বিএনপির ভোটারদের উদ্দীপ্ত করা, ভোটকেন্দ্রে আনার কাজটা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা করতে পারে। ইউপি নির্বাচনে কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরোধী প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছে এই প্রক্রিয়াতেই। এতে নিস্তেজ বড় একটা অংশের ভোটারকে উদ্দীপ্ত করা যাবে।
Published : 26 Dec 2023, 05:18 PM
স্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষ অন্তত খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়। এই মানসিকতা লড়াইয়ে সহায়তা করলেও, বাঁচার বিষয়টা নির্ভর করে কোন জায়গায়, কোন সময়ে জানপ্রাণ লড়াই চলে তার ওপর। নয়তো সকল আশা বৃথায় পর্যবেশিত হতে বাধ্য। আগামী নির্বাচন নিয়ে আশার ধরনটা ঠিক এরকমই। আশা খুঁজে ফেরা।
দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা বুঝতে বিগত নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি এবং ভোটদানের হার লক্ষ্য করলেই চলে। এসব বলে হৃদয় ভারাক্রান্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই। গণতন্ত্রে সকলে যদি সমানভাবে ভূমিকা রাখতে না পারে, তাহলে শক্তিশালী পক্ষকে একনাগাড়ে দোষারোপ করাও কোনো কৌশল হতে পারে না। সেক্ষেত্রে অন্যদের দুর্বলতাগুলো নিয়ে কথা হতে পারে।
আওয়ামী লীগ যা করতে পারছে তার পাল্টা কেউ কিছু করতে পারছে না কেন? এই প্রশ্নও এখন পুরোনো হয়ে গেছে। অন্যরা কেন পারে না— সেটাই তারা জানে না। এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ তৈরি করে নিয়েছে। অন্তত এই রাজনীতিটা তো তারা করছে।
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে আশা-ভরসা তাই দুপক্ষেই। জনগণ এবং সরকার দুদিক থেকেই। সরকার তথা নির্বাচন কর্তৃপক্ষের আশা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফিরে আসবে। ভোটার টানতে প্রার্থীদের কাজ করতে হবে। ভোটের দিনটা আরও জমে উঠবে কারণ, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা তাদেরই রয়েছে। যেমনটি গাজীপুর সিটি নির্বাচনে দেখা গিয়েছে। সেখানে প্রায় ১২ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬ লাখ ভোটার ভোট দিয়েছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনটা ছিল সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।
এই হিসাব ধর্তব্যে নিলে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টা ভোট তথা গণতন্ত্রের মান রক্ষায় একটা ভালো ‘আবিষ্কার’। সারাদেশে ঝিমিয়ে পড়া ভোটের হাট-বাজার একটু জমে উঠবে এই সুযোগে। আর দীর্ঘদিনের পরিচয়ের সূত্রে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখার মতো প্রভাব রাখতে পারবে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় নির্বাচন খুঁজতে গেলে এদেশে এর চেয়ে ভরসার উপায় আপাতত আর নেই। দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল আওয়ামী নেতৃবৃন্দের। অনেক আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আর স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ক্ষমতার পার্থক্য খুব একটা বেশি নয়। প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে ব্যবহার করতে চাইলে তারা সেটাও করতে পারবে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নামধারী ‘বড় বিরোধী পক্ষ’ জাতীয় পার্টি তাদেরকে নির্বাচনে ওয়ার্মআপে রাখবে। তারা তো সমঝোতার মধ্যেই খেলে আসছে বহুদিন থেকে। তারা অনেকটা ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ যারা গণতন্ত্রের নামে ফোকরের খোঁজে দীর্ঘদিন রাজনীতি করে যাচ্ছে। কখনও গাছেরটা কখনও তলারটা, সময় বুঝে দুটোতেই একসঙ্গে উদরপূর্তি করে আসছিল। তারপরও জাতীয় পার্টি তাদের আসনগুলোতে এবার কতটুকু খেলবে সেটাও দেখার বিষয়।
