“আমার নাম মো. আনিসুর রহমান, ড. আনিসুর রহমান নয়। ডক্টরেট একটি ডিগ্রি। এটা আমার নামের আগে বসাবেন না। এখানে যারা দর্শকসারিতে আছেন, উপযুক্ত সুযোগসুবিধা পেলে এবং চেষ্টা করলে প্রত্যেকেই তা অর্জন করতে পারেন। এটা বাড়তি কিছু নয়। ড. নামের অংশও নয়।”
Published : 06 Jan 2025, 05:24 PM
১৯৯৭ সালের ঘটনা। তখন ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতাম। তখন সংস্থার পক্ষ থেকে চারদিনের একটা অনুপ্রেরণামূলক প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে যেতাম দেশের বিভিন্ন-জেলা-উপজেলায়। মূলত মানুষের ভেতরের আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তোলাই ছিল সেই প্রশিক্ষণের মূল বিষয়বস্তু। আত্মনির্ভর দেশ গড়তে হলে দান-খয়রাত নয়, নিজেদের আত্মশক্তিকে জাগিয়ে, নিজেদের শ্রম ও সম্পদ বিনিয়োগ করে যৌথভাবে ও স্বোচ্ছাব্রতী মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। তবেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। স্বেচ্ছাব্রতী মনোভাব নিয়ে আমরা সাক্ষরতা বাড়াতে পারি, পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি। গাছ লাগাতে পারি। বাল্য বিয়ে দূর করতে পারি। নারীর পুষ্টির ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি। নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে পারি।ছোট ছোট উদ্যোক্তা হিসেবে বিকশিত হতে পারি। এভাবে আমরা নানা উদাহরণ-দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে, গ্রুপ-ওয়ার্কের মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণটি পরিচালনা করতাম। অংশগ্রহণকারীরা সমাজের জন্য নিজে যা করতে পারে— একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করত এবং তা বাস্তবায়নের শপথ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ শেষ হতো।
তখন বগুড়া জেলায় তেমন এক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছিল। দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার সেই প্রশিক্ষণে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে রাজি করিয়েছিলেন মো. আনিসুর রহমানকে। আমার উপর দায়িত্ব বর্তেছিল তাঁকে কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড থেকে পাকড়াও করে বগুড়ায় নিয়ে যাওয়া। দুপুর বারোটায় হানিফ পরিবহনের একটি বাসে আমরা পাশাপাশি সিটে বসে বগুড়া গিয়েছিলাম।
সেটা ছিল একটা ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আনিসুর রহমান যখন বাস স্ট্যান্ডে আসেন, আমি দৌড়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিই এবং বলি: ‘এ যাত্রায় আমিই আপনার সঙ্গী।’ এরপর আমি স্যারের ট্রলি ব্যাগটি হাত থেকে প্রায় টান মেরে নিয়ে বাসের দিকে হাঁটা দিই। তিনি দৌড়ে গিয়ে আবার আমার হাত থেকে খপ করে ব্যাগটা কেড়ে নেন। এরপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, ‘আমি কি তোমাকে আমার ব্যাগটা নিতে বলেছি?’
আমি আহাম্মকের মতো একটা হাসি দিয়ে বললাম, ‘না স্যার।’
তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি আমার ব্যাগ নিচ্ছ কেন?’
আমি ভীষণ রকম অপ্রস্তুত হলাম। বললাম, ‘সরি স্যার।’
তিনি বললেন, ‘শোনো, এভাবে আর কখনো কারো ব্যাগ নিবে না। কেউ যদি অসমর্থ কিংবা গুরুতর অসুস্থ হয় এবং সে যদি বলে, তবেই কেবল অন্যকে সাহায্য করবে। একজন সুস্থ-সবল ব্যক্তিকে কখনো সাহায্য করার দরকার নেই। তার বোঝাটা তাকেই বহন করতে দিবে! বুঝেছ?’
আমি মুখে ‘জি স্যার’ বললেও একেবারে চুপসে গেলাম। কী কঠিন মানুষ রে বাবা!
