হরতাল-অবরোধ এবং রাজনীতিতে জয়-পরাজয়ের খেলা

তর্কের খাতিরে ধরা যাক, হরতাল-অবরোধের মতো ভোঁতা কর্মসূচি ডেকে বিএনপি নিজেদের অজনপ্রিয় করে তুলছে এবং এতে আপাত বিজয় হয়েছে আওয়ামী লীগের। কিন্তু হরতাল-অবরোধ যত ভোঁতা অস্ত্রই হোক না, ভোঁতা অস্ত্রে পা কাটলে ধনুষ্টঙ্কার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

রাজীব নূররাজীব নূর
Published : 30 Oct 2023, 03:42 PM
Updated : 30 Oct 2023, 03:42 PM

হরতাল ডেকে ঘরে বসে যেতে হবে— এটা কি বিএনপির জানা ছিল না? আজ বাদে কাল থেকে শুরু হওয়া অবরোধে কী হবে? রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল-অবরোধ যে ভোঁতা অস্ত্রে পরিণত হয়েছে, বিএনপির নিশ্চয়ই তা অজানা নেই।

এর আগে ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় হরতাল পালন করেছিল দলটি। পরে ঢাকার বাইরে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে দু-একবার হরতাল ডাকলেও ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ৪৫ মাস পর আবার হরতাল করেছে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন হরতাল-অবরোধের মতো ভোঁতা অস্ত্রটি বিএনপির হাতে গছিয়ে দিয়েছে সরকারি দল। তাদের এমন মতামতের যৌক্তিকতাও হয়তো খুঁজে পাবেন কেউ কেউ।

তবু কথা রয়ে যায়। বিএনপির মতো একটা বড় রাজনৈতিক দল অন্যের পাতা ফাঁদে এত সহজে পা দিয়ে ফেলবে? তাদের কি জানা ছিল না, হরতাল সফল করার কোনো বাস্তবতাই নেই আর। রাজধানী ঢাকাকে যদি উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়, তাহলেই তো বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রায় দুই কোটি নাগরিকের এই মহানগরে যদি মাত্র ১০ শতাংশও ঘরের বাইরে বের হতে বাধ্য হন, তাহলে ২০ লাখ মানুষ থাকবে চলাচলের মধ্যে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো আছেনই, বেসরকারি অফিসগুলোও হরতালের দোহাইয়ে কর্মীদের অফিস কামাই করা মানতে নারাজ হবে এবং এটাই স্বাভাবিক।

“হরতালে একটা মন্দের ভালো আছে,” ২৯ অক্টোবরের হরতাল চলাকালে বলছিলেন আমার এক সহকর্মী। অন্য সব দিনের মতো সেদিনও আমাদের দুজনের অফিসে যেতে হয়েছিল। সাংবাদিকের জন্য সমস্ত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিশেষ ছাড় থাকলেও ওই দিনের হরতালে দিন গড়াতে আমরা সাংবাদিক নিগ্রহের অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। অফিস যাওয়ার পথে সহকর্মীটি বলছিলেন, “হরতালে পথে-ঘাটে যানবাহন চলাচল কমে যায় বলে অন্তত ওই দিনটা ধোঁয়া ও দূষণ থেকে রেহাই মেলে ঢাকাবাসীর। যারা ঘরের বাইরে বের হতে বাধ্য হন, তারা যানজটহীন শহরে সহজেই গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারেন। যানজট তো দূরের কথা, সিগন্যাল বাতির কবলেও পড়তে হয় না এমন দিনে।”

আমার সহকর্মীটি আমাকে নিতে মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ থেকে সিএনজি অটোরিকশায় রওয়ানা করে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছিলেন সাত মিনিটে। আমার ধারণার চেয়ে অনেক আগে পৌঁছে যাওয়ার কারণে সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো তার। পরে স্কয়ার হাসপাতাল থেকে তিতুমীর কলেজের কাছে পৌঁছাতে আমাদের সাকুল্যে মিনিট দশেক লাগল।

সহকর্মীর ভাষ্য, “এই রকম আধা সফল হরতালে জনগণের পথ চলাচলে একটু হলেও স্বস্তি মেলে। তবে সঙ্গে মনে একটু উদ্বেগ থাকে।”

