আমি আর আমার ছেলে সূর্যকে দুধ খাওয়াতে পারিনি। তার সাথে দুই মাস অন্ততপক্ষে ছয় ফুট দূরত্ব রাখতে হয়েছিল। ওর বয়স তখন মাত্র নয় মাস চলে। আস্তে আস্তে সে-ও বুঝে গিয়েছিল যে মা এখন আর কাছে আসবে না। সে-ও দূরে বসেই খেলত।
Published : 05 Jun 2024, 06:50 PM
২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ওই দিন ছিল আমার এফএনএসির ((Fine Needle Aspiration Cytology, একধরনের ছোটোখাটো বায়োপসি বলা যায়) রিপোর্ট আনতে যাওয়ার দিন। কিছুদিন ধরেই গলায় একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। কিন্তু আয়নায় বারবার দেখলেও কোনো কিছুই সেভাবে চোখে পড়ছিল না। পরে ৮ তারিখ রাতের বেলায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঢোক গিলে দেখতে পেলাম গলার ডান দিকের থাইরয়েড গ্ল্যান্ডটি একটু অন্য রকম দেখাচ্ছে। পরের দিন ৯ তারিখে যাই ডাক্তার দেখাতে, আর ১০ তারিখে এফএনএসি করি। ডাক্তার বলেছিলেন অনেক সময়ে থাইরয়েডের নডিউল বড়ো হয়ে যায়, বেশির ভাগ সময়েই ভয়ের কিছু থাকে না। আমিও তাই অনেকটাই চিন্তামুক্ত ছিলাম। পাশের রমনা পার্ক থেকে একটু ঘুরেও এলাম।
আমার বাচ্চার বয়স তখন ছয় মাস চলে। এর আগের মাসেই আমার গলস্টোন অপারেশন হয়েছে। তাই আমার একটা বিশ্বাস ছিল যে রিপোর্ট ভালো আসবে। মানুষের জীবন নিশ্চয়ই এত কঠিন নয়। জীবন অনেক বেশি দেখিনি তো, তাই এমন অদ্ভুত ধারণা ছিল।
যা-ই হোক, ১৪ তারিখ বেলা তিনটায় বের হলাম বাসা থেকে। এই প্রথম নিজে যাচ্ছি রিপোর্ট আনতে। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে সাথে এসেছে আমার জীবনসঙ্গী জুয়েল। হালকা উদ্বিগ্ন চেহারার একজনের কাছ থেকে রিপোর্ট হাতে নিলাম। রিপোর্ট পেলাম, কিন্তু পড়তে পারলাম না। ডায়াগনসিসের জায়গায় লেখা প্যাপিলারি কার্সিনোমা। ইংরেজিতে মন্দ নই আমি, তবে তখনো জানা ছিল না কার্সিনোমা মানে ক্যানসার। অপরিচিত শব্দ দেখে গুগল করলাম, জানলাম এটি একটি বিরল প্রকৃতির থাইরয়েড ক্যানসার। তারপরই আমি একেবারে নাটকীয় কায়দায় মুখে হাত চেপে ধরে ছোট্ট একটা চিৎকার দিলাম। জুয়েল দৌড়ে এল। বারবার বলতে থাকল, কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ মোটামুটি যান্ত্রিকভাবে চলতে থাকল। বারবার মনে হচ্ছিল এইগুলো বুঝি আমার সাথে নয়, অন্য কারও সাথে হচ্ছে।
আমি ২০০৯ সাল থেকে ওই হাসপাতালেরই একজন বিখ্যাত এন্ডোক্রাইনোলজিস্টকে দেখাই। আমার হাইপোথাইরয়েডিজম আছে। তাই রিপোর্ট পাওয়ার পরই তার সাথে একটু দেখা করতে চাইলাম। তার রুমের বাইরে যে রিসেপশনিস্ট বসে, তিনি কিছুতেই আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলেন না। বললেন, সিরিয়াল নিয়ে তারপরে আসতে। আমি তাকে বললাম যে আমি মাত্রই আমার ক্যানসার ডায়াগনসিসের রিপোর্ট হাতে পেয়েছি, একটু দেখা করতে দিন। নাহ্, তিনি আমাকে ভেতরে যেতে দেননি। এটা যেন একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। হতেই পারে, আমার যদিও জানা নেই। কিন্তু সেই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম এত বছর ধরে অনেক মানুষের অনেক সহমর্মিতা অনেকটাই Ôtaken for grantedÕ নিয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা আসলে অনেক কঠিন। সহৃদয়তা, সহমর্মিতা, মায়া— এগুলোর চর্চা মনে হচ্ছে মানুষের মাঝ থেকে উঠে গিয়েছে। যা-ই হোক, পরে আরেকজন ডাক্তারের সাথে কথা বলি। তিনি অনেকক্ষণ ধরেই আমাকে বোঝালেন। চিন্তা করতে মানা করলেন। তিনিই প্রথম আমাকে পরামর্শ দেন ইন্ডিয়ায় যাওয়ার জন্য।
