একজন শেখ কামাল এবং অরক্ষিত সংস্কৃতি অঙ্গন

সেই শেখ কামালকেও পরিবারের অন্যদের সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৭৫ এর ট্রাজেডিও আজ প্রায় পাঁচ দশকে। আমরা পার করেছি স্বাধীনতার অর্ধশতাধিক বছর।

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমান
Published : 14 August 2022, 03:21 PM
Updated : 14 August 2022, 03:21 PM

অগাস্ট জাতীয় শোকের মাস। ৫ অগাস্ট ছিল বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের জন্মদিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জবানিতে আমরা জানতে পারি, ১৯৭৫ সালে অগাস্ট ট্রাজেডির পূর্বে তিনি তার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে যাবার প্রাক্কালে তার ছোট ভাই শেখ কামাল অনুরোধ করেছিলেন জার্মানি থেকে ফেরার সময় তার দল আবাহনীর জন্যে বুট কিনে নিয়ে আসতে। আমরা সকলেই জেনে থাকবো শেখ কামাল প্রচলতো রাজনীতি ও ক্ষমতার ধারার বাইরে বিকল্প বিষয় ও উদ্যোগ নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত ছিলেন। তা ছিল সংস্কৃতি এবং ক্রীড়াঙ্গন।

এই ঘটনা উল্লেখ করে আমি অন্য একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই। আজকে ঢাকায় নাট্যাঙ্গনের যারা মোড়ল তাদের কারো অবস্থাই কোনো দিক দিয়েই শেখ কামালের চেয়ে জৌলুসের ছিল না। সেই শেখ কামাল দেশের রাষ্ট্রপতি, দেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর সন্তান হয়েও কোনোরকম প্রভাব বা প্রতিপত্তির দিকে না গিয়ে বা সরকারি অবকাঠামো পরিকাঠামোর উপর নির্ভর না করে সাংগঠনিক অগ্রগতি অর্জনের জন্যে যুবসমাজকে সময়ের নিরিখে আলোর পথযাত্রী করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে গড়ে তুলেছিলেন স্পন্দন, খেলাধুলার জন্যে গড়ে তুলেছিলেন আবাহনী আর মঞ্চনাটকের জন্যে ঢাকা থিয়েটার।

সেই শেখ কামালকেও পরিবারের অন্যদের সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৭৫ এর ট্রাজেডিও আজ প্রায় পাঁচ দশকে। আমরা পার করেছি স্বাধীনতার অর্ধশতাধিক বছর। এরকম একটা অবস্থায় আমাদের সংস্কৃতি বিশেষ করে দেশের মঞ্চনাটক কোন অবস্থায় আছে সেই বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। স্বাধীনতার পর শেখ কামাল যখন এই সমস্ত সৃজনশীল আর মননশীল বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন তার বয়স ছিল ২২ বা ২৩। আজকে যারা ঢাকার সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশেষ করে নাট্যাঙ্গনের মোড়ল তারা প্রায় প্রত্যেকেই শেখ কামালের প্রজন্মের।

বর্তমান সময়ে সংস্কৃতি অঙ্গনের চিত্র তুলে ধরতে আমি তিনটি ঘটনার অবতারণা করতে চাই:

ঘটনা: এক

প্রথম ঘটনাটি জুলাই মাসের ২২ তারিখে। অই দিন ঢাকার বেইলি রোডে মহিলা সমিতিতে মিলিত হয়ে ঢাকার মঞ্চনাটকের সঙ্গে জড়িত কর্মীরা এক মতবিনিময় সভায় মঞ্চনাটকের সঙ্কট নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। খবরটির সারমর্ম মোটামুটি এরকম:

ঢাকার নাট্যকর্মীদের এক সময়ের গর্ব বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। যাত্রা শুরু করার পর থেকে দেশের নানা সঙ্কট, আন্দোলন–সংগ্রাম আর দাবী আদায়ে ভূমিকা রেখেছে এ সংগঠন। এখন সেই সংগঠন নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ নাট্যকর্মীরা। মুক্ত আলোচনা ও মতবিনিময় সভায় নিজেদের ক্ষোভ ও ফেডারেশনের নানা অনিয়ম তুলে ধরলেন তাঁরা।

