সংকটে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ‘অদৃশ্য হাত’

বিদেশি ঋণদাতার শর্ত পূরণের লক্ষ্যেই সরকার আয়-ব্যয়ের হিসেব কষছে কিনা, এ প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক।

শুভাশীষ পালশুভাশীষ পাল
Published : 3 June 2023, 03:04 PM
Updated : 3 June 2023, 03:04 PM

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘আয় বুঝে ব্যয় করো’। বিগত এক দশকের বাজেট বিশ্লেষণ করলে এই প্রবাদের বাস্তবতা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যুতসই মনে হয় না। আপনি যদি শুধুমাত্র কিছু উপাত্ত বিশ্লেষণ করেন তখন সহজেই অনুমান করতে পারবেন আমাদের জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনা বলছে ‘আয় যত কম-ই হোক শুধু ব্যয় করো’। বাজেট ঘাটতি আছে তো চিন্তা নেই, গৌরী সেন হিসেবে আছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও রাজস্ব বোর্ড। ব্যক্তি ও সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসেব অনেকটা বিপরীত।

সরকার কতটুকু ব্যয় করবে তার ওপর নির্ভর করে আয় নির্ধারণ করে। তাই এ ধরনের বাজেটে ঘাটতি থেকে যায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজেট সাধারণত ঘাটতি বাজেট হয়ে থাকে। এই ঘাটতি বিমোচনে সরকার দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন খাত থেকে অর্থ লগ্নি করে তা বিনিয়োগ করে থাকে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, প্রায় সাত লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা সমপরিমাণের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে সরকারের রাজস্ব থেকে আয় ধরা হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা, যার প্রায় ৮৫ শতাংশ (৪.৩ ট্রিলিয়িন টাকা) যোগান দেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। অর্থাৎ এরপরেও দুই লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার মতো বাজেট ঘাটতি রয়ে গেছে এবং এই ঘাটতি পূরণে সরকার বিভিন্ন বৈদেশিক খাত ও রাজস্ব-বহির্ভূত উৎসের ওপর নির্ভর করবে।

এবারের বাজেট জনবান্ধব কিনা এ নিয়ে অনেক আলোচনা করা যেতেই পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপার তা হলো বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের যে পরিকল্পনা রয়েছে, এতে করে বাজারে চরম মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে বলে ধারণা করা যায়। একদিকে সরকার আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ানোর দিকে ঝুঁকছে অন্যদিকে রপ্তানিকে উৎসাহিত করার জন্য ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক বৃদ্ধি (ডার্টি ফ্লোটিং) করা হয়েছে। এতে করে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের পরিমাণ সাময়িক বৃদ্ধি পেলেও ভোক্তা পর্যায়ে বাজার গরম হবে।

