বিএনপির হাতে হ্যারিকেন, সংলাপ মুখ থুবড়ে

“দেশে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় শেখ হাসিনার সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তারা এমন একটি পদক্ষেপ নিলেন, যা তাদের খুব চেনা-জানা বটে! তারা পাওয়ার সংকটকে পুঁজি করে দলকে পাওয়ারে নিতে চান, কিন্তু হাতে যে ধরিয়ে দেওয়া হলো হ্যারিকেন!” –লিখেছেন অজয় দাশগুপ্ত।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 3 August 2022, 12:37 PM
Updated : 3 August 2022, 12:37 PM

বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিলেন দলের নেতারা! বিষয়টি প্রতীকী বটে! দেশে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় শেখ হাসিনার সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তারা এমন একটি পদক্ষেপ নিলেন, যা তাদের খুব চেনা-জানা বটে! তারা পাওয়ার সংকটকে পুঁজি করে দলকে পাওয়ারে নিতে চান, কিন্তু হাতে যে ধরিয়ে দেওয়া হলো হ্যারিকেন!

২০০৬ সালের ২৬ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলো একটি খবর প্রকাশ করেছিল এভাবে– ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলিতে সাতজন নিহত হওয়ার প্রতিবাদে বুধবার স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে অচল হয়ে পড়ে পুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জ’। ২৮ জানুয়ারি দৈনিক সমকালের শিরোনাম ছিল– ‘ক্ষোভে উত্তাল কানসাট’।

কেবল কি কানসাট বিদ্যুতের দাবিতে বিক্ষুব্ধ ছিল? ২০০৭ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় ফোরাম (ডেইলি স্টারের সাপ্তাহিক আয়োজন) লিখেছিল– ‘২০০৬ সালে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল গড়ে ৫২০০ মেগাওয়াট, উৎপাদন হতো ৩৩০০ মেগাওয়াট।’

এটা ছিল বিএনপি-জামায়াতে ইসলামের দ্বিতীয় মেয়াদের দুঃশাসনের শেষ বছর। ঘরে ঘরে হ্যারিকেন ছাড়া তখন উপায় কী ছিল?

২০০৬ সালের ২৪ মে ডেইলি স্টারের খবর ছিল এভাবে– ‘Shanir Akhra in Demra turned turbulent yesterday as clashes erupted between locals and the police after the law enforcers swooped on the agitating people from different areas who blockaded Dhaka-Chittagong highway demanding smooth supply of water and power. As the police failed to bring the situation under control, a few hundred activists of Jatiyatabadi Chhatra Dal (JCD) armed with sticks went there and drove away the agitators to take control of the area in the evening. Locals said they resorted to violence only after their lawmaker Salahuddin Ahmed ordered the police to open fire on them instead of negotiating to solve the three-month-old water and electricity crises that had taken an acute turn in Demra and Shyampur in the last 15 days. The BNP lawmaker was wounded in the head as the angry agitators hurled brickbats at him and beat him with sticks.’

ওই সময় ‘দৌড় সালাহউদ্দিন’ কৌতুকের সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছিল। বিদ্যুতের দাবিতে মিছিলকারীদের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়ে তিনি এমন তাড়া খেয়েছিলেন যে চাচা আপণ প্রাণ বাঁচা বলে ছুটছিলেন অজানার পথে।

ফোরামের ওই সংখ্যায় বিএনপির আমলে প্রতিষ্ঠিত টঙ্গীর ৮০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রসঙ্গে লেখা হয়– `Tongi plant turned out to be a grossly flawed project. The plant is highly unreliable and it tripped more than 75 times between May 2005 and May 2006. Internal investigations revealed, literally, hundreds of flaws in the machinery and sub-standard equipment. The Tongi plant is the only project the BNP-led alliance government could present to the country during its five year regime.’

