বাংলাদেশের জনগণ আসলে রাজনীতিবিদদের হাতে জিম্মি। মুখে জনগণের কথা বললেও তাদের আসল লক্ষ্য দূরে কোথাও।
Published : 31 Jul 2023, 03:57 PM
গণতন্ত্রেরও অনেক নেতিবাচকতা আছে। তারপরও প্রচলিত শাসনব্যবস্থার মথ্যে সবচেয়ে ভালো গণতন্ত্রই। কারণ গণতন্ত্র হলো জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য। গণতন্ত্রে জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন। নির্বাচিত জনপ্রিতিনিধিদের মাধ্যমে আসলে জনগণই দেশ পরিচালনা করে। যারা রাজনীতি করেন, তারা অন্তত মুখে বলেন, তাদের সবকিছু জনগণের জন্য। জনগণের যাতে ভালো হয়, সেটাই তাদের করার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে হয় উল্টোটা।
জনগণের এখানে কোনো অধিকার নেই, কোনো কণ্ঠ নেই, কোনো বক্তব্য নেই। বাংলাদেশের জনগণ আসলে রাজনীতিবিদদের হাতে জিম্মি। মুখে জনগণের কথা বললেও তাদের আসল লক্ষ্য দূরে কোথাও। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করে সরকার পতন ঘটাবে, এমন আশা বিএনপি করে না। তাদের আশা, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা অন্য কোনো শক্তি তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। আর জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়াই পরপর দুটি নির্বাচনে পার পাওয়া আওয়ামী লীগের কাছেও জনগণের খুব একটা গুরুত্ব নেই। সবাই যেন জেনে বসে আছেন, বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা না থাকা বাংলাদেশে নির্ধারিত হয় না বা হবে না। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কর্মসূচিতেই জনগণ ফোকাসে থাকে না।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।‘
সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জনসভা ও শোভাযাত্রা করার অধিকার আছে। এটা সবার গণতান্ত্রিক অধিকার। যে কোনো দল যে কোনো দিন সমাবেশ, শোভাযাত্রা করতে পারবে। আবার সংবিধানেই কিন্তু বলা আছে, জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যের কথা। বলা আছে শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার কথা।
সংবিধান বা আইনে যাই বলা থাকুক, এর বাইরে বলেও কিছু কথা আছে। একসময় বাংলাদেশে দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ হয়েছে। পেট্রল বা গান পাউডার দিয়ে গাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। একসময় পল্টন ময়দানে জনসভা হতো। পাশাপাশি রাজপথ দখল করে জনসভাও হয়েছে। আওয়ামী যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন তারাও এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। আবার বিএনপিও বিভিন্ন সময় হরতাল-অবরোধ-অগ্নিসন্ত্রাস করেছে। তবে অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। সরকার নানা কৌশলে, মামলা-হামলায় বিরোধী দলকে পর্যুদস্ত করে রাজনীতিকে রাজপথ থেকে নির্বাসিত করে রেখেছিল। কিন্তু আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতি আবার রাজপথে ফিরেছে। গণতন্ত্রের জন্য এটা স্বস্তির খবর। কিন্তু আমরা ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই।
অতীতে রাজনীতির নামে যা হয়েছে, তা মনে পড়লে আমরা আঁতকে উঠি। সরকার বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেছে বড় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি যেন রাজপথের বদলে কোনো মাঠে হয়। পল্টন ময়দানকে আমরা অনেক আগেই গিলে খেয়েছি। একসময় প্যারেড গ্রাউন্ডকেও জনসভার মাঠ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা হয়েছে। একসময় মুক্তাঙ্গনেও সভা-সমাবেশ হয়েছে। এখন আছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠ, গতবছর ১০ ডিসেম্বর বিএনপি বাধ্য হয়ে গোলাপবাগ মাঠে তাদের বিভাগীয় সমাবেশ করেছে। তবে এসব নয়, রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য বিএনপির পছন্দ নয়াপল্টনে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তা। আর আওয়ামী লীগের পছন্দ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ বা বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট।
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে রাজপথ দখল করে যখন আপনি সমাবেশ করতে চাইবেন, তখন আপনার মাথায় জনগণ থাকবে না। বাংলাদেশে আন্দোলনের সাফল্য বিবেচনা করা হয় জনভোগান্তি দিয়ে। ভোগান্তি যত বেশি, আন্দোলন যেন ততই সফল। এই যে রাজনৈতিক দলগুলো একদিনে সমাবেশ ডেকে গোটা ঢাকা অচল করে দেয়, এর মধ্যে একটা দেখনদারির ব্যাপার আছে। তারা যেন দেশবাসীকে দেখাতে চায়, দেখো আমাদের কত ক্ষমতা। আমরা চাইলেই তোমাদের জীবনযাপন অচল করে দিতে পারি।