উদ্বেগের কারণ সরল। হরতালকারীরা যদি কর্মসূচিটি সফল করতে চান, বলপ্রয়োগের বিকল্প থাকে না। হরতাল একটি গুজরাটি শব্দ। হর মানে সব। আর হরের সঙ্গে যুক্ত তাল সব কিছু তালা অর্থে ব্যবহৃত হয়। গুজরাটি হাড়্তাল্ থেকে এসেছে শব্দটি, যা সর্বাত্মক ধর্মঘটের প্রকাশক বলে মনে করা হয়। গুজরাটে জন্ম নেওয়া মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে যে অসহযোগের প্রবর্তন করেছিলেন, তা এখন আমাদের এখানে হরতালে পরিণত হয়েছে। হরতাল শব্দটির অর্থও বদলে অরাজকতা, মারামারি-কাটাকাটিতে দাঁড়িয়ে গেছে। এর প্রবর্তক মহাত্মা গান্ধী এমনটা চাননি, করতেও দেননি।

২৯ অক্টোবর হরতাল শেষে ডাকা হয়েছে অবরোধ। দুটিতে পার্থক্য কতটা? মঙ্গলবার থেকে দেশজুড়ে তিন দিনের অবরোধ ডেকে বিএনপির পক্ষে বলা হয়েছে, “রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথে এই সর্বাত্মক অবরোধ পালন করা হবে।” বোধহয়, কর্মসূচি হিসেবে অবরোধটা হরতালের তুলনায় কঠোর। অবরোধের মধ্যে তো জবরদস্তির ঘোষণাই রয়েছে। হরতালকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্মসূচি বলা হলেও হরতাল ডাকার আইনগত অধিকার রয়েছে নাগরিকের। হরতাল না মানারও অধিকার রয়েছে নাগরিকদের। কার্যত তা হয় না।

এই যে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার, ২৯ অক্টোবর একটি হরতাল পালিত হলো, দিনশেষে আরও মৃত্যু, আরও অরাজকতা ছাড়া কি নিয়ে এসেছে তা? হরতালকে একসময় সবচেয়ে কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের আগে তো বটেই, মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালে জিয়া এবং এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনামলেও হরতালের প্রতি যথেষ্ট জনসমর্থন ছিল। এরপর থেকে হরতাল নামক রাজনীতির এই হাতিয়ারটিতে মরচে ধরা শুরু হয়েছে। এখন এর আবেদন নেই বলেই মনে করা হয়। মানুষের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা তৈরি করা ছাড়া হরতালের মতো কর্মসূচি পুরো কার্যকারিতা হারিয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪-১৫ সালের দিকে বিএনপি-জামায়াত জোটের টানা হরতাল-অবরোধে অতিষ্ঠ হয়ে এই কর্মসূচিগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে জন্ম নেয় এক ধরনের বিতৃষ্ণা। আগুন সন্ত্রাসের স্মৃতি বহু পরিবারের কাছে গভীর ক্ষত হয়ে আছে। মূলত ওই সময়েই হরতাল-অবরোধ নামক কর্মসূচিগুলো পুরো অকার্যকর হয়ে পড়ে, আর দশটা সাধারণ দিনের মতোই হরতালের দিনেও ঢাকাবাসীকে পড়তে হয় তীব্র যানজটে। কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে হরতাল পরিণত হয় নিতান্তই নিয়মমাফিক আন্দোলনে। ২৯ অক্টোবর হরতালের দিন সকালে যান চলাচল সীমিত থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পথে যানবাহন বাড়তে দেখা গেছে। যদিও গণমাধ্যমে আসছিল আতঙ্কিত হওয়ার মতো অনেক খবর।

রাত পোহাবার আগেই ঢাকার ডেমরায় বলি হলো আরেকটি প্রাণ, সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে, তাতে প্রাণ গেছে ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা চালকের সহকারীর। নিহতের নাম নাঈম ওরফে নাজিম। বয়স ২০ বছর। তার সঙ্গে বাসে থাকা রবিউল নামে আরেক তরুণ আগুনে দগ্ধ হয়েছেন। হরতাল চলাকালে মানিকগঞ্জে যাত্রীদের নামিয়ে বাসে আগুন দেওয়া হয়। স্বপ্ন পরিবহনের বাসটির চালক জানান, যারা আগুন দিয়েছে, যাত্রীবেশে গাড়িতে উঠেছিলেন তারা।

হরতালের সময় রাজধানীতে তিন তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। আগুন লাগার আগ দিয়ে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে এসব বাসের যাত্রীরা হুড়মুড় করে নেমে যাওয়ায় হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। লালমনিরহাটে বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে পিকেটিং ও মিছিলের সময় দুই পক্ষে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পরে আওয়ামী লীগের তিন জনকে কুপিয়ে জখম করা হয়। ঢাকায়ও আবদুর রশিদ নামে একজন ‘খুন হয়েছেন’ বলে বিএনপির অভিযোগ। অবশ্য পুলিশের দাবি, মোহাম্মদপুরে বাসে আগুন দেওয়ার পর স্থানীয়দের ধাওয়ায় নির্মাণাধীন এক ভবনের ছাদে গিয়ে উঠেছিলেন রশিদ। সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যান তিনি।

