২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারস্থ ভাড়া বাসায় মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার এবং তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি নৃশংসভাবে খুন হন। নির্মম এ খুনের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় এ পর্যন্ত ১১১ বার পিছিয়েছে।
Published : 08 Sep 2024, 11:48 AM
‘অমীমাংসিত’র মীমাংসা হয়নি, অপেক্ষা বাড়ল’, ‘অনুমতি পেল না ‘অমীমাংসিত’, ‘সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত’, ‘অমীমাংসিত’ প্রদর্শনযোগ্য নয়!’ ‘অমীমাংসিত’ প্রদর্শনের অনুপযোগী!
এপ্রিল-মে মাস ধরেই দেশের সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই সংবাদ বিভিন্ন শিরোনামে গুরুত্বপূর্ণভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায় রায়হান রাফী পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘অমীমাংসিত’ গত ২৯ ফেব্রুয়ারি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র না মেলায় তা আর সম্ভব হয়নি।
গত ২৫ এপ্রিল চারটি বিশেষ কারণ দেখিয়ে চলচ্চিত্রটিকে দর্শকের সামনে অপ্রদর্শনযোগ্য বলে রায় দিয়েছিল চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। ১) চলচ্চিত্রটিতে নৃশংস খুনের দৃশ্য রয়েছে ২) কাল্পনিক কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপের বিষয়বস্তু বাস্তবতার সঙ্গে মিল রয়েছে ৩) এ ধরনের কাহিনি বাস্তবে ঘটেছে এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ৪) চলচ্চিত্রটির কাহিনি/বিষয়বস্তু বিচারাধীন মামলার সঙ্গে মিল থাকায় ভুল বার্তা দিতে পারে এবং তদন্তে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
এ বিষয়ে পরিচালকের ভাষ্যও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, “বাস্তবের সঙ্গে মিলে গেছে, তাই এটা মুক্তি দেওয়া যাবে না। সিনেমা হতে হবে অবাস্তব।” তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে আরও বলেন, “বিষয়টা তাহলে এমন, কোনো সিনেমায় কোনো সাংবাদিক দম্পতি খুন হতে পারবে না?...তাহলে কি সিনেমায় কোনো মেয়ে গুম হয়ে খুন হলে তা কুমিল্লার তনুর সঙ্গে মিলানো হবে? সিনেমায় কোনো কিশোরের লাশ নদীতে পাওয়া গেলে, তার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যাকাণ্ড মিলানো হবে?”
ঘটনাক্রম এবং পরিচালকের বক্তব্য আমাদেরকে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অভিমন্যুর মতো চক্রবুহ্যের আবর্তে থাকা আমরাও আজও জানি না এ বুহ্য থেকে বেরোবার পথ কী?
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে নিজেদের বাসায় নির্মমভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। নির্মম এ খুনের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় এ পর্যন্ত ১০৫ বার পিছিয়েছে। সর্বশেষ এ বছর তদন্তের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, “পুলিশ যদি তদন্ত শেষ না করতে পারে, তাহলে জোর করে সেই তদন্ত সমাপ্ত করে একটা চূড়ান্ত প্রতিবেদন কিংবা অভিযোগপত্র দেওয়াটা কি ঠিক? তাদের তদন্তে সঠিকভাবে দোষীকে নির্ণয় করতে তাদের সময় দিতে হবে, তাতে যদি ৫০ বছর লাগে, তাহলে ৫০ বছর সময় দিতে হবে।” অর্থাৎ যারা সাগর–রুনি খুনের বিচার চান তাদের ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হবে তদন্ত প্রতিবেদন কি হবে তা দেখার জন্য। তবে এই প্রতিবেদন পেতে যদি ১০০ বছরও লেগে যায় অবাক হবার কিছু থাকবে না। আর বিচার প্রক্রিয়া, সে তো তদন্ত শেষ হলে তারপর শুরু হবে। সেটা শেষ হতে আবার কতদিন প্রয়োজন পড়বে তা মন্ত্রী মহোদয় তখন বলেননি অবশ্য। ফলে সার্বিকভাবে আদালতগুলোতে মামলার জট বিবেচনায় সাগর–রুনি হত্যার বিচার পেতে কত বছর অপেক্ষা করতে হবে তা অনুমান করা সম্ভব না, আর এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দক্ষতা, যোগ্যতা, জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করার অধিকার সাধারণ জনগণের আছে বলেও মনে হয় না। এমনকি সরকার পরিবর্তনের আগপর্যন্ত কোনো গণমাধ্যমে লেখালেখি করার উপায় পর্যন্তও ছিল না, শুধু অবাক বিস্ময়ে জনসেবার নমুনা দেখা ছাড়া।
বাংলাদেশের সরকারি দফতরে কর্মরত মানুষের কর্মদক্ষতার যে নমুনা আগে-পরে আমরা দেখেছি তাতে সাগর-রুনি খুনের মামলার তদন্ত করতে তাদেরকে ৫০ বছর সময় তো বিনা প্রশ্নে দেয়া যেতেই পারে! তবে খুনের ঘটনার পরপরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে রহস্য উদঘাটনের অঙ্গীকার করেছিলেন। তারপর কত ৪৮ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। প্রাথমিক কয়েকদিন পুলিশ তারপর কয়েক মাস ডিবি এবং সেখান থেকে এখনও র্যাব তদন্ত করে চলেছে। প্রথম প্রথম আশার বাণী শোনা যেত আর এখন শুনতে হয় তদন্ত শেষ হয়নি, সময় প্রয়োজন।
