হাতে এলো সুমনের লেখা প্রবন্ধের একটি বই, সেখানে আমার প্রিয় বেশ কয়েকজন লেখক সম্পর্কে তো বটেই, সম্ভবত মার্কেসকে নিয়েও ছিল একটি নিবন্ধ। একজন গীতিকার ও গায়ক লিখছেন এসব প্রবন্ধ! অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল।
Published : 14 Oct 2022, 05:06 PM
কবীর সুমন তখন সুমন চট্টোপাধ্যায়। তখন মানে নব্বই দশকের শুরুতে। ১৯৯২ সালে যখন বাংলা গানে বাঁকবদলের সেই গানের অ্যালবামটি বেরুলো ‘তোমাকে চাই’ শিরোনামে, তখন সুনামির মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেল বাংলা গানের শ্রোতাদেরকে। মানবিক সৌন্দর্য আর নান্দনিক সৌকর্য তার গানকে আগের সকল ধারার গান থেকে আলাদা করে তুলেছে এবং নতুন রাজপথ তৈরিতে সহযোগিতা করেছে। এই গানের সুরে নেই নজরুলী সুরের জৌলুস, নেই রাবীন্দ্রিক কথার কাব্যিক কুহক, কিন্তু সুমনের ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গীকারের শিল্পিত স্বভাব।
প্রেমকে তিনি দীক্ষিত করেছিলেন আগুনের প্রবণতায়, আর মানবীয় মূল্যবোধগুলোকে তিনি পুনর্বিন্যাসের জন্য এমন সব গান বাঁধতে শুরু করলেন যার নজির আগে আমরা কখনো দেখতে পাইনি। কিশোর কুমার বা মোহাম্মদ রফির মতো স্বর্ণকণ্ঠ নন তিনি, কিন্তু ওই কণ্ঠ আমাদেরকে ইস্পাতপ্রত্যয়ে সবচেয়ে বেশি উজ্জীবিত করে। তার গান শুনে অজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ, উভয় গোষ্ঠীই মুগ্ধ। তার গানের পথ ধরেই হাঁটতে গিয়ে একদিন হঠাৎ করেই দেখতে পেলাম দেশ পত্রিকায় ‘কহেন কবি কোহেন’শিরোনামে লিওনার্দো কোহেনকে নিয়ে সুমনের লেখা এক সুখপাঠ্য প্রবন্ধ। এরই কিছুদিন পরেই বোধহয় হাতে এলো তার লেখা প্রবন্ধের একটি বই, খুব সম্ভবত ‘দূরের জানালা’ নামে, সেখানে আমার প্রিয় বেশ কয়েকজন লেখক সম্পর্কে তো বটেই, সম্ভবত মার্কেসকে নিয়েও ছিল একটি নিবন্ধ। একজন গীতিকার লিখছেন এসব প্রবন্ধ? অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। গান শুনে তো বটেই, এসব লেখা দেখে বুঝতে বাকি ছিল না, তার উত্থান আকস্মিক হলেও, তার প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘ এবং অবশ্যই শিল্পরুচি ও অঙ্গীকারে দীক্ষিত।
এই সুমন গান গাইবেন ঢাকায় বহুদিন পর। কিন্তু কোথায়? প্রথমে জায়গা নির্ধারিত ছিল জাতীয় জাদুঘর। আমাদের দক্ষ পুলিশ বাহিনী নাকি জাদুঘর ও নাগরিক শ্রোতাদের নিরাপত্তার স্বার্থে অন্যত্র করার পরামর্শ দিয়েছেন। আমাদের পুলিশ বাহিনী আজকাল তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের অতিরিক্ত আরও বহু দায়িত্ব পালন করে, যেমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো আদৌ হবে কি হবে না, হলেও কয়টার মধ্যে শেষ করতে হবে, এসব তারাই নির্ধারণ করে দেয়। তারা নির্ধারিত জায়গা বাতিল করে দেওয়ার হুকুম দিতে পারেন। এর আগে আমরা দেখেছি পহেলা বৈশাখ তাদের আবদারে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই শেষ করে দেয়ার কথা। কিন্তু কোনো ওয়াজ মাহফিল নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার কোন হুকুম তারা জারি করেননি কখনো। কোত্থেকে আসে এসব হুকুম? আমি জানি, এ কেবল পুলিশ বিভাগের মর্জির ব্যাপার না, তাদের উর্ধ্বতন অদৃশ্য কেউ আছেন যিনি তাদেরকে কলকাঠির মতো নাড়েন।
মৌলবাদী শক্তিগুলো বহুদিন থেকেই চেষ্টা করছে যা কিছু বাঙালি সংস্কৃতির তাকে নিশ্চিহ্ন করার, গান, বাজনা, খেলাধুলাসহ আরও বহু কিছু। আমাদের প্রতিভাবান মেয়েগুলো কিছুদিন আগে যে-বিজয় ছিনিয়ে এনেছে সেটাকেও মোল্লারা ফতোয়া দিয়ে বলেছে এটা নাকি অশ্লীলতা, কারণ ওরকম পোশাকে মেয়েদের প্রকাশ্যে বেরুতে নেই। স্বয়ং রাষ্ট্র এই বিজয়িনীদেরকে অভিনন্দিত করেছে,কিন্তু এই মোল্লারা করেছে বিরোধিতা। কই পুলিশ কিংবা রাষ্ট্র কি এদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার জন্য? কিন্তু যা রাষ্ট্রবিরোধী নয়, বরং মানবিক ও সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রের উচিত সেসবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কোন মতেই অনুষ্ঠানের স্থান পরিবর্তনে বাধ্য করা বা সময় সংকুচিত করার জন্য বাধ্য করা উচিত নয়। কিন্তু পুলিশ সেই কাজটাই করলো সুমনের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে। প্রথমে জাদুঘরে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ডিএমপি অনুমতি দেয়নি বলে এখন সেটা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের একটা ঘুপচির মধ্যে হবে। ডিমপি বা সরকারের সঙ্গে সহযোগী শক্তি হিসেবে কিছু কিছু ‘তথাকথিত বুদ্ধিজীবী’ আবার প্রশ্ন তুলেছে সুমন যদি গণমানুষের জন্যই গাইবেন তাহলে ওনার গান শোনার জন্য হাজার টাকার টিকিট-এর ব্যবস্থা কেন। গণমানুষের জন্য গান গাওয়া মানে গরীব থাকার অঙ্গীকার যেমন নয়, তেমনি তার গান সরাসরি কোনো শ্রোতা যদি হাজার টাকা দিয়ে দেখতে পারেন, তাতে করে সুমনের সংগীতের গণমুখী চরিত্রই বা কেন নষ্ট হবে? আর্থিক সামর্থ্য নেই, এমন কেউ তার গান হয়তো অনুষ্ঠানে গিয়ে শুনতে পারবেন না, কিন্তু অনুষ্ঠানে না গিয়ে তো শুনতে কোনো বাধা নেই। তাহলে এসব কুতর্ক তুলে তাকে বিতকির্ত করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য কী? সরকারই বা কী চায়- - এ ধরনের অনুষ্ঠানের পেছনে নানান রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মাধ্যমে?
আমাদের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা, বইমেলায় গত কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমির যোগসাজসে পুলিশ বাহিনী মেলার স্টল থেকে নির্দিষ্ট কোনো কোনো লেখকের বই সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। অথচ সেই বইগুলোর বিরুদ্ধে কোন আইনি নিষেধাজ্ঞা বা আইন বিভাগের বা বিচার বিভাগের কোন নিষেধাজ্ঞাই কখনো জারি হয়নি। কিন্তু পুলিশ কোনো আইনি ঘোষণা ছাড়াই সেবব বই সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। আমি বলছি না এটা পুলিশের একক সিদ্ধান্তে ঘটেছে, পেছনে নিশ্চয়ই কেউ আছে, যদি তেমন কেউ নাও থাকে, তবে নিশ্চয়ই রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটির পেছনে একটা সরকার আছে। সেই সরকারের উদ্দেশ্যটা আমরা স্পষ্ট করে এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। না বোঝার কারণ সরকারটি আওয়ামী লীগ। এটি সেই দল যার সাংস্কৃতিক চরিত্রের মধ্যে রয়েছে অসাম্প্রদায়িকতা, প্রগতিশীলতা, এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু সাম্প্রতিক বহু ঘটনাই এইসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা আমাদেরকে যে মাদ্রাসা সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শুধু মাদ্রাসাই নয়, তা একই সঙ্গে শক্তিশালী করে তুলছে রাজনৈতিক সেই শক্তিকে যারা এই ধরনের নিষেধাজ্ঞার পক্ষে। আওয়ামী লীগ কি এই নিষেধা্জ্ঞাই সমর্থন করবে, তাও পুলিশি রাষ্ট্রের চেহারায়? সুমনকে হয়তো এই রাষ্ট্রের বা সরকারের প্রয়োজন নেই, কিন্তু যারা মানুষ, যারা উদারপ্রাণ, যারা আজও মানবিকতা ও উচ্চতর মূল্যবোধে বিশ্বাস করে তাদের কাছে সুমন ও তার গানের প্রয়োজন সবসময়ই থাকবে। তথাকথিত রাজনৈতিক ‘পল্টিবাজির’ধোয়া তুলে তাকে কলঙ্কিত করে তার গানের সর্বজনীন আবেদনকে অস্বীকার করা যাবে না। মৌলবাদীদের বয়ান আর সরকারের পদক্ষেপ যদি অভিন্ন হয়ে ওঠে তাহলে সত্যিই খুব দুশ্চিন্তার ব্যাপার।