বড় বড় প্রকল্প, প্রকল্পের পেছনে জলের মতন খরচ করা অর্থ, নিত্য নতুন পরীক্ষামূলক পদ্ধতি — কোনো কিছুই এ দেশে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারছে না। রাজধানী ঢাকায় কোথাও মানুষ চলবার মতন কোনো পথ নেই, আছে শুধু মেশিনে চালিত যানবাহন।
Published : 19 Nov 2023, 11:07 PM
ছোটবেলায় ঢাকায় আসতাম বছরে একবার, নিয়ম করে। তিন-চার বছর বয়স থেকে স্পেকটেকল চাইল্ড হওয়ার কারণে চোখের ডাক্তার দেখাতে আসতেই হতো। আশির দশকের বিখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ মুস্তাফিজুর রহমান এবং হারুন অর রশিদের চেম্বারে আমাদের এবং মাঝেমধ্যে আমাদের দাদীকেও নিয়ে যেতেন আব্বা-আম্মা। ঢাকা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরের প্রাচীন শহর ময়মনসিংহ থেকে আসতে পথে পড়ত ঘন বনাঞ্চল। গাজীপুরে তখনও ভাওয়ালের শালবন অবশিষ্ট ছিল। ঢাকায় এসে মনে হতো টেলিভিশনের দৃশ্যের মধ্যে ঢুকে গিয়েছি।
ঢাকায় যে সকল জিনিস দেখে টেলিভিশনে দেখা দৃশ্যের কথা মনে পড়ত তার মধ্যে একটা হচ্ছে ট্রাফিক লাইট। বিটিভিতে ম্যাকগাইভার বা এই জাতীয় নানান সিরিজে দেখতাম, ট্রাফিক আলো হলুদ থেকে লাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন করে থেমে যায় সকল যান। ঢাকায়ও তেমনটা ছিল। মেশিন চালিত চাকার যান থেমে গেলে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে বড় বড় রাস্তা পার হয়ে যেত পথচারীরা। পথচারী পারাপারের পর ট্রাফিক বাতি সবুজ হয়ে গেলে আবারও চলত চাকা, বাজত ভেঁপু।
যেকোনো ভদ্র-সভ্য নগরীতে এমনটাই হওয়ার কথা। যেকোনো দেশের রাজধানীতেই থাকে জেব্রা ক্রসিং, আলোর রঙ দেখে সেই মতো পায়ে হেঁটে রাজপথ পার হয় নাগরিক। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই স্বাভবিক দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়ার সময় লিখতে হচ্ছে অতীতকালে, ‘ছিল’। কেননা, ৮০-৯০ দশকের মতন ট্রাফিক লাইট আর জেব্রা ক্রসিং এখন আর এই শহরে নেই। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই শহরটা চলছে ট্রাফিক বাতি ও জেব্রা ক্রসিং ছাড়াই। নগরের কিছু কিছু অভিজাত অংশে পথের ওপর জেব্রা ক্রসিংয়ের আভাস আছে মাত্র, কিন্তু তা মানে না কেউই, না গাড়িচালক, না পথচারী, না পুলিশ।
হ্যাঁ, শহরের নানা ব্যস্ত সড়কের ওপর ফুটওভারব্রিজ আছে বটে। ইদানীং উন্নয়নের খাতিরে, ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল তৈরির পরিকল্পনার চাপে অনেক ব্যস্ত পথের ফুটওভার ব্রিজ ভেঙ্গেও ফেলা হচ্ছে, যেমন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে শ্যামলীর ওভার ব্রিজটি। ফুটওভার ব্রিজ অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবতী নারী, শারিরীক প্রতিবন্ধীসহ অনেক মানুষের জন্যই কোনো যুতসই বা বাস্তব বিকল্প নয়। তারপরও কিছু সাবধানী মানুষ এসব ব্রিজ ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারতেন ও করেনও রোজ। কিন্তু সেই উপায়ও কমে আসছে পথচারীদের জন্য।
কেউ তর্ক করতে পারে, উন্নয়ন কি হচ্ছে না? আশি বা নব্বইয়ের দশকে তো ঢাকায় ওয়াটারবাস ছিল না, এখন আছে। কত লোকেই তো হাতিরঝিলের ওয়াটারবাস করে অফিস যায়! সত্য বটে! সুন্দর ব্যবস্থা! বনশ্রী ও আফতাবনগর নামের দুটি বিশাল আবাসিক প্রকল্প রয়েছে যেখান থেকে ডিআইটি রোড পার হয়ে রামপুরা জেটিতে এসে ওয়াটারবাসে করে গুলশান, নিকেতন, এফডিসি এমন নানান দিকে অনেকেই অফিস করতে যান। কিন্তু তাদেরকে পায়ে হেঁটে রামপুরা জেটিতে যেতে হয়। অ্যাবসার্ড হলেও সত্য, এই রাস্তা পার হওয়ার কোনো সরল ও নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। কোনো ফুটওভারব্রিজ নেই, কোনো ট্রাফিক লাইট নেই, কোনো জেব্রা ক্রসিং নেই। তাহলে এই অঞ্চলের মানুষেরা কী করেন? তারা যা করেন তা হচ্ছে হাতের মুঠোয় জীবনটা চেপে ধরে নিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হন। যেকোনো সময় দ্রুতগতিতে আসা কোনো বাস বা ট্রাকের তলায় জীবন চলে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হতে হয় প্রত্যেককে, প্রতিদিন।
