Published : 25 Feb 2019, 02:42 PM
বইমেলা ঘিরে আমাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আমরা শুনতে পাই এক অতিপরিচিত হুতাশ: মানুষ আর বই পড়ছে না। অথচ অসংখ্য মানুষ বইমেলা যাচ্ছে, ছবি তুলে ফেসবুকে দিচ্ছে, অসংখ্য 'লাইক' পাচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে নানা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে বই বর্তমানে বেশি পরিমাণে ছাপা হচ্ছে। আমাদের সাংস্কৃতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্ভবত আর্থিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার থেকেও বেশি! ফেসবুক খুললেই দেখা যাবে অসংখ্য মানুষের নতুন বই, কখনও বা একাধিক, এই বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে এবং অমুক নম্বর স্টলে গেলেই পাওয়া যাবে। লেখক কোন সময় নতুন বইসহ সেই স্টলে থাকবেন, অটোগ্রাফ বিতরণ করবেন-সেই বিবরণও থাকছে।
বইমেলার বার্ষিক উৎসবটিকে কেন্দ্র করে যে ভাবে বইপ্রেম উদযাপিত হচ্ছে, তাতে মনে হয় বই নিয়ে হাহাকারটি বাঙালির দৈনন্দিন ও শৌখিন অন্যান্য বিষাদবিলাসেরই অংশ। যখন টেলিভিশন আবিষ্কৃত হয়েছিল, অনেকেই হলফ করে বলেছিলেন সংবাদপত্রের দিন শেষ হলো, যে খবর মানুষ সেই মুহূর্তে চোখে দেখছে, সেই খবর পরের দিন বিস্তারিত পড়ে সে কী করবে। কিন্তু তা হয় নি, ভিন্ন আবেদন নিয়ে সংবাদপত্র টিকে গেছে। আজ দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম এসে বইকে আক্রমণ করেছে, মানুষ ওয়েব-সিরিজ় দেখছে তাই বই পড়বার সময়-ধৈর্য-অভ্যাস সবই গিয়েছে বলে যত অভিযোগ উঠুক, সত্য হচ্ছে: মানুষ হইহই করে বই পড়ছে কিনছে লিখছে। অনেকে বলে, যে বইগুলি প্রচুর বিক্রি হচ্ছে সেইগুলির মান ভালো নয়, লোকে কাফকা না পড়ে কমিক আর ভূতের গল্প পড়ছে। বিভিন্ন মোটিভেশানাল স্পিচ পড়ছে। কিন্তু তাদের শৈশব কৈশোর যৌবনকালে লোকে দস্তয়েভস্কি কিংবা কমলকুমারেই নিমজ্জিত থাকত, মোটে মাসুদ রানা কিংবা বিমল মিত্র পড়ত না— ব্যাপার এমন নয়। এদেশে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিংবা শওকত আলী কখনই পাঠকপ্রিয়তা পায়নি। তুলনায় হুমায়ূন-মিলনরা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অধিকাংশ মানুষ পত্রপত্রিকা ও থ্রিলার পড়তে ভালোবাসবে, সামান্য সংখ্যক লোকই মহৎ ও জটিল শিল্প নিয়ে মাথা ঘামাবে, এটাই যুগে যুগে সত্য। তাই বই পড়বার অভ্যাস ও ভালো বই পড়বার অভ্যাস সমার্থক নয়।
অনেকেই এখন বই পড়ছে ট্যাব-এ, বা কম্পিউটারের পর্দায়, বা কিন্ডল জাতীয় যন্ত্রে। অনেকে মোবাইলেই পড়ছে। কেবল মোবাইলে পড়বার জন্য লেখার জোগান দেয়ার প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে। সেইগুলিও তো পাঠ। ফেসবুকে কেউ যদি দিনরাত অন্যের পোস্ট পড়তে থাকে, তাও তো পাঠ। কেবল পৃষ্ঠায় মুদ্রিত অক্ষর পড়লে তা কুলীন অভ্যাস, আর পর্দায় সেই অক্ষর স্ফুট থাকলে তা নিম্নমানের অধ্যয়ন, এই মতের কোনও ভিত্তি নাই। নিঃসন্দেহে মানুষে এখন টেলিভিশন ও ইন্টারনেটে