আন্দোলনের সাফল্যের আরো মাপকাঠি হলো, নিহত, আহত, গ্রেপ্তার। একটা লাশ পেলেই আন্দোলনে গতি আসে। কখনো সেটা আসাদ, কখনো মতিউর, কখনো নুর হোসেন, কখনো জেহাদ। তার মানে জনগণের জানমালকে জিম্মি করতে পারাটাই আন্দোলনের সাফল্যের সূচক। তবুও রাজনৈতিক দলগুলো চক্ষুলজ্জার কারণে কোনো কর্মসূচি দেয়ার আগে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় রাখতো। বড় কোনো পরীক্ষা আছে কিনা, কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান আছে কিনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা আছে কিনা, অন্য কোনো সামাজিক সংগঠনের বড় অনুষ্ঠান আছে কিনা—এসব বিবেচনা করেই কর্মসূচি দেয়া হতো। গত কয়েকবছরে আরেকটা অলিখিত নিয়ম দাড়িয়েছিল—বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়া হতো সরকারি ছুটির দিনে, যাতে মানুষের ভোগান্তি তুলনামূলক কম হয়। এর ব্যতিক্রম হয় গত ১২ জুলাই, সেদিন ছিল বুধবার। বিএনপি সেদিন নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করে। যথারীতি আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সমাবেশ থেকে, শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন, এই একদফা ঘোষণা করে।
রীতি ভেঙ্গে হঠাৎ কর্মদিবসে কর্মসূচি কেন? বিরোধীদের সঙ্গে সরকারি দলের পাল্টাপাল্টি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানলেই আপনি বুঝবেন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অগ্রাধিকাররের তালিকায় জনগণের অবস্থান কোথায়। ১২ জুলাই মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া বাংলাদেশ সফরে ছিলেন। একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রাক নির্বাচনী দলও ঢাকা সফর করছিল। বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল আসলে বিদেশীরা। তারা বিদেশীদের নিজেদের জনপ্রিয়তা দেখাতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগও মাঠ ছাড়তে রাজি নয়। বিএনপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ১২ জুলাই কর্মদিবসে মাঠে ছিল আওয়ামী লীগও। ১২ জুলাইয়ের সমাবেশ থেকে বিএনপি ১৮ ও ১৯ জুলাই পদযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করে। যথারীতি আওয়ামী লীগও সেই দুদিন শোভাযাত্রা করেছে। এই দুদিনই ছিল কর্মদিবস। ২৭ জুলাই বিএনপি মহামহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। পুলিশ কর্মদিবসে রাস্তায় সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি। পুলিশ বলেছিল গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করতে। কিন্তু নয়াপল্টনেই মহাসমাবেশ করতে অনড় বিএনপি কর্মসূচি একদিন পিছিয়ে দেয়।
২৮ জুলাই শুক্রবারের মহাসমাবেশ থেকে বিএনপি পরদিন শনিবার রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন আশুরা হলেও বিএনপি তাতে পিছিয়ে আসেনি। এই লেখা যখন লিখছি, মানে ৩১ জুলাই সোমবার। এদিনও ঢাকায় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে।
রাজনীতি বলেন, ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকা যাই বলেন; সবকিছুর উর্ধ্বে অর্থনীতি। পেটে খেলে পিঠে সয়। অর্থনীতি সচল থাকলে জনগণ কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। এমনিতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রবল চাপের মুখে আছে। মূল্যস্ফীতি আকাশ ছুঁয়েছে। এই সময় রাজপথ উত্তপ্ত হলে রাজনীতি অস্থিতিশীল হলে; তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।
কর্মদিবসে বড় কর্মসূচি থাকলে ভয়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়, শেয়ারবাজারের সূচক কমে যায়, রাস্তাঘাট তো বটেই স্থবির হয়ে যায় অর্থনীতিও। অর্থনীতিতে যত নেতিবাচক প্রভাবই পড়ুক, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার তো আর স্থগিত থাকবে না। মানুষ মানবাধিকারের কথা বলবে, ভোটাধিকারের কথা বলবে, রাজপথে চিৎকার করে বলবে। তবে জনগণের ভালো করাটাই যদি রাজনীতির মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত আন্দোলনের পাশাপাশি জনগণের কথাও বিবেচনায় রাখা।
কর্মসূচি বন্ধ করা নয়, অন্তত ক্ষতি যতটা কমিয়ে রাখা যায়, সেটা মাথায় রাখা। এমন কর্মসূচি দেয়া যাতে জনগণের দুর্ভোগ কম হয়। অন্তত কর্মদিবসে কর্মসূচি না দেয়ার যে রেওয়াজ গড়ে উঠেছিল, সেটা যেন বজায় থাকে।