Published : 06 Nov 2020, 10:54 AM
বিগত শতকের নব্বই দশকের শেষের দিকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। গ্রাম আর মফস্বলের পাট চুকিয়ে ততদিনে রাজধানী ঢাকা শহরে স্থিত হতে শুরু করেছি। রাজধানী জীবনের পূর্বভাগে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য সাময়িকীগুলো তন্ন তন্ন করে পড়লেও জানা হয়ে উঠেনি কোন কাগজের সাহিত্য সম্পাদক কে। স্বল্পদৈর্ঘ্য রাজধানী জীবনে জেনে গিয়েছি জনকণ্ঠের সাহিত্য সম্পাদক কবি নাসির আহমেদ, সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত। ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক কবি আল মুজাহিদী, নামটি আগেই জেনে গিয়েছিলাম।
একদিন আমার বিভাগের এক শিক্ষক, সকলের প্রিয় শিক্ষক, যার স্নেহের অগ্রাধিকারে অনেকে ধন্য। আমিও সেই দলে। তিনি লেখালেখি এবং চিত্রসমালোচনা জগতের একজন মানুষ। তিনি একদিন আমাকে গোটা তিনেক ক্যাসেট আর একটা টেপ দিয়ে বললেন এই ক্যাসেটগুলোতে একটা সাক্ষাৎকার রয়েছে, তুমি এগুলো শুনে শুনে লিখবে। এই জন্যে তুমি টাকা পাবে। আমি মহাখুশিতে কাজটা করে দিয়েছিলাম। যদিও টাকা আর পাইনি, সে আক্ষেপও আর নাই। কেননা আমার কৃষক বাবার কাছ থেকে একটা শিক্ষা ছোট সময়ে পেয়েছিলাম। সেটা বড় হয়ে ওঠার কালেও দারুণ কাজে দিয়েছে। জীবনে ঠকা আর জেতা বড় বিষয় না, বড় বিষয় হল মানুষ চেনা। এর চেয়ে বড় শিক্ষা আর নাই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মানুষ চেনার শিক্ষাটা বড় কাজে দিয়েছে, ঠকি আর জিতি। ক্যাসেটের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ঐ ক্যাসেটের সাক্ষাৎকারটি ছিল ভারতের বাঙালি চিত্রশিল্পী গণেশ হালোই'র। যিনি জন্মেছিলেন আমাদের পাশের এলাকা জামালপুরে, আমার বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুরে।
আমি এর আগে গণেশ হালোই'র নামটিও জানতাম না। আমার পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকেই সাক্ষাৎকারটি লিখতে বেশ কয়েকদিন লেগে গেল। অনেক কিছু জানা হল। ঐ সাক্ষাৎকারটি হাতে লিখে ক্যাসেট আর টেপসহ স্যারকে দিতে গেলাম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন দুইজনে- তাদের একজন হলেন আমার শিক্ষক, আরেকজন হলেন মাহমুদ আল জামান। সাক্ষাৎকারটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে স্যার বললেন, তুমি কি জানো এই মাহমুদ আল জামান কে? আমি বললাম, 'না'।
উনি হচ্ছেন সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত। মাহমুদ আল জামান হচ্ছে ওনার লেখক নাম। বলা সংগত মাহমুদ আল জামান নামে ছাপা হওয়া গদ্য ও কবিতা আমি কাগজে পড়েছি। তখনও জানি না এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি সংবাদেই ছাপা হবে। এর দিন কয়েক পরে কোনো এক বৃহস্পতিবারে সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে দুই কি তিন পৃষ্টা জুড়ে সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছে। আমার নামটি উল্লেখ নাই। তাতে আমার দুঃখ নাই, ভ্রুক্ষেপও নাই। আমি লিখে দিয়েছি, ছাপা হয়েছে, স্যার খুশি, আমিও খুশি।