অসংখ্য অনুষ্ঠান দেখছে, কিন্তু তা দেখে অনেকে বই কিনতেও ছুটছে। একটি উপন্যাসের চিত্ররূপ দেয়ার পর সেই উপন্যাসের বিক্রি বেড়ে গেছে, এমন ঘটনা বিরল নয়। চিত্র মানুষকে স্পষ্ট ভাবে ঘটনাটি দেখিয়ে দিতে পারে, তার আবেদন প্রবল। বইয়ের যা দুর্বলতা— সে অক্ষরের মাধ্যমে ধারণাটিকে উপস্থাপিত করে, তার পর পাঠককে স্বয়ং ছবিটি নিজ হৃদয়ে রচনা করে নিতে হয়— এটাই তার শক্তি। মানুষ যেমন অন্যের নির্মিত ছবি দেখে আরাম পেতে ভালোবাসে, তেমনই নিজের নির্মিত ছবির নেশাও তাকে আলোড়িত করে।
আর যদি সত্যই এমন দিন আসে, যখন নতুন নতুন মাধ্যম এসে বইকে একেবারে বিলুপ্ত করে দিবে, অসুবিধা কোথায়? আগে কথকতা হত, মানুষ অধীর আগ্রহে সেই কথককে ঘিরে গল্প শুনবার জন্য বসত। তার পর বই এলো, কথকের চাকরি গেল। নিশ্চয় অনেক কথনপ্রতিভা মাথা খুঁড়ে মরেছে। তাতে মানুষের সংস্কৃতির জয়যাত্রা থেমে থাকেনি। পুতুলনাচের কথা আর কেউ বলে না, নিশ্চয় অনেক মানুষ আছে যারা পুতুলনাচের সাহায্যে অসামান্য শিল্প সৃষ্টি করতে পারত কিন্তু চলচ্চিত্রের দাপটে তা করতে পারেনি। কিন্তু এই ভেবে গালে হাত দিয়ে কাঁদতে বসলে, পৃথিবীর নতুন নতুন শিল্পমাধ্যকে আহ্বান জানানো হবে না, ইতিহাস তার পূর্ণ বৈচিত্রে বিকশিত হবে না। যেমন নিজ দৌড়ের ব্যাটনটা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে, দৌড় থেকে সরে দাঁড়াতে হয়, তেমন ভাবেই বইকে যদি সত্যিই এক দিন নতুন মাধ্যমের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হয়, তা সব বইপ্রেমীকে মেনে নিতে হবে। এবং অভিসম্পাত নয়, আশীর্বাদ ও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা দ্বারা নতুন মাধ্যমকে বরণ করে নিতে হবে। বইয়ের কাছ থেকে আমরা নিশ্চয়ই সেই শিক্ষা পেয়েছি।
বইমেলা নিয়েও আমাদের অনেকের মনে অনেক ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে। সব ব্যাপারে আমরা যেমন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাই, একদল 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম'পন্থী; আরেক দল আছেন 'এই বেশ ভালো আছি'পন্থী। কিছু মানুষ এখনকার কোনও কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। এরা হল 'আমাদের সময়' পার্টি। কথায় কথায় 'আমাদের সময়' আর 'আমাদের সময়'। এই পার্টি বলে, এখনকার গরুরা আর খাঁটি দুধ দেয় না, খানিকটা জল মিশিয়ে দেয়। আলুর চপে সেই টেস্ট নেই। এখনকার ছেলেমেয়েগুলো মহাপাজি। মনে মোটে ভক্তিশ্রদ্ধা নেই। ঈশ্বর পর্যন্ত কেমন যেন হয়ে গেছেন আজকাল। হাজার মাথা ঠুকলেও কিছু দিতে চান না। সে ছিল বটে 'আমাদের সময়'। আহা! দুধ, ঘি, মাখন আকাশ থেকে ঝরে ঝরে পড়ত। আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেই হত। 'আমাদের সময়' আম্বালার বালুসাই মুখে দিলে মনে হত যেন বেহেস্তি কিসমিস খাচ্ছি। মনটা ভরে যেত। আমরা বড়দের দেখলেই মাথা নোয়াতাম। টেনে তোলা যেত না। তখন স্বয়ং ঈশ্বরও ছিলেন সদয়। কত কিছু যে চেয়ে পেয়েছি। সুখ, শান্তি, মোক্ষ, প্রাপ্তি!