সত্যি কথা বলতে কি আমি তখন আনিসুর রহমানকে ভালোভাবে চিনতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, অর্থনীতি পড়াতেন, লেখালেখি করেন— এইটুকুই শুধু জানতাম। ব্যাগ-সংক্রান্ত বেয়াদবির পর বাসে উঠে আমি আরেকটি বেয়াদবি করে বসি। পাশাপাশি সিটে চুপচুপ বসে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, এতদূরের পথ এভাবে চুপচাপ যাবার কোনো মানে নেই। আমি তার সঙ্গে খাতির জমাবার জন্য বলি, ‘স্যার, আপনার লেখা ‘আধুনিক অর্থশাস্ত্র’ বইটা আমি পড়েছি। খুবই সহজসরল ভাষায় বইটা লেখা। এটা ছাত্রদের জন্য খুবই উপকারী।’ এবার তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, ‘ওটা আমার লেখা নয়। অন্য কেউ লিখেছে।’ এরপর আমার মুখে আর কোনো শব্দ এলো না!
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অর্থনীতি পড়ার সময় ‘আধুনিক অর্থশাস্ত্র’ নামের বইটি পড়েছিলাম। লেখকের নাম আনিসুর রহমান। বইটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। আমি ওই লেখকের সঙ্গে অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমানকে গুলিয়ে ফেলেছিলাম! কম জানা বা ভুল জানার বিপদ সেদিন নতুন করে টের পেয়েছিলাম! পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওই আনিসুর রহমান আনন্দমোহন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।
যাহোক, আমাদের কথা আর হয়নি। বাস শেরপুর পৌঁছলে একটি হাইওয়ে রেস্টুরেন্টের সামনে যাত্রাবিরতিকালে আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘স্যার কি নামবেন?’ তিনি আমার কথা না শোনার ভান করে নিশ্চুপ ছিলেন!
ততক্ষণে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমার দু-দুটো ‘বেয়াদবি’ তিনি সহজভাবে নেননি!
এরপর আমরা চারদিন বগুড়ায় ছিলাম। তিনি চারদিনই পুরোটা সময় প্রশিক্ষণে কাটিয়েছেন। প্রতিদিনই তাকে অনেক অনুরোধ করা হয়েছে কিছু বলার জন্য। কিন্তু তিনি কিছুই বলেননি। তিনি শুনতে এসেছেন, বলতে নয়—এই ছিল তার শেষ কথা। তবে তিনি গান শুনিয়েছেন। সেবারই প্রথম তার কণ্ঠে গান শুনেছি। তিনি রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন। তার গায়নভঙ্গি ছিল আলাদা এবং অসাধারণ। পশ্চিমবঙ্গের পীযূষকান্তি সরকারের কণ্ঠের সঙ্গে তার কণ্ঠের ছিল আশ্চর্য মিল।
সেই যাত্রায় বগুড়ায় শিল্পকলা একাডেমিতে তিনি একদিন সন্ধ্যায় একক রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেছিলেন। পুরো ঘর অন্ধকার করে মঞ্চে মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে তিনি একের পর এক গান শোনাচ্ছিলেন। আর ফাঁকে ফাঁকে প্রতিটি গান রচনার প্রেক্ষাপট, রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ব্যাখ্যা করছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, সেদিন বগুড়ার শিল্প-সাহিত্য জগতের উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে সেই মোহনীয় সন্ধ্যাটি উপভোগ করেছিলেন। আমার জন্যও সেটি ছিল একটি স্মরণীয় সন্ধ্যা।
