গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২০০২ সালে বিএনপি ও চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকার সময় একুশে পদক এবং ২০২১ সালে আওয়ামী লীগের সময়ে স্বাধীনতা পদক পান। এটা কেবল তার মতো গুণীর পক্ষেই সম্ভব।
Published : 05 Sep 2022, 09:46 PM
যেথায় কোকিল ডাকে কুহু
দোয়েল ডাকে মুহু মুহু
নদী যেথায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়
বিবিসির জরীপে সেরা বিশ গানে স্থান পাওয়া এই গানে একবার,মাত্র একবার আপনি যেতে চেয়েছিলেন আপনার ছোট্ট সোনার গায়ে। মানুষ আসলে একবারই যায়। সবগুলো রেডিও, টেলিভিশন আর পত্রিকা একযোগে বলছে, আপনি চলে গিয়েছেন অন্য কোথাও অন্য কোনও খানে। জনপ্রিয় আরেক গানে মিনতি করে লিখেছিলেন- ‘বকুলেরও মালা শুকাবে/ রেখে দেবো তার সুরভী/ দিন গিয়ে রাতে লুকাবে/ মুছো না তো আমারই ছবি’...
হয়তো আপনি চোখের আড়াল হয়েছেন, হয়তো আপনি চলে গেছেন কাছে কিংবা দূরের কোথাও। দিন যেয়ে রাতে লুকানোর পরও খুব বেশি মনে হবে আমাদের-আপনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন। কোন কোন বকুলের মালা শুকোনোর পর আরও বেশি ঘ্রাণ ছড়ায়। কেউ কেউ আরও বেশি উজ্জ্বল হন চলে যাবার পর। প্রস্থানে আপনি আরও বেশি উজ্জ্বল, না মোছার আকুতি জানানো আপনার ছবি আরও বেশি শোক জাগানিয়া।
শোক জাগানিয়া শহীদ মিনারে আপনাকে দেওয়া বিদায়ী গান স্যালুট। যে শহীদ মিনারে আপনাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হলো সেখানে দাঁড়িয়ে আপনার সন্তানরা বুক উচু করে ভাবতে পারবে আপনি, হ্যা আপনিই লিখেছিলেন সেই কালজয়ী গান- ‘জয় বাংলা বাংলার জয়।’ স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই ইতিহাসের অংশ হয়ে যান আপনি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পর ‘জয় বাংলা’ শব্দটা আপনার মন থেকে যাচ্ছিল না। ফার্মগেটের এক বিখ্যাত স্টুডিওতে বসে আপনি গানটি লিখেছিলেন, সুর করেছিলেন আনোয়ার পারভেজ। শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও আব্দুল জব্বারের গাওয়া সেই গান নিয়ে আপনি গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। ‘জয় বাংলা’র মন্ত্রমুগ্ধতায় স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বেল দেশবাসীর কাছে এই গান হয়ে উঠলো প্রধান অস্ত্র. মানুষের হৃদয়ের এই গান রয়ে গেল মানুষের হৃদয়েই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা হলো এই গান দিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আপনি পেয়েছিলেন আপনার জীবনের অন্যতম সম্মাননা প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক। রাজনৈতিক বিশ্বাসের সূত্র ধরে স্বাধীনতার পর অনেকেই বিভাজিত হয়েছেন, আপনিও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাথে জড়িত হয়েছেন। ‘জয় বাংলার’ ভালোবাসা বা ঘোর থেকে আপনি বের হয়ে আসেন নি। এর কারণ হয়তো এই যে সংগীত কখনো তার শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। শারীবিকভাবে আপনি এই পৃথিবীতে থাকবেন না, কিন্তু আপনার প্রস্থানের পরেও আপনার লেখা গান আরও বেশি উজ্জ্বল হবে পরবর্তী প্রজন্মের কণ্ঠে। মানুষ থামতে বাধ্য হয় একদিন, সংগীত থামে না কখনো।
প্রস্থানের পর মানুষ যেখানে যায় সেই যাত্রার জনপ্রিয়তম এক গল্প আছে আপনার গানে। ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’ ছবির (পরিচালক আমজাদ হোসেন, শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী) সেই অমর গান- ‘আছেন আমার মোক্তার/ আছেন আমার ব্যারিস্টার/ শেষ বিচারের হাইকোটেতে তিনি আমায় করবেন পার/ আমি পাপী তিনি জামিনদার’।
