রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ এ কথাটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই কারণে যে, সাধারণ মানুষের সুবিচার পাওয়ার যে জন্মগত অধিকার, বিচারের বাণী যেন নীরবে-নিভৃতে কেঁদে না-মরে! কিন্তু ছবিটা ১০০ বছরেও খুব একটা বদলায়নি।
Published : 24 Mar 2023, 11:37 AM
আমাদের দেশে আইন-আদালত-বিচার এসব নিয়ে কোনোরকম আলোচনা বা মন্তব্য করাটা অত্যন্ত ঝঁকিপূর্ণ। বিষয়টি জটিল এবং স্পর্শকাতর। অথচ প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন একটা সত্তা আছে। সেই অর্থে প্রত্যেকে মানুষই এক-একজন বিচারক। কিন্তু সমাজে যেকোনো মানুষকে বিচারক বলা যায় না। শুধু যারা আইনস্বীকৃত আদালতে চূড়ান্ত রায় বা দণ্ড ঘোষণার দায়িত্ব পালন করেন, তারাই বিচারক বা বিচারপতি।
এখানে উল্লেখ করা ভালো যে, বিচারক ও বিচারপতির মধ্যেও পার্থক্য আছে। সাধারণভাবে, নিম্নতন আদালতে যারা বিচারব্যবস্থার দায়িত্বে থাকেন, তাদের 'বিচারক' বলা হয়। পক্ষান্তরে বিচারপতিদের কেবল উচ্চ আদালত ও শীর্ষ আদালতে নিয়োগ করা হয়। সমস্ত বিচারপতিই আসলে বিচারক, কিন্তু সমস্ত বিচারক বিচারপতি নন। এ ছাড়া, যেকোনো জনস্বার্থ মামলার শুনানি কেবল মাত্র বিচারপতিরাই করতে পারেন, বিচারকরা পারেন না।
আমাদের সমাজে বিচারপতি তো বটেই, বিচারকের পদটিও অত্যন্ত সম্মানীয় পদ। বিচারকেরা বিচারালয়ে সমস্ত মামলা-মোকদ্দমার শুনানির পর দু-পক্ষের বাদানুবাদের নিরপেক্ষ বিচার করে চূড়ান্ত রায় প্রদান করেন। বিচারালয়ে একজন বিচারককে নানাবিধ ভূমিকা পালন করতে হয়। যেমন: ১. বিচারকদের প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ মন দিয়ে শুনতে হয়। ২. সংবিধানের রক্ষক হিসেবে বিচারকদের ভূমিকা পালন করতে হয়। ৩. অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত দু-পক্ষের বক্তব্যকেই গুরুত্ব সহকারে শুনতে হয়। ৪. শুনানি চলাকালে একজন নিরপেক্ষ রেফারির ভূমিকা পালন করতে হয়। ৫. সমস্ত জুরিদের নির্দেশ দিতে হয়। ৬. অভিযুক্তরা নির্দোষ না দোষী, তা খতিয়ে দেখতে হয়। ৭. দোষী প্রমাণিত হলে তাদের সাজা ঘোষণা করা। ৮. শুনানির সময় আসামিদের সাজার মেয়াদ স্থির করা। ৯. আসামিদের অধিকার সম্পর্কে তাদের সচেতন করা। ১০. প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা সংক্রান্ত নিয়মাবলি তাদের জানতে হয়। ১১. মামলাটি নিয়ে বিচারককে অনেক পড়াশোনাও করতে হয়। ১২. আদালতে চূড়ান্ত আইনি ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় চূড়ান্ত রায় ঘোষণাও বিচারককে করতে হয়। ১৩. এই রায় যাতে নিরপেক্ষ থাকে, সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হয়।
আদালত, আইন, অপরাধ ও অপরাধী নিয়ে বিচারকদের কায়কারবার। যদিও সাধারণ মানুষের এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখের নয়। সুলেখক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত নিজে বিচারক ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ছোট আদালত মানে হচ্ছে ছোটা এবং ছোটা। ছুটতে ছুটতে কালো ঘাম বেরিয়ে যাবে। তা সেই ছোট আদালতের পরে সেজ, মেজ কতো আদালত, বড় আদালতে পৌঁছে মামলার নিষ্পত্তি হতে হতে একটা জীবন বরবাদ হয়ে যায়। মামলার ঘাড়ে মামলা, আপিলের পিঠে আপিল। একবার এ-পক্ষ জেতে, ও-পক্ষ জেতে আরেকবার। ততোদিন সর্বনাশ হয়ে যায়। হয় অর্থনাশ, কর্মনাশ, ধর্মনাশ।
এসব কথা অবশ্য আমরা সবাই কম-বেশি জানি। গ্রামে-গঞ্জে এখনো কেউ কারও ওপরে ক্রুদ্ধ হলে অভিসম্পাত করেন- ‘তোর ঘরে যেন মামলা ঢোকে।’ ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন, এর চাইতে বড় অভিশাপ হয় না। তারপরও অবশ্য মামলা থেমে নেই। রাস্তাঘাটে যানজট, শিক্ষাকেন্দ্রে সেশনজটের চাইতে আদালতে মামলাজট এখনো অনেক বেশি!
