দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে না পারা, লুটপাট ও ক্ষমতার গর্বে দিশাহারা দলের ফাঁক বুঝতে পেরে গদি দখলের স্বপ্নে বিভোর লোকগুলো ঢুকতে পেরেছে। এরা কোনভাবেই জনপ্রিয় কেউ নয়। বরং জনবিচ্ছিন্ন। কিন্তু এরা পুঁজি করেছে জনমনের ক্ষোভ।
Published : 06 Nov 2023, 05:46 PM
দূর দেশে থেকে দেশের চেহারা দেখতে পাওয়া যায়, তবে তা ঝাপসা। মাটিতে থেকে তাকে স্পর্শ না করলে কি তার গন্ধ পাওয়া যায়? মাটির গন্ধ বলে দেয় দেশ কেমন আছে। বাংলাদেশের যেসব প্রবাসীরা দেশের জন্য চিন্তার নামে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন, তাদের চোখে ঠুলিপরানো আছে বলে মনে হলো এবার দেশে গিয়ে।
দেশব্যাপী গণতন্ত্রের নামে যে গণ্ডগোলের হিসেব মেলানো ভার। রাজনীতির কথা থাক। বলছি নানান উৎপাতে মানুষ উন্নয়নের প্রতি আগ্রহহীন হয়ে পড়ায় এতো দুর্ভোগ। তাদের নজর কেড়ে নিয়েছে দুঃশাসন। এককেন্দ্রিক বাস্তবতায় মানুষ আপন পর ভুলে গেছে। দুঃসময়ের বন্ধু নেতারা চোখের সামনে ফুলেফেঁপে কলাগাছ। সে গাছ ছায়া দেয় না। ফলও দেয় না। মানুষ তাই বিরক্ত । একদিকে উন্নয়নের জোয়ার। রাস্তাঘাট, উড়াল সেতু, মাটির তলায় পথ সবই দৃশ্যমান। কিন্তু বাজারে যে আগুন। সাধারণ মানুষ হিসাব মেলাতে পারে না। এই বাস্তবতা এখন সারা পৃথিবীতে কিন্তু অন্য দেশের নেতা ও সরকার মুখ সামলে কথা বলে। তারা পরিবেশ সামাল দিতে ব্যস্ত। আমাদের উন্নয়ন কান্ডারি শেখ হাসিনা এবং কয়েক নেতা ব্যতীত বাকিরা মুখে জগত কাৎ করলেও বাস্তবে সবকিছু ফকফকা। তারপর ও মানুষ নৈরাজ্য চায় না। এই যে আগুন সন্ত্রাস বা মারামারির দায় তাদের নিতেই হবে। তাদের জবাবদিহিতা বাড়ছে । কারণ দেশ ও দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা অন্যায়। এমন কিছু ঘটলেও তা নিজেরা সমাধান করাই কাজের কাজ। সেটা না করে বড় বড় মানুষদের হাতে পায়ে ধরার ভেতর শক্তি পাওয়া যায় না। বরং নিজেরা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই কথা যারা বোঝে না তারা কী ভাবে দেশ চালাবেন?
অনেকদিন চট্টগ্রামে ছিলাম এবার। গোড়ার দিকে সম্মাননা, সংবর্ধনা, অনুষ্ঠান, আলোচনা, টিভির আয়োজন ও আড্ডায় জমজমাট ছিল সময়।
একটু থিতু হয়ে ঢাকায় যাবো, দু-দুটো সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠানের সবকিছু তৈরি। বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়া ফিরিয়ে দেয়া সবকিছু ঠিক। পূজার শেষদিন প্রমাণিত হলো একটি ক্ষুদ্র মশা মানুষের চেয়ে শক্তিশালী। এমনই যে সবকিছু তছনছ করে দিতে যথেষ্ট, গৃহবন্দী করে রাখতে পারে দীর্ঘ সময়। তখন কী করে ফিরবো সেটাই হয়ে উঠলো মূখ্য বিষয়। সে শক্তি সঞ্চয় করতে গিয়ে অজস্র প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করা হয়নি। তাদের মনস্তাপ ও কষ্টের জন্য দুঃখিত। এটাও তো সত্য তাদের সঙ্গে দেখা হলে আমিও ঋদ্ধ হতাম। মন পুলকিত হতো। হয়নি।
এবারের চট্টগ্রাম আমায় এত ভরিয়ে দিয়েছে যে, কারো ঈর্ষাই তা স্পর্শ করতে পারেনি। যে ব্যর্থ হাহাকার ও হিংসার গল্প শুনেছি তার সঙ্গে মানুষের বাহ্যিক চেহারা বা আচরণ মেলে না। তাতে কী আসে যায়? রাশেদ রউফের মতো অনুজ থাকলে, ওমর কায়সার, ইউসুফ মুহম্মদের মতো বন্ধু থাকলে, জিন্নাহ চৌধুরীর মতো সুহৃদ থাকলে, রাশেদ হাসানের মতো সঙ্গী থাকলে, বোধনের মতো ছায়াবৃক্ষ থাকলে, শুভানুধ্যায়ীরা থাকলে সবকিছু অবলীলায় হয়ে যায়। কবি আসাদ মান্নান নিজের অনুষ্ঠান স্থগিত রেখে গোলাপ নিয়ে এসেছিল। এর চেয়ে বড় পাওয়া নেই। এর নাম বন্ধুত্ব। এর নাম সাহচর্য। যে দিন চলে আসব সেদিন ছিল অবরোধের দিন। এর দুদিন আগে হরতাল ডেকেছিল বিএনপি, জামায়াত। আমার নাতনিতুল্য একজন স্কুলপড়ুয়া তার মাকে প্রশ্ন করছিল, ‘মা মা হরতাল কী?’
