যুদ্ধাহতের ভাষ্য-১১৫: নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে হবে

প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে এই বীরপ্রতীক বলেন, “একাত্তরে দেশের জন্য তিন-চারদিন না খেয়েও ছিলাম। নয় মাস পায়ে জুতা পরি নাই। এর মধ্যে নামাজও পড়েছি। তাদের তো জানাতে হবে মুক্তিযোদ্ধারা কতটুকু কষ্ট কইরা তাদের জন্য এই দেশ স্বাধীন করছে। এটা না জানলে তারাও দেশের জন্য ত্যাগী হতে পারবে না।”

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 27 April 2023, 12:19 PM
Updated : 27 April 2023, 12:19 PM

“কৃষিকাজ ছাড়াও বাবার ব্যবসা ছিল। কিন্তু যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে পরিবার চলত না। কষ্ট ছিল খুব। ভাতের পরিবর্তে ঝাউয়ের ছাতু, কালাইয়ের ছাতুও খেতে হয়েছে। মেট্রিক পাস করেছি অনেক কষ্টে। এরপরই চলে যাই ময়মনসিংহে। কেন?

গ্রামের এক বড় ভাই বললেন, তাড়াতাড়ি চাকরি পেতে হলে টাইপরাইটিং শিখতে হবে। অফিস-আদালতে এর অনেক চাহিদা। আমারও চাকরি দরকার। তাই টেলিগ্রাফি অ্যান্ড টাইপরাইটিং বিষয়ে ভর্তি হই ময়মনসিংহে, জর্জ কমার্শিয়াল কলেজে।

ওখানে এক বাড়িতে লজিং থাকতাম। দু-একজন ছাত্র পড়িয়ে যা পেতাম তাই দিয়েই চলত খরচ। আশা ছিল পাস করলেই চাকরি পাবো। কিন্তু তেমনটা ঘটল না। নানা জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েও চাকরি হয় না। মনটা খুব খারাপ হলো। কী করব ভাবছি। ওইসময় লোকমুখে শুনি আর্মিতে লোক নেওয়ার খবর।

কাজ কী সেখানে? অনুমান করে পরিচিত কয়েকজন বলল– ‘ক্লারিক্যাল জব।’ তখন ভাবলাম টাইপরাইটিং জানি। চাকরিটা পাওয়াও সহজ হবে। চলে যাই ময়মনসিংহ সার্কিট হাইজে। লাইনে দাঁড়াতেই উচ্চতা, ওজন ও বুকের মাপ নিলো ওরা। ফিজিক্যালি ফিট হলে মেডিক্যাল হয়। তাতেও টিকে যাই। প্রথমে ঢাকায় এবং পরে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের নতুনপাড়ায়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রেনিং হতো সেখানেই।

কিন্তু ট্রেনিং শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে জানতে পারি ক্লার্ক নয়, সিপাহি পদে চাকরি হয়েছে। শুনেই আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। ওদের সবকিছু খুলে বললাম। টাইপরাইটিংয়ের জন্য তাদেরও লোকের দরকার ছিল। ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি তারা রিক্রুট হওয়া ৯০০ জনের নাম ক্যাপিটাল লেটারে টাইপ করার কাজেও আমাকে লাগিয়ে দিলো। এভাবেই শুরু। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেই ১৯৬২ সালে, সিপাহি হিসেবে। আর্মি নম্বর ছিল ৩৯৩৩১৭৫।”

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদানের ঘটনাটি এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযাদ্ধা মো. আবদুল হাকিম, বীরপ্রতীক। তার বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলার মেদুর গ্রামে। এক সকালে বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা ঘটনা প্রসঙ্গে।

মাসুদ আলী ও মর্তবান নেছার চতুর্থ সন্তান আবদুল হাকিম। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি বাড়িপটল প্রাইমারি স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণি পাশের পর ভর্তি হন পিংনা উচ্চ বিদ্যালয়ে। মেট্রিক পাস করেন ১৯৬১ সালে। অতঃপর তিনি টেলিগ্রাফি অ্যান্ড টাইপরাইটিং বিষয়ে লেখাপড়া করেন ময়মনসিংহ জর্জ কমার্শিয়াল কলেজে।

