ধর্মের নামে কোথায় পৌঁছেছি আমরা?

আমাদের দেশে পাঠ্যপুস্তকে, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বারংবারই সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগ উঠছে।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 9 Nov 2022, 11:47 AM
Updated : 9 Nov 2022, 11:47 AM

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা শিক্ষা দান এবং গ্রহণ করতে আসেন, তাদের একটিই পরিচয়– শিক্ষক অথবা শিক্ষার্থী। এটা ছাড়া ধর্ম, রাজনীতি– সকল পরিচয়ই সেখানে গৌণ। সুতরাং, শিক্ষার কোনো রঙ নাই। তাকে বিশেষ কোনো রঙে রঞ্জিত করা ক্ষমাহীন অপরাধ। অথচ, আমাদের দেশে পাঠ্যপুস্তকে, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বারংবারই সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগ উঠছে। তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন চলমান এইচএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে একটি প্রশ্নের উদ্দীপক (সৃজনশীল প্রশ্নের একটি অংশ) হিসেবে এমন বিষয়কে বেছে নেওয়া হয়, যা খুবই সংবেদনশীল বিষয়। ঢাকা বোর্ডের ‘কাসালাং’ সেটের নাটক সিরাজউদ্দৌলা অংশের ১১ নম্বর প্রশ্ন নিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। সেখানে সাম্প্রদায়িক ভাবধারাপুষ্ট অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি উদাহরণ যোগ করা হয়েছে। প্রশ্নের উদ্দীপক অংশে বলা হয়, ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ-বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আবদুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে।

আবদুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’

তারপর শুরু হয়েছে প্রশ্ন-

ক. মিরজাফর কোন দেশ হতে ভারতে আসেন?

খ. “ঘরের লোক অবিশ্বাসী হলে বাইরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব”−ব্যাখ্যা কর।

গ. উদ্দীপকের ‘নেপাল’ চরিত্রের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার নাটকের ‘মিরজাফর’ চরিত্রের তুলনা কর।

ঘ. “খাল কেটে কুমির আনা” প্রবাদটি উদ্দীপক ও ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক উভয়ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য−উক্তিটির সার্থকতা নিরূপণ কর।

পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এমন স্পর্শকাতর উদাহরণ কেন দেওয়া হবে? কেন উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ‘সপরিবারে ভারত চলে যাওয়া’ ‘নেপাল’ চরিত্রের সঙ্গে ‘মিরজাফর’ চরিত্রের তুলনা করা হবে?

আসলে কয়েক বছরে আমাদের দেশে ধর্ম, বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এমন অনেক স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, তা এখন কেবলই বিভেদের উস্কানি দিয়ে চলেছে। এইচএসসির প্রশ্নপত্র তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এটা সরাসরি সংখ্যালঘুদের মনস্তত্বেও যে ধর্মীয় বিভেদ ব্যাপারটি আসন গেঁড়েছে তার একটি উদাহরণ।  

ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম শর্ত অন্য ধর্মের প্রতি সম্মানবোধ, সহিষ্ণুতা। সেই গুণটি যদি শিক্ষকদের মধ্যে সঞ্চারিত না হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা মানুষ হওয়ার শিক্ষা কোথায়, কার কাছে পাবে?

প্রশ্নপত্রের এমন নমুনা দেখে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা যাতে সংবিধান-বর্ণিত পথে হয়, তা দেখবার দায়িত্বটি কর্তৃপক্ষেরই। প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ যদি নিজ চরিত্র হারিয়ে অন্য পথে হাঁটতে চায়, তবে তাকে ঠিক দিশা দেখাবার প্রাথমিক এবং প্রধান কর্তব্যটিও কর্তৃপক্ষেরই হওয়া উচিত। অথচ, এই ক্ষেত্রে তেমন হয়নি বলেই অভিযোগ। এটা চরম উদ্বেগের বিষয় বৈকি। বস্তুত, স্বাধীনতার পর ড. কুদরত-ই খুদার নেতৃত্বে যে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছিল, সেই পথ থেকে বাংলাদেশ ক্রমশ সরে আসছে। সেই জায়গা নিয়েছে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। এইচএসসির প্রশ্নপত্র সেই ছবিটিকেই আরও একটু স্পষ্ট করল।

দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িকতা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলেও প্রশ্নপত্রে একেবারেই ভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দেশের বাস্তবিক চিত্রও এমন নয়। ধর্মীয় নানা উৎসবে দল-মত নির্বিশেষে এ দেশের মানুষ সবাই অংশগ্রহণ করে। তাহলে কেন এই ধর্মীয় বিভেদমূলক প্রশ্ন? এই মানসিকতা কি কেবল প্রশ্নপ্রণেতা মুষ্টিমেয় শিক্ষকের মধ্যে, নাকি তা বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বিরাজমান?

পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন কাঠামো কেমন হবে– এ ধরনের লিখিত নির্দেশনা এবং প্রশ্ন প্রণেতা ও প্রশ্ন সেটারদের ওরিয়েন্টশন করানো হয়। এর পরেও অমূলক প্রসঙ্গ টেনে ধর্মীয় উসকানি দেওয়া হয়েছে। এতে করে সমাজে বিদ্বেষ ছড়াতে পারে। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পর্যালোচনা, যাচাই, বিলি করার সময়ও বিষয়টি নজরে আসেনি কেন?