আমাদের প্রশিক্ষণের শেষ পর্বে তিনি কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কথা বলতে পছন্দ করি না। কারণ আমি নিজেকে একজন ব্যর্থ মানুষ মনে করি। জীবনে অনেক উদ্যোগ নিয়েছি। অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সফল হতে পারিনি। একজন ব্যর্থ মানুষের আর কী কথা বলার থাকে? তাই আমি বলার চেয়ে শুনতে পছন্দ করি। গল্প করতে পছন্দ করি। একজন মানুষ সংগ্রাম করে কীভাবে বেঁচে থাকে, নিজের বুঝ-বুদ্ধি দিয়ে কীভাবে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সফল হয়, টিকে থাকে, তা বোঝার চেষ্টা করি। কৃষক-শ্রমিকসহ দেশের শ্রমজীবীরা আমার কাছে আদর্শ। তাদের কথা শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। কোনো রকম তত্ত্ব ছাড়াই তারা জীবনকে এগিয়ে নেয়। সমাজকেও এগিয়ে নেয়। তাদের প্রতি আমার সব সময়ই গভীর শ্রদ্ধা।’
এই চারদিনে আমার সঙ্গেও একটু একটু করে স্যারের খাতির হয়ে যায়। তিনি হয়তো ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিলেন যে, আমি আসলে বেয়াদব নই, হয়তো না বুঝে একটু অসদাচরণ করে ফেলেছি, সেটুকু ক্ষমা করাই যায়! বগুড়া থেকে ফেরার পথে স্যারের সঙ্গে পুরো রাস্তা গল্প করতে করতে এসেছি। প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের কথা, বঙ্গবন্ধুর কথা, বঙ্গবন্ধু শাসনামলের কথা। আর ছিল রবীন্দ্রনাথ। শৈলজারঞ্জন মজুমদারের লেখা ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’ আমি পড়েছি জেনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন।
ঢাকায় ফিরেই আমি আনিসুর রহমান স্যারের লেখা বইগুলো সংগ্রহ ও পড়ার চেষ্টা করি। প্রথম পড়ি ‘যে আগুন জ্বলেছিলো।’ বইটি বৃহত্তর রংপুরের (সৈয়দপুর) কামারপুকুর ইউনিয়নের কুঁজিপুকুর গ্রামের স্বনির্ভর আন্দোলন নিয়ে লেখা। এই গ্রামের মানুষেরা সেদিন নিজেদের শ্রম আর সম্পদ দিয়ে বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়াই নিজেরা স্বাবলম্বী হয়েছিল— তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে বইটিতে। ১৯৭৪ সালের বন্যার পর দেশে যে চরম খাদ্য সংকট দেখা দেয়, তখনও কুঁজিপুকুর গ্রামের মানুষেরা সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা নেয়নি। কুঁজিপুকুর গ্রামের এই স্বনির্ভর আন্দোলনটি তখন গোটা রংপুর বিভাগে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এ আন্দোলন থেমে যায়।
বনেদি পরিবারের সন্তান আনিসুর রহমান জীবনে তেমন দঃখখ-কষ্ট ভোগ করেননি। কিন্তু একটি দরদি মন পেয়েছিলেন। তার সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ লিখেছেন, “অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমানকে আমরা শিক্ষক হিসেবে পাই। প্রথম দিনের ক্লাসে তিনি আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের কোনো টেক্সট বই নেই। তোমরা মাইক্রো ইকোনমিক্স শিখবে কৃষকদের কাছ থেকে। আর যদি টেক্সট বইয়ের দরকার হয়’, এই বলে আমাদের বিখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ঘরানার বিশিষ্ট ও জনপ্রিয় অর্থনীতিবিদ জোয়ান রবিনসন এবং ইটওয়েলের লেখা একটি বইয়ের নাম জানিয়ে দেন... স্যার একদিন বলেন, ‘ধরা যাক, একটা লোক পানিতে ডুবে যাচ্ছে। সাঁতার জানেন না। তাকে উদ্ধার করতে তুমি ঝাঁপিয়ে পড়লে। তারপর তার চুলের মুঠি ধরে তাকে ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে ঠেলে তাকে তীরে তুললে। লোকটা বেঁচে গেল। এটাকে কি উন্নয়ন বলা যাবে? এক অর্থে উন্নয়ন, কারণ তিনি মারা যাননি। কিন্তু ওই লোকটাকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো, আপনি কি এভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন? তিনি হয়তো বলবেন, ঠিক এভাবে নয়। অন্য একটা পথও তো ছিল। এটাকে এভাবে বলতে পারি, ধরা যাক, তুমি উদ্ধারের জন্য তার কাছে সাঁতরে গেলে। তাকে বললে, আমার এই হাতটা ধরেন এবং আমার সঙ্গে সঙ্গে তীরে চলেন। আমরা একসঙ্গে যাব। এটাই কিন্তু বেশি গ্রহণযোগ্য।’
