শীতার্ত বাংলাদেশ: মানুষ মানুষের জন্য!

শুধু শীতের সময় এলে বা মানুষ কষ্ট পেলে তখন তা নিয়ে ভাবতে হবে কেন? শীতকাল তো বলেকয়েই আসে।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 8 Jan 2023, 02:57 PM
Updated : 8 Jan 2023, 02:57 PM

যারা মনে করেন কলাম বা চলমান লেখালেখি মানে রাজনীতি বা দলীয় চর্চা আমি তাদের দলে পড়ি না। আবার এটাও মানি না যে, কলাম মানেই নিরন্তর সমালোচনা বা নিন্দা করা। এটা স্বীকার করি সবাই মিলেই এমন এক আবহ তৈরী করে ফেলেছি আমরা। আমার মনে হয় মানুষ তেমন লেখাগুলো পড়েন এবং পড়তে ভালোবাসেন যা তাদের মন স্পর্শ করতে পারে।

যখন এ লেখা লিখছি বাংলাদেশে তখন জাঁকিয়ে শীত পড়ছে। টিভিতে শীতে কাবু মানুষের দুরবস্থা দেখলাম। উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণবঙ্গের শীত প্রায় ফি বছরই শিরোনাম হয়ে যায়। এ বছর শীত খোদ ঢাকাকেও ছাড় দিচ্ছে না দেখতে পাচ্ছি। রাজধানী শহরের ধনী বা মধ্যবিত্তরা শীতের সকাল-রাতে কফির কাপ কিংবা ধোঁয়া ওঠা বারবিকিউ-এর ফটো দিয়ে নিজেদের দুঃখবিলাসের কথা জানাচ্ছেন। মন্দ কী? তা তারা করতেই পারেন। কিন্তু মন খারাপ হলো রাজপথে শীতার্ত মানুষগুলোকে দেখে। এমন কত হাজার বা লক্ষ মানুষ আছেন কে জানে? সংখ্যা নিয়ে যারা বাহাস করতে ভালোবাসেন তারা হয়তো এখনই ঝগড়া শুরু করে দেবেন। হাতে-কলমে পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণ করে ছাড়বেন আগের আমলগুলোর চাইতে ফুটপাত বা রাজপথের কিনারায় রাত কাটানো মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। নিশ্চয়ই কমেছে।

এ জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ। কিন্তু কমতে কমতেও থেকে গেছে অনেক মানুষ। যাদের রাতে কোথাও যাবার জায়গা নাই। টিভিতে এটাও দেখলাম, গাড়ি করে এসে যারা শীতবস্ত্র দিচ্ছেন তাদের ঘিরে আছে বেশ কিছু মানুষ। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় তারা কতটা কাবু। আপনি একবার ভাবেন এমন শৈত্যপ্রবাহ আর ঠান্ডায় আপনি-আমি যেখানে ঘরে থাকতে পারছি না তখন এই মানুষগুলো খোলা রাস্তায় কনকনে শীতের হাওয়ায় কীভাবে রাত কাটান?

এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ পোস্ট দেয় না এমন কোনো বিষয় নেই বললেই চলে। এসব পোস্টে কাজও হয়। এটা তো প্রমাণিত সত্য যে, খবরের কাগজ এমনকি বহু চলমান, দৃশ্যমান মিডিয়ার চাইতেও শক্তিশালি ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টুইটার। দেশের ভেতর সংঘটিত কত অন্যায়-অপমান আর বেদনার প্রতিকার করে ছেড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিশেষত ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা বা বিজ্ঞানহীনতার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা জনমত অনেক পরিবর্তন সম্ভব করে ছেড়েছে। অথচ এমন একটা মানবিক বিষয় নিয়ে কেন নীরব থাকবে বা থাকি আমরা?