এরপর আমি ঢাকা শহরের বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় ডাকযোগে কবিতা পাঠানো শুরু করলাম। ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকী আর জনকণ্ঠের সাময়িকী বাদে। কারণ ততদিনের এই দুই সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে সামাদ স্যারের সূত্রে (কবি মুহাম্মদ সামাদ) ব্যক্তিগত চেনা পরিচয় হয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জেনে গিয়েছিলাম ইত্তেফাকের বিশেষ সংখ্যাগুলোর দায়িত্বে আছেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের ছেলে শাহীন রেজা নূর। আমি ইত্তেফাকের বিশেষ সংখ্যার সম্পাদক বরাবর এবং সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক বরাবর ডাকযোগে কবিতা পাঠাতে শুরু করলাম। হঠাৎ একদিন দেখি সংবাদের সাহিত্যপাতার উপরের দিকে ডান কোণায় আমার একটি কবিতা ছাপা হয়েছে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ইত্তেফাকের ঈদসংখ্যায় একটি কবিতা ছাপা হয়েছে। তার পরপরই শাহীন রেজা নূর অনেকটা বিদেশেই থাকা শুরু করলেন। ইত্তেফাকের সঙ্গে লেখালেখির যোগাযোগটা ক্ষীণ হয়ে গেল। বাকি থাকল সংবাদ।
একদিন সংবাদে ফোন করে সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। ওপাশ থেকে হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে সংযোগ দেয়া হল। আমি পরিচয় দিলাম, কবিতা ছাপা হবার কথা বললাম। উনি পরিচয় পর্ব শেষ হতে না দিয়েই বললেন, "আপনার কবিতার বিল একসময় এসে নিয়ে যাবেন। আমি বিল করে দিয়েছি।" আমার ধারণা তিনি ভেবেছিলেন, আমি বিলের খোঁজ নেবার জন্যেই ফোন করেছিলাম। আমি বললাম, আমি আসলে এই জন্যে ফোন করিনি। আমি অন্য একটি কারণে ফোন করেছি। 'বলুন বলুন' কি কারণে ফোন করেছেন।
আমি কি আপনাকে আমার গদ্যলেখাও পাঠাতে পারি। "পাঠান পাঠান।"
আমি এরপরে ত্রিপুরার ককবরক কবি চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং এবং পশ্চিমবঙ্গের জয়দেব বসু এবং সেবন্তী ঘোষের সাক্ষাৎকারভিত্তিক দীর্ঘ একটি লেখা হাসনাত ভাইকে পাঠিয়েছিলাম। এরপরের সপ্তাহে দেখি উনি দুই পৃষ্ঠা জুড়ে সেই লেখা দরদ দিয়ে ছেপেছেন। যথারীতি সেই লেখার বিল করে দিয়েছেন। ঢাকা শহরের প্রথম জীবনের লেখালেখির শুরুর দিকের এরকম অদৃশ্য অভিষেক আমাকে সাহস জুগিয়েছিল। আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল। কিন্তু হাসনাত ভাই আর সংবাদে থাকলেন না। তিনি আমাকে একদিন জানালেন, হিসাব বিভাগ থেকে আপনার টাকাগুলো নিয়ে নিয়েন, আমি সব বিল করে দিয়েছি। আমি আর সংবাদে নিয়মিত থাকছি না, হয়তো অনিয়মিতভাবে যুক্ত থাকব। তবে যিনি দায়িত্ব নেবেন, তাকে আমি বলে যাব, আপনি লেখা চালিয়ে যাবেন। হাসনাত ভাই চলে যাবার পর সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সেই জৌলুস ধরে রাখতে পারেনি। আমি নিজে থেকে কেন জানি নবাগত বিজ্ঞজনের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনি। কালে ভদ্রে ডাকযোগে কোনো সূত্র ছাড়া একেবারে অভাজনদের একজন হিসেবে লেখা পাঠিয়েছি। বিজ্ঞ সম্পাদকের নজরে পড়েনি সেইসব লেখা, এমনটাই ভেবেছি।
এরপর হাসনাত ভাই বেঙ্গলের নানা কর্মযজ্ঞে নিজেকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছেন। ব্যক্তিগত যোগাযোগে দারুণ রকম ভাটা পড়েছে। যদিও ওই সময়গুলোতে ডেইলি স্টারে কর্মরত আমার বন্ধু চিত্রসমালোচক তকির হোসেনের মাধ্যমে হাসনাত ভাইয়ের খবরাখবর পেতাম। তিনি পুরান ঢাকার বাসা ছেড়ে ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট কিনেছেন। সেখানেই স্থিত হয়েছেন।
এরপরে আমিও নানান দেশের নানান শহরে রুটিরুজির দৌড়ে থাকতে থাকতেই পেরিয়ে গেল কয়েক বছর। শেষতক হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে ২০১৮ সালে কলকাতা আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলায় সাক্ষাৎ। আমি দূর থেকে তাকে দেখে কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে পরিচয় দিতে যাব, তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি চিনতে পেরেছি। কেমন আছেন? কোথায় কি করছেন? আমি এখন বেঙ্গলের পত্রিকা কালি ও কলমে আছি, লেখা পাঠাবেন। আমি বললাম, লেখা তো পাঠাই পত্রিকার ইমেইলে, আপনি পাননি? উনি বললেন, মনে তো পড়ছে না। আপনি এক কাজ করবেন, আমার ব্যক্তিগত মেইলেই পাঠাবেন। আমি দেখবনি। এই সাক্ষাতের পর একবার কি দুইবার তার সঙ্গে কথা হয়েছে। লেখালেখি বিষয়ে আর আলাপ হয়নি।