ঘটনা: দুই

এই ঘটনা এদেশের জনপ্রিয় স্বশিক্ষিত বা শিক্ষাবঞ্চিত শিল্পী হিরো আলমকে নিয়ে। জুলাই মাসের ২৭ তারিখ পুলিশ তাকে ডেকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের গান আর না করার জন্যে মুচলেকা আদায় করেছে। খবরটির মোদ্দা কথা এরকম: কয়েকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশে আলোচিত আশরাফুল আলম সাঈদ ওরফে হিরো আলমকে জিজ্ঞাবাসাদ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আর কখনো অনুমতি ছাড়া পুলিশের পোশাক পরবেন না এবং বিকৃত করে রবীন্দ্র ও নজরুল সংসঙ্গীত গাইবেন না বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে ডিবিকে মুচলেকা দিয়েছেন হিরো আলম।

ঘটনা: তিন

হিরো আলমকে ডেকে নিয়ে পুলিশ যেদিন তার কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করলো, সেই একই দিনে, আমাদের একজন শীর্ষস্থানীয় কবি কবিতার আকারে মাছি বন্দনা করে একটি কবিতা লিখেছেন। সেই কবিতা তিনি আবার তার ফেইসবুকে প্রকাশ করেছেন। কবিতার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন:

"তাই বলে আমার সব কবিতার প্রথম পাঠকই মাছি-- এটি সত্য নয়।

তবে আমার বেশ কিছু কবিতার প্রথম পাঠক হলো মাছি।"

আমরা এমন এক সময় পার করতেছি পুলিশ তৎপর সঙ্গীতের আভিজাত্য রক্ষায়, নাট্যকর্মীরা হতাশ ক্ষুদ্ধ নাট্যাঙ্গনের অচলাবস্থা নিয়ে আর নগরের ’শীর্ষ কবি’ কবিতা লিখছেন 'মাছির বন্দনা' করে।

তিনটি আলাদা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও, এদের কার্যকরণ যোগসূত্র সময়ের একই সুতোয় গাঁথা। আর সুতোটি হচ্ছে আমাদের সময়ের গলদ স্খলন আর পতনের বুনন।

কোন দুনিয়ায় আছে যে, সঙ্গীতের উচ্চমার্গ নির্ধারণ আবার রক্ষনাবেক্ষণের কাজটাও পুলিশকে নিতে হবে? পুলিশের কাজের কি অভাব হয়ে গেছে? এমনটাই পুলিশের উপর নানা বারোয়ারি কাজের চাপ, সম্পদ ও জনবলের বড় ঘাটতি। যেখানে পুলিশের সংস্কার সময়ের দাবি। সেখানে পুলিশ যদি ইউটিউবের শিল্পীদের পেছনে সময় ব্যয় করে কতজনকে সঙ্গীত বিষয়ে তালিম দিবে?

চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা দূর করার জন্যে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বা এফডিসির ভেতরে একসময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দপ্তর খোলা হয়েছিল। এসব বিষয়ে মন্তব্য করবো কি- মাথার উপর দিয়া যায় না, ফারাক দিয়া যায়- বুঝে উঠতে পারছি না।

এখানে আমার একটা খটকা মনের ভেতরে? পুলিশ হিরো আলমকে ডেকে এনে বকেঝকে মুচলেকা আদায় করে ছেড়ে দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছে কি তারা জনগণের কত কাছের, কত সুহৃদ? তারা হিরো আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী মহানদের নাগরিক উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। একই সঙ্গে হিরো আলমকে কোনো রকম হেনস্তা না করে কেবল জিজ্ঞাসাবাদ করে, মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা কত সুন্দর না? আমাদের পুলিশি কার্যক্রম কত এগিয়ে চলছে। ভাবতে তো ভালো লাগার কথা, তাই না? কিন্তু তারপর কিছু 'দুর্মুখ' কেন পত্রিকায় ফেইসবুকে এই ঘটনা নিয়ে পুলিশের উদ্দেশে নানা কথা বলছে?

