এখন রাজনৈতিক দলের চাইতে ব্যক্তিই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে। কোনো অবস্থায় ক্ষমতা হারাতে যাতে না হয় তার জন্য তারা নিজের ক্ষমতা, যোগ্যতা, শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে মারি অরি পারি যে কৌশলের মন্ত্র আকঁড়ে ধরেছে।
Published : 03 Apr 2024, 07:58 PM
আমাদের দেশে রাজনীতিকদের একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতা দখল করা, ক্ষমতা ধরে রাখা। এ জন্য যখন যেমন নীতি কৌশল প্রয়োজন সেটাই তারা গ্রহণ করে থাকেন। আমাদের দেশে নাকি নীতির রাজা রাজনীতি নয়, এখানে রাজার নীতিই রাজনীতি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজধানী পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ানো জাতীয় দলগুলোর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ যেমন জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়, ঠিক তেমন দেশ ও জাতির উন্নয়ন নীতির লক্ষ্যও স্পষ্ট নয়। জনগণ দেখে একটা ২০ টাকা দামের ফুলের তোড়ায় কীভাবে নীতি-আদর্শ ক্রয় বিক্রয় চলমান। সারা বছর ধরে এক দল বিক্রি করে আর অন্য দল তা ক্রয় করে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে এই প্রক্রিয়া গতি লাভ করে। এখানে ব্যবসায়ী, মাস্তান, পেশাজীবী থেকে শুরু করে অশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। তারা রাজনীতির মাঠে দাপিয়ে বেড়ায় একটা নির্দিষ্ট বাসনা নিয়ে। সেই বাসনা যদি শুধু জীবন নির্বাহের কড়ি সংগ্রহ হতো তাহলে জনগণ এককভাবে বিষয়টা বিবেচনায় নিতে পারত। কিন্তু এ বাসনা হচ্ছে দেশ-বিদেশে অভিজাত এলাকায় পরিবার পরিজনসহ রাজকীয় জীবন যাপনের।
আমাদের হাজার হাজার বছরের যাপিত জীবনে ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গিয়েছে ধারাবাহিক রাজতন্ত্র। যে সময়কালে শক্তিশালী, সাহসী সঙ্গে বুদ্ধিমান লোকেরা ছলে-বলে-কৌশলে রাজ্যপাট দখল করে রাজা হয়ে প্রজা শাসন শোষণ করত, প্রবল প্রতাপে পীড়ন করত। সবসময়ই প্রজারা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যেত। ভূ-স্বামী, জমিদারররা রাজদণ্ডের সহায়তায় একইভাবে প্রজা পীড়ন করত। শোষণ ও পীড়ন প্রজাদের কপালের লিখন হয়ে গিয়েছিল। তাই নতুন কোনো রাজা হলে, কেউ কারও রাজ্য দখল করে নিলে প্রজাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যেত না। কথিত আছে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহর পরাজয়ের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রারম্ভিক সকালে কৃষকরা প্রতিদিনের মতো মাঠে কৃষিকাজ করেছে। রাজার পরিবর্তনে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। নিত্য কর্ম থেকেও বিরত ছিল না তারা। স্বাধীনতা হারানোতে তারা নিষ্ক্রিয় থেকে নিজেদের চেতনা প্রকাশ করে। বর্তমান কালের শাসকরা রাজাদের মতো করেই জনগণের কল্যাণ সাধন করে চলেছে। অতীত ভুলে গিয়েছে তা বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। বরং বলা যায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
দেশের সাধারণ জনগণও যেন অনন্য এক গুণের অধিকারী। নেতাদের প্রতি তাদের প্রবল আস্থা। ধারণা করা যায় দেশে দীর্ঘসময ধরে গুরু বা পীর মানার যে সংস্কৃতি চলমান সেখান থেকেই নেতা মানার একটা চল জনমনে প্রবাহিত হয়েছে। আবার পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপেও নেতা মানার বাধ্যবাধকতা আসে। তার ওপর আবার যখন নেতা নির্বাচনের সুযোগ কাগজে-কলমে থাকলেও তার ব্যবহার দিনে দিনে সীমিত করে ফেলা হচ্ছে। গণের যে তন্ত্র গণতন্ত্র তা আর রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই নেই।
বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল জনগণের চাহিদার প্রতি সম্মান রেখে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতার চার মূলমন্ত্রকে সঙ্গে নিয়ে। সময়ের বিবর্তনে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থোদ্ধারের প্রক্রিয়ায় মন্ত্রগুলো একটা একটা করে হারিয়ে এখন শুধু জাতীয়তাবাদ অবশিষ্ট আছে। যদিও বড় দুই দলের মধ্যে এটা নিয়েও টানাটানি বিদ্যমান।
জনকল্যাণের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সংবিধান, গণআন্দোলন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বোধ করি আমাদের নেতারা এসবের প্রয়োজনীয়তাটুকুও অনুভব করে না। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের কফিনে একটার পর একটা পেরেক মেরে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাক্সবন্দি করে দেওয়া হলো। জনগণ দেশের মালিক বলা হলেও বর্তমান সময়ে অতীতের মতোই দেশের শাসকেরা দেশের রাজা হয়ে গিয়েছে। জনগণের যে মাতৃভূমিতে জন্মগত অধিকার তা নেতারা উপলব্ধির মধ্যে রাখেননি। শাসনকে চিরস্থায়ী রাখতে ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ নীতিই রাজনৈতিক দলগুলোর অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাধারণভাবে কোনো ব্যক্তি নিজস্ব কোনো ১০ টাকার কাজ ৮ টাকায় আর না পারলেও ৯ টাকায় শেষ করার জন্য নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। নিজের জ্ঞান, মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় কাজটা শেষ করতে চেষ্টা করে। সে জানে যে টাকা বাঁচাতে পারবে তা তার নিজেরই থাকবে এবং এই সঞ্চয় যোগ করে আগামীতে আরও একটা প্রয়োজনীয় কাজ সম্ভব হবে। আমাদের জাতীয় জীবনে এই স্বাভাবিকতার বিন্দুমাত্র দৃশ্যমান নেই। সংশ্লিষ্ট সবার মনে স্থির বিশ্বাস দেশ চিরকালের, তাই নিজ নিজ ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য শতভাগ নিবেদিত হয়ে যেতে হবে। এখন দেশ স্বাধীন, নিজেরাই দেশের মালিক। শক, হুন, মোঘল, পাঠান, ব্রিটিশ, পাকিস্তানিরা কেউই নেই। এমনকি জমিদাররা পর্যন্ত নেই। জমিদার কখন পুকুর কেটে দেবে, কখন রাস্তা বানিয়ে দেবে, কখন স্কুল তৈরি করে দেবে— ওই আশায় বসে থাকার দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপরও জনগণের ভাগ্যের কি পরিহাস, স্বাধীনতা আজ শুধু স্বজাতির শাসনের মধ্যে সীমিত হয়ে রয়েছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে যে পরিবর্তন আসার কথা ছিল তা হলো না, বরং রাজকীয় মানসিকতা স্বগর্বে বিরাজমান রয়ে গেল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দল নয়, আমিত্বের মধ্যেই সবকিছু বন্দি হয়ে আছে।
দেশকাল বিবেচনা করে জনগণের কল্যাণে দেশে একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা চলছে। তেমনি প্রকল্প পরিচালকের পদ পাওয়ার প্রতিযোগিতাও চলমান। যেহেতু অধিকাংশই বিশ্ব মহাজনী স্বার্থ রক্ষার প্রকল্প ফলে সংশ্লিষ্ট সকলে স্বাভাবিকভাবেই শাসক দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষ ধারণা করে এ কারণেই নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ হয় না এবং ১০ টাকার কাজ ১০ টাকায় শেষ না করে কয়েকগুণ বেশি টাকা ব্যয় হয়। অতিরিক্ত এ টাকা ব্যক্তি খাতকে সমৃদ্ধ করে। দেশে এই একটিমাত্র জায়গা রয়েছে যেখানে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে ঐক্যমত আছে। পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা আছে।
একই মতাদর্শের হওয়ার এখানে কেউ কারও বিরুদ্ধাচরণ করে না, সবকিছুর মধ্যেই তারা জনকল্যাণ দেখতে পায়। ফলে দেশে ৬২ লাখ টাকা দিয়ে নারকেল গাছ কেনা হয়, ৬৫০ কোটি টাকার সার কারখানা নির্মাণ প্রকল্প ১৬৫০ কোটি টাকায় শেষ হয়, বিদেশে পুকুর কাটা বা খিঁচুড়ি রান্না শিখতে যাওয়ার মহোৎসব চলে, প্রদানকৃত চাঁদার পরিমাণ হয় ২ কোটি টাকা। বিশ্বে কোটিপতি বৃদ্ধিতে রোল মডেল হওয়া, বিদেশে সেকেন্ড হোম, অভিজাত এলাকায় অভিজাত জীবনযাপন— কোনো কিছুর মধ্যে এরা কোনো অসঙ্গতি খুঁজে পায় না। তাই দলে দলে মানুষ রাজনৈতিক মতাদর্শভুক্ত হতে মরিয়া হয়ে ছুটে চলেছে। লুব্ধ মানুষ বুঝে গিয়েছে দেশে এটাই সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থান। তাই সাধারণ জনগণ দেখছে এখন রাজনৈতিক দলের চাইতে ব্যক্তিই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে। কোনো অবস্থায় ক্ষমতা হারাতে যাতে না হয় তার জন্য তারা নিজের ক্ষমতা, যোগ্যতা, শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে মারি অরি পারি যে কৌশলের মন্ত্র আকঁড়ে ধরেছে। দিনে দিনে দল গৌণ হয়ে পড়েছে।
মারি অরি পারি যে কৌশলে এখন সবধরনের বিরোধীদের ওপর প্রয়োগ হচ্ছে তা সে নিজ মতাদর্শে বিশ্বাসী বা বিরোধীদলীয় যাই হোক না কেন! রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ব্যক্তি ক্ষমতাবান হতে গিয়ে দলের মধ্যে আজ একাধিক বিভক্তি স্পষ্ট। কাড়াকাড়ি মারামারিতে জীবন কেড়ে নেয়ার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। নিজেকে ক্ষমতাধর দেখাতে সর্বশক্তি নিয়ে নিয়োজিত তারা। সরকারি দলে এটা বেশি হলেও অন্যরাও পিছিয়ে নেই। তবে সরকারি দলের সুবিধা যে বহিরাগতদের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের অপকর্মগুলো ঢেকে দেওয়া যায়। তাই সমাজে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়ছে, আইন না মানার মানুষ বাড়ছে, লজ্জা, ঘৃণা, ভয়শূন্য হয়ে লুটপাটে উৎসাহী হয়ে পড়ছে মানুষ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দিতে নিষ্ঠুর হিংস্র হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে দ্বিধাবোধ করছে না। সুনিশ্চিত জীবন জীবিকার অভাব, অনিশ্চিত আর্থিক জীবন এবং বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে, মানুষের মধ্যে বিরাজমান গুরু মানার গুণকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতারা তাদের কর্মীদের সুকুমার বৃত্তিগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে। ক্ষমতার গদি দখলে এরাই এখন মূল পুঁজি। আবার এরাই ঠিকাদারি, মজুতদারি নিয়ন্ত্রণের সহায়ক।
১৯৭১ সালে যে উৎসাহ, যে প্রত্যাশা নিয়ে বাঙালি স্বাধিকার সচেতন হয়েছিল, যে প্রেরণা নিয়ে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যে মুক্তির মানসে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ ও দু-লক্ষ মা-বোন নিপীড়িত হয়েছিল তা শুধু স্বজাতির শাসনই নিশ্চিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের অর্জন আজ স্বাধীন দেশের গর্বিত শাসকরা ভুলে গিয়েছে। মুখ আর অন্তরের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। প্রত্যাশা, প্রেরণা আর মুক্তির মানসকে পাশ কাটিয়ে দেশের রাজনীতি আজ উন্নয়নের দৌড়ে আছে। জনকল্যাণের নামে বিশাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সাথে যোগ হয়েছে ঋণ খেলাপী, অর্থ পাচার, ব্যাংকের অর্থ লুটপাট ব্যবস্থাপনা। জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু যদি সমাজের উপরের শ্রেণির ১০/২০ ভাগকে বাদ রেখে বাকিদের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের হিসেব করা যায় তাহলেই প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে। পাশাপাশি মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ প্রকাশ করলেও প্রকৃত রাজনৈতিক উন্নয়ন পরিষ্কার হয়ে যাবে।
জনগণের প্রত্যাশা দেশের পথ হারানো রাজনীতি বর্তমান ধারাকে বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নাগরিক জীবনের জীবিকায় চাহিদা মেটানোর অঙ্গীকার রক্ষার রাজনীতিতে ফিরে আসুক। স্বাধীনতা ও সংবিধানকে সামনে রেখে আমলাতন্ত্র উদার ও সহিষ্ণু এবং অধিকতর মানবিক হোক। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যেকোনো ১০ টাকার প্রকল্প অন্তত ১০ টাকায় শেষ করায় উদ্যোগী হোক। ২০ টাকার একটা ফুলের তোড়ায় আদর্শ পরিবর্তনের প্রথা থেকে সব দল সরে আসুক। আইন সবার জন্য সমভাবে প্রয়োগ হোক। সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হোক। স্বপ্ন দেখি, বর্তমান মারি অরি পারি যে কৌশলের নীতি থেকে দেশ বের হয়ে এসে যথার্থ রাষ্ট্রিক জাতীয়তাবাদে গণতান্ত্রিকভাবে ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে। বিশ্বকবির ভাষায় প্রত্যাশা করি “অন্ধকার ভেদ করি আসুক আলোক/ অন্ধকার মোহ হতে আঁখি মুক্ত হোক।”