নতুনপাড়ায় ট্রেনিংয়ে হাকিমের নয় মাস কেটে যায়। তার চেয়ে দ্রুতগতিতে টাইপ করতে পারত না কেউ। ফলে অল্প সময়েই সকলের নজরে আসেন। ট্রেনিং শেষে তার পোস্টিং হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টে, কোম্পানি ক্লার্কের কাজে। ১৯৬৬ সালে তার পোস্টিং হয় লাহোরে। ছিলেন সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। দুই বছর পর তারা চলে আসেন ঢাকায়, জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে। হাকিম তখন হাবিলাদার হন। জয়দেবপুরে তাদের কমান্ড করতেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ, সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক।

৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনেন হাকিমরা। কীভাবে? তিনি বলেন, “ব্যারাকে বসেই পরদিন রেডিওতে শুনেছি ভাষণটি। তখন অন্যরকম ভাবনা আসে। মনে হয়েছে, ২০০ বছর পর আবারও যেন সিরাজউদ্দৌলাই বঙ্গবন্ধু নামে ফিরে এসেছেন। সব নির্দেশনাই ছিল বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ওই ভাষণে। তা শুনে বাঙালি হিসেবে প্রবলভাবে আবেগতাড়িত হই। বুঝে যাই কী করতে হবে।”

সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে তখন অনেক অস্ত্র ছিল। কেননা গাজীপুরে সমরাস্ত্র কারখানায় আধুনিক চায়নিজ রাইফেল তৈরি হতো। একাত্তরে বাঙালি সেনাদের প্রতিরোধ ঠেকাতে ১৫ মার্চের মধ্যে তাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অস্ত্র জমা পড়ে না। ১৯ মার্চ ঢাকা থেকে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত একটি সেনাদল নিয়ে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে আসেন পাঞ্জাবি ব্রিগেড কমান্ডার জাহান জেব।

এদিকে জয়দেবপুরে সাধারণ মানুষ ও নেতাদের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ হয় সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। ফলে তাদের নিরস্ত্র করার খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা স্থানীয় জনসাধারণকে নিয়ে তখন পথে নামেন। ওইদিন ছিল হাটবার। হাজার হাজার মানুষ দেশি বন্দুক, রাম দা, বটিসহ যার কাছে যা ছিল তা নিয়েই জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টের নিকটস্থ রেলগেইটের সামনে ব্যারিকেড দেয়।

এ অবস্থা দেখে জাহান জেব কৌশল আটেন। ঘটনাস্থলে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি সেনাদের ঢাল হিসেবে সামনে দিয়ে পেছনে তিনি অবস্থান নেন এবং গুলির নির্দেশ দেন। কিন্তু বাঙালি সেনারাও কৌশলে জনতার দিকে অধিকাংশই ব্ল্যাংক ফায়ার (ফাঁকা গুলি) করে। ফলে হতাহত কম হয়। এরপর আধঘণ্টার মধ্যেই সকল ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলা হয়। এ অবস্থা দেখে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা ত্যাগ করে জাহান জেবের বাহিনী ঢাকার দিকে ফিরতি পথ ধরে। কিন্তু পথেই চন্দনা চৌরাস্তাতে তারা জনতার ব্যারিকেডের ভেতর পড়ে যায়। সেটি অপসারণ করতে গেলে হুরমত নামে এক খ্যাতিমান ফুটবলার এক পাঞ্জাবি সেনার রাইফেল কেড়ে নেয়। অন্য পাকিস্তানি সেনারা তখন তার মাথায় গুলি করে। হুরমত ওখানেই শহীদ হন। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ওই জায়গায় এখনও জাগ্রত চৌরঙ্গী স্মৃতিস্তম্ভটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

এরপর কী ঘটল? সে ইতিহাস শুনি জয়দেবপুর ব্যারাকে থাকা আবদুল হাকিমের মুখেই।

তার ভাষায়, “২৬ মার্চ ১৯৭১। ব্যারাকে ছিল ৭০ জন অবাঙালি পাঞ্জাবি ও পাঠান সেনা। ওদের কী করা হয়েছে সেটা ছিল আর্মির গোপন বিষয়। আমার ছেলের বয়স তখন দশ মাস। স্ত্রী ও সন্তানকে রেখেই সফিউল্লাহ সাহেবের স্কোয়ার্ডের সাথে বেরিয়ে চলে যাই ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে। পরে নরসিংদী হয়ে ভৈরবে বিশ্ব গোডাউনে পজিশন নিই।