এখানেই ফোরাম থামেনি। পত্রিকাটির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম দিকে লেখা হয়– ‘Tongi plant deal as a grand success the young leader of the alternative powerhouse of the government intervened with all other power projects in the pipeline and started awarding power projects on the basis of the political affiliation of the contractors or their ability to offer "commissions.’

এই young leader কে সেটা নিশ্চয়ই আমাদের বুঝতে সমস্যা হয় না। তবে ওই সময়েই বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ৭ জুন (২০০৬) যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সদম্ভে ঘোষণা করেন– ‘তারেক রহমান অপ্রতিদ্বন্দ্বী, ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। তার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ বিএনপিতে নেই। তিনি বিএনপির সম্পদ।’

তারেক রহমান ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে লন্ডনে বসবাস করছেন। ১৪ বছর হয়ে গেল ‘বনবাস’! young leader আর নেই তিনি। তবে বিএনপিতে তিনিই সর্বেসর্বা, এমনটিই বলা হয়। বিএনপি নেতারা দাবি করছেন– লন্ডন থেকে তারেক রহমান নির্দেশ দিলেই ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে শেখ হাসিনার সরকারকে।

বিদ্যুতের বেহাল দশা কাটিয়ে উঠতে শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন ক্ষমতা গ্রহণ করেই নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। ২০০০ সালে তিনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার এম এ মালেককে নিয়োগ দেন, এর আগে যিনি ছিলেন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রধান। বিদ্যুতের তখন ভয়াবহ সংকট। বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন। সেখানে ব্রিগেডিয়ার এম এ মালেক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য কিছু পদক্ষেপের সুপারিশ করেন। ওই সময় বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু কাজের সমালোচনাও ছিল। পরদিন তাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য টেলিফোন করা হয়। ব্রিগেডিয়ার এম এ মালেক পরে আমাকে বলেছেন– ‘আগের দিন বিদ্যুৎ বিভাগের পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সুপারিশের পাশাপাশি কিছু সমালোচনাও করেছিলাম। আমার ভয় ছিল এ জন্যই কি প্রধানমন্ত্রী ডেকে পাঠিয়েছেন? কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন– ‘গতকাল যে সব সুপারিশ করেছেন, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আপনাকে দিলাম। আপনি এখান থেকেই পল্লী বিদ্যুতের অফিস ছেড়ে মতিঝিলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অফিসে যোগ দিন। নিয়োগপত্র তৈরি আছে।’

একেই বলে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। ১৯৯৬ সালের পরের পাঁচ বছর এবং ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যুৎ পরিস্থিতি উন্নয়নে তিনি যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা সুফল দিতে শুরু করেছে। ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ নিয়ে একটি মতলববাজ মহল যতই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করুক না কেন তারাও জানে যে বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ নিয়ে যে সংকট সৃষ্ট হয়েছে তা কেটে যাবে। মূলত বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। কৃচ্ছ্রতায় এর সমাধানের খোঁজার চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে বিকল্প পন্থার কথাও ভাবা হচ্ছে। উন্নত বিশ্ব অনেক বছর কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। পারমাণবিক প্রকল্পও হাতে নিয়েছিল। মাঝে ভিন্ন পথে চলছিল তারা। এখন ফের এ পন্থার কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশে কয়েক ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রয়েছে। এতে সুবিধা হচ্ছে একটি উৎস বন্ধ হলেও পুরো সিস্টেম অচল হয়ে পড়ে না। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। তবে উভয় খাতেই সমস্যা রয়েছে। সরকারি খাতে অপচয়-অদক্ষতা প্রকট। আর বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের একটি অংশ সর্বদা ছুটে চলে সীমাহীন মুনাফার লোভে। বহু আগে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন– অতি ধনবানরা সীমাহীন মুনাফার সন্ধান পেলে ফাঁসির ঝুঁকি নিতেও পিছ পা হয় না। সরকার অতি ধনবানদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করলে তারা সুযোগ নেবেই। এটা বন্ধ করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক উদ্যোগ। জনমত গঠনও গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের মতো একটি গণমুখী রাজনৈতিক দল বিষয়টিকে কম গুরুত্ব দিলে দেশের ক্ষতি।