এমনিতেই আমাদের দেশে বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস খুব একটা দৃঢ় নয়। ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে’-এই আপ্ত বাক্যের কোনো ভিত্তি আমাদের দেশে অন্তত বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। আসলে আইন কখনোই তার নিজস্ব গতিতে চলে না। কারণ আইন নিজে ‘চলতে’ পারে না। আইনকে ‘চালাতে’ হয়। আইনকে ‘চালান’ একদল ক্ষমতাবান মানুষ। ফলে আমাদের দেশের আইন ‘নিজে চলার’ চাইতে ‘চালানোর’ ওপরই নির্ভরশীল বেশি।
যে নিজে ‘চলতে’ পারে না, যাকে ‘চালাতে’ হয়, সে ‘কর্তার’ ইচ্ছেয় ‘কর্ম’ করবে, এটাই স্বাভাবিক। আর কর্তার ইচ্ছেকে যে পরিবর্তন করা সম্ভব একথা কে না জানে? ‘তুষ্ট’ করতে পারলে ঈশ্বরও ভক্তের অনুকূলেই ‘রায়’ দেন। কাজেই আইন নিজ গতিতে আপন নিয়মে সুষ্ঠুভাবে কখনোই চলে না। বাংলাদেশের মতো ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও লোভের ‘দেবতার দেশে’ তো নয়ই। এখানে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবই শুধু দেখা যায় না, একই আইনের প্রয়োগ একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতেও দেখা যায়। কখনো বা সম্পূর্ণ বিপরীত।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ এ কথাটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই কারণে যে, সাধারণ মানুষের সুবিচার পাওয়ার যে জন্মগত অধিকার, বিচারের বাণী যেন নীরবে-নিভৃতে কেঁদে না-মরে!
কিন্তু ছবিটা ১০০ বছরেও খুব একটা বদলায়নি। রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন প্রায় ৮২ বছর আগে। মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে তিনি ওই লাইনগুলো লিখেছিলেন। অর্থাৎ ১০০ বছরেরও বেশি। এই সময়কালে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। লিখিত সংবিধান এসেছে। যেখানে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা একটি স্বীকৃত মূল্যবোধ হিসাবে স্থান পেয়েছে। কিন্তু সুবিচার পাওয়ার যে জন্মগত অধিকার সাধারণ মানুষের, সেটা এখনও ঠিক চোখে পড়ে না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। সংবিধানে বর্ণিত যে সার্বিক ন্যায়ের কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ রাজনৈতিক ন্যায়, সামাজিক ন্যায় এবং অর্থনৈতিক ন্যায়— রাষ্ট্রযন্ত্র সেটাকে মেনে চলছে না।
বিচারক ও বিচারপতিরাও তাদের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন না। পৃথিবীখ্যাত বিচারপতি লর্ড ডেনিং বলেছিলেন, বিচারপতিরা দু-ভাগে বিভক্ত। একদলকে বলা যায় ‘টিমোরাস সোল’ (ভীতু), অন্য দলকে তিনি বলেছেন ‘বোল্ড স্পিরিট’ (উদ্যমী)। আমাদের দেশে কোনো কোনো বিচারক আছেন, যারা কেবল নিজেদের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ নিয়ে মাথা ঘামান। সম্প্রতি বগুড়ায় তেমন একজন