এক ব্যাটেলিয়ানে প্রায় ৭৯৯ জন ছিলাম। সেখানে আমাদের পজিশন ছিল নদীর ধারে। ৪টা পাকিস্তানি যুদ্ধ বিমান বোম্বিং করেও কিছু করতে পারেনি। কারণ খুব পোক্তভাবে ওই গোডাউনটি তৈরি করেছিল জাপানিরা। পাকিস্তানিরা তখন হেলিকপ্টারে করে আমাদের ঠিক পেছনে সেনাদের নামিয়ে দেয়। শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। ওই যুদ্ধেই সুবেদার সিরাজুল ইসলাম শহীদ এবং নাসিম সাহেব আহত হন।

এরপর শাহাবাজপুর হয়ে আমরা সরে যাই মাধবপুরে। পাকিস্তানি সেনারা মাধবপুরের দিকে এগোলে আমরা সিলেটের দিকে অবস্থান নিই। ওদের সঙ্গে গোলাগুলি চলতেই থাকে। মেশিনগান চালাতাম। সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গলে হাতিয়ার সেকশনের কমান্ডারও ছিলাম। ওরা এক সময় মাধবপুরের ডিফেন্স ছেড়ে দিলে এগিয়ে এসে আমরা মাধবপুরেই পজিশনে থাকি।

ওইসময় সুবেদার নূর ইসলাম একদিন বাঙ্কার থেকে আমাকে সরিয়ে নিয়ে অন্য এক ছেলেকে ডিউটি দেয়। আমি উঠে আসার পরেই ওই বাঙ্কারে পাকিস্তানিদের আর্টিলারি শেল এসে পড়ে। অল্পের জন্য বেঁচে যাই। কিন্তু ডিউটিতে থাকা ছেলেটি শহীদ হয়। এভাবে কখন কে মারা যাবে একাত্তরে তার কোনো গ্যারান্টি ছিল না।”

মাধবপুরে থাকতেই আবদুল হাকিম পরিবারের খোঁজ নিতে ছুটি পান।

এরপর কোথায় গেলেন?

হাকিম বলেন, “নেত্রকোনা থেকে ট্রেনে আসি ময়মনসিংহ। ব্রিজের ওপর পাঞ্জাবিদের তল্লাশি চলছিল। সবাইকে চেক করলেও আমার কাছে এসেই কেন জানি তারা চলে যায়। এভাবে আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দেন। পরে ময়মনসিংহ কালিবাড়ি রোডে চাচাতো ভাইয়ের বাসায় এক রাত থাকি। সকালেই জামালপুরের দিকে রওনা হই, কখনও হেঁটে কখনও রিকশায়। রশিদপুর পাকুল্লা নামে একটা গ্রামে রাত্রিযাপন করে পরদিন আসি ধনবাড়ি।

দিনটা ছিল মঙ্গলবার। আমার জেঠাত ভাইয়ের ছেলেকে বিয়ে করেছে ধনবাড়িতে, ছলিম মাস্টারের মেয়েকে। ওই বাড়িতে এসে ছলিম মাস্টারের ছেলে শাহজাহানের মুখেই শুনি, আমার স্ত্রী ও সন্তানকে বাবা ও শ্বশুর খুঁজে এনেছে। কী যে আনন্দ লেগেছে শুনে!”

হাকিম তখন থাকেন শ্বশুরবাড়িতে, গোপালপুরের জাওয়াইলে। পাঞ্জাবিরা তার খোঁজ করতে থাকে। কাদের সিদ্দিকীও ছিলেন গোপালপুরে, সুতি নামক স্থানে। খবর পেয়ে হাকিম তখন গিয়ে কাদেরীয়া বাহিনীতে যোগ দেন।