আনিসুর রহমানের বাবা হাফিজুর রহমান ১৯৩৩-এ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিও ছিলেন। আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছিলেন, তার আগে প্রাদেশিক সরকারের। এমন বাবার সন্তান হয়ে লেখাপড়ায় ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আনিসুর রহমান ছিলেন কিছুটা খেয়ালি। অনার্স ফাইনালের থার্ড পেপার পরীক্ষা দিতে গিয়ে আনিসুর রহমান সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। পরীক্ষা অসমাপ্ত রেখেই এক সময় বেরিয়ে এলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন অর্থনীতি আর নয়, সাংবাদিকতা করবেন। তখন তিনি অভিভাবকদের এড়াতে বাড়ি ছেড়ে তাঁর সুহৃদ শিল্পী কামরুল হাসানের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। চাচা এসে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। দৈনিক সংবাদে মাসিক ৭৫ টাকা বেতনের অ্যাপ্রেন্টিসের চাকরি নিলেন। তিন মাস বাংলা সংবাদপত্রে কাজ করার পর শুভানুধ্যায়ীর পরামর্শে ভালো ক্যারিয়ার গড়ার প্রয়োজনে বিনা মাইনেতে পাকিস্তান অবজারভার-এ অ্যাপ্রেন্টিসশিপ শুরু করলেন। কিছুদিন পর আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলেন এবং এমএ পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেন। এর মধ্যে ১৯৫৪ সালের ফজলুল হক হল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ভিপি পদে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়ী হন।
তিনি অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স দুটোতেই প্রথম শ্রেণি ও প্রথম স্থান নিয়ে ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে যোগ দেন। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৫৯ সালে পিএইচডি করতে যান হার্ভার্ড। পিএইচডি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলেন বটে; কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে বনাবনি না হওয়া চাকরি ছেড়ে ঢাকাও ছাড়েন। পরে ভিসি পরিবর্তন হলে সত্তরে পুনরায় যোগ দেন।
আনিসুর রহমান সেই সময়ের একটি ঘটনার কথা লিখেছেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। রমজানের ছুটিতে লাইব্রেরি বন্ধ। কিন্তু উপাচার্যের অফিস খোলা। উপাচার্য অফিসে বসে কাজ করছেন। আনিসুর রহমান বিনা অনুমতিতে ঝড়ের বেগে তার অফিসে ঢুকে পড়লেন।
‘স্যার, এই যে আপনি বসে কাজ করছেন আর আমি কাজ করতে পারছি না।’
উপাচার্য অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী বললেন?’
আমি তখন বুঝিয়ে বললাম, ‘স্যার লাইব্রেরি বন্ধ, আমি আমার কাজ করতে পারছি না আর আপনি তো আপনার কাজ করে যাচ্ছেন।’
উপাচার্য এবার যেন ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি দয়া করে একটু বসবেন।’
আমি বসলে তিনি বললেন, ‘আপনি একটু আগে যে কথাটা বললেন, সেই কথাটা আবার বলবেন কী?’