শুধু তাই নয়, সরকার তার বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অন্যান্য নন-ব্যাংকিং লগ্নিদানকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ, সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ে থাকে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ঋণ প্রস্তাব কোনোভাবেই ভালো বার্তা দেয় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী, গত অর্থবছরে শুধুমাত্র এপ্রিল মাসেই সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করেছে প্রায় ২৯ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের মতো লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশ। এ বছরের বাজেটে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ নেয়ার পরিধি গতবছরের থেকে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এতে করে বাজারে ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হবে। সরকার যেভাবে crowd out করে অর্থ বিনিয়োগ করছে এতে করে বেসরকারি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়বে আর তা থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উৎস নগদ টাকা ছাপানো।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মায়ার্ড কেইনস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে সকল অনুন্নত দেশের অর্থনীতির ভারসাম্য পুনরুদ্ধারে যে তাত্ত্বিক পরামর্শ দিয়েছেন তার সরলীকরণ করলে দাঁড়ায়, আর্থিক অসচ্ছলতা ও সংকটে ঋণ করে ঘি খাওয়া। অর্থাৎ, টাকা নেই তো ঋণ করো, বিনিয়োগ করো, লভ্যাংশ থেকে ঋণ পরিশোধ করো। আর এই বিনিয়োগ ঘাটতিতে অর্থের যোগান দেবে বিশ্ব মোড়লদের মস্তিষ্কপ্রসূত মুদ্রা তহবিলগুলো। বাংলাদেশ বর্তমানে কেইনসের নীতি অনুসরণ করছে ঠিকই তার মধ্যে বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছে ‘মনিটারিস্ট’ নীতি। আপনার যখন আয়-ব্যয়ের ঘাটতি চরমে, সরকারের রাজস্ব নীতি বাস্তবায়ন সংকট শীর্ষে, সরকারি বিনিয়োগ অধিক কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তারল্য নেই, তখন এই সংকট উত্তরণে অন্যতম প্রধান অবলম্বন হলো বাজারে তারল্য বাড়িয়ে দেয়া। যদি যথেষ্ট পরিমাণ টাকা না থাকে তখন তা ছাপানোর প্রয়োজন পড়ে। সরকারের তারল্য সংকট উত্তরণের জন্য নগদ টাকা বা ‘হাই-পাওয়ার্ড মানি’র যোগান বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে থাকে। একথা সত্য যে অধিক টাকা ছাপিয়ে সরকার তার বিনিয়োগ ঘাটতি পূরণ করতে পারে, কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হয় এতে কিন্তু তারল্যের আধিক্যতায় মানুষের ব্যয় বেড়ে যায়। সামগ্রিকভাবে বেড়ে যায় নিত্যপণ্যের দাম।

যে সম্প্রসারণশীল রাজস্বনীতির ধারাবাহিকতা সরকার বজায় রেখেছে তাতে সাফল্য আসার সম্ভাবনা থেকে দুশ্চিন্তা বেশি। রাজস্বনীতির সঙ্গে মুদ্রানীতির ভারসাম্য থাকা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেখানে সরকারের হস্তক্ষেপ থাকা সমীচীন নয়। বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে অনেকদিন থেকেই। সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতির কারণে বাজারে সুদের হার কমিয়ে দেয়া হয়েছে। খুব সহসা এটা চিন্তা করা হয় যেন মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে ব্যক্তিগত বিনিয়োগে উৎসাহী হয়। এটা করা গেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি মোট দেশজ আয়ও (জিডিপি) বাড়ে।

সরকারি হিসাবে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশ বা তার বেশি। অর্থাৎ, ১০০ টাকার কোনো পণ্য কিনতে ভোক্তাকে ন্যূনতম ১০৯ টাকা দিতে হচ্ছে। যদিও সরকার এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করাতে চাইছে। অর্থনীতির তত্ত্ব কি বাস্তবে সম্ভব বলে মনে করে? সম্প্রসারণশীল মুদ্রা ও রাজস্বনীতি এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে স্বল্প সুদ হার, সঞ্চয়পত্র থেকে আয় কমে যাওয়া—এমনটা বলে না।

সাধারণত উন্নয়নশীল দেশের বাজেট প্রস্তাবনায় প্রায়শই আয়-ব্যয়ের হিসাবে ভারসাম্যহীনতা থাকে, ঘাটতি থাকে যা পূরণের জন্য বিভিন্ন দেশীয় ও বিদেশী খাতকে বিবেচনা করা হয়। বিগত এক দশকের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায় বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়, বরং প্রস্তাবিত ঘাটতি মোকাবেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে মানুষের আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, ইত্যাদি। চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেট ঘাটতি প্রায় ১৭ শতাংশ যা অন্যান্য যেকোনো বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। জাতীয় রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে প্রায় ৫.০৪ ট্রিলিয়ন টাকা যা গত অর্থ বছরের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। এই বাজেটের প্রায় ৫৬ শতাংশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)-কে দেওয়া যৌক্তিক হয়েছে কি? গত অর্থবছরের বাজেটে এনবিআর রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬০ শতাংশ। তাদেরই তথ্য মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৪ লাখ (২.৪ মিলিয়ন) কর দিয়ে থাকে এবং বৈধ নিবন্ধন আছে প্রায় ৮৪ লাখ (৮.৪ মিলিয়ন) মানুষের। অর্থাৎ, প্রায় ৬০ শতাংশ নিবন্ধিত ব্যক্তি কর প্রদানযোগ্য আয়ের বাইরে আছে বলে ধারণা করা যায়। যেখানে মাত্র ১.২ শতাংশ মানুষ কর দেয়, সেখানে উচ্চ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কার্যকর করা দুরূহ।

