Published : 09 Aug 2016, 11:56 PM
ধূমপান ও স্থূলতা মানবদেহের হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসজনিত বিভিন্ন রোগের জন্য রিস্ক ফ্যাক্টর। ক্যন্সারের জন্যও তা রিস্ক বহন করে। এই রিস্ক হচ্ছে ঘটার সম্ভাবনা। নাও ঘটতে পারে। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আজকের যত বিতর্ক তাও সেরকমই রিস্কভিত্তিক বিতর্ক।
সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে ১,৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া কেন্দ্র করে যত বিতর্কের উৎপত্তি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্ভাব্য আশঙ্কার মধ্যে বায়ু, মাটি, পানি ও শব্দদূষণ ইত্যাদির প্রভাব বিবেচনায় আসে।
সুন্দরবন পৃথিবীর মধ্যে একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন যা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অংশে বিস্তৃত। বাংলাদেশ অংশে বনটির প্রায় ৭০ ভাগ বিদ্যমান। তাই সুন্দরবন বললে মূলত বাংলাদেশকেই বোঝানো হয়।
বনের বাস্তুতান্ত্রিক সার্ভিসের আলোচনায় বাংলাদেশের সুন্দরবনই একমাত্র বন যা বনের চরিত্র ধরে রেখেছে। এ বন ঠিক বাংলাদেশের একটি একক 'ফুসফুস' হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশে বিদ্যুতের যেমন প্রয়োজন আছে, মানবদেহের ফুসফুসের মতো সুন্দরবনেরও কোনো বিকল্প নেই।
রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতির যে আশঙ্কা তা সত্যিকারভাবে খতিয়ে দেখা যেমন প্রয়োজন, তেমনি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রামপালে না করে অন্য জায়গায় করা যায় কি না, যেখানে সুন্দরবন ব্যবহার করে কয়লা আনা-নেওয়ার প্রয়োজন পড়ত না, তা-ও ভাবলে ভালো হত।
গত ৬ আগস্ট একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত 'রামপাল প্রকল্প নিয়ে ১০টি প্রশ্নের উত্তর' শিরোনামের একটি লেখায় বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড যে উত্তরগুলো দিয়েছে, তাতে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আমাদের যে শঙ্কা তার অনেকখানি দূর হবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমাদের শঙ্কার মধ্যে ছিল বিদ্যুৎ কেন্দ্র যখন চলবে, তখন সেটি অধিক পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড ও মারকারিসহ জীবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর নানা রকম পদার্থ ও ভাসমান কণা নিঃসরণের জন্য দায়ী হবে। নাইট্রোজেন ও সালফারের অক্সাইডগুলো বায়ুমণ্ডলে গিয়ে নাইট্রিক এসিড ও সালফিউরিক এসিড তৈরি করবে, যা বৃষ্টির মতো মাটিতে পড়বে, যাকে আমরা 'এসিড বৃষ্টি' বলি।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড উত্তরে বলেছে, নাইট্রোজেনের অক্সাইডগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্টয়কিয়োমেট্রিক এয়ার ফুয়েল ও স্বল্পমাত্রার কমবাসশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। সালফারের অক্সাইডগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উন্নতমানের নিম্ন সালফারের কয়লা ব্যবহার করা হবে। তাছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির ফুয়েল-গ্যাস ডিসালফারাইজেশন (এফজিডি) পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে।
তদুপরি, নির্গত গ্যাস থেকে সালফারের অক্সাইড ও পারদ দূর করার জন্য ওয়েট লাইমস্টোন, ফোর্সড অক্সিডেশন এফজিডি ও ডাবল ফ্লু কনট্যাক্ট স্ক্র্যাবার টাইপ এফজিডি পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। ক্ষতিকর উড়ন্ত কণা দূর করার জন্য উন্নতমানের ইএসপি ব্যবহার করা হবে। বটম অ্যাশ ও ফ্লাই অ্যাশ দুটোই শুকনো অবস্থায় সংগ্রহ করে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করা হবে।
পানি পরিশোধন করার জন্য উন্নতমানের পরিশোধন পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। পশুর নদীতে পানি ফেলার পূর্বে পানির নিরাপদ পিএইচ মাত্রা সাতে পরিবর্তিত করা হবে। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রত্যাশিত নিরাপদ মাত্রায় চলছে কি চলছে না, তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য সার্বক্ষণিক অনলাইন মনিটরিং পদ্ধতি ব্যবহারের কথাও বলা হযেছে।
কয়লা পরিবহনেও সতর্কতা অবলম্বনের প্রতিজ্ঞা করেছে কোম্পানিটি। বড় জাহাজে করে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত কয়লা পরিবহন করা হবে। তারপর ছোট ছোট জাহাজে করে সম্পূর্ণ আবৃতাবস্থায় আকরাম পয়েন্ট থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত কয়লা নিয়ে যাওয়া হবে।