বিচারক আলোচিত হয়েছেন। বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি নিয়ম রয়েছে যে, প্রত্যেক শিক্ষার্থী পর্যায়ক্রমে শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে, ঝাড়ু দেবে। কিন্তু ওই স্কুলে একজন বিচারকের মেয়ে ছিল। সে শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দিতে অস্বীকার করে। এ নিয়ে অপর সহপাঠীদের সঙ্গে তার বাগবিতণ্ডা হয়। মেয়েটি বাসায় গিয়ে সহপাঠীদের নামে নালিশ করে। এরপর ওই বিচারক তার মেয়ের সঙ্গে যারা তর্ক করেছে, সেই শিক্ষার্থীদের অভিভাবকে ডেকে নিয়ে পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন। বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়।
আমাদের দেশে বিচারক ও বিচারপতিরা মাঝেমাঝেই এমন সব কাণ্ড করে বসেন। যদিও তাদের ব্যাপারে কোনো কিছু বলা বারণ। এ ব্যাপারে কথা না বাড়িয়ে একটি বহুল প্রচলিত কৌতুক বলা যাক।
বহু যুগ আগের কথা। তখন দেশে লোকসংখ্যা ছিল কম। এলাকার সবাই সবাইকে চিনত। হাঁড়ির খবর রাখত। সেই সময় এক জেলার একটি মামলায় সাক্ষী হিসাবে এলাকার ডাকসাইটে কাজের বুয়া রহিমা খালার ডাক পড়েছে।
আসামিপক্ষের উকিল কুদ্দুস সাহেব রহিমা খালাকে কে ঘাবড়ে দেবার জন্য প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি আমাকে চেনেন?’’
রহিমা খালার উত্তর, “ওমা চিনব না কেন? তুমি কুদ্দুস। তোমায় ল্যাংটা বয়স থেকেই চিনি। তোমার মতো তোমার বাপেরও ছিল দুষ্টুবুদ্ধি। কানু ঘোষের বাড়িটা তোমরা কারসাজি করে দখল করে নিয়েছিলে। পুরো বখে যাওয়া ছেলে ছিলে। মিথ্যা কথা বলতে। লোক ঠকানোয় ওস্তাদ ছিলে। তোমার আরও সব কীর্তির কথাও আমি জানি। সে সব আর বলছি না। তোমাকে আমি ভালোই চিনি!’’
কুদ্দুস সাহেব খুই বিব্রত বোধ করলেন। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না কি করবেন। কথা ঘোরাবার জন্য তিনি বিচার কক্ষের অপর প্রান্তে বাদী পক্ষের উকিল আবুল সাহেবের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, “উনাকে চেনেন?’’
রহিমা খালার উত্তর, “ওমা চিনব না কেন? ওতো আবুল। ওর বাবা ছিল আক্কাস মিয়া। খুব ভালো করেই চিনি। অলস, অকর্মণ্য। কারও সাথে সদ্ভাব ছিল না। পাঁড় মাতাল। শহরের সবচেয়ে পিশাচ উকিল হলো আবুল। বৌয়ের চোখে ধুলো দিয়ে আরও দুটো মেয়ের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে। তার মধ্যে একজন তোমার বউ। আবুলকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি!’’
এবার বিবাদী পক্ষের উকিল খুবই বিপন্ন বোধ করলেন!
এমন সময় জজ সাহেব দুই উকিলকে কাছে ডাকলেন। উকিলদ্বয় কাছে যাবার পর নিচু গলায় দৃঢ় কণ্ঠে জজ সাহেব বললেন, “দুই গর্দভের একজনও যদি ওই মহিলাকে প্রশ্ন করো যে আমায় চেনে কিনা, তাহলে তোমাদের আমি ফাঁসি কাঠে চড়াব!’
তারপর থেকে বিচারকদের ব্যাপারে কেউ কোনো প্রশ্ন করে না!