খবরে বলা হচ্ছে, গত পনের বছরে ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত করবার জন্য খরচ করা হয়েছে ১১৯ কোটি টাকা। এই উন্নয়নের পরিকল্পনায় ছিল ডিজিটাল ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে ডিজিটাল টাইমারসহ নানা কিছু। ইতোমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট বা ইপিসি নামের একটি ফার্মকে ৫৩টি স্থানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে ট্রাফিক বাতি স্থাপন কার্যক্রম হাতে নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই পরীক্ষা করবার জন্য খরচা বাবদ ৫ কোটি টাকাও দিয়েছে। এআই প্রযুক্তিতে ক্যামেরা স্থাপন করে, ট্রাফিক পর্যবেক্ষণ করে, সেই মোতাবেক আলো জ্বলা-নেভার মতন উন্নততর ব্যবস্থা থাকবে বলেও জানা গেছে। সোলার প্যানেল স্থাপন করে সেই শক্তি থেকে ট্রাফিক বাতি জ্বলার বিদ্যুৎ সরবরাহ করবার পরিকল্পনাও রয়েছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় ডিজিটাল ট্রাফিক বাতি ছিল। রীতিমত কাউন্টডাউন করা টাইমার দিয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবার উচ্চাশা নিয়ে স্থাপিত হয়েছিল সেই পদ্ধতি। কিন্তু যথাযথ পরিচালনার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে সেই প্রকল্প। বড় বড় প্রকল্প, প্রকল্পের পেছনে জলের মতন খরচ করা অর্থ, নিত্য নতুন পরীক্ষামূলক পদ্ধতি — কোনো কিছুই এ দেশে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারছে না। রাজধানী ঢাকায় কোথাও মানুষ চলবার মতন কোনো পথ নেই, আছে শুধু মেশিনে চালিত যানবাহন।
ঢাকায় ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বেপরোয়া গতিতে বাস চালিয়ে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়াকে চাপা দিয়ে মেরে চলে যায় চালক। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন করতে পথে নেমে আসতে হয় স্কুল-কলেজের কিশোর শিক্ষার্থীদের, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ অগাস্ট ২০১৮ পর্যন্ত সংঘটিত একটি আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ। কিন্তু এই আন্দোলনে পরিবর্তিত হয়নি কিছুই। এ ঘটনার বছর ঘোরার আগেই ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ দুই বাসের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা যান ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনাল-বিইউপি’র শিক্ষার্থী আবরার। বিইউপির শিক্ষার্থীরাও বন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে, বিচারের দাবি জানায়, চায় নিরাপদ সড়ক। বলা বাহুল্য তাতেও কিছু বদলায়নি। ওই বাস চালকদের বিচার বা শাস্তি হয়নি, ওই বাস কোম্পানিগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, মালিকপক্ষকে জবাবদিহি করা হয়নি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়নি, ভারী যানের গতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি, ট্রিপভিত্তিক মজুরিব্যবস্থায় উপার্জনের প্রতিযোগিতা থেকে চালকদের মুক্ত করা হয়নি, বাস ও ট্রাক ড্রাইভারদের ডোপটেস্ট বা মাদকপরীক্ষা করা হয়নি, লোডেড ট্রাকের মতন ভারী যানবাহন শহরের পথ দিয়ে চলা বন্ধ হয়নি।
