ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে দেশের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখার স্বপ্ন। ফিকে হয়ে আসে নিজের পঠিত বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণার ইচ্ছা। জীবনের বহমানতায় মলিন হয়ে যায় দেশ থেকে বয়ে আনা স্মৃতির সোনালি রং।
Published : 27 Jun 2023, 07:12 PM
জামান বাংলাদেশের একটি জেলা শহরের একাত্তর-উত্তর প্রজন্ম। মধ্যবিত্ত পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা। স্কুল ও কলেজের গণ্ডি সাফল্যের সঙ্গে পেরিয়ে লেদার টেকনোলজি বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আরো বেশি পড়াশোনা করে চামড়া শিল্পে নতুনভাবে অবদান রাখবার আশায় বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু সার্বিক যোগাযোগ, পাসপোর্ট, ভিসার কাজ সম্পন্ন হবার শেষ পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি জানায় নির্ধারিত বিষয়ে পড়ার সুযোগ বর্তমান সেমিস্টারে আর নেই। কিন্তু তখন জামানের পক্ষে অস্ট্রেলিয়া না যাবার সিদ্ধান্তটি ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। ফলে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ মোতাবেক তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি বিষয়ক পড়াশোনা করতে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। পূর্বসূরীদের মতোই পড়াশোনার খরচ জোগাতে খণ্ডকালীন কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন জামান। পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দোকানের সেলসবয়সহ বিভিন্ন অড জব থেকে প্রাপ্ত আয়ে দুবছর পাড় করে পড়াশোনা শেষ করেন। ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে দেশের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখার স্বপ্ন। ফিকে হয়ে আসে নিজের পঠিত বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণার ইচ্ছা। জীবনের বহমানতায় মলিন হয়ে যায় দেশ থেকে বয়ে আনা স্মৃতির সোনালি রং। আগামীর অভিজাত নিরাপদ জীবনের আশায় জামান শুরু করেন নাগরিকত্ব লাভের যুদ্ধ। বর্তমানে স্ত্রী সন্তান নিয়ে তার স্থায়ী বসবাস অস্ট্রেলিয়ায়। কর্মরত আছেন নিজের পড়াশোনার বিষয় থেকে যোজন যোজন দূরের এক পেশায়। কয়েকবছর পর পর দেশে ফেরা শুধুই অবসরযাপনের জন্য।
ব্যক্তিগত কর্মসূত্রে গত কয়েকমাস ধরে অস্ট্রেলিয়াতে বাস করতে হচ্ছে আমার। প্রয়োজনেই যোগাযোগ হচ্ছে প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে। আলাপচারিতা আর আড্ডায় উঠে আসছে তাদের প্রবাস জীবনের নানা দিক। অনুসন্ধিৎসু মন বারবার তাগাদা দিচ্ছে প্রবাসী জীবন সম্পর্কে দেশের মানুষ হিসেবে আমার জানা-বোঝাকে একটু মিলিয়ে নিতে। পাশাপাশি দেশের সুহৃদদের বারবার তাগাদা আসছে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী বাঙালিদের প্রথম প্রজন্ম সম্পর্কে কলম ধরবার। সবমিলিয়েই এ লেখার অবতারণা।
জামানের মতো দেশের সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যেই আজ প্রবাসী জীবন গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর। আগামীর একটা অভিজাত নিরাপদ জীবনের আশায় ছুটে চলেছে সবাই। অস্ট্রেলিয়া যেহেতু ল্যান্ড অফ মাল্টিকালচারাল সোসাইটি ফলে বাঙালিদের বিচরণ এদেশেও নিতান্ত কম নয়। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এ অভিবাসীজনেরা সকলেই নিজেদের শ্রম বিক্রি করে উপাজর্নে মগ্ন, যার বেশিরভাগই তাদের অতীত শিক্ষা বা পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। অপরিচিত পরিবেশ হওয়ায় এসব ব্যাপার কারও বিবেচনায়ও আসে না। পরিযায়ী পাখিদের মতোই আপন কুলায় ফিরে যাওয়ার পথ এরা পেরোতে পারে না, পেরোতে চায়ও না। সাময়িক অভিবাসন রূপান্তরিত হয় স্থায়ী অভিবাসনে।