তিনি বলেন, “কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আসি ভুয়াপুরে (ভুঞাপুর)। সেখান থেকে এক রাতে নৌকায় রওনা হই দেওপাড়ার দিকে। চাঁদের আলোয় পানি ঝলমল করছিল। গভীর পানি ও কম পানি বোঝা যায় না। পথ ভুলে করে কালিহাতির উত্তরে একটা ব্রিজের নিচে চলে আসি আমরা। ওখানে পাঞ্জাবি ও রাজাকারদের পাহারা ছিল। টের পেয়ে ওরা ফায়ার শুরু করে। কাদের সিদ্দিকী একটা নৌকা নিয়ে সরে যান। আমার নৌকাও তীরে ভেড়ে। যে যার মতো আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে। কিন্তু অন্ধকারে আমি কিছুই চিনতে পারি না।

কী করব তখন? এর মধ্যে আমজাদ নামে একটা ছেলে আসে। সে বলে, ‘তুমি কই থেকে আইলা। সবাই তো রাইফেল থুইয়া পালায়া গেছে।’ তখন ওকে দুইটা ও আমি দুইটা রাইফেল নিয়ে এক বাড়িতে আসি। বৃষ্টির কারণে বাঙ্কারে থাকা পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা তখন উঠে গেছে। ফলে আমরা নিরাপদে ওই রাস্তা পার হয়ে এক মাইল দূরে এক হিন্দু বাড়িতে আশ্রয় নিই। পরে রাইফেলসহ কাদের সিদ্দিকীর কাছে রির্পোট করি দেওপাড়ায়।

তিনি খুশি হয়ে ওইদিনই আমাকে কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব দেন। অস্ত্র ছিল রাইফেল, স্টেনগান আর গ্রেনেড। কারণ তখনও ভারত থেকে কোনো অস্ত্র পাইনি। থানাগুলোতে আক্রমণ করে অস্ত্র সংগ্রহ করে তা দিয়েই যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পরে ভারত থেকে অনেক অস্ত্র পাই। হাকিম কোম্পানি নামেই সবাই চিনত। অপারেশন করেছি দেওপাড়া, ধলাপাড়া, সরাবাড়ি, সাগরদীঘি প্রভৃতি এলাকায়। পাঞ্জাবিরা যেদিকে যাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। এটাই ছিল কাদেরীয়া বাহিনীর নির্দেশ। অ্যাম্বুশ করে ওদেরকে ঘায়েল করতাম আমরা।”

সাগরদিঘীতে এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের থ্রি-ইঞ্চ মর্টারের স্প্লিন্টারে রক্তাক্ত হন আবদুল হাকিম। কীভাবে? তিনি বলেন, “১৭ অগাস্টের ঘটনা। পাকিস্তানি সেনারা এক রাস্তা দিয়া সাগরদিঘীর দিকে অগ্রসর হয়। আমরা ওদের ঠেকানোর চেষ্টা করি। পাহাড়ি পথ। অ্যাম্বুশ করি রাস্তার উত্তর পাশে। ওরা আসলে গোলাগুলি শুরু হয়। তখনই বোমিং শুরু করে। থ্রি-ইঞ্চ মর্টারের একটি স্প্লিন্টার এসে লাগে আমার পিঠের ডান সাইডে। পিঠের কিছু অংশ কেটে সেটা বেরিয়ে যায়। ভেতরে ঢুকলে হয়তো বাঁচতে পারতাম না। প্রথমে বুঝি নাই। রক্ত পড়ছিল ক্রমাগত। সঙ্গে ছিল আবুল হোসেন নামে এক ডাক্তার। পিঠে জখমের প্রাথমিক চিকিৎসা তিনিই করেন।”

কাদের সিদ্দিকী আহত হয়ে চলে যান ভারতে। লোক মারফত তিনি খবর পাঠান, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। হাকিমরা তখন জামালপুরের গারামারার চর হয়ে চলে যান ভারতে। তুরাতে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করেন। সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে তারা চলে আসেন মানকাচরে। কাদের সিদ্দিকীর নিকট থেকে বিদায় নিয়ে অস্ত্র বোঝাই ১৮টি নৌকা নিয়ে রওনা হন হাকিমরা। পথিমধ্যে ঝড়ে একটা নৌকা নদীতে ডুবে যায়। ২৪ সেপ্টেম্বরে বাকি নৌকাগুলো নিয়ে তারা চলে আসেন চর কবরিবাড়ি, সরিয়াবাড়িতে। কাদের সিদ্দিকী আগেই চলে আসেন এবং তার নির্দেশেই কাদেরীয়া বাহিনী আবার আক্রমণ শুরু করে।