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। একটু থতমত খেয়ে কথাটা আবার বললাম। উপাচার্য তখন আমাকে বললেন, ‘আমি এতদিন এই ইউনিভার্সিটিতে ভাইস চ্যান্সেলরি করছি, এরকম কথা তো আমাকে কেউ বলেনি। আনিস সাহেব আপনাকে আমি বিশেষ অনুরোধ করছি একদিন এসে আমার ঘরে সারাদিন বসে থাকেন দেখবেন কত রকমের দাবি আর তদবিরের জন্য শিক্ষকরা আসতে থাকেন, কই ছুটির দিনে লাইব্রেরি খোলা চান এরকম দাবি তো কেউ করতে আসেন না।’ উপাচার্য স্কেলিটন স্টাফ রেখে ছুটিতে লাইব্রেরি খোলা রাখার বন্দোবস্ত করেছিলেন।
গান গাওয়া নিয়ে তিনি লিখেছেন, দেবব্রত বিশ্বাস মানে সবার জর্জ দা ঢাকায় এসে কলিম শরাফীর বাসায় উঠলেন। দুজন একসঙ্গে গান করেন। কলিম শরাফী, তার কাছ থেকে গান তুলে নেন। “আমি সেখানে গিয়ে সতৃষ্ণ নয়নে বসে থাকতাম এবং মাঝে মাঝে জর্জ দা যখন কলিম ভাইকে শেখাচ্ছেন আমি অনুমতি না নিয়েই গলা মিলিয়ে দিতাম। একদিন গানের মাঝখানে জর্জ দা হঠাৎ থেমে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার পঞ্চমটা বেসুরো আসে, সাইধ্যা ঠিক কইরা নেন।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘গলাটা ভালো।’ আমাকে আর পায় কে। দেবব্রত বিশ্বাস বলেছেন, আমার গলাটা ভালো, বেসুরো পঞ্চম হলে কী হবে, ওটা তো ঘষামজার ব্যাপার। আমার উৎসাহ আকাশে উড়ে চলল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি ১৯৬৭-তে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি অধ্যাপক পদে যোগ দেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দরকষাকষিতে অন্য অর্থনীতিবিদরা যখন কেবলই সাফল্যে পুলকিত হচ্ছেন, আনিসুর রহমান দেখছেন এটা জাতিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার কৌশল হিসেবে, তিনি বুঝেছিলেন এরপর হঠাৎ আসবে অসহনীয় আঘাত।
একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ আনিসুর রহমানের সমাজ ও অর্থনীতি চিন্তায় গভীরতর প্রভাব ফেলে। দেশ স্বাধীনের পর চারদিকে সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার। আনিসুর রহমান কখনো স্বঘোষিত সমাজতন্ত্রী না হলেও নতুন স্বাধীন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে নিজস্ব শর্তে কাজ শুরু করেন। যদিও তার মধ্যে অনেক প্রশ্ন ছিল। ‘পথে যা পেয়েছি’ বইয়ে লিখেছেন, “একদিকে দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের প্রতিশ্রুতি আর অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে চরম গণদারিদ্র্য ও অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে এলিটদের বিলাসিতা বেড়েই চলেছে...।” দেশকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পথে ধাবিত করার প্রশ্নে তিনি বৈজ্ঞানিক শব্দের পর বন্ধনীতে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসিয়ে লিখেছেন,… কিন্তু আসলে তো দেশ মৌলিকভাবে বৈষম্য বৃদ্ধি ও দুর্নীতির পথেই এগোচ্ছিল, পরিকল্পনা কমিশনের সাধ্য ছিল না এই প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার।
এক সময় তিনি কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে ছিলেন আনিসুর রহমান; অগাস্ট ট্রাজেডির পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তখন আর দেশে ফেরেননি তিনি। এই সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন তিনি।
১৯৭৭ সালে তিনি জেনিভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার আমন্ত্রণে এই সংস্থায় যোগ দিয়ে গ্রামীণ উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণের ওপর একটি বিশেষ কর্মসূচি তৈরি করেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই কর্মসূচি পরিচালনা করেন এবং একানব্বই সালে দেশে ফিরে আসেন। অংশীদারী গবেষণা এবং আত্মনির্ভর অংশীদারত্ব উন্নয়নের দর্শন ও পদ্ধতিগত প্রশ্নে তার অবদান বিশ্বস্বীকৃত এবং বিভিন্ন দেশে এই কাজে তার চিন্তা ও রচনাবলি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
