ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি জানানোর অনিচ্ছাই যে হামাসের মতো সংগঠন সৃষ্টির মূল নিয়ামক, এই সত্যকে অস্বীকার করা যাবে কি? হামাসের সশস্ত্র প্রতিরোধ ফিলিস্তিন সরকারকে ইসরায়েলের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করার অনিবার্য ফলাফল।
Published : 11 Oct 2023, 05:54 PM
ফিলিস্তিনিদের অনেকগুলো সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে। হামাস তার মধ্যে একটি। হামাস সদস্যরা গত ৮ অক্টোবর আকস্মিক ইসরায়েলে হামলা পরিচালনা করলে পুরো ফিলিস্তিনজুড়ে পাল্টা হামলা পরিচালনা শুরু করে ইসরায়েল। এ ব্যাপারে সরাসরি মদদ ও সমর্থন যোগাচ্ছে আন্তর্জাতিক মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একটি সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ইসরায়েল ও আমেরিকা এখন জাতিগত নিধনের মতো ভয়ংকর অপরাধে লিপ্ত রয়েছে।
হামাস কোনো রাষ্ট্র নয়, সব ফিলিস্তিনিও হামাস নয়। একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা সন্ত্রাসবাদের সমর্থক একটি শাসকগোষ্ঠীর দায়িত্বহীন আচরণের বলি কোনো জাতিগোষ্ঠী হতে পারে না। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।
গাজায় ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে শনিবারের হামলা আসলে গণঅভ্যুত্থান। এই হামলায় শত শত ফিলিস্তিনি অংশগ্রহণ করেছে। হামাসের ছাতার নিচে সমবেত হয়েছে দীর্ঘদিনের জুলুম-নির্যাতনে সংক্ষুব্ধ সাধারণ জনতাও। কিন্তু ফিলিস্তিনি নিপীড়িত মানুষের এই প্রতিরোধ যুদ্ধ ও দীর্ঘদিনের পূঞ্জীভূত ক্ষোভের বহির্প্রকাশকে এখন ভিন্ন চেহারা দেবার চেষ্টায় মেতে উঠেছে জুলুমবাজ ইসরায়েলি সরকার ও তার দোসর নীতি-নৈতিকতাহীন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো। মূলত ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে জনমতকে বিষাক্ত করার জন্য এবং ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী শাসকদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের ওপর পরিচালিত প্রতিশোধমূলক ধ্বংসযজ্ঞকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী দেশের সরকার ও মিডিয়া এখন একযোগে প্রচারণা চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে নাটের গুরু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রথম সুর তোলেন।
গত শনিবার হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সহানুভূতি জানানোর জন্য ফোন করেন বাইডেন। ফোনে ‘গাজা থেকে হামাস সন্ত্রাসীদের দ্বারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর আক্রমণের’ নিন্দা করে বলেছিলেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য তার দৃঢ় ও অটুট সমর্থন অব্যাহত থাকবে। ইসরায়েলি বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর খবরে এক সারিতে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসারী দেশগুলো ‘সন্ত্রাসবাদী’ ও ‘ইসরায়েলের উপর আক্রমণ’-এর নিন্দা করেছে। তাদের সবার ছিল অভিন্ন সুর, অভিন্ন প্রতিক্রিয়া। যারা এই সুরে গলা মেলায়নি, তাদের ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদ’ বা ‘সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করার’ সমতুল্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, হামাসের হামলায় বিপুল সংখ্যক ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিনিদের নিপীড়নের জন্য কোনো ব্যক্তিগত দায় বহন করেননি। এমন অনেক লোকের ভাগ্যে ট্র্যাজেডি নেমে এসেছে, যারা কেবল ভুল সময়ে ভুল জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছেন। গাজার যোদ্ধারা, আজীবন ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও নৃশংসতার কারণে কঠোর হয়েছিলেন এবং প্রতিজ্ঞা করেছেন যে তারা জীবিত গাজায় ফিরে আসবেন না। তারা প্রথম টার্গেট করেছে উপকণ্ঠে একটি নাচের আসরকে। যেখানে অন্তত তিনশ ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয়েছে। তাদের মৃত্যুর জন্য চূড়ান্ত দায়ভার কে বহন করে?
হামাস যা করেছে, তা অবশ্যই নিন্দনীয় ও বর্বরোচিত ঘটনা, কিন্তু এই ট্র্যাজেডির জন্য কেবল কি হামাসকে দায়ী করা চলে? এ জন্য ইসরায়েলি বর্ণবাদী শাসন এবং তার মার্কিন সমর্থকরা কি দায়ী নয়? যারা যুগের পর যুগ ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে এবং তাদের ক্রমাগত সঙ্কুচিত-সীমাবদ্ধ করে একটি একচেটিয়া ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পুরো প্রতিক্রিয়াশীল জায়নবাদী প্রকল্প চালু রেখেছে, তাদের অপরাধকে ঢাকা যাবে কীভাবে? যারা যুগের পর যুগ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে, পুরো দেশটাকে কারাগার বানিয়ে সেখানে তাদের সীমাবদ্ধ জীবনযাপনে বাধ্য করেছে, তাদের নিন্দা কি কখনও জোরালোভাবে করা হয়েছে? যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর যে ভয়ঙ্কর ‘সন্ত্রাস’ ও ‘সহিংসতা’ চালানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে এই তথাকথিত মানবতাবাদী রাষ্ট্রগুলো কি কখনও সর্বসম্মত নিন্দা জানিয়েছে?
ইসরায়েলি সাধারণ মানুষের নিহতের ঘটনায় পশ্চিমা বিশ্বের দুঃখ ও সহানুভূতি তাই চরমভাবে কপট। বাইডেন নিজেই একজন যুদ্ধাপরাধী ও সহিংসতার মদদদানকারী। ২০০৩ সালে, তিনি ইরাকে অবৈধ আগ্রাসন ও দখলের জন্য সিনেটে ভোট দেন, যার ফলে দশ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। মার্কিন চণ্ড নীতির কারণেই ফিলিস্তিনিরা বর্তমানে আগ্রাসী এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র তার শিকার। এই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোই ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর নিপীড়ন, একতরফা নির্যাতন চালিয়ে, নির্মমভাবে সমস্ত প্রতিরোধকে দমন ও প্রত্যাখ্যান করেছে। ২০০৮-২০০৯ সালে গাজায় তিন সপ্তাহ ধরে বিমান থেকে বোমাবর্ষণে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছিল, হামাসের হামলায় নিহত ইসরেয়েলিদের হতাহতের সংখ্যা তুলনা করলে যা বড়জোর ১০০:১ হবে।
পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা চরম মানবেতর জীবনযাপন করে। সারাক্ষণ তাদের ঘিরে রাখে শতাধিক ইসরায়েলি সামরিক চেকপয়েন্ট। পুরো গাজাকে একটি উন্মুক্ত কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়েছে। গাজা হচ্ছে ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত এমন একটি এলাকা যা পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন। এই এলাকাটি ৪১ কিলোমিটার বা ২৫ মাইল দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার চওড়া। একদিকে ভূমধ্যসাগর, তিন দিকে ইসরায়েল ও দক্ষিণ দিকে মিশরের সিনাই সীমান্ত। এখানে বসবাসকারীরা বেঁচে থাকে ইসরায়েলি সরকারের দয়ায়। ইসরায়েলি সেনারা গাজার আকাশসীমা এবং এর উপকূল নিয়ন্ত্রণ করে এবং কারা বা কী ধরনের পণ্য এর সীমানা অতিক্রম করতে পারবে তাও নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও উন্মুক্ত কারাগারে বন্দী জীবনযাপন করে। এই প্রেক্ষাপটে, গেল সপ্তাহে হামাস যে আক্রমণ চালিয়েছে, সেটাকে ‘আক্রমণ’ না বলে দীর্ঘদিন অন্যায়ভাবে জুলুম নির্যাতনের শিকার হওয়া কারাবন্দীদের কারাগার ভাঙ্গার একটি দীর্ঘ গল্পের সর্বশেষ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা ভালো।
সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ‘সহিংসতা’ এবং ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর কপট নিন্দায় মুখরিত হচ্ছে, এই সুযোগে ইসরায়েল ইতিমধ্যেই গাজায় প্রতিশোধমূলক আক্রমণ শুরু করেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ‘গাজায় সম্পূর্ণ অবরোধ’ ঘোষণা করেছেন, এমন ভাষা ব্যবহার করে যা তার শাসনের চরিত্র এবং এর অন্তর্নিহিত আদর্শকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করে। “কোন বিদ্যুৎ থাকবে না, খাবার থাকবে না, জল থাকবে না, জ্বালানি থাকবে না, সবকিছু বন্ধ থাকবে” বলে গ্যালান্ট ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, “আমরা মানব পশুদের সঙ্গে লড়াই করছি এবং আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করি।” জাতিসংঘে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি, যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রাথমিক মনোনয়নের রিপাবলিকান প্রার্থী, তিনি ঘোষণা করেছেন, এটা শুধু ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ। তিনি সরাসরি নেতানিয়াহুকে ‘তাদের শেষ করার’ আহবান জানিয়েছেন। নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন যে, “আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আমরা আমাদের শত্রুদের সঙ্গে যা করব তা প্রজন্মান্তরেও প্রতিধ্বনিত হবে।”