রণাঙ্গণের একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশনের কথা শুনি বীরপ্রতীক আবদুল হাকিমের মুখে।

অকপটে তিনি বলেন, “স্বাধীনতা লাভের কয়েকদিন আগের ঘটনা। আমরা তখন মোগলপাড়া স্কুলে। খবর আসে টাঙ্গাইল থেকে পাঞ্জাবিরা ময়মনসিংহের দিকে যাবে। ইছাপুরায় ওদের ঠেকাতে হবে। রাত তখন চারটা হবে। মোগলপাড়া থেকে রওনা হয়ে দ্রুত ইছাপুরায় গোরস্তানে এসে পৌঁছি। সঙ্গে ছিল থ্রি-ইঞ্চ মর্টার। যার একটা অংশ ৭৫ পাউন্ড, একটা ৬৫ পাউন্ড ও আরেকটা ৪৫ পাউন্ড। অন্যান্য আর্মস ও অ্যামুনেশনও ছিল।

গোরস্থানের উত্তর পাশে ছিল একটা কাঠাল গাছ। ওখানেই থ্রি-ইঞ্চ মর্টার সেট করি। ১৯৫০ গজ হলো ওই মর্টারের রেঞ্জ। যেই দিকেই দিই ওটা ওই রেঞ্জে গিয়েই পড়বে। আর ওদের ট্রাকের গতির কোনো হিসেব জানা ছিল না। মর্টার সেট করার সঙ্গে সঙ্গে দেখি পাকা রাস্তা দিয়ে পাঞ্জাবি বোঝাই কয়েকটা ট্রাক আসছে। তখন মজনুকে বললাম একটা বোমা ফায়ার কর। বোমা ওদের চলন্ত ট্রাকের ওপর গিয়ে পড়ে। ফলে ট্রাকটা উল্টে যায়। পেছনে থাকা ট্রাকও থেমে যায়। আমরা ক্রমাগত বোমা ও গুলি করতে থাকি। চারদিকে আগুন আর আগুন। ফলে ভয়ে পাঞ্জাবিরা আর অগ্রসর হতে পারে না।

পরে পেছন দিক থেকে গাড়ি নিয়ে আসে ভারতীয় বিগ্রেডিয়ার সন্দ সিং বাবাজি। তিনি এসে আমাদের থ্রি-ইঞ্চ মর্টারটি দেখলেন। মর্টারের টেলিস্কোপ সাইড নাই, ডিগ্রি উঠানামারও কোনো কিছুই নাই। শুধু একটা ট্রাইপড আছে। এ অবস্থায় কীভাবে ফায়ার করা সম্ভব! তিনি অবাক হলেন।

আমাকে ডেকে বললেন, ‘হাউ হ্যাভ ইউ ফায়ার।’

আমি বলি, ‘ওপিজি গড।’ মানে আল্লাহ নিজেই অবজারবেশন পোস্টে কাজ করেছেন।

শুনে তিনি পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘সাব্বাশ বাঙালি।’ তার এই কথাটা এখনও কানে বাজে।”

স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্দি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। এ কারণে কাদেরীয়া বাহিনী ঘোষণা দেয়, বঙ্গবন্ধু ফিরে না আসা পর্যন্ত তারা অস্ত্র জমা দেবেন না। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ২৪ জানুয়ারি তার কাছে অস্ত্র জমা দেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। টাঙ্গাইল শহরের বিন্দুবাসিনী স্কুল প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন এই বাহিনীর বীর সদস্যরা। ওইদিন বীরপ্রতীক আবদুল হাকিম ছিলেন অস্ত্র জমাদানকারী যোদ্ধাদের কমান্ডার।

ঐতিহাসিক অস্ত্র সমর্পণের কথা তিনি তুলে ধরেন ঠিক এভাবে, “টাঙ্গাইল শহরের মুখে শিবনাথ হাইস্কুল মাঠে জাহাজ মারা কমান্ডার মেজর হাবিব বীরবিক্রমের নেতৃত্বে আমরা প্রায় ১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদান করি। এরপর তিনি আসেন বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে। মাঠের উত্তর পাশে মঞ্চ আর পশ্চিমে কয়েক হাজার অস্ত্র থরে থরে সাজিয়ে রাখা ছিল। পাশেই তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। অস্ত্র জমাদানকারী যোদ্ধাদের কমান্ডার ছিলাম আমি নিজেই।

