নারী ও পুরুষভেদে করোনা-পরবর্তী সময়ে হোম অফিস ও সশরীরে অফিসকে বেছে নেওয়ায় কিছুটা তারতম্য আছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, পরিবারকে এড়ানোর জন্য যারা অফিসে যাওয়ার উপায়টিকে বেছে নিয়েছেন তাদের মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা দ্বিগুণ।
Published : 19 Aug 2023, 04:31 PM
করোনা মহামারীর প্রকোপ কমেছে। কিন্তু রেখে গেছে অসংখ্য পদচিহ্ন। তার ছাপ কি শুধুই শরীরে না বাজারের আগুনঝরা দামে? জরিপ বলছে মানুষের দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেও করোনার প্রভাব পড়েছে। আমরা সবাই জানি দুনিয়া থেমে যায়নি, থেমে থাকেনি। কোভিডের প্রাথমিক ঝাপটা সামলে ওঠার পরপরই মানুষ বিকল্প পথ খুঁজে নেয়। দুনিয়া তো বন্ধ থাকতে পারে না। বন্ধ হতে পারে না কাজকর্ম। তাহলে তো জীবনই থেমে যেত। ওই সময় ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা বাড়ি থেকে কাজ করার যে পদ্ধতি চালু হলো আজ তা ভিত্তি লাভ করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আর আগের মতো বিপুল কর্মচারী নিয়ে বড় অফিস লালন করে না। এতে আর্থিক সাশ্রয়ের পাশাপাশি নানাদিকে খরচের হার নেমে গেছে। ফলে অনেকেই আর আগের জায়গায় ফিরতে নারাজ।
আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি কিন্তু দেশের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগে যুক্ত থাকতে পছন্দ করি, আমাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল করোনা। সব খারাপ বিষয়েরও ছোট ছোট ভালো দিক থাকে। দেশের বাইরে থেকে নিয়মিত টকশো বা অনলাইন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছি আমরা। কিছুটা থিতিয়ে এলেও এই প্রবণতা বা অভ্যাস এখন দেশের মানুষজনের ভেতরও কাজ করছে। ট্রাফিকের জট আর দুর্ভোগ পেরিয়ে স্টুডিওতে যাবার পরিবর্তে মানুষ যুক্ত হচ্ছেন নিজ নিজ ঘরবাড়ি বা অফিস থেকে। এতে উভয় দিক থেকে লাভ। কিন্তু আমাদের অজান্তে একটি দিক আবার তার স্বরূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। সে দিকটাই আজকের লেখার বিষয়, যার নাম দাম্পত্য।
জরিপ বলছে, করোনা মহামারীর পর ‘হোম অফিস’ ছেড়ে আবারও সশরীরে অফিস করছেন চাকরিজীবী নারী-পুরুষেরা। তবে এখনো এমন অনেকেই আছেন যারা বাড়িতে থেকেই অফিস চালিয়ে যাচ্ছেন। নারী ও পুরুষভেদে হোম অফিস ও সশরীরে অফিসকে বেছে নেওয়ার কিছু তারতম্য আছে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, কিছু সময়ের জন্য স্ত্রী কিংবা পরিবার থেকে দূরে থাকতে অফিসে যাওয়ার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেন অসংখ্য পুরুষ। বলা হচ্ছে, পরিবারকে এড়ানোর জন্য যারা অফিসে যাওয়ার উপায়টিকে বেছে নিয়েছেন তাদের মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা দ্বিগুণ।
দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও পুরুষের অফিসের যাওয়ার প্রবণতা ও কারণ নিয়ে জরিপটি পরিচালনা করেছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ‘রানওয়ে ইস্ট’। সমসংখ্যক নারী-পুরুষের মধ্যে পরিচালিত জরিপটিতে অফিসে যাওয়ার কারণ হিসেবে ‘পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকা’র অপশনটি বেছে নিয়েছিলেন প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষ। আর যারা এই অপশনটি বেছে নেন তাদের মধ্যে নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা ছিল দ্বিগুণ।
অন্যান্য অপশনের মধ্যে অফিস থেকে ব্যক্তিগত কাজের উদ্দেশে স্টেশনারি সংগ্রহ করার মতো বিষয়টিকেও বেছে নিয়েছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পুরুষ। এ ছাড়া অফিসে আড্ডাবাজির মতো বিষয়গুলোও নারীর তুলনায় পুরুষকে বেশি আকৃষ্ট করে। অফিসে গেলে নতুন মানুষদের সঙ্গে পরিচয় এবং পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হওয়ার অপশনটিকে নারীর তুলনায় পুরুষেরা দ্বিগুণ হারে বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে গত জুনে প্রকাশিত মার্কিন ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকসের প্রতিবেদনটি অন্যতম। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনা মহামারীর পর পুরুষেরা নারীদের তুলনায় অনেক বেশি হারে অফিসে ফিরেছেন। নারীরা গৃহস্থালির কাজগুলোতে সময় দেওয়ার বিষয়টিকে বেশি হারে বেছে নিয়েছেন।
দাম্পত্যের জটিল রসায়ন বোঝা সহজ কিছু না। যুগ যুগ ধরে মানুষ এর রহস্য আবিষ্কারের চেষ্টা করলেও পারেনি। এখনো যে পারে তা কিন্তু নয়। দেখা যাচ্ছে করোনার সময় বাড়ি থেকে অফিস করা পুরুষেরা যে আনন্দ আর রিলাক্স অনুভব করত, তা এখন ফিকে হতে শুরু করেছে। জরিপ বলছে তারা দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় আবার অফিসে যেতে চায়। এটা যে অফিস যাবার জন্য তাড়া বা ভালোবাসা এমন কিছু ভাবা অন্যায়। এদের যদি পার্কের বেঞ্চিতে বসে কাজ করতে বলা হয় আমার ধারণা তারা তা করতেও রাজি হবে। কারণ তাদের মূল উদ্দেশ্য বাড়ির বাইরে যাওয়া। বাড়িতে যদি পত্নী না থাকেন তো এরা বাড়ির বাইরে যেতে চাইবেন কিনা সেটাও গবেষণার বিষয়। মোদ্দা কথা হলো দাম্পত্য যতো মধুরই হোক দেখা যাচ্ছে এক পর্যায়ে সারাদিনে একসঙ্গে থাকা বোরিং মনে হচ্ছে সবার। সঙ্গে যোগ হচ্ছে অভিযোগ।
অভিযোগগুলো পুরানো। ঝগড়া বা মতানৈক্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বহুল আলোচিত অনিবার্য অনুষঙ্গ। এই কলহ যেমন মধুর তেমনি তিক্ততার। আমি এমন দম্পতি দেখেছি এবং জানি যারা দিনে দু-এক পশলা ঝগড়া করবেই। ৫০ বছর কাটানোর পরও হয়তো সে কলহ থামেনি। অথচ কী আশ্চর্য তারা একে অপরকে ছাড়া থাকতেই পারে না। যখন তারা সেজেগুজে বাইরে যায় বা কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, তখন কারও সাধ্য নেই যে বোঝে তারা ঝগড়া করে এসেছে। আবার এমন দম্পতিও দেখেছি যারা মুখে কোনো শব্দ করে না কিন্তু তাদের ভেতরে মিল বা মধু বলে কিছু নেই। এ এক আশ্চর্য জীবন আমাদের।