আমার তখন চিন্তা আমাদের ছেলেকে নিয়ে। সে পুরোপুরিই ব্রেস্টফিডিং বাচ্চা। অন্য খাবার বা ফরমুলা মিল্ক তখনো দিইনি। ওকে রেখে আমি কীভাবে কী করব, কিছুই ঢুকছিল না মাথায়। তাই বিকেলে আরেকজন সার্জনের সাথে কথা বললাম। তিনি তো পরের সপ্তাহেই অপারেশনের ডেট দিয়ে দিলেন। এটা নাকি একটা মামুলি অপারেশন। মাত্র দুই রাত থাকতে হবে হাসপাতালে। কোনো বিষয়ই না এটা। জানতে চাইলাম কোনো অনকোলজিস্ট দেখাতে হবে কি না। বললেন, ‘নাহ, লাগবে না!’ আমার ফুল থাইরয়েডেকটমি অপারেশন হবে, এরই মধ্যে ক্যানসারের ডায়াগনসিসও আছে, কিন্তু আমার অনকোলজিস্ট দেখানোর প্রয়োজন নেই! আমাদের ডাক্তাররা তো সব কাজের কাজি! যা-ই হোক, এরপর আমাকে বাংলাদেশে অনকোলজিস্ট খোঁজার মতো জটিল কাজে আর যেতে হয়নি। কারণ, সেই রাতেই আমার আরেকজন ক্যানসার সার্ভাইভার আপু আমাদের বাসায় এসেছিলেন। তিনি তার নিজের ক্যানসার-জার্নির কথা বললেন, বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ার চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে বললেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তিনি আমাকে বুকভর্তি সাহস দিয়ে গিয়েছিলেন।
তার পরের দিন থেকেই আমার পাসপোর্ট রিনিউ আর মেডিকেল ভিসার কাজ চলতে থাকল। ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে মুম্বাই টাটাতে যাই। সেখানে গিয়ে সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, টাকাপয়সা জমা দিয়ে প্রথম যখন ডাক্তারের সাথে কথা বলি, আমার মনে হয়েছিল আমি বুঝি অর্ধেক সুস্থ হয়ে গিয়েছি তখনই। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, আমার সব ধরনের রোগশোকের বিস্তারিত ইতিহাস নিলেন। তারপর অপেক্ষা করতে বললেন। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম প্রথমে। আমাকে সবকিছু বিশদভাবে বোঝালেন। আমি এক হাজারটা প্রশ্ন করি, তিনি সব প্রশ্নেরই জবাব দেন। এত এত রোগী দেখছেন তিনি, অথচ আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। আমি শুধু ভাবছিলাম তিনি বিরক্ত হচ্ছেন কি না। অথচ তার লক্ষ্য ছিল আমাকে শক্ত রাখা। আর আমি যেন একটা ইনফর্মড ডিসিশন নিতে পারি। একটু পরে মূল সার্জনের সাথে কথা হলো। তিনি দেখি আরও সহনশীল। আমাকে বোঝালেন যে আবার সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপর আবার দেখবেন। তাড়াহুড়ো করার চেয়ে ভালো করে সময় নিয়ে চিকিৎসা করাই ভালো।
ক্যানসারের ক্ষেত্রে সঠিক ডায়াগনসিসটাই সবচেয়ে জরুরি। সময় লাগলে লাগুক। সেইমতন টাটাতে আবার চলল সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এবারের এফএনএসি রিপোর্টটা একটু খারাপ এসেছিল। আমি তো কান্নাকাটি শুরু করে দিই। তখন জুনিয়র একজন ডাক্তার ছিলেন চেম্বারে। তিনি শুনলেন, তারপর বললেন, যদি প্যাপিলারি কার্সিনোমা হয়, তাহলে ভয়ের কিছু নেই। এর প্রগনোসিস অনেক ভালো ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই কাউন্সেলিংটাও যে একজন ক্যানসার রোগীর জন্য কত প্রয়োজনীয়!