বিএনপি সরকার উৎখাতের ডাক দিয়েছে। এ লক্ষ্যে দলটি ‘সংলাপ’ শুরু করেছে। ২৪ মে থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম সংলাপ শুরু করেন কয়েকটি দলের নেতাদের সঙ্গে। দলের নেতারা বলেছিলেন, সরকারবিরোধী সব দলের সঙ্গে তারা কথা বলবেন, সংলাপ করবেন। এখন পর্যন্ত কথা বলেছেন যাদের সঙ্গে, তাদের সকলের সঙ্গেই বিএনপির শীর্ষ নেতারা নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সেমিনার কক্ষের ঘরোয়া বৈঠকে। সেই ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে টানা তিন মাসের হরতাল-অবরোধ ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি যে ঘর নিয়েছে, এখনও তা চলছে– জাতীয় প্রেসক্লাবের সেমিনার কক্ষ কিংবা সামনের ফুটপাতে তাদের যত হুঙ্কার।

এতে কি সরকারের পতন ঘটানো যাবে? বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন কেমন শাসন ছিল? এ বিষয়ে ২০০৭ সালের ৬ মার্চ Bureau of Democracy, Human Rights, and Labor মন্তব্য করেছিল– ‘The government's human rights record remained poor, and the government continued to commit numerous serious abuses. Extrajudicial killings, arbitrary arrest and detention, and politically motivated violence were among the most egregious violations. Security forces acted with impunity, and committed acts of physical and psychological torture. In addition violence against journalists continued, as did infringement on religious freedoms. Government corruption remained a significant problem. Violence against women and children also was a major problem, as was trafficking in persons.’

বিএনপি কি ওই সময়ের তুলনায় নিজেকে একটুও বদলাতে পেরেছে? মনে হয় না। তারা একটি বড় রাজনৈতিক দল, যাদের প্রচুর সমর্থক রয়েছে; কিন্তু পথ হারা। ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তারা সহিংস পন্থায় আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ ১৯৯৬ এবং ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ রাজপথের আন্দোলনে খালেদা জিয়ার সরকারকে উচ্ছেদ করতে পেরেছিল। তারা নির্ভর করেছিল জনতার শক্তির ওপর, পেট্রোল বোমা-গ্রেনেডে নয়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপি বানচাল করতে চেয়েছিল সহিংস পন্থায়। তারা সেটা করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ অনুপম রাজনৈতিক কৌশল খাটিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যায়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য অগ্রসর হয় ড. কামাল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আসম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সামনে রেখে। খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত। তার পুত্র তারেক রহমানও দণ্ডিত হয়ে লন্ডনে। বিএনপির যাত্রালগ্নে গঠনতন্ত্রে একটি ধারা ছিল– দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত কেউ দলের নেতা হতে পারবে না, দলের হয়ে নির্বাচনও করতে পারবে না। কিন্তু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান কেবল অভিযুক্ত নয়, দণ্ডিত হওয়ার পর বিএনপি অতি গোপনে দলের এ ধারাটি তুলে দেয়। এমন একটি দলের ওপর জনগণ কী করে আস্থা-ভরসা রাখবে?

বিএনপিও কিন্তু জনগণের ওপর আস্থা রাখছে না। তারা বরং তাকিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র-বিশ্বব্যাংক-আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রতি, তারা যদি কোনো কায়দা-কানুন করে শেখ হাসিনাকে প্যাচে-বিপদে ফেলে দিয়ে বিএনপির জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিতে পারে। দেখা যাক, এ পন্থা কতটা কাজ দেয়। যদি বিএনপির পথ চলা দীর্ঘায়িত হয়, ততদিন কি তারা হাতে হ্যারিকেন নিয়ে চলবে? তাদের সংলাপও যে ইতোমধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছে!