আলুর ফলন চাহিদার চেয়ে বেশি বলে কৃষি বিভাগের দাবি। কিন্তু হিমাগার মালিকরা বলছেন, তাদের ধারণক্ষমতার চাইতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কম আলু এবার জমা রেখেছেন ব্যবসায়ীরা।
Published : 09 Oct 2023, 07:48 PM
পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের দাম লাফিয়ে বাড়ছে দেখে সরকার যে তা কমাতে গিয়েছিল, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে তা কার্যকর করার প্রয়াস বাজার অর্থনীতি সমর্থন করে না। এতে হিতে বিপরীতও হয়ে থাকে। সরকারের ওইসব কর্মকাণ্ডের পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্যের দামে কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে ঊর্ধ্বগতি!
নিবন্ধটি লেখার দিন এক ডজন ফার্মের বাদামি ডিম কিনেছি ১৫৫ টাকায়। ক'দিন আগে একই দোকান থেকে কিনেছিলাম ১৫০ টাকায়। আর সরকার দাম বেঁধে দিয়েছিল ১৪৪ টাকা। ডিমের ক্ষেত্রে যেমন তেমন— আলু ও পেঁয়াজের বেলায় নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশিতেই বিক্রি হচ্ছে পণ্যগুলো। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, কম দামে আনতে না পারলে কিভাবে কমে বেচব?
সরকার অবশ্য ডিমের ঊর্ধমুখী দাম কোনোভাবেই কমাতে না পেরে এটি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ খবরে ডিমের বাজারে কিছু প্রভাব পড়েছে বলে বক্তব্য রয়েছে। আমদানি অবশ্য শুরু হতে পারেনি এখনও। নতুন করে আরও কিছু আমদানিকারককে ডিম আনার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বোধহয় ১৫ কোটি পিস। কিন্তু চাহিদার তুলনায় এটা সামান্য। এ অবস্থায় ওই দাবিও সঠিক বলে মনে হয় না যে, আমদানির খবরেই দাম কিছুটা কমে এসেছে।
ডিম উৎপাদকরা বলছেন, ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় খামার চালিয়ে যাওয়া কঠিন। বড় উৎপাদকদের পক্ষেই নাকি কেবল বিদ্যমান দামে ডিম সরবরাহ করা সম্ভব। এদিকে আবার ভোক্তার দিক থেকে চাপ রয়েছে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পেও এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। ডিমের দাম ক্রমে বাড়তে থাকলে এর ব্যবহারকারীদের ওপর প্রভাব পড়বে স্বভাবতই। এ অবস্থায় সরকার যে পরিমাণ ডিম আমদানি উদ্যোগ নিয়েছে, সেটাকে প্রতীকী বলা যায়। ব্যাপক মানুষকে কম দামে খাওয়াতে চাইলে ডিম নিয়মিতভাবে আনতে হবে। ওভাবে আমদানি হলে আবার ক্ষুদ্র ও মাঝারিরা অধিকতর চাপে পড়ে উৎপাদন থেকে বিদায় নেবে কিনা, প্রশ্ন রয়েছে। বড় খামারিরা হয়তো পুষিয়ে নেবে তাদের উৎপাদন ব্যয় কম বলে। অনেকে তাই বলছেন, সরকারের উচিত ছিল ডিম উৎপাদকদের 'যন্ত্রণার জায়গা'য় পরিচর্যা করা। এদিকে বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটিগুলো অ্যাড্রেস করে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ছিলেন প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী। কৃষিমন্ত্রীও। তারা এখনও মনে হয় আমদানির বিরুদ্ধে। তবে তাদেরও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন— ডিমে আমরা এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ আছি কিনা।
আলুতেও আমরা নাকি স্বয়ংসম্পূর্ণ। এবারও আলুর ফলন চাহিদার চেয়ে বেশি বলে কৃষি বিভাগের দাবি। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা। বিশেষত হিমাগার মালিকরা বলছেন, তাদের ধারণক্ষমতার চাইতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কম আলু এবার জমা রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। কিছু আলু তো সংরক্ষণ করা হয় বীজ হিসেবে ব্যবহারের জন্যও। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আলু নষ্টও হয়ে যায়। আলুর দাম এবার গেলবারের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। তবে মুশকিলের কথা হলো, দাম বাড়তে থাকার সময়টায় এসব পণ্য কৃষকের হাতে থাকে না। এটা তখন থাকে ব্যবসায়ীদের হাতে এবং দাম বাড়তে থাকলে পণ্যের হাতবদলও হতে থাকে, এমনকি হিমাগারে। এখন যিনি অধিক দামে আলু কিনে রেখেছেন, তিনি কেন সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করে লোকসান দেবেন? এ অবস্থায় কিছু হিমাগারে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিতর্কে জড়ালেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারেননি। মাঝখান দিয়ে কিছু ব্যবসায়ীকে তারা জরিমানা করেছেন বড়জোর। এতে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ এবং বাজারে বেড়েছে অস্থিরতা। এরকম শঙ্কার কথা অনেকেই কিন্তু বলেছিলেন। এখন বাণিজ্যমন্ত্রীও স্বীকার করছেন, দাম বেঁধে দিয়ে তা বাস্তবায়নের কার্যক্রমে সফলতা মেলেনি।
দেশে উৎপাদিত আর আমদানি করা পেঁয়াজের দামও বেড়েছে নতুন করে। আমরা পেঁয়াজ উৎপাদনেও সাফল্য পেয়েছিলাম সরকারি তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী। গত ক'বছরে নাকি হয়ে উঠেছি এমনকি স্বয়ংসম্পূর্ণ! উচ্চহারে পেঁয়াজের অপচয় বিবেচনায় নিলে যে আবার ঘাটতিতে পড়ে যাই, এক্ষেত্রে সেটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো। সেজন্য প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। সমস্যা বেশি দেখা দেয় প্রতিবেশী দেশ থেকে আমদানিতে বাধাবিঘ্ন বেড়ে উঠলে। এবারও দেশে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে যখন জানা গেল— ভারত শুল্ক বাড়িয়েছে রপ্তানিতে। যাহোক, মাঝে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হয়েছিল। তাতে দাম কিছুটা কমে আসার প্রবণতা ছিল। এখন এর দাম আবার বাড়ছে বেঁধে দেওয়া দামের পরোয়া না করে। এ অবস্থায় টিসিবির মাধ্যমে নতুন করে ফ্যামিলি কার্ডধারীদের মাঝে পেঁয়াজ বিক্রির কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরিবারের উপকৃত হওয়ার কথা অস্বীকার করা যাবে না। তবে যে পরিমাণ পণ্য এতে জোগানো হয়, তাতে বাজারে প্রভাব পড়তেও দেখা যায় না। বাজারে প্রভাব সৃষ্টির মতো কার্যক্রম পরিচালনা সরকারের পক্ষে বলা যায় অসম্ভব। প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আছে ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে সংকট। সরকার তো রাজস্ব ঘাটতিতে রয়েছে। ক্রমে বাড়তে থাকা ডলার সংকটে বেশি আমদানি করাও কঠিন। অনেক ক্ষেত্রে দেশীয় বাজার থেকে কিনে তাকে পরিচালনা করতে হয় খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম। তাতেও বাজারে সৃষ্টি হয় কিছু অস্থিরতা। দেশে উপস্থিত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্যও কিছু নিত্যপণ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সংগ্রহ করতে হয় দেশীয় বাজার থেকে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে চাহিদার হিসাব করা হয় কিনা, সেটাও প্রশ্ন। স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও তা ধরে রাখা তো কঠিন।
এখন দেখা যাচ্ছে, দাম কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে ভোক্তা অধিদপ্তর 'সীমিতভাবে' আলু আমদানির পক্ষে। এক্ষেত্রে সম্মতি লাগবে যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের, তারা আমদানির বিরুদ্ধে। তাদের যুক্তি, দাম বাড়লেও আমদানির অনুমতি দেওয়া ঠিক নয়। এতে উৎপাদকরা পরবর্তী উৎপাদনে আগ্রহ হারাতে পারেন। দেশে এ মুহূর্তে যে পরিমাণ আলু রয়েছে, তাতে আরও দু'মাস নাকি চলবে। কিছু এলাকায় কৃষকরা 'আগাম আলু' ফলাতে লেগে গেছেন বলেও খবর মিলছে। গুদামের আলু ফুরিয়ে আসার আগেই আগাম আলু এসে যাবে হাতে। আলুর 'বিলম্বিত ফলন'টাও বাজারে আসতে থাকবে। তবে আলু চাষে এত আগ্রহ কৃষকের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। আমরা তো অতিউৎপাদনের সংকটের কথা জানি। এতে দাম কমে যায়। সমস্যা হলো, ভালো উৎপাদন করলেও কৃষক তার পণ্য ধরে রাখতে পারে না। তার নগদ টাকা চাই বলে এখন খুচরায় যে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা কেজিতে— কৃষক তার দাম হয়তো পেয়েছিল বড়জোর ১৫ টাকা। তাতেও নাকি এবার কৃষকের কিছু লাভ হয়েছে। আগামীতে তার হিস্যা আরও বাড়ানো যায় কিভাবে, সেটা গভীরতর প্রশ্ন।