যে প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি। জাতীয় এই শোকের মাসে আমরা ঘটে যাওয়া ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করবো। ইতিহাসের অগ্রগামী মানুষের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমরা শিখবো। কিন্তু তার কি কোন লক্ষণ হাল আমলের রাজনীতি, শিক্ষা আর সংস্কৃতি অঙ্গনে উল্লেখ করার মতো কোনো বিষয় আছে ? শেখ কামালের জীবন ও কর্ম থেকে কতটুকু অনুপ্রেরণা সংশ্লিষ্ট মহল কার্যকরভাবে গ্রহণ করেছে?

আজকে যারা সংস্কৃতি অঙ্গনের মোড়ল তাদের প্রায় প্রত্যেকেই শেখ কামালের প্রজন্মের। ১৯৭৫ এর আগে এদের কারো অবস্থাই আজকের মতো রমরমা ছিল না। শেখ কামাল যখন আবাহনীর ছেলেদের জন্যে তার বড় বোনের কাছে জার্মানি থেকে ফেরার সময় বুট নিয়ে আসার আবদার করেছিলেন তখন আজকের মোড়লদের আর্থিক অবস্থাও এরকমটাই ছিল। আজকে মোড়লদের কেউ কেউ কোটি কোটি টাকার মালিক, মন্ত্রী এমপি পর্যন্ত হয়েছেন, ছুটিছাটায় এমনকি উৎসব পার্বণে ছুটি কাটাবার জন্যে ব্যাংকক সিগারপুর বিলেত নিউ ইয়র্ক পাড়ি জমান।

এর বিপরীতে সংস্কৃতি অঙ্গন বিশেষ করে নাট্যাঙ্গন দারুণভাবে অরক্ষিত এবং নিগৃহীত। আওয়ামী লীগের বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে সংস্কৃতির জন্যে আলাদা কোনো অধ্যায়ই ছিল না। যুব ও ক্রীড়া অধ্যায়ে দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি যুব কমপ্লেক্স স্থাপনের কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়নের কোনো আভাস এখন পর্যন্ত নাই।

সংস্কৃতি অঙ্গনের অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধির, যে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছিলেন ঢাকার মহিলা সমিতিতে, তা ইতিবাচক। তারপরও কথা থাকে। সময়ের সাধন সময়ে করতে হয়। যাদেরকে সামনে রেখে, মঞ্চে রেখে এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার কথা ভাবছেন, তারাও কি এই সঙ্কটের দায় থেকে মুক্ত? মঞ্চে বসা এদের একজন সংস্কৃতি মন্ত্রী ছিলেন, আছেন সংসদ সদস্য। উনার কাছে কি সংস্কৃতি অঙ্গনের কেউ সাহস করে প্রশ্ন করেছেন? দুই একজন ব্যতিক্রম ছাড়া নাট্যাঙ্গনের মোড়লদের সকলেই কোন না কোনো ঠিকাদারি বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

আসলে আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গন বা নাট্যাঙ্গন মোড়লমুক্ত হওয়া দরকার। মোড়লিয়ানাই যত সর্বনাশের মূল। এই মোড়লগিরির মূলোৎপাটন করে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিশেষ করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে জাতীয় সংস্কৃতি নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া। আওয়ামী লীগ টানা এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায়। অথচ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় চলছে ২০০৬ সালে প্রণীত জামাত-বিএনপি প্রণীত সস্কৃতি নীতি নিয়ে। সর্ষের মধ্যে ভূত রেখে ভূত তাড়ানোর গল্প বলে লাভ নাই।

এই সত্যটা বঙ্গবন্ধু যেমন বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন তার সন্তান শেখ কামাল তরুণ বয়সেই। তাই তাঁর হাতে যাত্রা শুরু হয়েছিল আবাহনী ক্লাবের, সংস্কৃতি সংগঠন স্পন্দনের এবং ঢাকা থিয়েটারের। এর পেছনে শেখ কামালের ব্যবসা বা ঠিকাদারি কোনো উদ্দেশ্য ছিল না; উদ্দেশ্য ছিল জাতিগঠন। সেখান থেকে আমাদের সংস্কৃতির ঠিকাদার মোড়লরা না শিখলেও শিখতে হবে তরুণ প্রজন্মকে আর এর অনুকূলে ভূমিকাটা রাখতে হবে সরকারকেই।