করোনাভাইরাস সংক্রমণ: মুক্তির প্রত্যাশায় নববর্ষ পালন

Published : 13 April 2021, 07:05 PM
Updated : 13 April 2021, 07:05 PM

'বাংলা নববর্ষ' বাঙালির জীবনের এক অবিস্মরণীয় আনন্দের উৎসব। এ উৎসবের দিনে বাঙালি জাতির প্রতিটি মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়। বাংলা নববর্ষের এ অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটি এ উৎসবকে অন্যান্য উৎসব থেকে করেছে পৃথক। বাঙালির জীবনের অন্যান্য উৎসবগুলো কোন নির্দিষ্ট ধর্ম, বর্ণ বা জাতির জন্য হলেও এই বাংলা নববর্ষের উৎসবের কোন পরিসীমা নেই যে কোন স্তরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এই উৎসবে অংশ নিতে পারে। উৎসবের এই সার্বজনীনতা উৎসবের আনন্দ কে বহুগুন বাড়িয়ে একে করেছে বাঙালির প্রাণের উৎসব।

আর সে কারণে হয়ত বাঙালির  জীবনের পরতে পরতে মিশে আছে এ উৎসবের রঙ। বাঙালির জীবনের কোথায় নেই নববর্ষের ছোঁয়া? নববর্ষ আছে  আমাদের সাহিত্যে, কবিতায়, আছে  আমাদের গানে, আছে আমাদের জীবনে। বাঙালির পরম আরাধ্য নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথেও আছে নববর্ষের ছোঁয়া। সে নববর্ষের ছোঁয়া  থেকেই বাঙালির গায়ক মন মেতে ওঠে- 'এসো হে বৈশাখ, এসো এসো… গানের সুর মূর্চ্ছনায় কিংবা 'তোরা সব জয়ধ্বনি কর… গানের সুর ঝংকারে।' 

তবে বাংলা নববর্ষের এ অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলা নববর্ষকে কম ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয় নি,  হয়নি বাংলা নববর্ষকে ঘিরে কম চক্রান্ত ।তবে কোন চক্রান্তই সফল হতে পারেনি বাঙালি সকল প্রতিকূলতা ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছে। ম্লান হতে দেয়নি তার পরম আকাঙক্ষ্যার উৎসব বাংলা নববর্ষের সৌন্দর্যকে। 

এ বাংলা নববর্ষকে ঘিরে হয়েছে বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র। কখনও সাম্প্রদায়িক কালিমা লেপনের চেষ্টা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলা নববর্ষ হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি। অথচ  বাংলা সালের প্রবর্তন করার উদ্যেগ নেন- সম্রাট আকবর, বাংলা সালের নিয়ম প্রণয়ন করেন- তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি, বাংলা সন প্রণয়ন হয়- সৌর সাল এবং আরবি হিজরি সালের উপর ভিত্তি করে,বাংলা সন গোনা শুরু হয় ১ থেকে নয়, তৎকালীন হিজরি সন ৯৬৩ থেকে,আধুনিক বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রস্তাবক – ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহএমন ধ্রুব শাশ্বত ইতিহাস থাকার কারণেই কুচক্রীদের নববর্ষকে ঘিরে কালিমা লেপনের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি ।

কখনওবা এ উৎসবকে পরতে হয়েছে জঙ্গিবাদের রোষানলে২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন; বাংলা ১৪০৮ সনের পহেলা বৈশাখ। প্রতি বছরের মতো সেবারও রমনার বটমূলে ছায়ানট কর্তৃক ঐতিহ্যবাহী বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে গানের অনুষ্ঠান চলাকালীন বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনা স্থলে ৯ জন সাংস্কৃতিক কর্মী ও দর্শক প্রাণ হারানোর পাশাপাশি আহত হন আরো অগণিত মানুষ; পরবর্তীতে আরো একজন মারা যান।জঙ্গিদের এ হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল বোমা হামলা ও মানুষ হত্যার মাধ্যমে চিরতরে এই উৎসবকে বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু বাঙালি বীরের জাতি জঙ্গিবাদের সেই রক্ত চক্ষুকে বুড়ো আঙ্গুল  দেখিয়ে পরের বছর দ্বিগুণ লোকের জমায়েত গড়ে তোলে