শুধু জাতীয় পার্টিই নয়, বিশেষ করে গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল রাজনীতি করার যোগ্যতা হারিয়েছে। রাজনীতি বলতে তাদের আর কিছু নেই। কারণ ক্ষমতাসীন দলের ওপর ভর করে ক্ষমতাবলয়ে থাকা আর যাই হোক নিজেদের সক্ষমতার পরিচয় বহন করে না। এরপরও তারা রাজনৈতিক দল হিসাবে পরিচিত। তাদের অযোগ্যতার কারণেই নির্বাচন এলে ‘কিংস পার্টি’র জন্ম হয়। এই কিংস পার্টির জন্ম হওয়া মানে এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অযোগ্যতা চাউর হওয়া। এসব কথা বলতে রাজনীতি বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। সাধারণ মানুষের মনেই এই প্রশ্নগুলো উদয় হওয়া স্বাভাবিক।
এখন দেখার বিষয়, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনকে কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে পারবে। কোথাও কোথাও ইতোমধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মিলছে। নির্বাচনের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। উদ্বেগ-উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। ব্যাপক আকারে না হলেও শুরু হয়েছে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের যা কিছু দেখানোর আগামী ৭ জানুয়ারির মধ্যে দেখিয়ে দিতে হবে। এর মধ্যে সমীকরণ দাঁড় করিয়ে ফেলতে হবে। এতে রাজনীতিতে একটা দিশাও মিলতে পারে। সংগঠক হিসেবে স্থানীয় রাজনীতিতে তারা ব্যক্তিগত কারিশমাকে তুলে ধরতে পারে। এটা আওয়ামী লীগের পরীক্ষার জায়গাও। মানে আওয়ামী লীগ নিজেদেরই বাজিয়ে দেখার সুযোগ পাচ্ছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একটা ভালো আবিষ্কার এটা। যদিও এদেশে বিরোধীপক্ষকে সংগঠিত করার মতো কোনো রাজনীতিবিদ এখন নেই বললেই চলে। এছাড়া ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে চাইলে বিএনপি তাদের সঙ্গে আঁতাত করতে পারে। কারণ প্রত্যেকেই ক্ষমতার জন্য ঘুরছে। এটা বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসা শাহজাহান ওমরের কথা শুনলেও আমরা বুঝতে পারি। আর অন্য যারা ক্ষমতার ধারেকাছে যেতে পারবে না তাদের আসলে কিছুই করার নেই। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ পথ মসৃণ করার জন্য তাদের কোনো উদ্যোগও ছিল না এই পর্যন্ত।
আর যদি বিএনপির কথা বলি, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্তত এই সময়ে বিএনপি আর কোনো প্রসঙ্গ নয়। ভোটে তারা না-ই যেতে পারে। কিন্তু জনগণের সঙ্গে বা জনগণের রাজনীতিতে তারা ছিল না। গণতন্ত্রের জন্যও তারা ছিল না। থাকলে তারা জনগণের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা-সমর্থন পেত। তাদের আন্দোলন সংগ্রাম ছিল বেদিশা, পথহারা। ভোট না হোক ভোটের মতো কোনো বিষয়ে তাদের প্রাসঙ্গিক থাকা প্রয়োজন ছিল। এখানেই বরং একটা সুযোগ আছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। বিএনপির ভোটারদের উদ্দীপ্ত করা, ভোটকেন্দ্রে আনার কাজটা তারা করতে পারে। ইউপি নির্বাচনে কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরোধী প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছে এই প্রক্রিয়াতেই। এতে নিস্তেজ এক বড় অংশের ভোটারকে উদ্দীপ্ত করা যাবে। যেমনটি সেই খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার আশার কথা শুরুতে বলা হয়েছিল।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি এখনও পর্যন্ত। হলে তাদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে জানা যেত। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবর মতে, এবারের নির্বাচনে ২৭টি দলের ১৫১৩ জন এবং স্বতন্ত্র ৩৮২ জন প্রার্থী রয়েছেন। স্বতন্ত্ররা ২২৫ আসনে লড়ছেন। এর বাইরে ৭৫ আসনে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ২৬৮ জন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ২৬৫ জন। এককভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি।
এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি নামকাওয়াস্তে প্রার্থী না হয়ে থাকে তাহলে ভালো একটি নির্বাচনই আশা করা যায়। ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়ে দিয়েছেন, দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চাপে রাখতে কোনো কমিটি বিলুপ্ত করা হলে বা কাউকে বহিষ্কার করা হলে তা কার্যকর হবে না। আওয়ামী লীগের এই ঘোষণা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য সহায়ক হবে। সেই সঙ্গে নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে কাজে লাগবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি মানেই আওয়ামী লীগের বিরোধিতা আর বিএনপির পক্ষ নেয়া অথবা আওয়ামী লীগের পক্ষ নেয়া বা বিএনপির বিরোধিতা করা। চিরায়ত গল্পের প্লটের মতো বিষয়টি। বাংলাদেশের গণতন্ত্র মানেই বিএনপিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এমনটি নয় আবার আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই। গণতন্ত্রের জন্য অন্য পথের সন্ধান থাকাও জরুরি।
বাংলাদেশে রাজনীতি বিশ্লেষণের জায়গা থেকে এসব বিষয় খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির পক্ষ নিলেই মনে করা হয় গণতন্ত্র রক্ষা হবে। বিষয়টা ঠিক তা নয়। যারা দলছুট হয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে একটি দল সৃষ্টি করে তাদেরও কোনো লক্ষ্য থাকে না। এসব হচ্ছে নিজের নামটা প্রচারের আলোয় আনার একটা উদ্যোগ মাত্র। গণতন্ত্রের নামে এরকম চিন্তা-চেতনার রাজনীতির কারণেই বাংলাদেশের আজ এই অবস্থা।
গণতন্ত্রের জন্য বিকল্প পথের অনুসন্ধান ছাড়া শুধু সরকারি দলকে কাবু করার প্রচেষ্টাও আজকের সময়ে কোনো কার্যকর পন্থা নয়। এ ধরনের রাজনীতি জনগণ গ্রহণ করছে কিনা সেটাও দেখার বিষয়। দেশের একটা বড় অংশের মানুষের মনেই রাজনীতিতে অনীহা তৈরি হয়েছে।
জনগণের গণতন্ত্রের অনেক আশাই স্ফুলিঙ্গের মতো অদৃশ্য হয়েছে। যেসব আশা ফলবতী হয়েছে তার বেশিরভাগই ক্ষমতাবানদের স্বপ্ন ছিল। গণতন্ত্র বা রাজনীতির লক্ষ্যে ছিল না সেসব। যে কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শঙ্কা দূরীকরণে রাজনীতিবিদদের কোনো ভূমিকা নেই গত কয়েক দশকে। কারণ তারা গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা চায়।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসটাই ক্ষমতাকেন্দ্রিক। যারা ক্ষমতার সঙ্গে ছিল তারা উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্যরা রাজনীতিও বদলাতে পারেনি, সমাজও বদলাতে পারেনি। নিজেদেরকে তো না-ই। হতাশায় অনেকে অবসরেই গেছেন।
রাজনীতির সঙ্গে ব্যাপক অর্থযোগের বিষয়টা সবসময় গোপন রাখা হয়। এই লোভ ও লুকোচুরির কারণে রাজনীতি বিপথে গেছে। রাজনীতিতে অধিকাংশের উদ্দেশ্যই অর্থযোগ। এটা প্রকাশ্যে নিয়ে আসার কোনো হিম্মত রাজনীতিবিদরা রাখেন না। যদিও ক্ষমতায় গিয়ে তারাই আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি নিরোধক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃত্ব পেয়ে বসেন।
গত ১৫ বছর ধরে রাজনীতিতে সরকারি দল এবং তাদের অনুগত বিরোধী দল যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে তা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। নির্বাচনে বিএনপি না থাকলে জাতীয় পার্টিই বড় বিরোধীদল। ক্ষমতার হালুয়া-রুটি পেতে লেজ নেড়েচেড়ে ঘুর ঘুর করে তারা। গণতন্ত্রের জন্য নয় তারা নির্বাচনে এসেছে সুযোগ-সুবিধা ভোগের আশায়। এরকম ওয়ানম্যান শো পার্টিগুলোই নির্বাচনে এসেছে। যেমন জাসদ। আগে তো জাসদ অনেক বার ভেঙেছে। গত ১৫ বছর ধরে সরকারের সঙ্গে ঐক্যে থাকা জাসদটি নিজেদের ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি, এই সময়ের মধ্যেও কয়েক টুকরো হয়েছে তারা। জাসদের মতো একটি দল গত ১৫ বছর ধরে এত সুযোগ-সুবিধা পেলেও সরকারের বাইরে গিয়ে দল গোছানোর জন্য কোনো কাজ করেনি। অথচ তাদের একটি বিরাট সুযোগ ছিল এটা। এসব ভাবলে এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে বেশ সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
আওয়ামী লীগের এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে নতুন করে ভাবনার সুযোগ তৈরি হতে পারে। তবে তাদেরকে দক্ষতার সঙ্গে চালনা করা কী সম্ভব? বাংলাদেশে কার্যকর বিরোধী দল থাকা জরুরি। নির্বাচনকেন্দ্রিক এই হুজুগে পার্টিগুলোই দেশের গণতন্ত্রহীনতাকে আরও ত্বরান্বিত করবে।