মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ আমাদের কী সংকট বাড়াবে?

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরাকানরা সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশের উচিত এদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক যোগাযোগ তৈরি করা।

মঞ্জুরে খোদামঞ্জুরে খোদা
Published : 9 Feb 2024, 06:05 PM
Updated : 9 Feb 2024, 06:05 PM

যুগ যুগ ধরে যে দেশটিকে আমরা বার্মা বলে জেনেছি ১৯৮৯ সালে সামরিক সরকার এর নাম পরিবর্তন করে রাখে মিয়ানমার। রাজধানী রেঙ্গুনের নাম বদলে রাখা হয় ইয়াঙ্গুন। ২০০৫ সালে ইয়াঙ্গুনের বদলে দেশের রাজধানী করা হয় নেপিদোকে। 

মিয়ানমারে মোট জনসংখ্যার ৬৮ ভাগ বামার হলেও সেখানে অন্যান্য জনগোষ্ঠী আছে আরও ৩২ ভাগ  (৯% শান, ৭% কারেন, ৪% রাখাইন, ৩% বর্মী চীনা, ২% বর্মী ভারতীয়, ২% মোন এবং ৭% অন্যান্য) । ছোট-বড় ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে মিয়ানমার গঠিত। এর বাইরেও বেশ কিছু জাতিগোষ্ঠী আছে, মিয়ানমার সরকার যাদের নিজেদের জনগোষ্ঠী বলে স্বীকার করে না। যেমন রোহিঙ্গা, অ্যাংলো বার্মিজ, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, বার্মিজ ইন্ডিয়ানদেরকে তারা অস্বীকার করতে চায়। স্বীকৃত-অস্বীকৃত প্রায় দেড়শ জাতিগোষ্ঠী ৮টি প্রধান ভাগে বিভক্ত। এই ভাগাভাগি জাতিগত নয়, হয়েছে প্রদেশভিত্তিক। তবে শাসকদল, সরকার-প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে বামার বা বর্মীদের অবস্থান-প্রাধান্য অধিক।

মিয়ানমারের অবস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে। আকৃতিতে দেশটি বাংলাদেশের প্রায় চারগুণ, জনসংখ্যায় চার ভাগের এক ভাগ। বাংলাদেশ ছাড়াও মিয়ানমারের সঙ্গে আছে ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, লাওস ও থাইল্যান্ডের দীর্ঘ সীমানা। 

হাজার বছর ধরে মিয়ানমারকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী শাসন করেছে। তবে দেশটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল ১২৪ বছর (১৮২৮-১৯৪৮)। তবে এর মধ্যে তিন বছর (১৯৪২-৪৫) তারা জাপানের দখলে ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মিয়ানমার মাত্র ১২ বছর বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে ছিল। বাকি সময় সামরিক সরকার দেশটি শাসন করেছে।

ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছর অং সানের নেতৃত্বাধীন অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট পিপলস ফ্রিডম লিগ (এএফপিএফএল) মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতায় ছিল। ১৯৫৮ সালে এএফপিএফএল-এ ভাঙন হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। ১৯৯০ সালে মিয়ানমারের নির্বাচনে অং সান সুচির দল 'ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি' বা এনএলডি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সেনাবাহিনী ওই ফল বাতিল করে দেয়। এরপর দেশটি ফের সামরিক জান্তার হাতে চলে যায়। বিরোধীদের আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক চাপ-নিষেধাজ্ঞাও সেনাশাসককে টলাতে পারেনি।

বর্তমান সংকটের শুরু ২০২০ সালে অং সান সুচির ক্ষমতাগ্রহণের মাধ্যমে। সুচি ক্ষমতাগ্রহণের পর তার সরকার ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার যে সংবিধান প্রণয়ন করে সেনাবাহিনী তা পছন্দ করেনি। তখন থেকেই তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ২০২১ সালে সুযোগ বুঝে তারা সুচিকে ক্ষমতাচ্যুত ও কারাগারে আটক করে।

মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীকে আস্থায় নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলেও সে পথে হাটেননি সুচিও। তিনিও সেনাবাহিনীর সঙ্গে নানাভাবে বোঝাপড়া করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিপীড়ন ও নিধনে তিনিও সামিল হয়েছেন। 

গত তিন বছরে রাজনৈতিক ও জাতিগত সংঘাত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশটির ২৬ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিকভাবে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে। এর অর্ধেক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ সময়ে মিয়ানমারের অর্থনীতিতেও ধস নেমেছে। জ্বালানির দাম প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য পণ্যের দামও লাগামহীন। গৃহযুদ্ধ অনিবার্য হয়েছে।  

২০২১ সালে ক্ষমতাচ্যুত এনএলডির নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়ী সদস্যরা জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে, যাকে সংক্ষেপে এনইউজি বলা হয়। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও এতে যোগ দেয়। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলে তারা প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে এবং সব গোষ্ঠীর সমন্বয়ে ‘পিপল ডিফেন্স ফোর্স’ গঠন করে।

সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ নতুন মাত্রা পায় উত্তরাঞ্চলের তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী এক হয়ে আক্রমণ শুরুর পর। ২০২৩-এর অক্টোবরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর একজোট হয়ে সুসংগঠিতভাবে হামলা চালায় দেশটির উত্তরের শান রাজ্যের জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী, যাদের একসঙ্গে ডাকা হচ্ছে 'থ্রি গ্রুপ অ্যালায়েন্স' নামে। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) নিয়ে এই জোট গঠন করা হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হচ্ছে আরাকান আর্মি (এএ)। যাদের সবকিছু নিয়মিত সেনাবাহিনীর আদলে গড়ে তোলা। এ গ্রুপগুলো দেশটির পশ্চিম-উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে। 

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত গ্রুপগুলো মিয়ানমারের বিভক্তির পক্ষে নয়। তাদের দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও দেশটিকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত করা। যে  দাবি তারা ১৯৪৮ সাল থেকে করে আসছে।  

পর্যবেক্ষকদের ধারণা, মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর সবচেয়ে কঠিন অবস্থা পার করছে এখন। এমন সংকটে তাদের আগে কখনো পড়তে হয়নি। গত আড়াই বছর দমন-পীড়নের মাধ্যমে যতটা চাপমুক্তভাবে জান্তা ক্ষমতায় ছিল এখন সেই পরিস্থিতি নেই। চিত্র অনেক পাল্টে গেছে।

চলমান গৃহযুদ্ধে মিয়ানমান কি তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে? এখনো এ প্রশ্নে চূড়ান্ত কিছু বলার সময় আসেনি। রাজধানীসহ প্রধান শহরগুলোতে এখনো এ যুদ্ধের কোনো আঁচ পড়েনি। দেশটির মধ্যাঞ্চল সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বৃহৎ জনগোষ্ঠী বর্মীদের অবস্থান এখানেই। সে কারণে শিগগিরই বা যে কোন সময় জান্তা সরকার ক্ষমতা হারাবে বা নিয়ন্ত্রণহীন হবে সেটা বলা যায় না। সেনাবাহিনী নিয়ে বিভিন্ন কথা শোনা গেলেও সেখানেও কোনো স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়নি। জান্তা বিরোধীদের একটা বড় সীমাবদ্ধতা তাদের মধ্যেও কোনো একক নেতৃত্ব নেই। গেলিরাদের মধ্যে সুচির সেই আগের ভাবমূর্তি-প্রভাব নেই।  

মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করছে এমন একটি সংগঠন 'স্পেশাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার'-এর বক্তব্য সামরিক সরকার 'পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ' করছে মাত্র ১৭ শতাংশ ভূখণ্ড, ২৩ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দখলে রয়েছে ৫২ শতাংশের মতো ভূখণ্ড। থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম ইরাবতী বলছে, সামরিক বাহিনী জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশে ৩৩টি শহরের দখল হারিয়েছে। এর মধ্যে চিন, সাকাই, কিয়াং প্রদেশ এবং উত্তরাঞ্চলের শান এবং শিন রাজ্য উল্লেখযোগ্য।