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কালি ও কলমের সম্পাদকের দায়িত্ব ছাড়াও নানা বারোয়ারি কাজে তিনি ব্যস্ত থেকেছেন। তার মুখ দেখে মনে হয়েছে সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত কোথায় যেন আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছেন, আড়াল হতে বের হতে পারছেন না। পরে ভেবে দেখেছি একটা ঘটনা তারুণ্যের শুরুতে আমাকে লেখালেখিতে সংবাদের সাহিত্যের পাতায় আমাকে অভিষেক করা জাঁদরেল সম্পাদক আবুল হাসনাতের দৃষ্টি হয়তো এড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আবুল হাসনাতের চাকরি নিয়ন্ত্রণের সূতা যাদের হাতে ঘটনা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। ঘটনাটা ২০০৭-২০০৮ সালে মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন জামানায় ফ্রান্সে বাংলাদেশের অনন্য কিছু প্রাচীন প্রত্মনিদর্শন প্রদর্শনীর নামে পাচারের উদ্যোগের সঙ্গে নানাভাবে ঢাকার সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। এই প্রশ্নগুলো ওই সময়ে আমার কয়েকটি লেখায় আলোকপাত করেছিলাম। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই একজনের নামও এসব আলোচনায় স্থান পেয়েছিল। যে কারণে নানা মহলে অনেকে বিরাগভাজন হয়েছেন। আমার ধারণা আবুল হাসনাত এই বিরাগভাজনের দলে ছিলেন না। আমি এই ধারণা সারাজীবন লালন করতে চাই।
কবি মাহমুদ আল জামান বা সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাতের নন্দনভাবনার জগৎ ছিল ঈর্ষণীয়। তার সাজানো সংবাদ সাহিত্য সাময়িকীর সাদাকালো পাতাও কোনো কোনো কাগজের রঙিন পাতার চেয়েও বেশি আলোর দ্যুতি ছড়াত। হাসনাত ভাইয়ের পাতা সাজানো, অঙ্কন বাছাই, অলঙ্করণের সমাহার দেশ-বিদেশের নানা ভাষার সাহিত্য সাময়িকীর পাতা ঘাটাঘাটি করে বলা যায় অভিনব। সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী তার রেখে যাওয়া নন্দনভাবনার ঐতিহ্য বা নমুনা রক্ষা করতে পারেনি। বাকি কাগজগুলো আবুল হাসনাতের নন্দনভাবনার জগৎ কল্পনাও করতে পারেনি।
বেঙ্গলের কব্জায় দুই দশকের আবুল হাসনাতকে মূল্যায়ন করতে গেলে, সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক সাহিত্য-প্রজাতন্ত্রের অপ্রতিদ্বন্দী পথিকৃত আবুল হাসনাতকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আবুল হাসনাতের সংবাদে দুই যুগের সঙ্গে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের দুই দশকের তুলনা করতে গেলে এক কাথায় বলা যায় ইউ-টার্ন। কিন্তু আমি সত্যটাকে ভিন্নভাবে তুলে ধরতে চাই। কথায় আছে, পুরনো প্রেম ভাল, নতুন খেলনা ভাল। সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী ছিল আবুল হাসনাতের পুরনো প্রেম, আর কালি ও কলম সাময়িকী ছিল তার নতুন খেলনা।
বাংলা সাহিত্যের একটি প্রজন্মে আবুল হাসনাতের তারুণ্যে বাংলাদেশের লেখালেখির জগতে যদি সেরকম সময়ের ছাপ বাঙালির মনে দাগ ফেলে থাকে তা ছিল তার পুরনো প্রেমের কাল, সংবাদের দুই যুগ।
সময়ে ছাপ ফেলা রাতের আড়াল সরানো লন্ঠন হাতে চলা লেখালেখি জগতের সেই রানার, সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক, পুরনো পল্টনের ৩৬ নম্বরের দোতলায় বসা আবুল হাসনাতের মুখটিই আমার মনে যে স্মৃতির ছাপ ফেলেছে- সেই স্মৃতিই আমার মনে সারাজীবন থেকে যাবে। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ হাসনাত ভাই।