এই প্রজন্ম হরতাল-অবরোধ জানত না। চিনত না। মহান রাজনীতি এবার তা চিনিয়ে ছাড়ছে। দেশে যাবার আগে প্রবাসী সুশীল রোগে আমি সরকারের তীব্র সমালোচনা করতে ছাড়িনি। এখনো করি তবে দেশে গিয়ে মনে হয়েছে কারা চাইছে গণতন্ত্র? কারা এরা? দেশ ও দশের সঙ্গে সম্পর্কহীন এরা গদি ছাড়া কিছুই বোঝে না।
সরকারের ব্যর্থতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে না পারা, লুটপাট ও ক্ষমতার গর্বে দিশাহারা দলের ফাঁক বুঝতে পেরে গদি দখলের স্বপ্নে বিভোর লোকগুলো ঢুকতে পেরেছে। এরা কোনভাবেই জনপ্রিয় কেউ নয়। বরং জনবিচ্ছিন্ন। কিন্তু এরা পুঁজি করেছে জনমনের ক্ষোভ।
বলাবাহুল্য এসব সবাই জানেন। সরকারের এতো উন্নয়ন কেন কাজে আসছে না সেটাও সবাই বোঝেন।
বলছিলাম ফেরার দিনের কথা। কয়েকটি সিএনজি ভাড়া করে, একটিতে মালামাল, একটিতে আমরা, আমাদের সামনে বাইকে গার্ড এভাবে এয়ারপোর্টে এসেছি। এর নাম আন্দোলন? এই ব্যবস্থার নাম উন্নয়ন?
কোথাও মানুষের জন্য কেউ আছে এমনটি মনে হয়নি। ঘাপটি মেরে থাকা, আত্মগোপনে থাকা লোকজন হঠাৎ বাইরে এসে বোমা ফাটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেশ অচল করে দিচ্ছে, এটাও অবাক হবার মতো বৈকি।
রাজনীতি বিমুখ মানুষ কোনভাবেই ভালো থাকতে পারছেন না। এই দেশে হঠাৎ এতো গণতন্ত্রপ্রেম আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। ঘরে বাইরে সমাজে একনায়কতন্ত্রের জয় জয়াকার। ‘আমি আমি’ করা সমাজে গণতন্ত্র বলে মাতম ও জীবন অচল করে দেয়া বড়ই তাজ্জবের।
মানতে হবে, মানুষকে কথা বলতে না দেয়া, ভোট দিতে না দেয়া, চাপিয়ে দেয়া দলতন্ত্রের কারণেই উন্নয়ন মার খেয়ে গেছে। উত্তরণের উপায় যে আমেরিকা-ইন্ডিয়া না, সেটাও সবাই বোঝে।
নেত্রীকে সাধারণ মানুষের ভাষা বুঝতে দিলে উত্তরণ সহজ হবে। তাঁকে কাঁচের ঘরে নয়, মানুষের মনে রাখতে হবে। এখনো ভরসা তিনি। সবাই বোঝেন শেখ হাসিনা না থাকলে এই দেশ অচল। তিনি দেশকে যে অবস্থায় নিয়ে গেছেন তার হাল ধরা মূর্খ ও অতিশিক্ষিত চতুরদের দ্বারা অসম্ভব। আমাদের এসব লেখাকে অনেকে তেলবাজি মনে করেন। তা তারা করতেই পারেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো কোন সুবিধা নেইনি। চাইও না। বরং দলের বিপর্যয় আর গণতন্ত্রহীনতায় মর্মাহত। এমন মনে করার কারণ আছে যে এদেশ আর আগের জায়গায় ফিরতে পারবে না। পারলেও ততদিনে দেরি হয়ে যাবে অনেক। এতো সব বোঝার পর ও সবাই মিলে কেন যে সত্য আর সঠিক পথে আসে না কে জানে? কেবল স্তাবকতায় মুক্তি নেই। অন্ধ বিরোধিতায়ও মুক্তি নেই। যুক্তি আর বিশ্বাসের সেতুবন্ধনই পারে জাতিকে মুক্তি দিতে। এই জাতি বহু রক্তশ্রমে স্বাধীন । এদেশের সব বিপদে মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে পথে। তাদের ভালোবাসা আর ত্যাগে মুক্তি মিলেছে বারবার।এটাই ইতিহাস। এর কোন ব্যত্যয় নেই। এখনো এতোকিছুর পর মানুষই আশ্রয়। উন্নয়ন যেমন মানুষের জন্য, তেমনি সব অর্জনের মূলেও মানুষ। মানুষকে পাশে রাখতেই হবে। যে কোন দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ মানুষ।