আমরা দেখেছি এ উৎসবকে ঘিরে নোংরামি করা হয়েছে। এ উৎসবের দিনে কিছু নরপশু কর্তৃক  নারীকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে- সমাজের নারীদের কাছে এক ভীতিপূর্ণ বার্তা দেওয়ার যে এ উৎসব নারীদের জন্য নিরাপদ নয় । কিন্তু চক্রান্তকারীদের সেই চেষ্টাও ভেস্তে গেছে। সকল মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে। 

শুধু এ নববর্ষ নয় নববর্ষের মূল আকর্ষণ। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়েও করা হয়েছে চক্রান্ত। এ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিতে চেষ্টা করা হয়েছে, বলা হয়েছে এই শোভাযাত্রা হিন্দু ধর্ম থেকে অনুপ্রাণিত। অথচ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশে দুটি শোভাযাত্রা হয় যা ধর্মভিত্তিক একটি হচ্ছে মহররমের সময়কার শোভাযাত্রা এবং অপরটি জন্মাষ্টমীর  শোভাযাত্রাবরং মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে কোন ধর্মীয় বিষয়ের সম্পর্ক নেই এবং যেকোনও ধর্মের উৎসবের বাইরে বাঙালি হিসেবে সার্বজনীন একটি উৎসব হিসেবেই সূচনা হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার। চারুকলা থেকে এ শোভাযাত্রার শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। যদিও সেটা তখন এতটা বর্ণাঢ্য ছিল না।  

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিজ-নিজ জায়গা থেকে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছিলেন অনেক শিল্পী-সাহিত্যিকমঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখা যায় কোন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির উদ্ভব হয়নি বরং উদ্ভব হয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে এবং যা আজও অব্যাহত আছে। ২০১৬ সালে বাংলা নববর্ষ বরণ করে নেওয়ার  এ উৎসবটি ইউনেস্কোর অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যে বাঙালিকে কোন বিভ্রান্তির বেড়াজালেই আবদ্ধ করা যায় নি। বাঙালি সমস্ত বেড়াজাল ছিন্ন করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।সকল প্রতিকূলতা এবং বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে লড়াই করে স্ব মহিমায় উজ্জ্বল রেখেছে প্রানের উৎসব বাংলা নববর্ষকে। এবার নববর্ষেও বাঙালিকে লড়াই করতে হবে। তবে এবারের লড়াইটা ভিন্ন আঙ্গিকে ,জোট বদ্ধ নয়, বরং লড়াইটা হবে একা এবং নিজ অবস্থান থেকেলড়াইটা করতে হবে করোনাভাইরাস নামক এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। যে শত্রু পৃথিবীব্যপি লাখো প্রাণের স্পন্দনকে থামিয়ে দিচ্ছে। যে শত্রু বিশ্ব মানবতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা নামক ভাইরাসের দ্বিতীয় ধাক্কায় করোনার সংক্রমণ ভয়াবভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনার নুতুন নতুন ও শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে মানুষকে। অদৃশ্য এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষ রীতিমত অসহায় হয়ে পড়েছে।এই ভয়াবহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র পথ হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র উদাসীনতা ডেকে আনতে পারে মহা বিপদ। তাই নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে আমাদের এইনববর্ষে জনসমাগম পরিহারের বিকল্প নেই।      

প্রতিবারের মত এবার আমরা বাঙালিরা 'মঙ্গল শোভা যাত্রা' করবো না, তবে বুকে থাকবে  করোনা নামক অমঙ্গল বিনাশের দৃপ্ত শপথ। এবার হয়ত আমরা মৌলবাদী শক্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জোটবদ্ধভাবে উৎসবে মেতে উঠবো না। বরং এবার  ঘরে থেকে করোনাভাইরাসকে বাংলাদেশ থেকে বিদায়ের লড়াইয়ে মেতে উঠবো। 

সর্বোপরি বলা যায়-  'মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,.. অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা… ' গানটি গেয়ে আমরা হয়ত এবারও   আমাদের নববর্ষ উদযাপন শুরু করবো তবে ভিন্ন আঙ্গিকে , জোটবদ্ধভাবে নয় বরং যার যার বাসগৃহে অবস্থান করে গাইবো এবং আমাদের ধরাকে শুচি করার জন্য সত্যিকারের এক জ্বররার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবো।