পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা না পাল্টে নারীর ক্ষমতায়নের নামে বড় বড় কিছু পদে নারীদের স্থাপন করলেই সমাজ থেকে লৈঙ্গিক বৈষম্য উঠে যাবে না, কোটি কোটি নারীর জীবন সহজ হয়ে যাবে না।
Published : 25 Jul 2023, 10:57 AM
যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, সংসদের স্পিকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে নারীর অধিষ্ঠান, সে দেশে বসে নারীর ক্ষমতায়নকে ধোঁকাবাজি বলবার মতো স্পর্ধা দেখানো উচিত নয়। নারী এখানে সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে সসম্মানে বহাল হয়েছেন, হচ্ছেন। দেশে যদি নারীর অবস্থার উন্নতি না হতো, তাহলে এতসব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে শুরু করে প্রাইভেট সেক্টরের বিভিন্ন জরুরি পদে নারীদের দেখা যেত না। পৃথিবীর কিছু দেশে যখন শুধু ঘোমটা সরে গিয়ে চুল দেখা যাওয়ার ‘দোষে’ নারীকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় কিংবা কন্যাশিশুকে ভ্রূণ অবস্থায়ই হত্যা করা হয়, সে হিসেবে নারীর অবস্থা কিংবা অবস্থান নিশ্চয়ই যথেষ্ট ভালো এখানে।
আত্মশ্লাঘা কিংবা আত্মতুষ্টিতে ভুগতে হলে অবশ্যই আপনি আরও যুক্তি দিতে পারেন। ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ ধরনের গালভরা কথা, ব্যক্তিগতভাবে আমি যাকে ‘এনজিও টার্ম’ বলতে বেশি পছন্দ করি। শুনতে ভালো শোনালেও ক্ষমতায়নের গর্জনের আড়ালে বর্ষণ কম। ‘ক্ষমতা’ শব্দটি নিয়ে সমস্যা অনুভব করার প্রধান কারণ, ক্ষমতা আসলে দুর্নীতি সৃষ্টি করে। ক্ষমতার চর্চা মূলত মানুষের সভ্যতার সকল সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ। আমরা যাকে পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক আচরণ বলি, সেগুলোর মূল কারণ পুরুষতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে পাওয়া ক্ষমতা। পুরুষের সমাজে টিকে থাকতে হলে, নিজের অধিকার আদায় করতে হলে নারীকে ক্ষমতা অর্জন করতে হবে–এই ধারণাটির সঙ্গেই আমি একমত নই।
শুরুতেই বলে নেওয়া ভাল, ক্ষমতার লড়াইয়ে নেমে পুরুষতন্ত্রকে মোকাবিলা করা যায় না। পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে নারীতন্ত্র তৈরি করা, পুরুষ যেভাবে নারী শিশু, ভিন্ন লিঙ্গের মানুষের ওপর নিজের পৌরুষিক ক্ষমতার প্রয়োগ করে এসেছে সেই একই উপায়ে ‘ক্ষমতায়িত’ নারীরা পুরুষ, শিশু, অন্য লিঙ্গ কিংবা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাপ্রাপ্ত নারীর ওপর নবলব্ধ ক্ষমতার প্রয়োগ করবে এমনটি আশা করা নারীবাদী আন্দোলনের কাজ নয়। লৈঙ্গিক বৈষম্য নিরসনে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামো ভেঙে ফেলার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ক্ষমতায়িত নারীর উত্থান আসলে নারীবাদের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, যাঁকে আমরা বেগম রোকেয়া বলে পরিচিত করে দিয়েছি, তাঁর ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামক রচনায় দেখিয়েছেন ক্ষমতায় বসে নারী কীভাবে পুরুষকে মর্দানা নামক একটি অবরোধের মধ্যে বাস করতে বাধ্য করে। আমার ধারণা রোকেয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল নারীকে অবরোধে কিংবা জেনানায় আটকে রেখে সমাজ আর রাষ্ট্র পরিচালনা করার পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাটির খুঁত ধরিয়ে দেওয়া; শুধু লৈঙ্গিক পরিচয়ের ভিত্তিতে যে একজন মানুষের জীবনযাত্রা, পেশা ইত্যাদি নির্ধারিত হয়ে যাওয়া উচিত নয়, সন্তানধারণ ও পালন যে নারীর একমাত্র অভীষ্ট ক্যারিয়ার হতে পারে না সে কথাটিই স্পষ্ট করা। রোকেয়া সবসময়ই বলেছেন সাইকেলের দুটি চাকা সমান না হলে সেটি যেমন এগোতে পারে না, এক পা বেঁধে রাখলে একজন মানুষ যেমন