সাংবাদিক পরিসরে সাগর-রুনি দেশের পরিচিত মুখ। সাংবাদিকদের মতো অগ্রসর পরিসরের মানুষদের খুনের তদন্ত করতে যদি যুগের প্রয়োজন পড়ে তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। আসলে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারি দায়িত্ব পালনে সবসময়ই প্রচণ্ডভাবে ব্যস্ত থাকার ফলে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার সময় পায় না। আর দেশে জনবলের সংকট নেই এমন কোনো দপ্তর যেমন পাওয়া যাবে না তেমনি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনগণের হয়রানি কমানোর উদ্যোগও দেখা যায়নি এতদিন। ফলে জনবল সংকট এবং সামগ্রিকভাবে আমাদের মানসিকতা যোগ হয়ে বিচিত্র একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা স্বজাতির শাসন নিশ্চিত করেছে মাত্র, কিন্তু মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে অক্ষমই রয়ে গিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতার চাইতে দলীয়করণ, পরিবারতন্ত্র এবং ক্ষমতা বেশি গুরুত্ব পাওয়ায় কাঙ্ক্ষিত সকল সেবাই আজ সোনার হরিণ হয়ে গিয়েছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর চাপ নেহাত কম আছে বা আগেও ছিল এমন ভাবার কারণ নেই। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাংবাদিক, শিক্ষক ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিত্বের খুনের ঘটনা তদন্তের তালিকায় ছিল, যাদের সবার তদন্ত শেষ হয়েছে এমন দাবি করার সুযোগ নেই। বিচার তো অনেক পরের কথা। এমনকি সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীও আছেন তালিকায় এবং তাদের অবস্থাও অন্যান্য পেশার ব্যক্তিত্বদের মতোই। তার মানে যে আবার সবার অবস্থা একই রকম সেটা মনে করারও কোনো কারণ বা সুযোগ নেই।
সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে খুনের রহস্য উদঘাটন সবসময়ই সরকারের সদিচ্ছার ওপর সরাসরি নির্ভর করে। আর যেখানে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি কর্মচারীরাও রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত তারা কি কোনোভাবেই জনগণের সেবক হতে পারে? কীসে জনগণের মঙ্গল হবে, জনগণের কীভাবে উপকার করা যায় এর চাইতে তাদের অনেক বেশি চিন্তা থাকে কীভাবে রাজনীতিবিদদের সন্তুষ্ট করে নিজেদের পদ-পদবী ঠিক রাখা যাবে, পদোন্নতির পথ সুগম রাখা যাবে, কীভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া যাবে এসব নিয়ে। অথচ আমাদের সমাজব্যবস্থায় বা আর্থিক খাতে এমন কোনো উন্নতি কিন্তু হয়নি যার ফলে সাধারণ জনগণের আয় ৫ বছরে অন্তত দ্বিগুণ করা সম্ভব হয়েছে। তবে হ্যাঁ রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সততার ব্যবসা-বাণিজ্য লক্ষ-হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে তা তারা নিজেরাই স্বীকার করেন এবং জনগণও তা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।
দেশের পেশাজীবীদের বিভিন্ন মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে পড়ার কারণে সকলের চাওয়াটাও আজ আর এক নেই। ভিন্ন ভিন্ন দলের ভিন্ন ভিন্ন চাওয়ার ফলে দায়িত্বপ্রাপ্তরা সুবিধা পেয়ে গিয়েছে। তারা সাধারণের প্রকৃত চাওয়া থেকে সরে এসে অন্য কোনো কম জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজেদের দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করেছে। এতে করে প্রথমত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সাধারণ জনগণের আস্থা নষ্ট হয়েছে আর দ্বিতীয়ত দেশে ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি লাগামছাড়া হয়েছে। দীর্ঘসময় ধরেই একটার পর একটা ঘটনা ঘটার ফলে মানুষ নতুনের পেছনে ছুটে গিয়ে পুরানোটা নিয়ে যুদ্ধ করার কথা মনেই রাখতে পারেনি। ফলে বছরের নির্দিষ্ট একটা দিনে শুধু স্মরণ করার মধ্যেই প্রতিটি ঘটনা সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে এবং ওই প্রক্রিয়ামাফিক ফাইল ওপরে উঠে আবার নিচে নেমে গিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তাহের হত্যার বিচার পেতে তার কন্যাকে আইনজীবী হতে হয়েছে, তেমনই আমরা আশা করে অপেক্ষায় থাকি সাগর-রুনির সন্তান মেঘ পুলিশ অফিসার হয়ে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে দেবে। সাগর-রুনির একাধিক সন্তান থাকলে আশা করতাম অন্যজন আইনজীবী হয়ে পিতা-মাতা হত্যার বিচারে ভূমিকা রাখুক।
সাধারণ মানুষ দিনে দিনে অসহায় হয়ে পড়েছিল, কারণ ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা মানুষগুলো প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিল। জনগণকে বোকা বিবেচনায় নিয়ে আস্ফালনের মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছানোর কাজ চলছিল দ্রুততালে। অনিয়ম চিরদিন চলে না, তা বিশ্বাস করার অবস্থায় ক্ষমতার বলয় তখন ছিল না। ফলে অমীমাংসিত ঘটনার সংখ্যা বাড়ছিল। তবে আগামীর চাকা ঘুরতে কতক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার অঙ্গীকার রক্ষায় জনগণের সামনে কোনো শক্তিই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তাই আজ শুধু সাগর-রুনির খুনের বিচার নয়, দেশে অনাচার-অনাসৃষ্টি দূর হবার প্রত্যাশা রাখি। বিশ্বাস করি অমীমাংসিত সকল রহস্যই মুক্তির আলো দেখবে।