এবারের বাজেটে সরকার আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে যেকোনো কর সনদের (TIN) বিপরীতে দুই হাজার টাকা প্রদান বাধ্যতামূলক করেছে, যার বিনিময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তি প্রায় ৩৮টি সরকারি সেবা পাবেন। সরকারের এ উদ্যোগ নতুন এবং জিডিপিতে খুবই অল্প প্রভাব তৈরি করতে পারে। আমরা যদি ধরে নেই, এই অর্থবছরে প্রায় এক কোটি মানুষ এই সেবার আওতায় আসবে, তাহলে সরকার আয় করবে দুই হাজার কোটি টাকা, যা ৫ ট্রিলিয়ন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। এক্ষেত্রে, সরকারের দৃষ্টি থাকতে হবে রাঘব বোয়ালদের দিকে, যারা হাজার কোটি টাকার কাস্টমস কর চোরাচালান ও কিছু ক্ষেত্রে সরকারি দায়িত্বশীল কর্মকর্তার যোগসাজশে দুর্নীতির মাধ্যমে ফাঁকি দিচ্ছে।

কর ও মোট দেশজ উৎপাদনের হার (ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত) বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। অতি সাধারণ অর্থে, কর-জিডিপি অনুপাত একটি দেশের সরকার তার আয়ের ওপর নির্ভর করে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে কিনা তা নির্ধারণ করে। এই অনুপাত যত বেশি হবে সরকার জনসাধারণের কাছে প্রয়োজনীয় সরকারি পণ্য ও সেবার চাহিদা তত বেশি মেটাতে সক্ষম হবে। গত দুই দশকের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়লেও ২০২০-২১ অর্থবছরে কিছুটা কমে প্রায় ১০.৩০ শতাংশে পৌঁছায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আগামী অর্থবছরগুলোতে তা ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে প্রায় ১৫ শতাংশে উন্নীত করার পরামর্শ দিয়েছে, যা অর্জন খুব সহজ নয়।

সরকার ব্যয় মেটানোর জন্য বৈদেশিক ঋণ চাহিদার মাত্রা প্রায় ১৪ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ এবারই প্রথম রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দেবে প্রায় ৪.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা, যার প্রথম কিস্তি ইতোমধ্যে সরকার গ্রহণ করেছে। তবে এই ঋণের বিপরীতে সরকারকে মেনে চলতে হবে বেশ কিছু কঠিন শর্ত। আইএমএফের প্রস্তাবিত ৩৮টি শর্ত পূরণের লক্ষ্য মাথায় রেখেই যেন পরিকল্পিত হয়েছে এবারের বাজেট। তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্বের সকল উন্নয়নশীল বা স্বল্প আয়ের দেশের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অনুকরণীয় উদাহরণস্বরূপ। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বিদেশি দেনাদার সংস্থা ও দেশের কাছে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে একদিনও বেশি সময় নিয়ে কিংবা কোনো জরিমানা প্রদানপূর্বক ঋণ পরিশোধ করেনি। যাই হোক, আইএমএফের ঋণের বিপরীতে আরোপিত শর্তগুলোর বাস্তবায়ন নির্বাচন-পূর্ব বাজেটে জনসাধারণের জীবনযাত্রায় কোনোভাবেই স্বস্তি দেবে না।

