রুচি ও রুচির দুর্ভিক্ষ

আমাদের সামগ্রিক রুচি যে ক্রমেই অবক্ষয়গ্রস্ত হয়ে পড়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এ জন্য কে দায়ী, কী দায়ী তা মনে হয় চট করে বলে ফেলাটা অনুচিত।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 29 March 2023, 04:39 AM
Updated : 29 March 2023, 04:39 AM

‘আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির উত্থান। এই উত্থান কীভাবে রোধ করা যাবে, এটা যেমন রাজনৈতিক সমস্যা, তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক সমস্যাও।’ সম্প্রতি এই কথাগুলো বলে দেশের খ্যাতিমান নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলেছেন। রুচির দুর্ভিক্ষের ‘প্রতীক’ হিসেবে হিরো আলমের নাম বলায় এক শ্রেণির ফেসবুক-লিখিয়ে আহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা মামুনুর রশীদের মুণ্ডুপাত করছেন। আবার ছোট্ট একটা গ্রুপ মামুনের রশীদের বক্তব্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে।

বাংলা অভিধানে রুচি শব্দটির বিভিন্ন মানে আছে। অভিধানে রুচি মানে ১ শোভা, দীপ্তি (তনুরুচি, দন্তরুচি); ২ পছন্দ (কুরুচি) ৩ মার্জিত বুদ্ধি বা প্রবৃত্তি (বেশভূষায় রুচির পরিচয়); ৪ স্পৃহা, ইচ্ছা (আহারে রুচি নেই); ৫ অনুরাগ, আকর্ষণ ইত্যাদির কথা বলা আছে।

সমাজবিজ্ঞানে, রুচি বলতে বোঝায় কোনো ব্যক্তি বা সামাজিক গোষ্ঠীর খাদ্যাভাস, ডিজাইন, সাংস্কৃতিক ও নন্দন তত্ত্ব চর্চার ধরন ইত্যাদি সম্পর্কিত বিষয়ভিত্তিক পছন্দ বা নির্বাচনকে। মানুষ কীভাবে কোনো কিছুকে সুন্দর, ভালো বা মূল্যবান হিসেবে বিচার করছে তার ভিত্তিতেই মানুষের রুচি বোঝা যায়। সমাজে বিভিন্ন রকম রুচি দেখা যায়, আর এর অন্যতম কারণ হলো সেই সমাজে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির উপস্থিতি।

তবে রুচির কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। এক এক কালে এক এক অঞ্চলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভেতর ভিন্ন রকমের রুচি থাকে, থাকতে পারে। এর কারণ রুচি কোনো প্রবল অটল বিষয় নয়। স্থান-কাল এমনকি জলবায়ুভেদে রুচি পরিবর্তনশীল। রুচি ব্যক্তি-বিশেষের শিক্ষা-দীক্ষা-নীতি-নৈতিকতার উপরেও নির্ভরশীল। এমনকি বয়স ও অভিজ্ঞতার উপরেও রুচির তারতম্য হয়। রুচির নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। ফলে আমরা কখনোই নির্দিষ্ট রুচির মানদণ্ডে কারুর বিচার করতে পারি না। কিন্তু সেই রুচির উপরে নির্ভর করেই আমরা কাউকে কাছে টানতে পারি। কাউকে দূরে ঠেলে দিতে পারি। এটা আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয়।

একটি শিক্ষিত ও উন্নত সমাজের রুচি আর একটি অনুন্নত নিরক্ষর সমাজের রুচি অভিন্ন হতে পারে না। গরুর দুধে জল মিশিয়ে ব্যবসা করার রুচি যে সমাজের ভিত, সেই সমাজ কখনোই মানবসম্পদ উন্নয়নে কাজ করতে সক্ষম নয়। আবার যে সমাজ নিরন্তর মানবসম্পদ উন্নয়নে ক্রিয়াশীল, সেই সমাজের জনরুচি কখনোই গরুর দুধে জল মিশিয়ে ব্যবসা করতে পারবে না। এমনটাই হয়ে থাকে। পরীক্ষায় পাশ করানোই যে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল অভিমুখ, সেই ব্যবস্থায় পড়া মুখস্থ করার জনরুচিই শিক্ষার মানদণ্ড ঠিক করে দেবে। এটাই স্বাভাবিক। আবার সেই পড়া মুখস্থের জনরুচির কারণেই ঠিকমত পড়া মুখস্থ না হলেই পরীক্ষার খাতায় গণটোকাটুকি, কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঐতিহ্য গড়ে ওঠার জনরুচিও অতি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু শিক্ষার অভিমুখ যেখানে মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটানো, সেখানে কোনভাবেই পড়া মুখস্থ কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁসের জনরুচি গড়ে উঠবে না। ওঠে না।