দুনিয়ার বহুদেশে এখন ছিন্নমূল মানুষেরা রাস্তায় থাকেন। হোমলেস মানুষ সিডনিতেও আছে। কাজে যাই ভোর সাতটার আগে। বাংলাদেশের চাইতে অনেক বেশি শীত আর কনকনে ঠান্ডা বাতাসে তিন-চার স্তরের কাপড় পরিহিত আমারই খবর হয়ে যায়। এখানকার হোমলেসরা ঠিক পথে থাকে না, থাকে ছাদের তলায়। কিন্তু আমি যেটা খেয়াল করি প্রায় সবাই পর্যাপ্ত গরম কাপড়ে ঢাকা। তাদের গায়ে ব্র্যান্ডের পোশাক। পায়ে দামী কেডস। বোঝাই যায় এরা সরকারের অনুদান পায়। হয়তো তা নানা অকাজে খরচ করে ফেলে অথবা কুলিয়ে উঠতে পারে না। এই মানুষগুলোকে কয়েকদিন বা মাসখানেক পর আর দেখা যায় না। এর কারণ সরকারি তরফে খবর গেলেই পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন এসে হাজির হয়ে যায়। তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় হাউজিং কমিশন নামের বাড়িগুলোয়। ওইসব বাড়ি-ঘর দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো কি কারও কেনা বাড়ি না সরকারি কমিশনের হাউজিং। বরং এমনও দেখেছি এদের অনেকেই সেখানে যেতে নারাজ। হয়তো শেডের তলায়, স্টেশনে বা জনবহুল এলাকায় দিনের বেলা ভালো পরিমাণ ডলার জোটে বলেই এরা যেতে চায় না। আসামীর মতো ধরে-বেঁধে সরকারি কমিশনের হাউজিংয়ে নিয়ে যাবার দৃশ্যও দেখেছি। আমাদের দেশে সরকারের আন্তরিকতা থাকলেও এমনটা সম্ভব না।

যাদের কথা বলছি তারা হতদরিদ্র। তাদের সংখ্যাই বেশি। এরা ভালো না থাকলে দেশ বা সমাজ ভালো থাকে কী করে? যে আয়-উন্নতি-প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয় তা বাস্তব হলে শীতকাল কেন এমন কষ্টে কাটবে এদের? কিন্তু এটাতো ঠিক এই সময়েই ঢাকায় এমন উৎসব হচ্ছে যার টিকেটের দাম দশ হাজার টাকা। এমন সব খেলা বা বিনোদনের আসর রয়েছে যার টিকেটের দাম আকাশ ছোঁয়া হলেও মেলা ভার। এসব মানুষদের সবাই না হোক একটা অংশ যদি তাদের উপচে পড়া অর্থের কিছুটা দান করতেন তো শীতার্ত এই মানুষগুলোর শরীরে কাপড় থাকত।

আমাদের সমাজে ধনী মানুষ মূলত কারা? এর উত্তর আমাদের দিতে হবে না। এর জবাব একটি শিশুও দিতে পারবে। আঙুল ফুলে কলাগাছের দিনও শেষ। এখন আঙুল ফুলে বটগাছের যুগ। এইসব বটগাছের কোনো খবর নেই। কোনো ক্রান্তিকালে এদের খবর থাকে না। এরা দেশের টাকা, ব্যাংকের টাকা পাচার করে নিজেরা তেল-ঘিয়ে থাকে বটে কিন্তু গরীব-দুঃখীদের জন্য এদের মন খারাপ হয় না। এদের টাকায় গরীবের হক থাকলেও তারা এর পরোয়া করে না। এরা একবেলার খাবারের টাকা বা একদিনের অপচয় দান করলেও সমস্যার অনেকটাই সমাধান হতে পারত।

আরেকটা কথা, শুধু শীতের সময় এলে বা মানুষ কষ্ট পেলে তখন তা নিয়ে ভাবতে হবে কেন? শীতকাল তো বলেকয়েই আসে। কষ্টের খবরও নতুন কিছু না। আগেভাগেই কি প্রতিকারের জন্য কাজ শুরু করা যায় না? শীতের একমাস আগেই মানুষকে শীতবস্ত্র তুলে দেয়া যায় না? তা হলে আজ এই হাড়কাঁপানো কনকনে শীতে এদের খবর শিরোনাম হতো না। তারাও বাঁচতে পারত।

উন্নতি-উন্নয়ন এসব কাগজ কলমের বিষয় না। এর সাথে চাই আন্তরিকতা। চাই সম্মিলিত ভালোবাসা। যে মানুষগুলো এদের জন্য ভাবে বা যাদের মন কাঁদে তারা নিজেরাই অসহায়। আর টাকা ও বিত্ত আছে তাদের হৃদয় নেই। এই দুই অংশের সমঝোতা আর মিলনেই আমরা শীতে কাবু মানুষদের পাশে দাঁড়াতে পারি। মানুষ মানুষের জন্য এই কথা কি সত্য হবে না?