অবস্থা যখন এই রকম, তখন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য নেতারা আত্মগোপনে। নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয় কার্যত পুলিশের অবরোধের মধ্যে রয়েছে। ২৯ অক্টোবর হরতাল চলাকালে বিএনপির ফেইসবুক পাতায় দেখা গেছে লাঠিতে ভর দিয়ে ঢাকার উপকণ্ঠ নারায়ণগঞ্জে গুটিকয়েক মানুষের একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। হরতালে মাঠে না থাকলেও দিনশেষে বিএনপি তিন দিনের অবরোধ ডেকে বসেছে।

তর্কের খাতিরে ধরা যাক, হরতাল-অবরোধের মতো ভোঁতা কর্মসূচি ডেকে বিএনপি নিজেদের অজনপ্রিয় করে তুলছে এবং এতে আপাত বিজয় হয়েছে আওয়ামী লীগের। কিন্তু হরতাল-অবরোধ যত ভোঁতা অস্ত্রই হোক না, ভোঁতা অস্ত্রে পা কাটলে ধনুষ্টঙ্কার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

কী এমন সমস্যা হতো ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশটি নির্বিঘ্নে করতে দিলে? শান্তি সমাবেশে যোগ দেওয়াার জন্য আওয়ামী লীগের লোকজন কাকরাইলের রাস্তাটি পরিহার করলে কি সহিষ্ণুতার পরিচয় দেওয়া হতো না? ২৮ অক্টোবর সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বিএনপি মহাসমাবেশ আহবান করেছিল রাজধানীর নয়াপল্টনে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও একইদিনে একই সময়ে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ ডাকে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে। এই দুটি স্থানের মধ্যে দূরত্ব মাত্র দেড় কিলোমিটার। যাবার পথও প্রায় অভিন্ন।

নয়াপল্টনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের কথা থাকলেও বেলা ১১টার পর উত্তেজনা ছড়ায় কাকরাইল মসজিদের সামনে। বিএনপিপন্থীরা বলতে চেয়েছেন, কাকরাইলে আওয়ামী লীগের উপর হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে বিএনপিতে ‘ঘাপটি মারা সরকারি এজেন্টরা’। ওই পথে বায়তুল মোকাররমের সমাবেশমুখী আওয়ামী লীগের কর্মীদের বহনকারী একটি বাসে ইটপাটকেল ছোঁড়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা। লাঠিসোঁটা নিয়েও তেড়ে যেতে দেখা যায় অনেককে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে যায়; যা পরে ওই এলাকায় একের পর এক সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়। এরপর দুপুর ১টার দিকে সংঘর্ষ কাকরাইল থেকে বিএনপির সমাবেশের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। একজন পুলিশকে পিটিয়ে মারা হয়। মারা যান এক যুবদলকর্মীও। সমাবেশ পণ্ড হয়। ডাকা হয় হরতাল। হরতাল শেষে দেশ এখন অবরোধের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

জনমনে রীতিমতো আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, আবার না এখানে-ওখানে বোমাবাজি শুরু হয়, বাসে-ট্রেনে আগুন দেওয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটে। আন্দোলনের চিরাচরিত ওই ধারা থেকে বিএনপিকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানুষ মেরে, পুলিশ মেরে, রেললাইন উপড়ে, গাছ কেটে সারা দেশে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট যে তাণ্ডবের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে লক্ষ্য রাখতে হবে সেদিকটিতেও।

ধরা যাক, অবরোধ কর্মসূচিটি শান্তিপূর্ণ হলো। যদিও সেই আশার গুঁড়ে বালি ছিটানো হবে বলেই অনুমান করা যায় এবং বিএনপি চেষ্টা করবে সরকার পতনের আন্দোলন আরও জোরদার করার। জয়-পরাজয়ের রাজনৈতিক খেলায় সহিংসতার মধ্যে পড়বে দেশ। নির্বাচনের আগ-পর্যন্ত এই রকম হরতাল-অবরোধ চলতে থাকলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে? আর কিছু না হোক, বন্দর সচল রাখা তো কঠিন হবে। গার্মেন্টস কারখানাগুলো যদি আধা অচল থাকে, তাহলে কেমন হবে? দ্রব্যমূল্য কোথায় গিয়ে ঠেকবে? রিজার্ভ আর কত তলানিতে নামবে?

জোর করে জয়ী হওয়া সবসময় সুখকর হয় না।