নিপীড়িতদের প্রতিরোধ অত্যাচারীর কাছে সবসময়ই হিংস্রতা বা সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত হয়। আজ দুনিয়াজুড়ে নিপীড়কদের শক্তির শাসন কয়েম হয়েছে। তারা সদম্ভে ঘোষণা করছে যে, “আমরা নিপীড়ক, যখনই আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে এটি আমাদের স্বার্থের জন্য তখন আমরা স্বাধীনভাবে শক্তি প্রয়োগ করি। আমরা আপনাকে নির্বিচারে বোমা মারতে পারি, আমরা অবরোধ করতে পারি, আপনাকে অনাহারে রাখতে পারি, আমরা আপনাকে লুট করতে পারি, আপনাকে বন্দী করতে পারি এবং আপনার ঘাড় নতজানু করতে পারি। বলপ্রয়োগ আমাদের একচেটিয়া এবং একমাত্র অধিকার। আপনি, নিপীড়িত, কোনো অবস্থাতেই জবাবে বল প্রয়োগের অনুমতি নেই।” এই মনোভাব এতটাই প্রবল যে, দখলদারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিলে তাকে ‘সন্ত্রাসী’ ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়।
গাজার মানুষের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সরকার এখন যে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে তার সঙ্গে ব্রিটেনের দ্বারা কেনিয়ার মাউ মাউ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে অভিযান, আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দক্ষিণ আফ্রিকানদের সংগ্রামের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের ভূমিকার মিল রয়েছে। বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে অথবা মার্কিন সামরিক বাহিনী কর্তৃক ইরাক দখলের জনপ্রিয় প্রতিরোধের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিপীড়কদের মধ্যে রাজনৈতিক অভিজাতরা বরাবরই সশস্ত্র প্রতিরোধকে ‘সন্ত্রাস’ বলে নিন্দা করে এবং তারপর হাজার গুণ বেশি ধ্বংসাত্মক নির্দয় প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে যায়।
ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি জানানোর অনিচ্ছাই যে হামাসের মতো সংগঠন সৃষ্টির মূল নিয়ামক, এই সত্যকে অস্বীকার করা যাবে কি? হামাসের সশস্ত্র প্রতিরোধ ফিলিস্তিন সরকারকে ইসরায়েলের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করার অনিবার্য ফলাফল। ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের, তাদের ওপর পরিচালিত জুলুম নির্যাতনের বিরোধিতার কোনো বৈধ পথ খোলা রাখা হয়নি। “যদি আমরা সামরিক কায়দায় প্রতিরোধ সংগ্রাম করি, আমরা সন্ত্রাসী। আমরা যদি অহিংস উপায়ে সংগ্রাম করি তবুও আমাদেরকে সহিংস বলে বর্ণনা করা হয়। আমরা যদি শব্দ দিয়েও প্রতিরোধ করি, তাহলে আমাদের উস্কানিদাতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়।” এমন পরিস্থিতিতে তারা কী করবে?
আসলে ইসরায়েলি ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের রক্ষকদের কাছে ফিলিস্তিনি জনগণের বাঁচা-মরা, স্বাধীনতা, সংগ্রাম কখনোই গুরুত্ব পাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর কাছেও ইসরায়েলের ভূমিকাই সবসময় গ্রহণযোগ্যতা পাবে। কারণ তারা সবাই একই গোয়ালের গরু। এ পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ এবং ইহুদিবাদী শাসকদের সঙ্গে হিসাব মেটানোর একমাত্র উপায় হলো ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ঐক্য প্রতিষ্ঠা। যাদের একসঙ্গে গাজার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী হামলার বিরোধিতা করতে হবে। হামলা, হিংসা, রক্তপাত কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এক ফোঁটা রক্ত-কণার পরিণামে আরও বেশি রক্ত দিয়ে হিংস্রতার ব্যাপকতর ছবিই কেবল আঁকা হয়। আর কিছু নয়।