রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কি সিসিফাসের পাথর উত্তোলন?

আশা করব, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশের নিয়তি গ্রীক পুরাণের সিসিফাসের মতো হবে না।

মোস্তফা সারওয়ারমোস্তফা সারওয়ার
Published : 24 Sept 2022, 10:14 AM
Updated : 24 Sept 2022, 10:14 AM

২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একদিন আগে নিউ ইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। উত্থাপন করেন পাঁচটি প্রস্তাব। প্রস্তাবগুলোর প্রতিপাদ্য ছিল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ বাসভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন, তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মিয়ানমারের জনগণের জন্য ন্যায় ও শান্তি ফিরিয়ে আনা। এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে ও বিশ্বের দরবারে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চাপ অব্যাহত রাখার কথা তিনি বলেছেন।

শরণার্থী সমস্যার সমাধান নিদারুণ জটিল ব্যাপার। পাঁচ বছর আগে এর সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু তারও আগে পটভূমি তৈরি হয়েছিল। ১৯৮২ সালে জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। এই জঘন্য কাজটি ছিল খুবই যুক্তিহীন ও বর্বর। মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ চালিয়ে যাচ্ছে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ পাশবিক অত্যাচার। নিরুপায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়েছে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে।

এই জটিল সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক ও সাবধানী পদক্ষেপ প্রশংসার দাবিদার। তিনি দক্ষতার সাথে পশ্চিম বিশ্ব ও চীনসহ শক্তিধর মোড়ল দেশগুলোর সমর্থন আদায়ে সক্ষম হলেও সমস্যার সমাধান মেলেনি।

কার কারণে সমাধান মেলেনি? এর সঠিক উত্তর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার মতে, সমস্যার সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার এবং এর সমাধান করতে পারে একমাত্র মিয়ানমারই। 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ২০১৭ সালের তিনটি চুক্তির সফল প্রয়োগের পরবর্তী দু-বছরের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছিল না বলে রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। সর্বোপরি, ২০১৯ সালে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের প্রবল বিস্তৃতি শরণার্থী সমস্যার সমাধান সুদূর পরাহত করেছে। 

এই নিরাশার অন্ধকারে কোনো আশার সম্ভাবনা রয়েছে কি? ২০২২ সালের কতগুলো ঘটনা হতাশার অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর আভাস দিচ্ছে। মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের ঢেউ কয়েক হাজার মাইল দূরে অনুভূত হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালত (International Court of Justice) এ মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করছে রাষ্ট্রদূত হান। সে আনুগত্য প্রদান করেছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার পক্ষে। অপর পক্ষে, জাতিসংঘে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত তুন-এর আনুগত্য রয়েছে প্রবাসী ন্যাশনাল ইউনিটি সরকারের প্রতি।

প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দফার অন্যতম দফা হলো বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র গ্যাবন দ্বারা দাখিলকৃত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সক্রিয় সমর্থন লাভ করা। নিরাশার অন্ধকারে ক্ষীণ আশার আলো হলো এ বছর ২২ জুলাই মিয়ানমারের আপত্তি নাকচ করে আন্তর্জাতিক আদালত গণহত্যার মামলাটি বিচারের জন্য গ্রহণ করেছে। আরও একটি ক্ষীণ আশার আলো হলো আসিয়ান (ASEAN) দেশগুলোর সাথে মিয়ানমারের চুক্তি। পাঁচ ধাপে কার্যকরী প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য হলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠার আলোচনা চালানো। তত্ত্বাবধানে থাকবে আসিয়ানের বিশেষ রাষ্ট্রদূত।

আরও খবর হলো, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তিন হাজার আবাসন নির্মাণ করেছে মিয়ানমারে প্রত্যাগমনকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ২০১৭ সালের তিনটি চুক্তি অনুযায়ী শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার অভাব ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে প্রত্যাগমন সফল হয়নি। শান্তিপ্রিয় এবং আতিথিপরায়ণ বাঙালির আশা ভেঙ্গে গেল। 

সম্প্রতি জার্মানি ও যুক্তরাজ্য ফলপ্রসূ পদক্ষেপের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। সম্ভবত চীনের কাছেই রয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ বাসভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জীয়নকাঠি। চীনই হল মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। অস্ত্র, অর্থ, নির্মাণ, কূটনৈতিক সমর্থন, ইত্যাদির মাধ্যমে মিয়ানমারের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখছে। কেন রাখবে না? বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে উন্মুক্ত দ্বার এবং চীনের সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট-এর জন্য মিয়ানমারের বন্ধুত্ব চীনের প্রয়োজন। তাই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে চীন কতটা উৎসাহী হবে সে সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। কয়েক দিন আগে মিয়ানমার ভূখণ্ড থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে মর্টার। এতে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক যুবক নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদেরকে ডেকেছিল সীমান্ত পরিস্থিতি অবহিত করতে। সেখানে চীনের রাষ্ট্রদূত আসেনি।

উপরোক্ত আলোচনার উপসংহারে বলা যেতে পারে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিদারুণ প্রচেষ্টা ও কূটনৈতিক বিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন কখন হবে তার অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। তবুও প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে। মনে হলো আলব্যের ক্যামুর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘দ্য মিথ অব সিসিফাস’। সিসিফাস ক্রুদ্ধ দেবতার তুষ্টির জন্য এক পাহাড়ের প্রচণ্ড চড়াইয়ে এক বিশাল পাথর তুলেছিল। শৃঙ্গের কাছাকাছি যেতেই পাথরটি হাতছাড়া হয়ে গড়িয়ে পড়ত নীচে। পুনরায় সিসিফাস চেষ্টা করে যেত। ব্যর্থতা সিসিফাসকে থামাতে পারেনি তার প্রচেষ্টা থেকে। আশা করব, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশের নিয়তি হবে না গ্রীক পুরাণের সিসিফাসের মতো।