স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারে না সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে সমাজ আর রাষ্ট্রও তেমন পিছিয়ে পড়বে, কেননা জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। যে রোকেয়া নারী-পুরুষের সমান অধিকার আর অংশগ্রহণে বিশ্বাস করতেন তিনি কেন ‘সুলতানার স্বপ্নে’ পুরুষকে অবরুদ্ধ করবার কথা বলবেন? তর্কের খাতিরে ধরে নিই, এমন এক দিন এলো যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে সকল ক্ষমতা শুধু নারীর হাতেই ন্যস্ত হলো, সেদিনের নারী কি আসলেই সুলতানার স্বপ্নে দেখা নারীদের মতো ক্ষমতার চর্চা শুরু করবেন? পুরুষকে বন্দী করবেন গৃহে? যদি করেন, তাহলে কি তা মানবসমাজের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে? নিশ্চয়ই আনবে না।
নারীর ক্ষমতায়নের ধারণাটি কীভাবে পুরুষতন্ত্রের উদ্দেশ্য হাসিল করে তা খানিকটা বিশদে ব্যখ্যা করার দরকার আছে বলে মনে করি। প্রথমত, যতদিন পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত না করা যাচ্ছে, পুরুষতন্ত্র নামক মহীরুহটিকে সমূলে উৎপাটিত না করা যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত ক্ষমতায়িত নারীরা পুরুষতন্ত্রের হয়েই কাজ করেন। প্রতিটি ক্ষমতাবান নারী হয়ে ওঠেন জৈবিক নারীর শরীরে বাস করা মননে ও মগজে একেকটি প্রবল পুরুষ। অর্জিত বা প্রাপ্ত ক্ষমতাকে তিনি নিজের মুক্তির উপায় হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষ্যান্ত হন না, একে ব্যবহার করেন অন্যকে শাসন ও শোষণ করার হাতিয়ার হিসেবে। এতে অন্য নারীর কোনো উপকার হয় না, আর পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার কেশাগ্রও স্পর্শ করা যায় না। দ্বিতীয়ত, এই গুটিকয় নারীর ক্ষমতা আর পদমর্যাদাকে সামনে রেখে আরও একশ জন সাধারণ নারীর রোজকার সংগ্রামকে নস্যাৎ করে দেওয়া যায়। একজন নারী সিইওকে দেখিয়ে বলা যায়, ‘উনি যদি পারেন তাহলে তুমি কেন পারবে না?’ ভাবখানা এমন যেন কর্মক্ষেত্রে আসলে কোনো বৈষম্যই নেই, গ্লাস সিলিং বলে যে অদৃশ্য কাচের ছাদটি নারীর পেশাগত উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেই ছাদটির অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা যায় সামনে একজন সফল নারীকে রেখে। তখন বেতনবৈষম্য ও কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের মতো আরও বহু প্রতিবন্ধকতার গল্পগুলোকে লুকিয়ে ফেলা যায়।
লেখক, সাংবাদিক, সমালোচক এবং বুকস্লাটের এডিটর ইন চিফ জেসা ক্রিস্পিন তাঁর ‘হোয়াই আই অ্যাম নট অ্যা ফেমিনিস্ট: অ্যা ফেমিনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে নারীবাদ কী করে পুরুষতন্ত্রের উদ্দেশ্য সাধন করে ও পঞ্চম অধ্যায়ে নারীর ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন কীভাবে নারসিসিস্টিক তা বিশদে আলোচনা করেছেন। ক্রিস্পিনের মতে, নারী যখন ক্ষমতা পায় তা সে সাধারণত পায় টাকা দিয়ে। প্রাপ্ত বা অর্জিত অর্থের মাধ্যমে প্রাপ্ত এই ক্ষমতা তাকে ক্যাপিটালিস্ট আচরণ শেখায় এবং ক্যাপিটালিজম মূলত পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারক ও সমর্থক। কাজেই একজন ধনী নারী স্বভাবতই হয়ে ওঠেন পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিনিধি। একজন পুরুষ যেভাবে টাকার বলে অন্যকে শোষণ-বঞ্চনা করেন, যারা নিপীড়ক নন তারাও অন্যকে প্রান্তিক ও দুর্বল অনুভব করান–একজন টাকাওয়ালা নারীও তাই করেন। সোজা বাংলায় বুঝিয়ে বলতে গেলে, স্বামীর বা নিজের পয়সায় রাখা গৃহকর্মী বা ড্রাইভারকে শ্রমশোষণ করা বেগম সাহেবাটি একজন নারী যিনি গৃহকর্মী কিংবা ড্রাইভারের তুলনায় ক্ষমতাবান। তাঁর টাকার মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষমতা দিয়ে কারও কোনো উপকার তো হয়ই না বরং পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চা করতে থাকা একজন নারীকে দেখতে পাওয়া যায়। কাজেই, নারীবাদ যখন শুধু নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে, নারীকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার জন্য অর্থ উপার্জন করতে বলে, তখন আসলে লাভবান হয় পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাই।