এরপর রিপোর্ট নিয়ে যখন মূল সার্জনের সাথে দেখা করলাম, তিনি সব দেখেশুনে একই কথা বললেন। তাড়াহুড়ো নয়, আমার দরকার ভালো একটা অপারেশন। কিন্তু এরপর যেটা সমস্যা হলো, অপারেশনের ডেট পাচ্ছিলাম না। এত রোগী, অনেকেরই জরুরি অবস্থা। শেষমেশ ডেট পেলাম এপ্রিলের ৮ তারিখে। ডাক্তার আমাকে বলে দিলেন, বাড়ি চলে যান, বাচ্চার সাথে সময় কাটান, টেনশনের কিছুই নেই। আমিও সেটাই করলাম। তারপর অপারেশন হলো। বায়োপসি রিপোর্ট এল। এটা একটু মন্দের ভালো এসেছে, প্যাপিলারি কার্সিনোমাই এসেছে কিন্তু ছড়িয়ে যায়নি।
এবার পরবর্তী চিকিৎসার পালা শুরু হলো। একেক ক্যানসারের চিকিৎসা পদ্ধতি একেক রকম। আমারটাতে রেডিও আয়োডিন থেরাপি দিতে হবে, পরিমাণের ওপরে নির্ভর করে আইসোলেশনে থাকতে হবে। আমাকে অনেক অল্প পরিমাণেই দিয়েছিল আর মাত্র এক দিন ছিলাম আইসোলেশনে। কিন্তু এর পরের সময়টাই ছিল সবচেয়ে কষ্টের। আমি আর আমার ছেলে সূর্যকে দুধ খাওয়াতে পারিনি। তার সাথে দুই মাস অন্ততপক্ষে ছয় ফুট দূরত্ব রাখতে হয়েছিল। ওর বয়স তখন মাত্র নয় মাস চলে। আস্তে আস্তে সে-ও বুঝে গিয়েছিল যে মা এখন আর কাছে আসবে না। সে-ও দূরে বসেই খেলত। এভাবেই কেটে গেছে সময়।
কিন্তু ডায়াগনসিসের পরের প্রথম ছয় মাস আমি গুটিকয় মানুষ ছাড়া কাউকে বলতেও চাইতাম না এই কথা। কারণ, এত দিন আমি দেখেছি ক্যানসার রোগীদের মানুষ কীভাবে দেখে। মনে হতো আমি আর পরিপূর্ণ মানুষ নেই। অনেকের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিলাম। অনেকে আমার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিল। আসলে দিন শেষে সবারই নিজস্ব যুদ্ধক্ষেত্র আছে। এর মধ্যে অনেকের অনেক অন্য রূপও দেখেছি। অনেক সময় এই প্রসঙ্গ এলে এড়িয়ে যেতাম। তখন মাথায় ছিল শুধু বেঁচে থাকার চিন্তা।
সেই সময়ে প্রথম বুঝেছিলাম আমার বাবা-মা কত দৃঢ় মনের মানুষ। আমার ছেলেটাকে সামলেছে পুরোটা সময়জুড়ে। জুয়েল কোনো দিন একটু বিরক্তি পর্যন্ত দেখায়নি। নিজের প্রতি অনেকটাই অবহেলা করেছিল। আমার খুব কাছের বন্ধুরা পাশে ছিল এই সময়ে। অনেক দূরের মানুষও হঠাৎ করে আপন হয়েছে, পাশে থেকেছে।
আমার সবচেয়ে গর্বের জায়গা হচ্ছে, এর মধ্যেও আমি মাত্র চার মাস বাদে বাকি পুরো সময়টায় ফুলটাইম জব করেছি। অফিস থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি, এমন নয়। চিকিৎসার সময় অবৈতনিক ছুটি নিতে হয়েছিল। আরেক চাকরিতে বারবার ঢাকা-কক্সবাজার করাচ্ছিল, যেন নিজে থেকেই ছেড়ে দিই। কিন্তু এইগুলো সবই সামলাতে পেরেছিলাম। যেটা পারিনি সেটা হচ্ছে চিন্তার লাগাম টেনে ধরা। আমার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি আসলে আমি নিজেই করেছি। সারা দিন শুধু টেনশন করতাম। শেষমেশ এটাই আমার জন্য বোনাস হিসেবে উচ্চ রক্তচাপ এবং প্যানিক অ্যাটাক নিয়ে এসেছে আমার জীবনে।