বাস্তবতা এই যে, দেশে প্রতিবছর যে সংখ্যায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় তার দশগুণ কর্মক্ষম তরুণ কর্মবাজারে আসে। ফলে কর্মসংস্থানহীন থাকে নব্বই শতাংশ তারুণ্য। অপরদিকে স্বউদ্যোগে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি সীমাহীন কঠোর আবরণে ঢাকা। বেশিরভাগ তরুণের পক্ষে ওই কঠোর আবরণ ভেঙ্গে নিজেদের জন্য ন্যূনতম পথে বের করা সহজ হয় না। ফলে শুধু তরুণরাই নয়, তাদের অভিভাবকরা পর্যন্ত সন্তানদের প্রবাস জীবনের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে থাকেন। তবে প্রবাস জীবনের শ্রেণিবিভাগ আছে। সবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক নয়।
দেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা প্রবাসে শ্রম বিক্রি করে পরিবারকে সামান্য উন্নত জীবন দেবার আশায়। পরিবারগুলো সহায়-সম্বল বিক্রি করে প্রথমবার একজনের প্রবাস জীবন নিশ্চিত করে। তারপর এই হাত ধরেই পরিবার-আত্মীয়স্বজন-পাড়া প্রতিবেশী প্রবাস জীবনের পথ ধরে। দেশের এই শ্রেণির প্রবাস জীবন খুবই সংগ্রামের। একে তো এরা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে শ্রমের যথাযথ মূল্য পায় না, তার ওপর শ্রমের যে মূল্য তারা পেয়ে থাকে তারও ভাগীদার দাঁড়িয়ে যায়। তবে এরা যা আয় করে তার শতভাগ দেশে পাঠায়। এদের পাঠানো অর্থই বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে সরকারের ঘরে জমা হয়ে থাকে। কিন্তু সরকার এই শ্রমিকদের থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলেও এদের প্রবাস জীবন-যাপনকে মসৃণ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। এ শ্রমিকদের কর্মের প্রতিটি পদে পদে ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িয়ে আছে। ওই কঠিন ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করে একজন সাধারণ অদক্ষ শ্রমিক তার শ্রম বিক্রির অর্থে পরিবারকে কতটা স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে তা লাখ টাকার প্রশ্ন। সরকার ভালো করেই জানে এদের ভবিতব্য আর এরাও জানে জীবনের বাস্তবতায় ক্ষুধার্ত পেটের আগুন নেভানো ভাতের মর্ম। যেহেতু, ক্ষুধার্ত দরিদ্র ঘরের তরুণদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়ার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। এরা মুখ বুজে মাথা নিচু করে সবকিছু মেনে নেবে তাই সরকার এখানে বাণী বর্ষণ ছাড়া কোনো উপকার করে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। এই শ্রেণির অভিবাসীদের জন্য অস্ট্রেলিয়ার দ্বার উন্মুক্ত নয়।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবীদের সন্তান তথা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত অংশ অভিভাবকদের অনুপ্রেরণায় এবং সহযোগিতায় বিদেশে শিক্ষা গ্রহণে উদ্যোগী হয়ে, দেশের উন্নত ভবিষ্যতের শপথে যে সকল দেশে প্রবাসী হন তার মধ্যে অন্যতম অস্ট্রেলিয়া। উচ্চতর পড়াশোনার দোহাই দিলেও যাদের অধিকাংশই পাড়ি জমিয়েছেন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়, আবার কখনোবা শুধুমাত্র মা-বাবা, ভাই-বোনসহ আত্মীয়স্বজনের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। নিজের দেশে তুলনামূলকভাবে উচ্চ জীবনযাত্রার মান বজায় থাকা সত্ত্বেও দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে এরা অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে ভিড় জমাচ্ছে। অনুসন্ধানে জানতে পারি ১৯৬২ সালে বাংলাদেশ নামক ব-দ্বীপ থেকে সমুদ্রঘেরা অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম অভিবাসী হয়েছিলেন জনৈক মাসুদুল করিম চৌধুরী। যদিও মাসুদুল করিম এদেশে এসেছিলেন তার অস্ট্রেলিয়ান স্ত্রীর সুবাদে, যিনি বাংলাদেশে একটি মিশনারি স্কুলে শিক্ষকতা করতে গিয়েছিলেন। জানা যায় ষাটের দশকে মাত্র কয়েকজন ছাত্র স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছিলেন। একাত্তরে এসকল ছাত্ররাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে আন্দোলন করেছিলেন। ওই সময়ে সারা অস্ট্রেলিয়ার মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাশ্চাত্য