বরং বেড়ে গিয়েছে উন্নয়নের জোয়ারে কাঁচামাল, ইট, সিমেন্ট, রড বোঝাই ট্রাকের আনাগোনা। এমনই এক ট্রাকের তলায় এই মাসেই প্রাণ হারিয়েছেন অর্জুন এবং আরিফ নামের দুই যুবক। অর্জুন এবং আরিফ আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে চিনি বলেই অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলতে পারি, এই দুজনের মতন মেধাবী ও চিন্তাশীল মানুষ পথেঘাটে পাওয়া যায় না। কিন্তু নির্মম সত্য এই যে, এমন তুখোড় দুই মানুষ পথেঘাটে মরে পড়ে থাকেন। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন ট্রাক এসে চাপা দিয়ে চলে যায় তাঁদের; হাইওয়েতে নয়, রং সাইডে নয়, তাঁদের বেপরোয়া গতির কারণে নয়, কোনো নিয়মভঙ্গের জন্যও নয়। শুধু কোনো এক চালকের বেপরোয়া গতিতে ট্রাক চালানোর কারণে মৃত্যু হয় মাত্র চল্লিশ পেরোনো দুই জলজ্যান্ত মানুষের। দুই-দুইজন সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত, উচ্চশিক্ষিত কর্মী, মানবিক মানুষ, মায়াময় বন্ধু, দায়িত্বশীল সন্তান, স্নেহময় পিতা নিমেষে নাই হয়ে যান।
আমার বন্ধুরা বিনা দোষে রাজপথে নিহত হয়েছেন, আমার নিশ্চয়ই বিচার চাওয়া উচিৎ। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ওই ট্রাক শনাক্ত করে, জব্দ করে ট্রাকের মালিক ও চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা উচিৎ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন বা সেই বয়স থাকলে হয়তো মিছিল-সমাবেশ-বিক্ষোভ ইত্যাদিতে অংশ নিতাম, কে জানে হয়তো সড়ক অবরোধ করে বাস-ট্রাক পোড়াতাম, ভাংচুর করতাম রাজপথে নেমে, অবস্থান ধর্মঘট করে বসে থাকতাম ঘটনাস্থলে। ছাত্রজীবনে অর্জুন-আরিফের সঙ্গে হেঁটেছি বহু মিছিলে, অংশ নিয়েছি নানা আন্দোলনে, গলা মিলিয়েছি বহু শ্লোগানে। ওদের মৃত্যুতে আমি কিছুতেই চুপ থাকতে পারি না, আমার আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে, মাটি ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করে। আমার ইচ্ছে করে এই নষ্ট, পচা, দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যবস্থাকে লাথি মারতে।
কিন্তু তাতে কি কিছু হতো? কিছুই যে হতো না তা-ও আমরা জানি, দেখেছি। ওই এক চালককে শাস্তি দিলে আমার বন্ধুরা যেমন ফিরে আসবে না, তেমনই পরিবর্তিত হবে না কিছুই, থামবে না এমন মৃত্যুর বা হত্যার মিছিলও। ওই চালক ব্যক্তিটির কোন দোষ নেই — এ কথা আমি দাবি করছি না মোটেই। কিন্তু তার কি অত ভারী ট্রাক মুহূর্তে থামিয়ে দেবার বাস্তবতা ছিল? পদার্থবিজ্ঞানের ভরবেগ সূত্র থেকে যতটুকু বুঝি, সেটা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি হতো। প্রশ্ন হচ্ছে সে এই রকম বেপরোয়া গতি তোলার সাহস কোথা থেকে পেল? রাজধানীর প্রধান সড়ক দিয়ে ওই রকম সময়ে ওই গতিতে ট্রাক চালানোর অনুমতি তাকে কে দিয়েছে?
দিয়েছে এই পদ্ধতি, দিয়েছে এই ত্রুটিপূর্ণ ট্রাফিক ব্যবস্থা, দিয়েছে এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি, দিয়েছে এই নগরীর পরিকল্পকরা — যাদের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য নেই, দাম আছে বৃহৎ প্রকল্পের। যাদের কাছে নাগরিকের নিরাপদ জীবন নয়, ইট বোঝাই ট্রাকের অর্থমূল্য বেশি জরুরি। যারা সড়ককে মানুষ চলার পথ নয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে উন্নয়নের প্রদর্শনীর ক্ষেত্র মনে করেন। আমার বন্ধুদের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ওই ট্রাক চালক একা নন, বরং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রতিটি মানুষ যারা অন্ধের মতন উন্নয়নের মরীচিকার পিছনে ছুটছেন। বৃহৎ প্রকল্পের নামে দুর্নীতি ও লুটপাটে জড়িত প্রতিটি মানুষ প্রকৃতপ্রস্তাবে আমার বন্ধুদের মতন নিরপরাধ মানুষদের হন্তারক। রাজীব, দিয়া, আবরার, অর্জুন, আরিফ — এই রকম নামের তালিকা দীর্ঘতর হলেও তাদের কোনো হেলদোল হয় না, এরা তাদের কাছে সংখ্যামাত্র। এই সকল নৃশংস হত্যাকাণ্ডে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে, কিন্তু ক্ষমতাশীলদের বুকে কাঁপন ধরে না। তারা অন্ধের মতন উন্নয়নের পেছনে ছোটেন আর আমরা নাগরিকেরা জানি না কোন পথে চলব! অন্ধের মতন স্রষ্টার নাম নিয়ে রোজ রাস্তায় নামি, দিন শেষে অবোধ সন্তানের কাছে, বৃদ্ধ পিতামাতার কাছে, প্রিয়তম সঙ্গীর কাছে, বহু যত্নে ও প্রেমে বোনা ঘরের কাছে ফেরার কোনো নিশ্চয়তা ছাড়াই।