পঞ্চম অধ্যায়ে, যার শিরোনাম ‘সেলফ এমপাওয়ারমেন্ট ইজ জাস্ট অ্যানাদার নেইম ফর নার্সিসিজম’, লেখক আরও বলেন পুরুষতন্ত্র বহুদিন ধরে শিখিয়েছে সুখের বা সাফল্যের মাপকাঠি হলো ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি; একজন মানুষ তখনই সুখি হয় যখন সে অন্যকে দাবিয়ে রাখতে পারে, নিজেকে উচ্চ আসনে বসাতে পারে, এই যে নার্সিসিজমকে সুখ ও সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়েছে, আর্থিকভাবে ক্ষমতাবান নারী সেই একই নার্সিসিজমে ভোগেন।
অ্যান্ডি জেইসলার তাঁর ‘উই ওয়্যার ফেমিনিস্টস ওয়ান্স: ফরম রায়ট গার্লস টু কভার গার্লস, বায়িং অ্যান্ড সেলিং অফ অ্যা পলিটিক্যাল মুভমেন্ট’ গ্রন্থে বলছেন, ক্যাপিটালিজম সবকিছুকেই পণ্যীকরণ (কমোডিফিকেশন) করতে পারে, নারীবাদ নামের ধারণাটিকেও তাই করেছে। নারীবাদী আন্দোলনের কোনো ধরনের কাজে অংশ না নিয়ে শুধু নিজেকে নারীবাদী দাবি করার সময় আর্থিকভাবে সফল এবং স্বাবলম্বী নারী একটি দামি টি শার্ট কেনেন এবং পরিধান করেন যার গায়ে লেখা ‘অ্যা প্রাউড ফেমিনিস্ট’ এবং ভাবেন নারীবাদী দাবি করার মধ্যেই দায়িত্ব শেষ, নারীর মজুরি বৈষম্য নিয়ে, লৈঙ্গিক বিভিন্ন অসমতা ও শোষণ নিয়ে কিছু যে বলতে হবে কিংবা করতে হবে সেটা তাঁর মনে হয় না। অবিবাহিত নারী যিনি স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী হিসেবে ভীষণ আত্মবিশ্বাসে ভোগেন, তাঁর কাছে বিক্রি করার জন্য ডি’বিয়ারসের মতো কোম্পানি বাজারে এনেছে স্পিন্সটার রিং যা অবিবাহিত নারী ডানহাতে পরেন। এই যে দ্যাখো, আমি স্বাবলম্বী নারী, আমি স্বামী বা প্রেমিকের টাকায় নয়, নিজের উপার্জিত অর্থে হীরার আংটি আঙ্গুলে গলিয়েছি–এই শ্লাঘায় ভুগে ভুগে স্পিন্সটার রিং কেনা একজন ধনী নারী কখনোই ভাবেন না হীরার কোম্পানিগুলো কীভাবে নারী ও শিশুশ্রমিকদের শোষণ ও বৈষম্য করে থাকে। সমাজে প্রচলিত নারীর প্রতি বহু অন্যায় বা নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা না বলে, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈষম্যের শিকার নারী বা অন্য যেকোনো লিঙ্গের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ না করে নারী যখন শুধুই নিজেকে ক্ষমতায়িত করে তখন তাতে নারীবাদী আন্দোলনের কোনো উপকার হয় না। সমাজে আর দশজন সাধারণ নারীর বেঁচে থাকার পথ সুগম হয় না।
এমন না যে নারীদের জেলা প্রশাসক কিংবা নভোচারী কিংবা সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য নিরসনের বদলে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা যতদিন বহাল তবিয়তে আছে ততদিন নারীর ক্ষমতায়নের শোকেসিং অনেকটা প্রতিবেশী দেশে মুসলমান, শিখ এবং বর্তমানে দলিত নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হবার মতো একটা ব্যাপার বলেই গণ্য হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে বারাক ওবামা ঢোকার পরেও যেমন ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স’ বলে চিৎকার করতে হচ্ছে সেদেশের বহু কালো মানুষকে, পুলিশি নির্যাতনে রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিতে হচ্ছে, তেমনি পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা না পাল্টে নারীর ক্ষমতায়নের নামে বড় বড় কিছু পদে নারীদের স্থাপন করলেই সমাজ থেকে লৈঙ্গিক বৈষম্য উঠে যাবে না, কোটি কোটি নারীর জীবন সহজ হয়ে যাবে না।