বর্তমানে আমাদের দেশে যে সকল রাজনৈতিক নেতা যত বেশি অকথা-কুকথা বলতে পারেন, জনসমর্থনের জনরুচি তাদের অভিমুখেই চালিত হয়। নির্বাচনের প্রক্কালে যে যত বেশি মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ঢেউ তুলতে সক্ষম হবে, সেই মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠার জনরুচি ততই জনসমর্থন বাড়িয়ে তুলবে। এটাই এই সময়ের বিশেষ বৈশিষ্ট।

এখানে বলে রাখা ভালো যে, রুচি ও ভোগ ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। নির্দিষ্ট ধরনের পোশাক, খাদ্য এবং অন্যান্য পণ্যের পছন্দ হিসেবে রুচি সরাসরি বাজারে ভোক্তাদের পছন্দকে প্রভাবিত করে। রুচি ও ভোগের মধ্যে কার্যকারণ যোগসূত্রটি বেশ জটিল। রুচি চাহিদা তৈরি করে, আর এর মাধ্যমে এটি যোগান ও সরবরাহ তৈরি হয়। একটি সমাজে রুচি নানাভাবে তৈরি হয়। কারো কারো মতে, শাসক শ্রেণির রুচিই হচ্ছে সমাজের বৈধ রুচি। আবার অনেকে সমাজে অগ্রসরমান অংশকে রুচি নির্মাণে মূল কারিগর মনে করেন।

রুচির ব্যাপারটি আসলে খুব এক সম্পাদ্য। কার রুচি যে কোথায় গিয়ে অরুচি সৃষ্টি করে, তা বলা খুব মুশকিল। প্রসঙ্গত, উনিশ শতকের কবি কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ (বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্যঙ্গাত্মক লেখালেখির জন্য যিনি প্রসিদ্ধ) ‘রুচি-বিকার’ নামে একটি কবিতা লিখে মুশকিলে পড়ে যান। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করলেন হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। তিনি সে-কালের ব্রাহ্ম সমাজের এক বিশিষ্ট প্রতিনিধি। কলকাতা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ, ইংরেজি সাহিত্যের এমএ এবং পিএইচডি হেরম্বচন্দ্র তাঁর পাণ্ডিত্য এবং বৈদগ্ধ্যের জন্যও সবার শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন।

১৮৯৬ সালের ২৪ জুলাই ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় ছাপা হয় ‘রুচি-বিকার’। হেরম্বের অভিযোগ ছিল, ওই কবিতা তাঁর স্ত্রী কুসুমকুমারী মৈত্রকে ‘ব্যঙ্গ’ করেই লেখা। কুসুমকুমারী সুন্দরী, পরিশীলিত, মুক্ত মনের নারী। ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চোখে পড়ত তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। ‘কুসুম’ শব্দটা বারবার ব্যবহার করে কালীপ্রসন্ন লিখেন:

“কুসুমের কোমলতা মাধুরী অপার

কিন্তু তার পবিত্রতা

জানি তাতে দুষ্ট অলি করেছে বিহার

লুটেছে সঞ্চিত মধু মধুর ভাণ্ডার॥"

কখনও কুসুমের অন্য প্রতিশব্দ (প্রসূন) নিয়ে লেখা হয়:

“পদে পদে প্রসূনের দেখি অনাচার

আজি উপেন্দ্রর ভোগ্য

কালই হেরম্বের যোগ্য

দেখিলে রুচির দোষ না হয় কাহার?”

হেরম্বচন্দ্র আদালতে অভিযোগ করেন, এই কবিতায় তাঁর স্ত্রীকে নিয়েই কটাক্ষ করা হয়েছে। এমনকি, তিনি নিজে এবং তাঁদের পরিচিত সমাজের অন্য বিশিষ্ট জনদের নিয়েও অনভিপ্রেত মন্তব্য করা হয়েছে। কালীপ্রসন্ন তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, “এ হলো নির্মল হাস্যরস। কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ বা অসম্মানের উদ্দেশ্যে এ কবিতা লেখা হয়নি।” বিচারপতি জেনকিন্সকে বোঝাতে গোটা কবিতাটা ইংরেজিতে অনুবাদও করা হয়। হাইকোর্টে প্রায় ছয় মাস ধরে বিচার চলে। ১৮৯৭ সালের ১৭ জানুয়ারি বিচারপতি জেনকিন্স কবিকে দোষী সাব্যস্ত করেন। তিনি বলেন, “কুৎসা এবং অসূয়াপ্রসূত বিবৃতির (scandalous and malicious libel) মাধ্যমে এই কবিতা নিশ্চিতভাবে কুসুমকুমারীর সম্মানহানি করেছে।” মানহানির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে দু’বছরের জেল কিংবা জরিমানার সাজা হতে পারে। কালীপ্রসন্ন জরিমানা দিয়েই রেহাই পেয়েছিলেন (সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ এপ্রিল ২০১২)।