আমার কয়েক গজ সামনে দাঁড়িয়ে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রশাসক আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম। সামনে মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পাশে প্যারেডের দিকে মুখ করা কাদের সিদ্দিকী ও আনোয়ার আলম শহীদ। অনুমতি নিয়ে প্রথমে প্যারেডকে সর্তক করি। এরপর পাকিস্তানি পুলিশ থেকে উদ্ধার করা কাদের সিদ্দিকীর ব্যবহৃত ব্যাটাগানটি এনায়েত করিমের হাতে দিলে তিনি মঞ্চে উঠে তা কাদের সিদ্দিকীর কাছে পৌঁছে দেন। কাদের সিদ্দিকী হাঁটু গেড়ে অবনত মস্তকে জাতির পিতার পায়ের কাছে রাখেন তার অস্ত্রটি।

আমরাও তখনই ডান পাশে অস্ত্র রেখে এক পা বামে সরে দাঁড়াই। বঙ্গবন্ধু অস্ত্রটি তুলে আনোয়ার আলম শহীদের হাতে দিয়ে কাদের সিদ্দিকীকে জড়িয়ে ধরেন। এরপর কাদের সিদ্দিকী ও বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে আবেগঘন ভাষণ দেন। তাদের বলা কথাগুলো মনে হলে এখনও আবেগতাড়িত হই। ভুয়াপুরে জাহাজ মারার আর্মস অ্যামুনেশনসহ ওইদিন কাদেরীয়া বাহিনীর ৪০ গাড়ি অ্যামুনেশন আর ৩০ গাড়ি আর্মস জমা দেওয়া হয়েছিল।”

দেশটা ভাল চললে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হন মুক্তিযোদ্ধারা। এমনটাই মনে করেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাকিম। স্বাধীন দেশ নিয়ে কষ্টের কথাও অকপটে বলেন এভাবে, “যেখানেই যাই স্বার্থ। স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না এখন। এমনটা তো চাইনি।”

কী করলে দেশ আরও এগোবে?

তিনি বলেন, “মানুষের মধ্যে সৎ কর্ম, সৎ সাহস, সৎ চিন্তা, সৎ ইচ্ছা, ন্যায়পরায়ণতা ও অল্প সন্তষ্টি– এগুলো যদি থাকে তাহলেই দেশ এগোবে। কম খাই, কিন্তু যেন হারাম নামের কোনো জিনিস না খাই। যদি মানুষ সত্যের দিকে ধাবিত হয়, সত্যকে যদি আকড়ায়া থাকে, তাহলেই দেশ এগোবে।”

প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে এই বীরপ্রতীক বলেন, “একাত্তরে দেশের জন্য তিন-চারদিন না খেয়েও ছিলাম। নয় মাস পায়ে জুতা পরি নাই। এর মধ্যে নামাজও পড়েছি। তাদের তো জানাতে হবে মুক্তিযোদ্ধারা কতটুকু কষ্ট কইরা তাদের জন্য এই দেশ স্বাধীন করছে। এটা না জানলে তারাও দেশের জন্য ত্যাগী হতে পারবে না।”

বাংলাদেশের মানুষ অনেক জ্ঞানী বলে মনে করেন এই সূর্যসন্তান। এ কারণেই যেকোনো দেশেই আমাদের সন্তানদের ওরা নাগরিক করে রেখে দেয়। তাই প্রজন্মকে নিয়ে পাহাড়সম আশা যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাকিম বীরপ্রতীকের। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন শেষ কথাগুলো, ঠিক এভাবে, “যদি সৎ নিয়ত, অল্প সন্তষ্টি আর সততা থাকে তাহলে দেশের উন্নতি হবে। তোমরা সে পথেই থেক। অনুরোধ রইল তোমরা সোনার বাংলাকে ছেড়ে যেও না। এই দেশটাকে ভালো রেখ। তোমাদের প্রতি দোয়া থাকবে সবসময়।’

ছবি: সালেক খোকন