মহান জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবনায় তার অনমনীয় মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারে অতি আবশ্যকীয় আমদানিযোগ্য কাচামালের মূল্যবৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ ইত্যাদি বিবেচনায় আমাদের এবারের বাজেট খুব সুখকর হবে না, সেটা অনুমেয় হলেও বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যে জনবান্ধব বাজেট প্রস্তাবনার প্রয়োজন ছিল, অনেকাংশেই তার অনুপস্থিতি রয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ‘অদৃশ্য হাত’ (ইনিভিজিবল হ্যান্ড)। চলতি বছরের বাজেট প্রস্তাবনা আমাদের ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের ‘অদৃশ্য হাত’ নিয়ন্ত্রিত বাজারের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। বিদেশি ঋণদাতার শর্ত পূরণের লক্ষ্যেই সরকার আয়-ব্যয়ের হিসেব কষছে কিনা, এই প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক। তা যাই হোক, কিছু কিছু শর্ত পূরণ অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশার কথা মাথায় রাখতে হবে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীনতা, দুর্নীতি আর অনিয়মের বেড়াজালে জড়িত বাজার ব্যবস্থা আগামী দিনগুলোতে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারকে ভাবতে হবে।

সরকারের ব্যয়ের খাত অসংখ্য। আয়ের পথ খুবই সংকুচিত। ব্যয়ের প্রধান খাত হিসেবে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, বিভিন্ন ধরনের ভাতা ও ভর্তুকি প্রদান উল্লেখযোগ্য। সরকারি বিনিয়োগ বাজেটের ব্যয় সংক্রান্ত খাতের একটি বড় অংশ দখল করে থাকে। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে যে দিন বদলের সনদ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তার পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো সম্ভব হয়নি বলেই হয়তো অধিক সরকারি ব্যয়ভিত্তিক বাজেট প্রস্তাব করা হচ্ছে। আমাদের অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটের নাম দিয়েছেন ‘উন্নয়নের অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা কি আমরা পেরোতে পেরেছি? বিগত দুই দশকে আমাদের দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ঈর্ষণীয় সাফল্য (১৮ থেকে কমে ৫ শতাংশে) অর্জন করলেও করোনা মহামারীর কষাঘাতে উল্লেখযোগ্য মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে এসেছে, তৈরি হয়েছে ‘নব্য গরিব’ বা ‘New Poor’। মানুষের দৈনন্দিন আয়ের সীমার কিছুটা উন্নতি হলেও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীনতা মানুষের দারিদ্র্য বাড়িয়ে দেবে, যেখানে ন্যূনতম পুষ্টি নিশ্চিতকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তার শৃঙ্খল ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে থাকবে। উচ্চ মূদ্রাস্ফীতি ঘটবে। বেসরকারি বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। গরিব আর নিম্নবিত্ত সংকটে পড়বে। বেকারত্ব বাড়াবে।

সরকারের ঘাড়ে ঋণের বোঝা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হ্রাস, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনসাধারণের নাভিশ্বাস যেখানে জীবনমানের ওপর হুমকিস্বরূপ সেখানে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন কঠিন। ভবিষ্যতের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। শুধুমাত্র ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়।

একটি ভারসাম্যপূর্ণ আর্থিক খাত, বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা, শিক্ষার হারের সঙ্গে দক্ষতাভিত্তিক জনবল সৃষ্টি ও সর্বোপরি মানবিক উন্নয়ন বিকাশে সরকারকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এনবিআরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও জনবল নিয়োগ তথা প্রকৃত আয়ের সাপেক্ষে সঠিক আয়কর প্রদানকারীর সংখ্যা নির্ধারণপূর্বক আয়কর ফাঁকি ঠেকাতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় ৬০ শতাংশ আয় নিশ্চিত করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। এছাড়াও, ঋণখেলাপি ঠেকানো, বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ কমানো অত্যন্ত জরুরি। নয়তো দেশের দুর্বল আর্থিক অবকাঠামো আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়বে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করবে। দেশের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়ার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারে ঋণ নিতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগকে বেগবান করতে সংশ্লিষ্ট খাতে সুবিধা দেওয়া জরুরি। তা না হলে স্বল্প প্রবৃদ্ধি, অধিক তারল্য, বেকারত্ব ও লাগামহীন মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিকে স্থবিরতার (stagflation) দিকে ধাবিত করবে। স্মার্ট বাংলাদেশে ‘স্মার্ট’ বাজেট পরিকল্পনার পাশাপাশি স্মার্টভাবে তার বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।