সমঝোতা: কার সঙ্গে এবং কেন?

যারা প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, দেশে যারা প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষবাষ্প ছড়াতে চায়—তাদের সঙ্গে সমঝোতা হয় কীভাবে?

মোনায়েম সরকারমোনায়েম সরকার
Published : 5 Jan 2024, 07:05 AM
Updated : 5 Jan 2024, 07:05 AM

অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জবাব দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে তৃতীয় পক্ষকে ক্ষমতায় আনার জন্য ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন এগিয়ে চলা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জয়লাভের কোনো বিকল্প নেই।

অনেকে রাজনীতিতে ‘সমঝোতা’ করে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু সমঝোতা হবে কার সঙ্গে? সমঝোতার ভিত্তিই বা কী? যারা ঘুরেফিরে মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার প্রয়াস পায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে বিভিন্নভাবে জাস্টিফাই করে এখনও এবং এর দীর্ঘদিন পরে শেখ হাসিনাকেও যারা হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল, তাদের সঙ্গে সমঝোতা হবে কীভাবে? যারা প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, দেশে যারা প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষবাষ্প ছড়াতে চায়—তাদের সঙ্গে সমঝোতা হয় কীভাবে? যারা দেশের সংবিধানে বিশ্বাস করে না এবং অসাংবিধানিক শক্তির উত্থানে সহায়তা করতে চায়, তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে দেশ গড়া যায় কি?

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা যে দেশ অর্জন করেছিলাম, তার পেছনে ছিল স্বাধিকার আদায়ে এদেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম। আর এর অগ্রভাগে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন দেশ গড়ার সংগ্রামও তিনি শুরু করেন নানা প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার এত বছর পর পেছন ফিরে তাকালে দেখি, দেশটি কত আত্মত্যাগে অর্জিত এবং কত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটি জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশকে শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও একটি কঠিন অবস্থায় এনে ফেলা হয়েছিল। এর সামাজিক গড়ন নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা সফল হয়নি। অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা শুধু গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করেছি তা নয়; অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথেও এগিয়ে যাচ্ছি। আর সে কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তাকেও কম প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে না, পিতার মতোই। দেশে-বিদেশে প্রতিকূলতা তাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার সঙ্গে।

রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে শেখ হাসিনা চাইলে অনেক বেশি প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারতেন পিতৃহত্যা এবং নিজেকেও হত্যার প্রচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি সে পথে না গিয়ে বরাবরই আস্থা রেখেছেন আইন ও আদালতের ওপর। যা কিছু হয়েছে, সেটা হয়েছে আদালতের মাধ্যমে। তিনি দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করেছেন। ২১ অগাস্ট তার ওপর পরিচালিত গ্রেনেড হামলার বিচারের রায়ও হয়ে আছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রমও চলমান। এসবের মধ্য দিয়ে জাতি বিভক্ত হচ্ছে বলে যারা বক্তৃতা করেন, তারা ভুল পথে আছেন। এর মধ্য দিয়ে জাতি আসলে একতাবদ্ধ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতে।

মুক্তিযুদ্ধই আমাদের পথ দেখাবে যেকোনো দুঃসময়ে। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আমরা মুক্ত হয়েছিলাম একটি স্বাধীন, স্বনির্ভর ও আধুনিক জাতি হিসেবে উঠে দাঁড়ানোর জন্য। অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে সে লক্ষ্য অর্জনের পথে আমরা এগিয়ে চলেছি দৃঢ়ভাবে। এ যাত্রাপথে এখনও বাধা আছে। সেটা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাও আমাদের রয়েছে। রয়েছে তার উপযুক্ত নেতৃত্ব। সততা ও বিচক্ষণতায় এ নেতৃত্ব দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় ও স্বাধীনচেতা মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। এর বিপরীতে যারা বিভিন্ন কৌশল কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছে নেতৃত্বহীনতা। এক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে যাদের তুলে ধরা হয়, তারা হয় দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত কিংবা সাজা ভোগ না করে পলাতক।

একশ্রেণির লোক আবার বিকল্প হিসেবে ‘তৃতীয় শক্তি’র ওপর নির্ভর করতে চায়। তারা কথিত সুশীল সমাজের মধ্যে নেতৃত্ব খোঁজে, যারা আসলে বিরাজনীতিকরণের ধ্বজাধারী। একের পর এক সেনাশাসনের মাধ্যমে রাজনীতিকে নষ্ট করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বছর পনের আগে বিরাজনীতিকরণের চেষ্টাও হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে চলা নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্বের দৃঢ় অবস্থানের কারণেই তা বানচাল হয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে দেশ আবার চলে আসে গণমানুষের প্রত্যাশিত ধারায়।

টানা তিন মেয়াদে যে সরকার দেশ পরিচালনা করছে, তার লক্ষ্য রাজনীতিকে নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে এনে দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সে লক্ষ্য অর্জনে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যা অনেক সময় আবার হয়ে উঠছে চ্যালেঞ্জের বিষয়। এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতুর কথা এখানে বলা যায়। পদ্মা রেল প্রকল্পও বাস্তবায়িত হয়েছে। দেশি-বিদেশি কত রকম প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হয়েছে, এসব কারও অজানা নয়। বাংলাদেশের জনগণ এখন এ গৌরবের অধিকারী। এর মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘ সময় ধরে যে সুফল পাওয়া যাবে, সেটা এদেশের মানুষ ও তার পরবর্তী প্রজন্ম ভোগ করবে।