বিভিন্ন তত্ত্ব, তথ্য ও উপাত্ত থেকে জানা যায়, রামপালে যে পরিমাণ কয়লা প্রতিদিন পোড়ানো হবে এবং যতটুকু নাইট্রোজেন ও সালফারের উদ্গীরণ হবে, তাতে কোনোভাবেই এসিড বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
এত সব সতর্কতা অবলম্বন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের যে প্রতিজ্ঞা তা যদি সম্পূর্ণ সততার সঙ্গে পালন করা হয়, তাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য প্রচলিত বাজার দর থেকে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সরকার কিংবা বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ভর্তুকি দেওয়ার মানসিকতা আছে কি না তা আলোচনার দাবি রাখে।
আশঙ্কা হয়, যে কোনো কোম্পানিই লাভক্ষতি হিসাব করে বিনিয়োগ করে। এত সব সতর্কতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার যদি তাদের লাভের মাত্রা কমিয়ে দেয় কিংবা লাভ না হয়ে লোকশান হয়, তাহলে চূড়ান্ত পর্যায়ে কী দাঁড়াবে? হয়তো জনগনকে 'আইওয়াশ' করে কিছুদিন পর প্রযুক্তির ব্যবহার ও সতর্কতা বিসর্জন দিয়ে শুধু লাভালাভের দিকেই এগুবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব প্রতিজ্ঞা যদি পালন না করা হয়, তাহলে এর প্রেক্ষিতে কী করা হবে? কোম্পানিটির অসতর্কতা ও সস্তা প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে যদি আমাদের সুন্দরবন সত্যিই হুমকির মধ্যে পড়ে যায়, তাহলে কোম্পানিটিকে কি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে?
প্রায় চার হাজার বছর আগে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া সুন্দরবনের বর্তমান আকার প্রায় ১০ লাখ হেক্টর, যার প্রায় ৬ লাখ ১৭০০ হেক্টর বাংলাদেশে অবস্থিত। ইউনেসকো সুন্দরবনকে 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট' হিসেবে ১৯৯৯ সনে ঘোষণা দিয়েছে। এটি বিশ্বের ৫২২তম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এখানে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩৫৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণি এবং ১২০ প্রজাতির মাছ আছে। এর মধ্যে ১০টির মতো প্রাণি আছে যা বিলুপ্তপ্রায়। জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে পৃথিবীর মধ্যে এটি একটি অনন্য 'জীববৈচিত্র্য হটস্পট' হিসেবে চিহ্নিত।
এই বন বাংলাদেশের রিজার্ভ বনের প্রায় ৫১ শতাংশ। এর মাধ্যমে বনসংক্রান্ত প্রায় ৪১ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়। সব সরকারি বনের মধ্যে প্রায় অর্ধেক তক্তা ও জ্বালানি কাঠের উৎপাদন হয় এই বনে। তাছাড়া কাঠের বাইরে ব্যাপকভিত্তিক বনজদ্রব্য সংগ্রহ করা হয় সুন্দরবন থেকে।
প্রায় ১০ লাখের মতো মানুষ সুন্দরবনের উপর নির্ভর করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। তদুপরি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের জনসমাজকে সুন্দরবন তার সারা শরীরের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে বিভিন্ন সময় সাইক্লোন ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করছে। কৃষি জমিতে লবণাক্ততা সীমিত রাখার জন্যও এই বন বন্ধুর মতো কাজ করছে।
সুন্দরবনের আর কোনো বিকল্প নেই। সুন্দরবন নিয়ে ছেলেখেলার তাই সুযোগ নেই। এটি 'পুলসিরাতের পুল' পার হওয়ার মতো সততা ও দক্ষতা নিয়ে এগুবার মতো দায়িত্ব। একটি ১,৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে সুন্দরবন হুমকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
কোনো একটি সেনসিটিভ বিষয়ের ব্যাপ্তি প্রকাশে আমরা অনেক সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। কিংবা বিষয়টি অতিরঞ্জিত করে এর আসল রূপ ঢেকে দিই। এতে বিভ্রান্তি বাড়ে। রামপাল নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। অনেক আন্দোলন ও নির্মোহ বৈজ্ঞানিক আলোচনাও হয়েছে। এতদিনে বিভ্রান্তি দূর হওয়ার কথা।
সতর্কতা ও প্রযুক্তি, প্রয়োজনে ভর্তুকি যদি ঠিকঠাক থাকে, তাহলে সুন্দরবন ভালো থাকবে। অন্যথায় তা হুমকির মধ্যে পড়বে। রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে যদি রাজনৈতিক কোনো বিকল্প না থাকে তাহলেও মনে রাখতে হবে আমরা পুলসিরাতের পুল পার হচ্ছি। পা একটুখানি ফসকে গেলে অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে হতে পারে।