'আমাদের সময়' পার্টির বিপরীতে রয়েছে আরেক পার্টি, যাদের বলা যায় ফেসবুক-সেলফি পার্টি। যারা নিজেদের 'টেক স্যাভি' বলে জাহির করে। সত্যি 'টেক স্যাভি' নয়, বানানো 'টেক স্যাভি'। এই পার্টি হল 'হামবড়াই পার্টি'। হাবভাব হল 'হেভি আইটি আছি'। ফেসবুক করি, সেলফি তুলি, ইনফো নামাই। এত ব্যস্ততার মধ্যে বাবা–মাকে দেখতে পারি না। বন্ধুদের ভুলে যাই। প্রতিবেশীদের বিপদে পড়লে চিনি না। বিশ্বের 'ইনফো' নামাতে এত ব্যস্ত থাকি যে পাশের মানুষটার দুঃখ–কষ্টের ইনফরমেশন জানতে সময় পাই না। কোনও বিষয়ের গভীরে জ্ঞান অর্জনে মন নেই। টাকা রোজগার করি ফুর্তিতে দিন কাটাব বলে। ভেতরে ফোঁপরা হলেও বাইরেটা চকচকে। স্মার্ট ফোনের মতো নিজেকে স্মার্ট রাখব। স্মার্ট ফোনের মতোই নিজেকে ঘনঘন বদলাব। চ্যাটসর্বস্ব জীবনযাপন। ভক্তি টু প্রেম সব চ্যাটে। এই নিজেকে নিয়ে মাতোয়ারা পার্টি যে–কোনও হুল্লোড়েই খুশি। বইমেলায় কেন ঘাস কম, কেন খাবারের এত এলাহি আয়োজন, কেন বইয়ের বদলে অন্য ব্যবসার দিকে ঝোঁক বাড়ছে, কেন বই পড়ার প্রতি উৎসাহ কমছে— এইসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করবার সময়ই নেই। সব ঠিক আছে। মাস্তি হলেই হলো। বইমেলায় ঢুকে বই পাই না–পাই সেলফি পাব তো? ব্যস। ফটো তুলেই ঝটপট ফেসবুকে।
বইমেলাকে এই দুরকম চোখে দেখলেই গোলমাল হয়ে যাবে। আগের বইমেলা খুব ভালো ছিল। 'ঘাসে আঁকা, বেশিটাই ফাঁকা/ মোবাইলহীন, ঝালমুড়ি খাওয়ার দিন' ফিরে আসুক বলে কপাল চাপড়ালে কোনও লাভ হবে না। সময় বদলেছে। মানুষের ধ্যানধারণা বদলেছে। টেকনোলজিতে আমরা হুড়মুড় করে এগোচ্ছি। মিথ্যে টেক স্যাভিরাই নয়, সত্যি টেক স্যাভিরাও অনেক আছে। যারা শুধু 'চ্যাট ম্যাট ঘ্যাঁট' করে না, অনলাইনে প্রচুর বই কেনে। কম্পিউটার খুলে দুনিয়ার খবর রাখে। তাদের বইমেলায় নিয়ে আসতে হলে, মেলাকে প্রযুক্তিবান্ধব করতে হবে। গোটা দুনিয়াতেই স্থায়ী মেলার মাঠ হয়ে গেছে। সেখানে খুব একটা ঘাস থাকে না। ধুলো থাকে না। ফলে এই বইমেলা কেন ঘাসহীন, কেন কংক্রিট বেশি— এই নিয়ে চোখের জল ফেলে লাভ নেই। ঘাস থাকলে মেলায় যেতাম, বই কিনে ঘাসে বসে বাদাম খেতাম— এসব মিথ্যে কথা।
আসলে বইমেলায় 'আমাদের সময়' পার্টি আর 'সেলফি-ফেসবুক' পার্টি উভয়ের মেলবন্ধন দরকার। বইমেলাটা বইপ্রেমীদের জন্যই রাখতে হবে। বইমেলায় আমি আসল জিনিস চাই। মুগ্ধ হওয়ার মতো বই চাই। শুধু গল্প–কবিতা নয়, সমাজ, ইতিহাস, লোককথা নিয়ে ভালো ভালো সব কাজ চাই। অনেক গবেষণা, অনেক পরিশ্রম দিয়ে তৈরি কাজ চাই।
এজন্য আমাদের মন-মানসিকতা বদলাতে হবে সবার আগে। বই কেনার, বই পড়ার অভ্যেস বাড়াতে হবে। আমরা যারা বড় বড় বুলি আওড়াতে প্রসিদ্ধ আমরাও যদি সামর্থ্য অনুযায়ী অল্প কিছু পত্রিকা, বই কিনি তাহলেও কিন্তু স্টলগুলো মুখর থাকার কথা। এমনকি লেখকরাও আমাদের দেশে বই কেনে না। লেখকরা বেশিরভাগই পকেট থেকে পয়সা বের করে না। নব্বই শতাংশ কবি–সাহিত্যিকই মেলায় আসেন নিজের জন্য। কবি–সাহিত্যিক-লেখকরা অনেকে ভালো ভালো চাকরিও করে। তবু তারা বই কেনে না। একটু সিনিয়র হয়ে গেলে খালি ফ্রিতে নেওয়ার ধান্দা।
আমি চাই এমন একটা বইমেলা, যেখানে প্রত্যেকে যেন অন্তত একটা করে বই কিনবে। নিজের মনের তাগিদে। যার যেমন সামর্থ্য, যার যেমন পছন্দ। মেলায় ধুলা কতটুকু, কতটা ঝামেলা পোহাতে হয়, সেসব নিয়ে কথা কম হোক। বইমেলায় বইটাই আসল। বইয়ের কেনাকাটা হলে তবেই মেলা বাঁচবে। এতে শুধু প্রকাশক, লেখক, ছাপাখানা, প্রুফ রিডার, বাইন্ডার, ভ্যান রিকশা চালক বাঁচবে না, একটা জাতি বাঁচবে।