আমাদের প্রশ্ন, এ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে কি শুধুই তা দালিলিক করে রেখে দেওয়ার জন্য? কেবিনেটের অনুমোদন দেওয়ার একযুগের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আজও কেন এটি কার্যকর হলো না?
Published : 06 Feb 2024, 05:32 PM
রাষ্ট্রের কাছে প্রতিবন্ধী মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কিংবা জাতীয় সংসদের সদস্য পদে তাদের মনোনয়ন দেওয়া যেন ‘অবাস্তব এক চাহিদা’র নাম। যদিও এই অধিকার নিশ্চিতের দাবি দীর্ঘদিনের।
প্রথম এই দাবি বাস্তবায়নের পথ খোলে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ বাস্তবায়নকল্পে করা জাতীয় কর্মপরিকল্পনা-২০১৩ এর মাধ্যমে। সেখানে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অংশে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের মধ্যে সংসদে ন্যূনতম দুটি আসন প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য বরাদ্দের আশ্বাস ছিল। কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেছে। এ নিয়ে আলোচনা আর নীতিমালায় দেওয়া ওই আশ্বাস ব্যতীত লক্ষ্য পূরণে কোনো অগ্রগতিই পরিলক্ষিত হয়নি। প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই মূলত এর জন্য দায়ী। রাষ্ট্রে সামগ্রিকভাবে তো বটেই, এমনকী নারী সমাজেও প্রতিবন্ধী নারীরা উপেক্ষিত।
২০১৩ সালে জুলাই মাসে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখার শিরোনাম মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংসদে সংরক্ষিত আসনের দাবি; সমাজকল্যাণ মন্ত্রী বললেন অবাস্তব’। তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর বক্তব্যে রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি জেঁকে বসা নেতিবাচকতাই যেন প্রকাশ পেয়েছিল। অথচ একই বছর নারীর জন্য গৃহীত কর্মপরিকল্পনায় সংসদে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য সংরক্ষিত দুটি আসন বরাদ্দের আশ্বাস কেবিনেটের অনুমোদন পায়। একই আশ্বাস আবারও মেলে ২০১৯ সালে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ এর ধারা-১৬ (১) ছ এর আলোকে এ বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা-২০১৯ এর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণ সংক্রান্ত ধারায় (৫-গ) সেই পুরনো আশ্বাস। এই ধারায় সংসদে সংরক্ষিত দুটি আসনে প্রতিবন্ধী নারীকে রাখার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এর সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কোটা বরাদ্দের বিষয়সহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি (পুরুষ ও নারী) উভয়ের জন্যেই জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ ও সদস্যপদ বাস্তবায়নের কথাও ছিল।
দুই কর্মপরিকল্পনাতেই মধ্যমেয়াদী (২০১৮-২০) এবং দীর্ঘমেয়াদী (২০১৮-২৫) পরিকল্পনায় এইসব আশ্বাস বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এ সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগ কি দেখা গেছে?
দেড় দশক এক মতাদর্শের সরকারই ক্ষমতায় রয়েছে। এমন না যে, এক সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অন্য সরকার এসে চোখ বুজে আছে। সবই হচ্ছে। স্বল্প আয়ের দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে, অর্থনীতির আকার প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। কেবল একের পর এক আইনি নীতিমালাই হচ্ছে, কিন্তু কাজীর গরু শেষ পর্যন্ত কেতাবেই থাকছে।
কেবল কী দেশের ভেতরকার জাতীয় নীতিমালা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারও রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে বলা যেতে পারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ সিআরপিডি-র কথা। এখানে প্রতিবন্ধী মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজিতেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১-এর প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে হওয়া জাতীয় নারী কর্মপরিকল্পনায় জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের ন্যূনতম দুটি আসন (ধারা-৩২.৭) প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য বরাদ্দের লক্ষ্যে কার্যক্রম সমন্বয় করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল— মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ, জাতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশনসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে। কিন্তু এদের কাউকেই এ সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এই কর্মপরিকল্পনাটির সকল সিদ্ধান্ত গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন, এ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে কী শুধুই তা দালিলিক করে রেখে দেওয়ার জন্য? কেবিনেটের অনুমোদন দেওয়ার একযুগের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আজও কেন এটি কার্যকর হলো না?
নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশকে অনেকেই মডেল বলছেন। কিন্তু সেখানেও প্রতিবন্ধী নারীরা উপেক্ষিত। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি, সকল রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে নারীর ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। নিঃসন্দেহে নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র কাঠামোর উচ্চ পর্যায়ে নারীর প্রতিনিধিত্ব দৃশ্যমান হয়েছে।
কিন্তু এ সুফলের ভাগ প্রতিবন্ধী নারীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না কেন? প্রতিবন্ধী নারী কি তবে নারীর মধ্যে পড়ে না? কেন প্রতিবন্ধী নারীরা কেবল নীতিমালাতেই থেকে গেল? প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক নীতিনির্ধারকরাও কেন বেমালুম তাদের ভুলে গেলেন? এই দায় কার?
জাতীয় সংসদ (সংরক্ষিত মহিলা আসন) নির্বাচন আইন-২০০৪ এর সর্বশেষ সংশোধিত গেজেট প্রকাশিত হয় গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। এতেও প্রতিবন্ধী নারীদের প্রসঙ্গ আমলে নেওয়া হয়নি। বর্তমান বা পূর্বের সংসদে বিভিন্ন সম্প্রদায়, জাতিসত্তা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংরক্ষিত আসন দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার প্রবণতা দেখা গেছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অথবা প্রতিবন্ধী নারীর প্রতিনিধিত্বকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নেই। তাদেরকে দেখা যায় না। কিংবা তারা চক্ষুশূল। কেন?
বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগ প্রতিবন্ধী মানুষ। সেক্ষেত্রে এদেশে প্রায় দুই কোটি প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে। যার অর্ধেকই প্রতিবন্ধী নারী। অর্থাৎ প্রায় এক কোটি প্রতিবন্ধী নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিষয়টি কেন গুরুত্ব পাচ্ছে না, এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
কোভিড পরবর্তী প্রেক্ষাপটে আমরা প্রতিবন্ধী মানুষরা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি, আরও পিছিয়ে পড়ছি। নানা অজুহাতে আমলাতন্ত্রও আমাদের ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের কাছে চাইলেও আমরা পৌঁছুতে পারি না। সংসদে দাঁড়িয়ে যদি নিজেদের অধিকারের দাবি পূরণে বা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে না পারি, কোথায় গিয়ে চাইব অধিকার?
আমরা প্রতিনিয়ত বৈচিত্র্যময় সমাজকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলি। কিন্তু মানববৈচিত্র্যের অংশ প্রতিবন্ধী মানুষকে কেন মনে রাখি না? জাতীয় সংসদের আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকেরা Disability Lens দিয়ে কবে থেকে দেখতে শুরু করবেন? এই প্রসঙ্গে সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের দৃপ্ত পদক্ষেপকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। এসডিজি ৫.৫.১ অংশে বলা হয়েছে, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত নারী আসনের অনুপাত নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা ভালো, এসডিজি বাস্তবায়নের মূল শর্তই হলো ‘কাউকে বাদ রেখে নয়’।
এ লক্ষ্য পূরণে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরকে একীভূত করার প্রসঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রসঙ্গ এলে এনজিও বা সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর শব্দচয়নের ক্ষেত্রে ‘একীভূত অংশগ্রহণের’ পরিবর্তে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ শব্দটি বেশি উচ্চারিত হয়। শুভঙ্করের এই ফাঁকি থেকে আমরা কী আদৌ বের হতে পারবে?
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রতিবন্ধী নারীর জন্য সংরক্ষিত দুটি আসন থাকার প্রসঙ্গে কেবিনেট থেকে একটি নয় দুটি গেজেটেড নীতিমালা প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের হাতে এতে বড় দুটি শক্তিশালী হাতিয়ার থাকার পরও প্রতিবন্ধী নারী নেতৃবৃন্দকেও এই বিষয়ে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যাচ্ছে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, দশম জাতীয় সংসদে বরগুনা থেকে নাসিমা ফেরদৌস আপা হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধী নারী হিসেবে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হলেও প্রতিবন্ধী মানুষের সাথে তার সরাসরি কোনো সংযোগ ছিলে না। প্রতিবন্ধী মানুষের সাথে কাজের অনভিজ্ঞতার কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকারের দাবিতে কোনো ভূমিকাও তিনি রাখতে পারেননি।
বর্তমানে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি-সদস্যের অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভোটাধিকার প্রসঙ্গে প্রতিবন্ধী মানুষেরা সচেতন হচ্ছে। সুতরাং স্থানীয় থেকে জাতীয় সংসদ সকল পর্যায়ে সকল স্তরে প্রতিবন্ধী নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা, প্রতিনিধিত্ব, নেতৃত্বসহ সর্বস্তরের কমিটিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হোক। এজন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ কাঠামোতে অর্থাৎ জাতীয় সংসদে প্রতিবন্ধী নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এজন্য প্রতিবন্ধী নারী নেতৃবৃন্দকেও অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।