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু রাশিয়ার সহায়তায় দেশের বিদ্যুৎ সংকট কাটিয়ে উঠতে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যা পূর্ববর্তী শাসকরা কল্পনাও করতে পারতেন না। বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের উন্নয়ন দ্রুততার সঙ্গে নিশ্চিত করতে ভ্লাদিমির লেনিন দেশটিকে বিদ্যুতায়িত করার মহাপরিকল্পনা নিয়েছিলেন। বাংলাদেশেও তেমনি বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হলো গোটা দেশে, সব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। এটি টেকসইভাবে সম্ভবপর করে তোলা গেলে উৎপাদন ও উন্নয়নের এক মহাযজ্ঞ শুরু হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ লক্ষ্য অর্জন ও তা ধরে রাখায় প্রয়োজন দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব, যার ওপর দেশের মানুষের আস্থা আছে।

আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি হলো কৃষি। আর এক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে বিশেষত গত দেড় দশকে। কৃষির ব্যাপক রূপান্তর ঘটে চলেছে। এটা হয়ে উঠছে আধুনিক ও রপ্তানিমুখী। তবে দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ হলো প্রধান লক্ষ্য। এর পাশাপাশি আমরা সাফল্য অর্জন করেছি তৈরি পোশাক ও জনশক্তি রপ্তানিতে। এর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ আমাদের রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করছে। তাতে সাময়িক সংকট দেখা দিলেও আশা করা যায় দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা আমাদের পথ দেখাবে। অবশ্য একটি রাজনৈতিক পক্ষের প্ররোচনায় রপ্তানি বাজার থেকে দেশে অশনি সংকত পাঠানোর চেষ্টা রয়েছে। সেটা সফল হবে না, কারণ বাণিজ্য পরিচালিত হয় পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে। বাংলাদেশ রপ্তানি বাণিজ্যে ভালো করছে কারও অনুকম্পায় নয়; এ জায়গায় তার সক্ষমতা আছে বলেই। এক্ষেত্রে নতুন নতুন দিগন্ত বরং উন্মোচিত হচ্ছে। আমরা নতুন নতুন পণ্য রপ্তানিতে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমেরিকা-ইউরোপের বাইরেও দুনিয়া রয়েছে এবং সেখানে আছে সম্ভাবনা। চীন ও ভারতের মতো যেসব দেশ থেকে আমরা বেশি আমদানি করি, তাদের সঙ্গে সম্পর্কের ভবিষ্যতও বিরাট।

বাংলাদেশের পাশে রয়েছে দ্বিতীয় প্রতিবেশী মিয়ানমার। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অবশ্য জটিলতার আবর্তে পড়েছে। এ কারণে এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ এটা এড়াতেই চাইবে। সব প্রতিবেশী ও বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়াটাই আমাদের মন্ত্র। আমরা কারও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না এবং আমরাও চাই, কেউ আমাদের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করুক। কিন্তু সময়ে সময়ে আমাদের ক্ষেত্রে সেই নীতি লঙ্ঘন করছে শক্তিমদমত্ত কিছু দেশ। তবে বাস্তবতা হলো, একাত্তরেও আমরা এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের মতো করে চলার সময়ও আমরা তাদের চাপ ও তাপ উপেক্ষা করে চলতে পারব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঠিকভাবেই বলেছেন, বাংলাদেশ আর সেই দেশ নেই। দেশটি এখন বছরের পর বছর আরও বড় বাজেট বাস্তবায়ন করে চলতে সক্ষম। বিদেশি ঋণসহায়তার ওপর তাকে আর নির্ভর করতে হচ্ছে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ এখন স্বনির্ভর। উন্নয়ন সহযোগী বলে যারা পরিচিত, তারাও বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির সঙ্গে থাকতে চায়। দেশের মানুষের অধিকার ও উন্নতিতে যারা বিশ্বাসী নয়, সেই অপশক্তির সঙ্গে তারা আর যোগ দেবে না বলেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্বাভাবিকভাবেই সম্পন্ন হওয়ার কথা। সংবিধানে তার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু আসন্ন নির্বাচন নিয়েও সংকট সৃষ্টির চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, কিছু বিদেশি মহল জল ঘোলা করার কাজে সহায়তা করতে নেমে পড়েছে। নির্বাচন নিয়ে তাদের অতিউৎসাহ দেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবে নেবে না। কেননা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের বিপজ্জনক ভূমিকার কথা সবার জানা আছে। একেক দেশে তারা একেক নীতিকৌশল নিয়ে আবির্ভূত হয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে তার পথে অবিচল থাকতে হবে। সব অপচেষ্টা, চক্রান্ত মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হবে জনকল্যাণে নিবেদিত নেতৃত্বকে। আগামী নির্বাচন অবশ্যই অতীতের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হবে। তাতে জনগণের ইচ্ছাই জয়ী হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায়, উন্নয়নের পথেই থাকবে দেশ। এ জায়গায় ‘সমঝোতা’ করে অগ্রসর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

৩০ ডিসেম্বর সকালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সরকারি শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ মাঠে আয়োজিত নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নির্বাচন বাতিলের জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। অনেকে আন্তর্জাতিকভাবেও জড়িত। তারা বাংলাদেশে তৃতীয় পক্ষকে ক্ষমতায় আনার জন্য কাজ করছে। আমরা আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত জবাব দেব। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, আপনারা সকালে সবাই সশরীর এসে ভোট দিয়ে এই বিশ্বকে দেখাবেন, এই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং আমরা তা করতে জানি ও করতে পারি। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন আমরা করতে পারি।

নতুন বছরের নতুন নির্বাচিত সরকারের সামনে নতুন নতুন নানা চ্যালেঞ্জ থাকবে। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও বিচক্ষণতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেখাতে পারবে বলেই দেশবাসীর প্রত্যাশা। কারণ শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক জীবনে এটা প্রমাণ করেছেন যে, অন্যরা যা পারে না, তিনি তা পারেন।