিক্ষক ও ৪১ জন আইনজীবীসহ ১০০৯ জনের জেলাওয়ারি তালিকা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু নাম ছিল না। তালিকায় এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ জন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন সর্বমোট ২২ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নামের তালিকা সংযোজন করা হয়। এরপর ৮ জন গণপরিষদ সদস্য, ১৩ জন সাংবাদিক, ৫০ জন চিকিৎসক ও ১৬ জন অন্যান্য শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামসহ তালিকা প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ ১৯৭২ সালে সরকারিভাবে প্রকাশিত এই স্মরণিকায় প্রবন্ধকার মোট ১১১৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। যার মধ্যে ১০৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষক ৯৬৮ জন ও আইনজীবী ৪১ জনের নাম তালিকায় ছিল না, শুধু সংখ্যা ছিল। এটাই শহীদ বুদ্ধিজীবীর সরকারি তালিকা হিসেবে কোনো এক অজানা কারণে এতদিন বিবেচিত হয়ে আসছিল। তাই সবখানেই শহীদ বুদ্ধিজীবী মানে ১১১৮ সংখ্যাটিকে এতদিন প্রচার করা হয়েছিল।
আলী মো. আবু নাইম ও ফাহিমা কানিজ লাভার সম্পাদনায় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগারের উদ্যেগে ২০১৯ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ প্রকাশ করা হয়। ভূমিকায় সম্পাদকরা লেখেন, “১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘বাংলাদেশ’ নামে বাংলাদেশের পরিচিতিমূলক একটি বই প্রকাশ করা হয়। সেখানে বুদ্ধিজীবী হিসাবে ১০৭০ জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছিল। এই ১০৭০ জনের মধ্যে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন শিক্ষক, কলেজ শিক্ষক ৫৯ জন, মাধ্যমিক শিক্ষক ২৭০ জন, প্রাথমিক শিক্ষক ৬৩৯ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, ডাক্তার ৫০ জন এবং অন্যান্য ১৭ জন।” ৪১ জন আইনজীবীর তথ্য এখানে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা নিয়ে একটি বড় বিভ্রান্তির জায়গা তৈরি হয়।
ডিসেম্বরের ২০২০-এর শেষের দিকে সুপা সাদিয়া ‘মুক্তিযুদ্ধে শত শহীদ বুদ্ধিজীবী’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। এটিতেও আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষের একই ভুল তথ্য প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ ১০৭০ জনের কথা উল্লেখ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ‘১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা’ শিরোনামে এম ফিল গবেষণা করেছেন অধ্যাপক ড. খোদেজা খাতুন। গবেষণাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছে সুবর্ণ। গ্রন্থের ২০২-২০৬ নং পাতায় মুক্তিযুদ্ধে পরিশিষ্ট-২-এ বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবস উপলক্ষে সৈয়দ আলী আহসানের সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক স্মরণিকার পৃষ্ঠা নংসহ তথ্যসূত্র উল্লেখ করে একটি ভুল তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে ৬১ জন আইনজীবী ও ২৩ জন স্কুল-কলেজ শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এই তালিকা তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বলে ভ্রান্ত তথ্য দিয়েছেন।
১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’-এর ভূমিকায় এই তালিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ৮ম খণ্ডে পরিশিষ্ট-২ হিসেবে ৫৭৫-৫৭৮ পৃষ্ঠায় শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের নামের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তালিকার তথ্যসূত্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্মরণিকায় প্রকাশিত ৯৬৮ জন শিক্ষক ও ৪১ আইনজীবীর জেলাওয়ারি তালিকাটিও দলিলপত্রে সংযুক্ত করা হয়েছে। যদিও ছাপার ভুলের কারণে তালিকায় প্রদত্ত যোগফল মেলে না। এখানে ১০৯ জনের নাম পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৯ ধাপে ১৫২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামে দুই টাকা মূল্যমানের স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করে। এখানে শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম, পিতামাতার নাম, জন্মস্থান, পেশা, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। রেলওয়ের হিসাব সহকারি থেকে শুরু করে সরকারি অফিসের পিয়ন, পুলিশের সুবেদার, সৈনিক যে যেভাবে পেরেছে আত্মীয়-স্বজনের নামে বুদ্ধিজীবী হিসেবে ডাক টিকেট প্রকাশ করে নিয়েছে।
১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’। এখানে ১৭৫ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা ও পরিচয় পাওয়া যায়। এই কোষগ্রন্থে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়। তাদের সম্পর্কে জানতে পত্রিকায় তথ্য চেয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। মোট ১৭৫ জন বুদ্ধিজীবীর তথ্য এতে প্রকাশ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় মুদ্রণের ভূমিকায় একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল লেখেন, “প্রায় সমস্ত প্রচার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জেলা প্রশাসন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, বার অ্যাসোসিয়েশন, মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, প্রেস ক্লাব ইত্যাদি জায়গায় যোগাযোগ করে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’-এর জন্য তিন শতাধিক নাম পেলেও আমাদের নীতিমালা অনুসারে অন্যূন দুইশত নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
দ্বিতীয় মুদ্রণে ৩২ জন নতুন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তথ্য প্রকাশ করা হয়। সবমিলিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২০৭ জনে। তবে এখানে ডুপ্লিকেশন আছে। গভীরভাবে তালিকাটি পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। যেমন এস. এম ফজলুল হক সম্পর্কে প্রথম মুদ্রণে তথ্য আছে দ্বিতীয় মুদ্রণে নতুন করে সংযুক্ত ৩২ জনের তালিকায়ও তার নামে আছে। ফলে ২০৭ সংখ্যাটি যথার্থ নাও হতে পারে।
১৯৮৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ। এখানে ৩৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা ও পরিচয় পাওয়া যায়। যাদের সবার নাম ও তথ্য ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’-এ রয়েছে।
রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে ১০ খণ্ডে ‘স্মৃতি: ১৯৭১’ প্রকাশ হয়। যেখানে ২৩৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।
এম. এ রহীমের সম্পাদনায় বের হয়ে ‘হিস্ট্রি অব দ্য ইউভার্সিটি অব ঢাকা’ গ্রন্থটি। যেখানে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ জন শিক্ষক, ৩ জন অতিথি শিক্ষক ও একজন চিকিৎসকের তালিকা পাওয়া যায়। যেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ৮ম খণ্ডে পরিশিষ্ট-১ হিসেবে সংযুক্ত আছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য গঠিত জাতীয় কমিটি ২৭ মে ২০২১ সালে ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর প্রথম গেজেট প্রকাশ করে। ২য় পর্যায়ে ২৩ মে ২০২২ সালে ১৪৩ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করে। কাজটি চলমান রয়েছে। তাবে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে স্বীকৃত শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ৩৩৪ জন।
শহীদ বুদ্ধিজীবীর প্রকৃত সংখ্যা কত এটা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় শহীদ বুদ্ধিজীবীর যে সংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেটাকে মানদণ্ড ধরলে শহীদ বুদ্ধিজীবীর প্রকৃত সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
এছাড়াও বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে আলাদা তালিকা প্রকাশ হয়েছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। যেখানে ১৩ জন শহীদ সাংবাদিকের বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে। বায়েজীদ খুরশীদ রিয়াজ মুক্তিযুদ্ধের শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষে ৬৮ জন চিকিৎসকের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন তাদের ভবনে নির্মিত স্মৃতিফলকে প্রায় ৭০ জন চিকিৎসকের নাম উৎকীর্ণ করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ ৪ শিক্ষককে নিয়ে প্রকাশ করেছে আলাদা গ্রন্থ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন শিক্ষক ও একজন আবাসিক চিকিৎসকের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
আশা করা যায় শহীদ বুদ্ধিজীবী কারা তা নিয়ে বিতর্কের অবসান হবে। নির্ভুলভাবে প্রণয়ন করা যাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা।
(লেখক: শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য গঠিত জাতীয় কমিটির সদস্য)