এই সময়ে বিদ্রোহীদের আক্রমণে টিকতে না পেরে শত শত সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এ সংখ্যা প্রায় তিনশ। শুধু বাংলাদেশ নয় ভারত, চীনসহ অন্যান্য দেশেও প্রবেশ করেছে। বিনা অনুমতিতে আরেকটি দেশের সীমানায় ঢুকে পড়াকে ‘অনুপ্রবেশ’ বলে। সেই হিসেবে মিয়ানমারের এই সব নাগরিক অনুপ্রেবেশকারী। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় এদেরকে তা বলা যাচ্ছে না, কেননা মানবিক কারণে তাদেরকে আশ্রয় দিতে হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই সংখ্যা এখন শতের কিন্তু তা আরও বেড়ে যে লাগামহীন হবে না সে নিশ্চয়তা কোথায়? রোহিঙ্গাদের বিষয়টিও তো এমন ছিল কিন্তু বাস্তবতা কি তাই বলে? সেই সময় জাতিসংঘ, পশ্চিমাদের চাপে সরকার মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু আজ তাদের ফিরিয়ে নেয়ার কোনো আলাপ-প্রক্রিয়া নেই। বাংলাদেশই একটি বিশাল জনসংখ্যার দেশ তার মধ্যে বাড়তি প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে কি আশ্রয় দেয়ার বাস্তবতা আছে?  

শুধু তাই নয় এর সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এমনকি ভারতও এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখছে না। আঞ্চলিক নানা বিষয়ে চীন-ভারতের দ্বন্দ্বও বহু পুরানো। জাতিসংঘ, পশ্চিমারাও নীরব। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকেই তাদের কৌশল ও করণীয় ঠিক করতে হবে।   

খবরে প্রকাশ, আরাকান আর্মিরা বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য দখল করে নিয়েছে। সামরিক বাহিনী ক্রমশ পরাজয়ের মুখে পড়ছে এবং দখলকৃত ভূখণ্ড ফিরে পেতেও ব্যর্থ হচ্ছে। সেটা হলে বাংলাদেশের জন্য ভিন্ন বাস্তবতা তৈরি হবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরাকানরা সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশের উচিত এদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক যোগাযোগ তৈরি করা।

বাংলাদেশকে মিয়ানমারের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও জাতীয় সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক-সংযোগ গড়ে তুলতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফর করেছেন। তার সফরের আগে ভারতের নিরাপত্তা প্রধান বাংলাদেশ ঝটিকা সফর করে গেছেন। ধারণা করা হচ্ছে এই সব যোগাযোগ ও দৌড়ঝাপের প্রধান কারণ মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেদের করণীয় ও কৌশলগত অবস্থান। বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতি একটা বড় ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

ভূ-রাজনৈতিক কারণ-সমীকরণে চীন-রাশিয়া সামরিক জান্তাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তারা সেখানে পশ্চিমা শক্তির প্রবেশ ঠেকাতে চায়। সরকার এবং বিদ্রোহী দু-দিকেই তাদের সংযোগ, সমর্থন রেখেছে চীন। মিয়ানমারের প্রান্তিক অঞ্চলজুড়ে আছে চীনের বিপুল বিনিয়োগ ও বাণিজ্য। তাকে নিরাপদ করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। 

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ হচ্ছে চরম ভুক্তভোগী। এখানেই সন্ধান করতে হবে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ। কারও ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজস্ব কূটনীতি-কৌশল দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার ও সংকটমুক্ত হয়ে বিপদ কাটাতে হবে। এখানেই বর্তমান নেতৃত্বের দক্ষতা ও দূরদর্শিতা প্রদর্শনের একটি বড় পরীক্ষা।