এ অবস্থায় এমনটিও বলা হচ্ছে, সরকার ধান-চালের মতো কিছু আলু কিনে মজুদ করতে পারে কিনা। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারও আলু কিনতে শুরু করলে কৃষকের ভালো দাম পাওয়ার সম্ভাবনা। তবে সরকারের পক্ষে চট করে এমন কর্মকাণ্ডে যাওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। তার ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানও সফল হয় কমই। ধান-চাল সংগ্রহ করেন মূলত ব্যবসায়ীরা এবং সরকারও তাদের কাছ থেকে চুক্তিতে সংগ্রহ করে চাল। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে যেমন তেমন— চাল উৎপাদন এবং এর দাম সহনীয় রাখতে তারা সফল হয়েছেন। চালের মজুদ এত ভালো যে, সাম্প্রতিকালে এটা আর আমদানি করতে হয়নি। তিনি খাদ্য নিরাপত্তায় দৃষ্টি রেখে বক্তব্য দিয়েছেন বৈকি। তবে চালের দাম না বাড়লেও এটা এখন 'উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল'। আর কেবল চালের বাজার ঠিক রাখলেই কি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যাবে? আরও কিছু নিত্যপণ্যের উৎপাদন ও দাম স্বাভাবিক রাখতে হবে। এর মধ্যে অবধারিতভাবে রয়েছে আলু। সবজির মধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর দাম সহনীয় রাখা গেলে চাল, আটার দাম বাড়তে থাকার সময়টায় বিশেষত দরিদ্রদের জন্য আলু হয়ে ওঠে বিকল্প। 'ভাতের বদলে আলু' খাওয়ার তাগিদও দেওয়া হয়ে থাকে। সরকারের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে কখনও কখনও চালের সঙ্গে আলু বিতরণের চল রয়েছে। আমরা অবশ্য জানি না, ডিম ও পেঁয়াজের মতো আলুও শেষতক আমদানি করা হবে কিনা। বরং শুনেছিলাম, এর রপ্তানি বাড়ানো হবে— যেহেতু উৎপাদিত আলুর একাংশ হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকছে। আমাদের আলু উৎপাদন ব্যয় বেশি বলে গবেষকরা কিন্তু বলে থাকেন। যেভাবেই হোক, আলুর উৎপাদন ব্যয় কমানো গেলে মৌসুমে দাম কম পেলেও কৃষকের পুষিয়ে যাবে। ভোক্তাও হয়তো তখন আলু পাবেন সহনীয় দামে।
শেষ কথা হলো, ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দাম বেঁধে দিয়ে সরকার যত তৎপরতাই চালাক— বাজার আগের ধারাতেই রয়েছে। সরকার অবশ্য দাবি করতে পারে, তার তৎপরতার ফলে দাম না কমলেও সেটা আর বাড়েনি! এসব বিতর্ক পাশে সরিয়ে রেখে আমাদের এখন উচিত হবে এ তিনটি পণ্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাসে কী করা যেতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করা। বাজার ব্যবস্থাপনায় কী কী সমস্যা রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা। চোখ বন্ধ করে আমদানির উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রেই কিন্তু এসব সমস্যা খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিকে মাটিচাপা দিয়ে দেয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদকদের জন্য সর্বনাশাও হয়ে দাঁড়ায় আমদানি। তারা তো ভিনদেশী উৎপাদক এবং তার সহযোগী দেশীয় আমদানিকারকদের সঙ্গে পেরে ওঠে না। এর সঙ্গে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের প্রশ্নও জড়িত। আর বেশি বেশি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরতা সহজে পণ্যসামগ্রী প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তাও বাড়িয়ে তুলতে পারে। কৃষিপণ্য আমদানির মাধ্যমে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কাও আছে।
তাছাড়া আমরা এখন মোকাবেলা করছি রিজার্ভ সংকট। আমদানি বরং কমাতে চাইছি। এ অবস্থায় কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একত্রে বসে খতিয়ে দেখতে হবে, কোন কোন নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে কোন সময় কী করা দরকার। এক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্তের সহায়তাও প্রয়োজন।