ও অন্যান্য উন্নত দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়াই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও দেশের উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার এই নৈকট্য ছিল এবং আছে। আশির দশকে অস্ট্রেলিয়ান আদমশুমারিতে বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা মাত্র ৪১৩ জন ছিল বলে জানা যায়। পরে এ সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, যা ১৯৯১-২০০১ পর্যন্ত নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ২০২১ সালের আদমশুমারিতে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১ হাজারেরও বেশি। যাদের বেশিরভাগই দক্ষ কর্মী (সাবক্লাস ৪৫৭ ভিসায়), বিদেশী শিক্ষার্থী হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় আগমন।
দেশটির বহু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিছু জলপানির সুযোগ দিয়ে এদের ভর্তির ব্যবস্থা করে। জলপানির ব্যবস্থায় শিক্ষা গ্রহণের একটা অংশ পূরণ হয়। বাকিটা মধ্যবিত্ত অভিভাবকদের সামর্থ্যের মধ্যে থাকে না, ফলে অর্থ উপার্জনের পথে নামতে হয় সবাইকে। বিদেশ বিভুঁইয়ে যেহেতু কে কি কাজ করে তা জানার ও দেখার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। ফলত; অধিকাংশই মূল লক্ষ্য থেকে সরে এসে ছোট ছোট কোর্সে ভর্তি হয়ে স্থায়ী আবাসনের সনদ সংগ্রহে নিবেদিত হয়ে পড়ে এবং ৫/৭ বছরের শ্রমে স্থায়ী থাকার সনদ পেয়ে যায়। দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সবাই অল্পদিনেই গাড়ি-বাড়ির মালিকও হয়ে যায়। একজন মধ্যবিত্ত অবিভাবকের জন্য সুখকর স্মৃতি বলতে হয়তো এটুকুই। তবে এখানে লক্ষণীয় একটি মজার বিষয় হচ্ছে কিছু অভিভাবক যারা দেশে লাভজনক ব্যবসা বা চাকরি করে থাকেন, তারা প্রবাসী সন্তানের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ পাঠিয়ে থাকেন। তারপরও এ প্রবাসীরা একটা নির্দিষ্ট সময়ে অতিরিক্ত আয়ের জন্য শ্রম বিক্রি করে থাকে এবং এই শ্রেণির কেউ পরিবারের জন্য দেশে অর্থ প্রেরণের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে না। শুধুমাত্র পরস্পরের মধ্যে যাতায়াত ও উপহারসামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে নিজের অভিজাত জীবন বোঝানোর উদ্যোগ অস্ট্রেলিয়া বসবাসরত এ শ্রেণির মধ্যে দেখা যায়। এই দলের মধ্যে দেশের দক্ষ জনশক্তিও রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বা প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য এদেশে আসেন। এদের মধ্যে অনেকেই আর দেশে ফেরেন না, কারণ তাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন না যে ক্ষুধার্ত দরিদ্র জনগণের করের টাকায় মেধার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ তারা পেয়েছেন। পারিবারিক অর্থানুকূল্য এবং সরকারি সুযোগ সৃষ্টি না হলে দেশের অনেক মেধার মতো এসব মেধাও মাঝপথে কোথায় হারিয়ে যেত তার হদিস পাওয়া গবেষণার বিষয় হতো। দেশের এসব মেধাবী সন্তানদের নিজেদের মেধার প্রতি প্রচণ্ড আস্থা। তারা বিশ্বাস করতে পারেন না তাদের এ মেধাবিকাশের ক্ষেত্রে দেশের কৃষক-শ্রমিকের অবদান কতখানি। সে কারণেই নিশ্চিত মনে প্রবাসে নিজের মেধা বিক্রি করে চলেন। কখনো কারো প্রশ্নের মুখে দাঁড়ালে দেশে যথাযথ মূল্যায়নের অভাব, কাজ করার সীমাবদ্ধতার কথা বলে এড়িয়ে চলেন। পরিবার ও দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিজাত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এরা দেশের ও নিজের বর্তমান উৎসর্গ করে দিয়েছেন। অথচ এই দক্ষ মানুষগুলো দেশের অদক্ষ জনশক্তিকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরে ভূমিকা পালন করলে দেশের চেহারা পরিবর্তন হয়ে যেত। আজ দেশের অদক্ষ শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্যের গরমে বা মালয়েশিয়ার জঙ্গলে শ্রম বিক্রি করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে যে ভূমিকা রাখছেন তা সহজেই তিনগুণ বৃদ্ধি পেতে পারত। সরকার কঠোর হস্তে ব্রেন-ড্রেন বন্ধ করলে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের সংগ্রাম সহজতর হতো। কিন্তু এদের সিংহভাগ সরকারের ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকার কারণে সরকার এদের কথা ভাবতেই চায় না।