তিনি নিজে ভেবেছেন। ভাবনার খোরাক যুগিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই লিখেছেন। ‘উন্নয়ন জিজ্ঞাসা’, ‘অপহৃত বাংলাদেশ’, ‘পিপলস সেলফ ডেভেলপমেন্ট’, ‘অসীমের স্পন্দন-রবীন্দ্রসংগীত বোধ ও সাধনা’, ‘যে আগুন জ্বলেছিল– মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ’, ‘সংস অফ টেগর, ফিলোসফি, সিলেক্টেড ট্রান্সলেশনস, পেইন্টিংস’, ‘পার্টিসিপেশন অব দি রুরাল পুয়োর ইন ডেভেলপমেন্ট’, ‘মাই স্টোরি অব ১৯৭১’, ‘একুশে ও স্বাধীনতা: বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সমাজবাস্তবতা’, ‘পথে যা পেয়েছি-১’, ‘পথে যা পেয়েছি-২’, ‘দ্য লস্ট মোমেন্ট: ড্রিমস উইথ অ্যা নেশন বর্ন থ্রু ফায়ার’ ইত্যাদি বইগুলো সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির শিক্ষার্থী ও রবীন্দ্রভক্তদের জন্য এক মূল্যবান সম্ভার।
মনে পড়ছে নব্বইয়ের দশকের একটি ঘটনার কথা। টিএসসি অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক অনুষ্ঠান। পুরো অডিটোরিয়াম ভরা। এর মধ্যে আনিসুর রহমান এসে একদম পেছন দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। অনুষ্ঠানে চাঞ্চল্য। সবাই তাকে সিট ছেড়ে দিচ্ছেন বসার জন্য। কিন্তু তিনি বসবেন না বলে জানালেন। মঞ্চে বসা অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেনও তাকে মঞ্চে আসার আহবান জানালেন। কিন্তু আনিসুর রহমান অনড় দাঁড়িয়ে রইলেন। এক পর্যায়ে অনুষ্ঠানের ঘোষক বললেন, “আমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন প্রসিদ্ধ অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. আনিসুর রহমান। সভাপতির অনুমতিক্রমে আমি তাকে মঞ্চে এসে আসন গ্রহণ করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।” এবার তিনি মঞ্চে গিয়ে সরাসরি ডায়াসে দাঁড়ালেন। মাইক নিয়ে বললেন, “আমি মঞ্চে বসার জন্য আসিনি। আমি অনুষ্ঠান শোনার জন্য এসেছি। এখন যেখানে আছি, সেখানেই আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি। আমাকে বসার জন্য পীড়াপীড়ি করলে চলে যেতে বাধ্য হব। আরেকটি কথা, এখানে আমাকে ড. আনিসুর রহমান বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমার নাম মো. আনিসুর রহমান, ড. আনিসুর রহমান নয়। ডক্টরেট একটি ডিগ্রি। এটা আমার নামের আগে বসাবেন না। এখানে যারা দর্শকসারিতে আছেন, উপযুক্ত সুযোগসুবিধা পেলে এবং চেষ্টা করলে প্রত্যেকেই তা অর্জন করতে পারেন। এটা বাড়তি কিছু নয়। ড. নামের অংশও নয়।” এই বলে তিনি মঞ্চ থেকে নেমে গিয়ে আগের জায়গায় আবার ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত তিনি সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলেন।
এই হচ্ছে আনিসুর রহমান। প্রচণ্ড জেদি, একরোখা। তাকে কখনো কোনো কিছুতে বাধ্য করা যেত না। তিনি নিজে যা ভালো মনে করতেন, তাই করতেন।
তার শেষের দিনগুলো খুব একটা সুখের ছিল না। প্রায় দেড় দশক ধরেই তিনি ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। আত্মমগ্ন হয়ে একাকী তিনি জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন। যেন নজরুলের মতো প্রতিজ্ঞা ছিল: ‘নিশ্চল, নিশ্চুপ; আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।’
৫ জানুয়ারি ২০২৫ সালে ৯২ বছর বয়সে এই মহাপ্রাণ ব্যক্তি পরলোকগমন করেছেন।