এরপর আমি অনেক লম্বা সময় ধরে কাউন্সেলিং নিয়েছি। আমাদের দেশে কাউন্সেলিং সেবা কিন্তু সেভাবে নেই। আমার সিভিয়ার পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন ছিল। তখন থেকেই খুঁজে ছিলাম। তারপর দুইটা অপারেশন, ছোটো বাচ্চা, রাত জাগা— সব মিলিয়ে বেহাল অবস্থা হয়েছিল। ঘনঘন প্যানিক অ্যাটাক হতো। আর এর মজা হচ্ছে, এটা যে প্যানিক অ্যাটাক, সেটা ধরতে পারা যায় না। কারণ, এর উপসর্গগুলো হলো শারীরিক প্রেশার বেড়ে যাওয়া, হাত-পা আর মাথা প্রচণ্ড ঝিমঝিম করা ইত্যাদি। আর আমি তো এমনিতেও অনেক ভয়ে থাকতাম। ক্যানসার সার্ভাইভারদের সবচেয়ে বড়ো ভীতি হচ্ছে ক্যানসার ফিরে আসার ভয়। আমার তো এমন হয়েছিল যে কোনো ক্যানসার রোগীর কথা শুনলেই আমার শরীর খারাপ হয়ে যেত। অনেক লম্বা সময় ধরে কাউন্সেলিং নিয়ে আর পরিবার ও বন্ধুদের সহযোগিতায় এখন আগের থেকে এই সমস্যা অনেক কমেছে। সবচেয়ে বড়ো বিষয় হচ্ছে নিয়মমাফিক চলা, ঠিকমতো ঘুমানো, খাওয়াদাওয়া করা এবং হাসিখুশি থাকা। আমার বই পড়ার নেশা এই সময়ে আমার জন্য বিশাল একটা আশ্রয় হয়েছিল। ঘুরতে পছন্দ করি, তাই অনেক ঘুরে বেড়িয়েছি। আসলে রিকভারির সময়ে ভালো লাগার কাজ করা অথবা কোনো একটা কাজে ব্যস্ত থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক সময়েই মনে হয়েছে আমার আগের আমিকে কি আর ফিরে পাব? আগে আমি রেগুলার ট্রেকিং করতাম, এখন এক ঘণ্টা হাঁটব চিন্তা করলেও ভয় লাগে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটু একটু করে আবার সামনে এগোতে পারছি।
গত দুই বছরের যুদ্ধ আমাকে অনেক শক্ত করেছে। এত দিন ভাবিনি, কিন্তু এখন মাঝেমধ্যে নিজেকে নিজেই একটু বাহবা দিই। বেশি দিতে এখনো সাহস হয় না। কিন্তু মনে হয় আমি তো অনেক কঠিন একটা যাত্রাপথ পার করে এসেছি। যদিও মনের কোণে থেকে যাওয়া একটু ভয় এখনো আছে। কিন্তু এই ভয় আমাকে জীবনের মূল্য শিখিয়েছে। আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, কোনো কিছুতেই আশা হারানো যাবে না। প্যান্ডোরার বাক্স খুলে আশাকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। বিশাল একটা বাকেট লিস্ট বানাতে হবে— তারপর একটা একটা করে শখ পূরণ করতে হবে। জীবন কারও জন্য যেমন থেমে থাকে না, আমিও কোনো কিছুর জন্যই থেমে যেতে চাই না।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)