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে পুরুষ কেন বাইরে যাওয়ার জন্য ছটফট করে? এর কারণ কি এই যে তারা বর্হিমুখী? যদি তা হয়ও পাশ্চাত্যের বেলায় তো তা খাটে না। সিডনি শহরে যেকোনো মেয়ে যেকোনো ছেলের তুলনায় কম স্বাধীন নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনতা আর দাপট বেশি। তারপরও দেখা যাচ্ছে নারী বাড়িতে থেকে কাজ করতে ভালোবাসে। আমার ধারণা এর পেছনে যে মনস্তত্ব কাজ করে তার নাম অধিকারবোধ। বাড়িতে নারী যেটুকু অধিকার রাখে বা যেভাবে তার ভূমিকা পালন করে পুরুষ তা পারে না। বাঙালি সমাজ ও পরিবারে আমরা দেখেছি আমাদের মায়েরা উপার্জন না করেও ছিলেন সর্বময় কর্ত্রী। তাদের কথাতেই সংসার উঠত, বসত। তাদের কাছে নতজানু পিতারা যত উপার্জনই করুক না কেন মূলত ছিলেন অসহায়। হয়তো তারা সকালে কাজে গিয়ে রাতে ফিরতেন বলে আমরা তাদের অন্তরের চাওয়া ধরতে পারিনি।
তাহলে কি দাম্পত্য মানে ভীতি? বা পরস্পরের থেকে কিছু সময় আলাদা থাকার নাম সুখ? এই রহস্যের সমাধান মুনী-ঋষিরাও দিতে পারেননি। আমাদের শাস্ত্র বলে নারীর হৃদয় স্বয়ং ঈশ্বরও নাকি পড়তে পারেন না। কবিতায় বলা আছে, ‘রমণীর মন সহস্রবর্ষেরই, সখা, সাধনার ধন।’ হয়তো সে কারণেই মাঝে মাঝে আলাদা হবার ভেতর এক ধরনের স্বস্তি বা সুখ খোঁজে পুরুষ। এগুলো ভাবের কথা বাস্তবে এটাও ভাবতে হবে এমন কি ঘটে আমাদের জীবনে, আমাদের পরিবারে যে কারণে পুরুষ বাড়ি থেকে কাজ করার আনন্দ পাবার পরও বাইরে যেতে আগ্রহী? সমাজবিজ্ঞানী বা দার্শনিকেরা এর কী ব্যাখ্যা দেবেন জানি না। কিন্তু এটা স্পষ্ট একঘেয়েমি আমাদেরকে ক্লান্ত করে তোলে, জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার ওই মানুষটির মতো, ‘বধূ শুয়েছিলো পাশে— শিশুটিও ছিল ‘ যার। তাই মাঝেমধ্যে একটু স্পেস হয়তো দরকারি। যেটা নারীর বেলায় আরও সত্য। তাদের মন ও মননের ইচ্ছেকে সম্মান করার কথাটাও ভাবা দরকার। তারও স্পেস চাই। তারও চাই নিজের ভেতর থাকার নিজের ভালোলাগার অধিকার।
দাম্পত্যের রসায়ন যাই বলুক সংসার ও জীবন চলে হাতে হাত ধরে। এক হাত অন্য হাত ছেড়ে দিলেই ভয়। নির্ভয়ের জন্য, দুনিয়ার জন্য আর সন্তানের জন্য পরিবারের কোনো বিকল্প নেই। করোনার সময় গৃহবন্দি মানুষ ওইটুকু জেনেছে। তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে সংসার বা ঘরের মতো নির্ভরতা আর কোথাও নেই।
জরিপের ভালো দিকটা বলছে ফাঁক-ফোঁকরের ভেতরেই আমাদের জীবনের নির্যাস। যেটুকু খারাপ তাকে খুঁজে নিয়ে আবার দিনশেষে বাড়ি ফেরা আর আনন্দে থাকাই মানুষের চাওয়া। দাম্পত্য এমন না যে আজীবনের নাভিশ্বাস। আবার এমনও না যে খেয়াল-খুশির পাল তোলা জাহাজ। সোজা কথায় সীমার ভেতর অসীম আর বন্ধনের ভেতরেই মুক্তি। জয় হোক দাম্পত্যের।