এর মাধ্যমে খুবই দুঃখজনক একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের সংবিধানের একটি বড় উপাদান। কিন্তু প্রশ্নকারী শিক্ষকদের মধ্যে সংবিধানের ন্যূনতম কোনো প্রভাব নেই। কোনো শিক্ষকের মধ্যে যদি সংবিধানের ন্যূনতম জ্ঞান ও চেতনা না থাকে তবে তিনি এমন প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। এখানে সরাসরি একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে আরেকটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরোধ লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

এখানে শুধু নামগুলোর মধ্যেই যে ধর্মীয় বিষয়গুলো টেনে আনা হয়েছে তা নয়, সেখানে মুসলমান শব্দ ব্যবহার, গরু কোরবানি দেওয়ার বিষয়গুলো অতিরঞ্জিত ও ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। এই প্রশ্নপত্র যারা প্রণয়ন এবং মডারেট করেছেন তাদের সবারই এখানে দায় আছে। তাদের সবাইকেই এই দায় নিতে হবে। এটা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থি একটি কাজ হয়েছে। বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ মহলের দৃষ্টিতে আসা উচিত। সেই সঙ্গে দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ভবিষ্যতে কেউ যেন এমন সাম্প্রদায়িক উসকানির বীজ বপনের দুঃসাহস না দেখায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

ভারতবর্ষের সুদূর অতীত থেকেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন রেখা ছিল। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সেই বিভাজনের সুযোগ নিয়ে প্রশাসনিক রণকৌশল তৈরি করে। আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। অমর্ত্য সেন তার ‘পরিচিতি ও হিংসা’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, এ হল সত্তার সঙ্কট এবং সত্তার পারস্পরিক সংঘাত। অন্যর সত্তাকে তার পরিসরটুকু দিতে না চাওয়া, সেটাই হল মূল সমস্যা। লিভ অ্যান্ড লেট লিভ!– এই দার্শনিক বহুত্ববাদী প্রত্যয়ের শিকড় নিয়েই আসলে টানাটানি। অনেকে বলেন হিন্দু-মুসলমান এই শব্দ দুটিই সংবেদনশীল। এ সব লেখা যায় না। হিন্দু শব্দটি লেখাও কি সাম্প্রদায়িক? লিখতে হবে সংখ্যালঘু। কিন্তু দেশে তো সংখ্যালঘু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, আরও কত সম্প্রদায় আছে! ট্রান্সজেন্ডার বা নাস্তিকদেরও সংখ্যালঘু বলা যেতে পারে। তাদের কথা লেখা যাবে না?

নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং অন্য ধর্মকে ঘৃণা করার একটা হাওয়া জোরেশোরে বইছে। সবখানে এই ধর্মবাদের চরম প্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে। ক্রীড়া-সংস্কৃতি রাজনীতি সবখানে আজ বিভেদের দাঁত বের হাসছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম। শিশুদের কোমল মনেও একটু একটু বিভেদের বীজ বপন করে দেওয়া হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে অত্যন্ত কৌশলে, সতর্কতার সঙ্গে। গত কয়েক বছরে পাঠ্যপুস্তকে বিরাট পরিবর্তন আনা হয়েছে। সেখানে হিন্দু লেখকদের বাদ দিয়ে মুসলিম লেখকদের লেখা যুক্ত করা হয়েছে। উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতার বাণী সম্বলিত অনেক লেখা তুলে দেওয়া হয়েছে। সংকীর্ণতা, বিভেদ আর ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে এমন অনেক লেখা সন্নিবেশিত হয়েছে। সবখানে সবকিছুতে ধর্ম আর ধর্মপরিচয়কে বড় করে দেখার একটা মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ধর্মের যুক্তি দিয়ে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও করা হচ্ছে।

মৌলবাদী শক্তি রাজনীতির হাতিয়ার এখন অনেক দেশেই। রাষ্ট্রশক্তি যখন মৌলবাদী শক্তির হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন তা ভয়ের কারণ হয়। বিশেষত, আমাদের মতো দরিদ্র কিন্তু বিশাল জনসংখ্যার দেশে যা মাথাব্যথার কারণ। কেউ কেউ মৌলবাদের জবাবে আর একটি মৌলবাদকে আশ্রয় করে দিচ্ছেন। এভাবে মানুষের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে জাগানোর কাজ চলছে।

এর বিষফলও ফলছে। কিছদিন পর পর ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর হামলা, নির্যাতন, সেই ঘটনার সূত্র ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট আমাদের দেশে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সমাজে নানাভাবে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে হিন্দু-বিদ্বেষ। শিক্ষার্থীরাও এর থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না। মগজধোলাই চলছে তাদেরও।

মৌলবাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অনেকের মধ্যেই মৌলবাদী উপাদান ঢুকে গেছে। ধর্মের ব্যাপারে তাদের আচরণ ও ধ্যানধারণা প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকেও হার মানিয়েছে। ধর্মচর্চা খারাপ কিছু নয়। এতে যদি ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী দলের পালের হাওয়া কেড়ে নেওয়া যায়, সেটাও ভালো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পন্থার পরিণামে উগ্র ধর্মীয়ভাবধারার যাথার্থতা স্বীকার করে নেওয়া হবে না কি? এই ‘কৌশল’ দিয়ে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সকল মানুষের বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে তোলা যাবে কি?

ধর্মের নামে বাংলাদেশ আজ যেখানে, সেখানে ধর্মান্ধ ছাড়া কারও অধিকারই কি সুরক্ষিত?