যেমন সরকার ভাবতে চায় না অবৈধ ব্যবসা, কমিশন বাণিজ্য, ব্যাংক জালিয়াতি, শেয়ার ধস কিংবা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দেশে নিরাপদ না মনে করে প্রবাসে পাড়ি জমানো মানুষগুলোকে নিয়ে। ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা ব্যক্তিরা এমন কাজে নিয়োজিত তা সরকার বিশ্বাসই করে না। অথচ এদের অনেকেই দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বহাল থেকে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সামিল থাকছেন। পরিবার অস্ট্রেলিয়া বা অন্যান্য উন্নত দেশে রেখে দেশ থেকে অর্থ পাচার করে অভিজাত জীবনযাপনের ব্যবস্থা চলমান থাকে এদের। অনেক সময় দক্ষ জনশক্তি হিসেবে এরা বিশেষ সুবিধা পায়, কখনও বিত্তবান হিসেবে বেশি সুযোগ ভোগ করে। প্রবাস থেকে কোনো কারণে অর্থ দেশে পাঠানোর তো প্রশ্নই ওঠে না বরং এদের সুখ শান্তির জন্য দেশ থেকে অর্থ আসে। এ যেন এক অদ্ভুত প্রহেলিকা।
দেশের জন্য খুব বেশি সহায়ক না হলেও উচ্চশিক্ষিত এ শ্রেণির প্রবাস জীবন যে খুবই সুখ-ছন্দময় এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। অন্তত প্রথম প্রজন্মের জন্য তো নয়ই। জামানদের পরিবারের মতো অনেকেই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শ্রম বিক্রি করে। অনেকে আবার একাধিক জায়গায় শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জন করে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ফিরে সাংসারিক কর্মে নিয়োজিত হয়ে পড়ে। আগামী সকালের প্রস্তুতির জন্য সন্তানের সঙ্গে আনন্দময় সময় ব্যয় করতে পর্যন্ত পারে না। সাপ্তাহিক দুদিন ছুটির একদিন সাংসারিক কাজে এবং অন্যদিনে সামান্য ঘোরাঘুরিতে কেটে যায়। বাড়ি-গাড়ি হয়, আর্থিক সামর্থ্য হয় কিন্তু তা আনন্দের সঙ্গে ভোগের মানসিকতা থাকে না। ফলে প্রথম প্রবাস জীবন একটা মেশিনে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে।
প্রথম প্রজন্মের কাছে বিষয়টা কষ্টদায়ক ও কঠিন হলেও বেঁচে থাকা এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিতের সংগ্রামে কেউ পেছনের দিকে তাকায় না। তাছাড়াও বাংলাদেশী অভিবাসীরা অভ্যাসগত কারণেই তাদের জাতিগত সম্প্রদায়ের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধন বজায় রাখে। যদিও সেখানে রয়েছে গণ্ডিবদ্ধতা । অর্থাৎ সকলেই নিজ নিজ গণ্ডির পরিচিতজনদের সঙ্গে মিশতে, সময় কাটাতে বা উৎসব পালন করতে পছন্দ করে। সবক্ষেত্রেই নতুন সেতুবন্ধনের সদিচ্ছা তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। ফলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি, পেশাগত দক্ষতা ক্রমশ বিলীন হয়ে যাওয়া, বর্ণবাদ ও বৈষম্যের অভিজ্ঞতা এ সবই অভিবাসীদের মানসিকভাবে দুর্বল করে রাখে; ফলে বিশেষভাবে প্রথম প্রজন্ম, প্রায়ই অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধার সম্মুখীন হন। তাদের মাঝে ভীষণভাবে কাজ করে কালচারাল শক বা সমাজ-সংস্কৃতির ধাক্কা। বসতি স্থাপনের প্রথম দিকে অনেকেই হোম সিকনেস নামক অদৃশ্য ঘেরাটোপে আটকে থাকেন। তবে অনেকক্ষেত্রে সমাজের উচ্চবিত্তের সন্তানেরা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই দেশ ত্যাগ করে বলে তাদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম বা দেশত্যাগের কোনো বোধ কাজ করে বলে মনে হয় না। তবে সাধারণ প্রবাসীদের প্রথম প্রজন্ম তাদের কর্মযজ্ঞের দ্বারা হাতের মুঠোয় সবকিছু নিয়ে আসতে পারলেও বুকের মধ্যে দেশ ছাড়ার এক হাহাকার নিয়েই বেঁচে থাকে অনেকটা কেবল বেঁচে থাকবে বলে অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে থাকার মতোই।