রুচি প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও লেখক অশোক মিত্র বলেছেন, ‘জীবনযাপনের বিভঙ্গই মানসিকতা তৈরি করে। পছন্দ-অপছন্দ, বাছ-বিচার, রুচি-অরুচি, চিন্তার প্রবাহ সমস্ত কিছুই জীবনযাপনের প্রকৃতি দিয়ে প্রভাবিত হয়, অর্থাৎ জীবনধারাই চেতনাকে গড়ে।’

আমাদের সামগ্রিক রুচি যে ক্রমেই অবক্ষয়গ্রস্ত হয়ে পড়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এ জন্য কে দায়ী, কী দায়ী তা মনে হয় চট করে বলে ফেলাটা অনুচিত। আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতির সামগ্রিক অবক্ষয়ই যে রুচির নিম্নগামিতা তৈরি করেছে, সেটা মেনে নিয়ে ‘রুচি’ নিয়ে একটি গল্প বলা যাক। গল্পটির কথক হিসেবে তেনালি রামকৃষ্ণের কথা শোনা যায়। তিনি ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণদেব রায়ের দরবারের একজন কবি এবং পরামর্শদাতা। 

বিজয়নগর রাজ্যে রাময়া নামের এক লোক বাস করতেন। সবাই তাকে অশুভ বা অপয়া বলে মনে করত।

তারা মনে করত, সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই যদি কেউ রাময়ার মুখ দেখে তবে তার সারাটা দিন খারাপ যাবে।

কথাটা রাজা মশাইয়ের কানেও পৌঁছাল।

ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য রাজা মশাই রাময়াকে তার প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানালেন।

রাময়া এলে রাজা বললেন, ‘তুমি আজ আমার প্রাসাদে থাকবে। সকালে উঠে সবার আগে আমি তোমার মুখ দেখব। তুমি শুভ না অশুভ সেটা আগামীকালই বোঝা যাবে।‘

রাতে রাময়া রাজার পাশের ঘরেই ঘুমালেন।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রাজা অন্য কারও মুখ দর্শন না করে প্রথমেই রাময়ার ঘরে ঢুকলেন। রাময়ার মুখ দেখলেন।

সেদিন দুপুরে খেতে বসে রাজা কিছুই খেতে পারলেন না।

তিনি রাঁধুনিকে ডেকে আবার তার জন্য রান্না করতে বললেন। এবারও তার খেতে ইচ্ছে করল না।

অভুক্ত থাকার কারণে সেদিন তিনি মন দিয়ে কোনো কাজ করতে পারলেন না।

তখনই তিনি বুঝতে পারলেন, সাধারণ মানুষ রাময়ার নামে যা বলে তা সঠিক।

রাজা মশাই ঠিক করলেন, এমন অশুভ এবং অপদার্থ লোক তার রাজ্যে বাস করতে পারবে না। তাকে ফাঁসি দিতে হবে।

রাময়ার স্ত্রী স্বামীর শাস্তির কথা শুনে তেনালি রামনের কাছে ছুটে গেলেন। খুলে বললেন সব কথা।

তেনালি রামন সাহায্য করবেন বলে কথা দিলেন।

পরের দিন সকালে যখন সৈন্যরা রাময়াকে ফাঁসিতে ঝোলাতে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তেনালি রামন কানে কানে রাময়াকে কিছু বুদ্ধি দিয়ে চলে গেলেন।

ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে সৈন্যরা শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলে রাময়া বলল, সে রাজার কাছে একটি চিঠি পাঠাতে চায়।

রাময়া চিঠি লিখলেন। সেটা রাজা মশাইকে দেওয়া হলো।

সেখানে লেখা ছিল, আমার মুখ দেখে আপনার মুখের খাবারের রুচি চলে গেছে। আর আপনার মুখ দেখে আমার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তাহলে কে সবচেয়ে অশুভ? আমি নাকি আপনি?’

রাজা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং রামায়াকে তখনই মুক্তি দিলেন!