'মনের ঘরে তালা দিয়া চাবি নিয়া যে সাঁই সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন' তার হুকুম ছাড়া কারোই বাইরে যাবার সাধ্য নেই। সাঁই এর কাছে যাত্রার যে দ্রুতযান সেখানকার টিকেট আপনি কেটে রেখেছিলেন যেন অনেক আগেই। গানে গানে যতই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হোক– ‘তুমি আরেকবার আসিয়া/ যাও মোরে কান্দাইয়া/ আমি মনের সুখে একবার কানতে চাই- আপনার লেখা গানের বাস্তবতা ধরেই বলা যায় আপনি আর ফিরবেন না। মরমের রাঙা পাখিটা উড়েই গেছে শেষমেষ! আপনি যেমন লিখেছিলেন- ‘মরমে রাঙা পাখি/ উড়ে সে গেল নাকি/সে কথা জানা হলো না…/ গীতিময় এইদিন চিরদিন বুঝি আর রলো না।’
আপনাকে দিয়ে কিছু হবে কি হবে না সেই ভয় ছিল আপনার পিতার, আপনার পিতা ভেবেছিলেন আপনাকে নিয়ে দেখা তার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। সমৃদ্ধ পরিবারের সন্তান আপনি। পড়ালেখাতেও ছিলেন ভালো। কলেজ পেরিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মেডিকেল কলেজে। শরীরের কাটাছেঁড়া আর ওষুধের চেয়ে হৃদয়ের রক্তক্ষরণের রঙ আপনাকে টেনেছিল বেশি। রক্ত আর ব্যান্ডেজের রঙের চেয়ে সংগীতের রঙটাকেই বেছে নিয়েছিলেন আপনি। ১৯৬১-৬২ সালে মেডিকেলে পড়ার সময়ে আপনি গানের নেশায় জড়িয়ে পড়েন, গান লিখতে শুরু করেন। গান লেখার কথা জানতে পেরে অভিমানাহত এক চিঠিতে আপনার বাবা আপনাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন- 'ইউ আর মাই লস্ট গেইম'। এরপর বহুদিন গেছে, এদেশের মানুষের মনে হয়েছে আপনার জীবনের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত ছিল ডাক্তারি পেশার সাথে না থাকা। মন যা চেয়েছে আপনি তাই করেছেন। তাই ‘বনের মনে রং লেগেছে’ গানটা লিখতে পেরেছিলেন এবং এই গান দিয়েই সংগীত যাত্রার শুরু। ১৯৬৪ সাল থেকে আপনি রেডিওতে গান লেখা শুরু করেন। ১৯৬৭ সাল খেকে ক্রমশ জড়িয়ে পড়েন চলচ্চিত্রের সাথে। চলচ্চিত্রের জন্য লেখা প্রথম গান ধুন্দুমার জনপ্রিয় হয়ে গেলে আপনাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সুভাষ দত্ত পরিচালিত সেই ছবির নাম ছিল ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ আর গানের কথা ছিল এমন- ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল/ বাতাসের আছে কিছু গন্ধ/ রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকি/ তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ।’
স্বাধীনতার আগে থেকেই আপনার গানের ছন্দ আর সৌরভ ছড়িয়ে পরেছিল চারিদিকে। চলচ্চিত্রের গানের সূত্র ধরে ছবির কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ রচনায় হাত দিয়েছিলেন। এরপর যুক্ত হন চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনায়। আপনার পরিচালিত সমাধি,স্বাধীন,সমর,শ্রদ্ধা, সন্ধি, পরাধীন, পাষাণের প্রেম, জীবনের গল্পসহ চল্লিশটির বেশি ছবি রয়েছে।
আসলে বাংলা ছবির স্বর্ণসময়ের কালজয়ী অনেক গান রয়েছে আপনার লেখা যা এদেশের মানুষের জন্য রুচিময় এক পথ তৈরি করেছে। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ যেমন আছে, দেশপ্রেম মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও তেমনি প্রকৃতি আর প্রেম বিরহের এক সহজাত বোধ আছে আপনার গানে যা শ্রোতাদের ধরে রেখেছে সুরের বন্ধনে। কিন্তু সব গান আপনার নিজের সংগ্রহেই ছিল না। আপনার ধারণা ছিল পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আপনি বিশ হাজারের মতো গান লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আপনার বাসাতে থাকা গানের পাণ্ডুলিপি যুদ্ধের পর আর ফেরত পান নি আপনি। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ পাকিস্তানিদের এমন কাঁপন ধরিয়েছিল যার ফলে পাকিস্তানিরা হামলে পড়েছিল আপনার বাসায়। জনপ্রিয় কত গান আছে আপনার? সারা বিশ্বের বাংলাভাষাভাষি মানুষের ভোটে বিবিসির প্রথম বিশটি গানের ভেতরে স্থান পেয়েছিল তার তিনটিই ছিল আপনার লেখা। এই তিন গান হচ্ছে- জয়বাংলা বাংলার জয়, একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল এবং একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গায়।
‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’র মতো দেশ প্রেমের বাইরেও প্রকৃতি আর প্রেমের গানেও আপনি ছিলেন অসাধারণ। যেমন- ‘সে যে কেন এলো না কিছু ভালো লাগে না’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও, পারি না ভুলে যেতে স্মৃতির ঐ মালা গেঁথে’, ‘আমি ধন্য হয়েছি ওগো ধন্য তোমারই প্রেমেরই জন্য’, ‘যার ছায়া পড়েছে মনেরই আয়নাতে’, ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাধন কেটে যায়’, ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে’ , ‘চোখের বাঁধন এমনি কইরা’, ‘ও আমার রসিয়া বন্ধুরে’, ‘ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না’, ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই’, ‘জানি না সে হৃদয়ে কখন এসেছে’, ‘চোখ যে মনের কথা বলে’, ‘বলে দাও মাটির পৃথিবী’, ‘তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছ আমার অজান্তে’, ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’, ‘নীল আকাশের নীচে আমি’, ‘প্রেমের আগুনে জ্বলে গেলাম’, ‘সজনী গো’ কিংবা ‘মন চায় প্রতিদিন তুমি আমি একদিন…’
এমন গানের আরও উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। নিজের পরিচয় তথা নায়ক-নায়িকার পরিচয় এর সূত্র ধরে লিখেছিলেন- ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়/ চলার পথে ক্ষণিক দেখা এ কি শুধু অভিনয়’। লিখেছিলেন এবং বেঁচে থাকবেনও- ‘গানের খাতার স্বরলিপি হয়ে’।
গান গেয়ে যে পরিচয়, যে বাংলা গানে আপনি বেঁচে থাকবেন স্বরলিপি হয়ে, সেই গানের জগতে আপনার আরেকটা পরিচয় আছে। গানে গানে বলেছিলেন- ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’। সেই দেশ মাতৃকার সাথে আপনি কখনো বেইমানি করেননি। অনেকেই সামান্য স্বার্থের জন্য বিভাজিত হয়েছেন, জাতীয়তাবাদী দল করা সংগীত ও অভিনয়ের মানুষরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু আপনি সম্রাট হয়েছিলেন আপনার জগতে। নিজ স্বার্থ আর বিভাজনকে কখনো মাথায় রাখেন নি। হয়তো আপনার পক্ষেই সম্ভব ছিল ২০০২ সালে (তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি তথা চারদলীয় জোট) একুশে পদক পাওয়া এবং ২০২১ সালে (ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ) স্বাধীনতা পদক পাওয়া। একাধিকবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থার (বাচসাস) পুরস্কার,আজীবন সম্মাননাসহ একশ-রও বেশি পুরস্কার পেয়েছেন আপনি। পুরস্কার এসেছে আপনার কাছে, আপনি পুরস্কারের জন্য কোথাও যাননি। সংগীতের শেকড়ের সাথে কখনো বেইমানি করেন নি। আপনি সংগীতের জগতে অভিভাবক হয়েই ছিলেন। শেষযাত্রায় বিউগলের করুন সুর জানান দিয়েছে- যে দেশে জন্ম নিয়ে আপনি ধন্য হয়েছেন, যে দেশের স্বাধীনতা বা ‘জয়বাংলার জয়ে’র আপনি ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী, সেই বাংলার সংস্কৃতিকেও ফেলে রাখা হয়েছে বিভাজনের বাঁকে। আপনি কি হৃদয়ের একান্ত চাওয়া সেই ঐক্যের শেষ বাঁশিওয়ালা ছিলেন? স্বাধীনতার পর পরই কী আপনি সেটা বুঝতে পেরেছিলেন? সেই কারণেই কী লিখেছিলেন- ‘সেই পথে পথে আমি একা চলি’!
বিশেষ দ্রষ্টব্য: যে জগতে উড়াল দিলেন সেই জগতে কী আপনার গানের খাতা আর স্বরলিপিও নিয়ে গেছেন? কেউ কি আপনাকে প্রশ্ন করবে –‘আলো নদীর এক দেশ’ থেকে এসেছেন? যদি কেউ প্রশ্ন করে কাব্যগীতি বা কলকাকলির কোন দেশ থেকে এসেছেন, আমরা জানি আপনি আপনার গানের ভাষায় উত্তর দেবেন- “বলবো আমি বাংলাদেশ”।
বিদায়ী অভিবাদনের বিউগলের সুরে আপনার গানের স্বরলিপি ছড়িয়ে গেছে সারা বাংলাদেশে।