বাংলা ভাষায় লেখা, বাংলায় ওয়েব অ্যাড্রেস তৈরিসহ সবদিকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু পিছিয়ে আছে ভাষার নিজের ডিজিটালাইজেশনে।
Published : 18 Feb 2023, 05:44 PM
আজকাল বহুল চর্চা হচ্ছে ‘ডিজিটালাইজেশন’ শব্দের। ট্রেনের টিকেট থেকে শুরু করে জমির খাজনা সবকিছুই প্রযুক্তির পরশ পাথরের স্পর্শে উজ্জ্বল। কয়েক যুগ আগেও কম্পিউটারে বাংলা লেখা বা দেখা কমবেশি কষ্টসাধ্য ছিল; আর তার আগের দশকগুলোতে ছিল অপার বিস্ময়ের। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে পাল্টেছে সাইবার স্পেসে বাংলা আর বাংলাদেশের অবস্থান। পুরনো মডেলের বোতাম চাপা মুঠোফোন থেকে হালের অত্যাধুনিক স্মার্ট ফোন– সবখানেই বাংলার জয়-জয়কার। ২০১৮ সালের নেওয়া ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবার যে লক্ষ্য ছিল সেটিকে পার করে আজ বাংলাদেশ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। হয়তো ২০৪১-এর আগে বা পরে বাংলাদেশ সেই লক্ষ্য অর্জন করবেও।
ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে ভাষার ব্যবহারেও কম-বেশি ডিজিটালাইজেশন ঘটেছে। বাংলা শব্দভাণ্ডারে জায়গা করে নিয়েছে মোবাইল, কানেকটিভিটি, অনলাইন, মাদারবোর্ড, মাউস, ইন্টারনেট, নেটওয়ার্ক, ই-মেইল ইত্যাদি শব্দসমূহ। এসব শব্দের অনেকগুলো সরকারের ভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাবাকো) মাধ্যমে স্বীকৃতিও পেয়েছে। অনেক ভাষাবিদ আপত্তি জানালেও, স্বীকার করেন যে, কালের পরিক্রমায় প্রয়োজন আছে বিদেশি শব্দের আত্তীকরণের। মোটা-দাগে বললে, দেশ ডিজিটাল হবার সাথে সাথে শব্দভাণ্ডারও বড় হচ্ছে। কিন্তু বাংলার ডিজিটালাইজেশন কি শুধুই নতুন শব্দের আত্তীকরণে সীমাবদ্ধ? ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ কি আদৌ ডিজিটাল হচ্ছে? যেকোনো ভাষার ডিজিটালাইজেশনের জন্য প্রথম শর্ত কম্পিউটারের সাথে সেই ভাষাকে যুক্ত করা। ভাষার সংযুক্তির ক্ষেত্রে মূলত তিনটি বিষয় রয়েছে: ভাষাকে কম্পিউটারে প্রবেশ করানো, প্রবেশ করিয়ে দেওয়া ভাষাকে কম্পিউটারের নিজের ভাষায় (যা মূলত বাইনারি সংখ্যা “০” আর “১” এর খেলা) রূপান্তর, আর সেই কম্পিউটারের সাহায্যে ডিজিটালি ব্যবহার করা।
বাংলা কম্পিউটিংয়ের ইতিহাস প্রায় অর্ধ শতকের। কম্পিউটারের স্থানীয়করণ বা লোকালাইজেশনের মাধ্যমে ৮০-এর দশকে শুরু হয় বাংলা কম্পিউটিং। পরবর্তীকালে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আর বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে প্রথাগত অ্যাসকি (ASCII) কোড প্রযুক্তি (কম্পিউটারের এক ধরনের ভাষারূপ) ঘুরে বাংলা কম্পিউটিং এখন অত্যাধুনিক ইউনিকোড (UNICODE)-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে কম্পিউটারে উপাত্ত দেওয়ার প্রধান মাধ্যম কিবোর্ডের ক্ষেত্রে বাংলা কম্পিউটিংয়ের ইতিহাস আরও অনেকে সমৃদ্ধ। আগের দিনের বাংলা টাইপরাইটার ‘মুনির অপটিমা’-এর নকশা থেকে শুরু করে হালের ফোনেটিক কিবোর্ড পর্যন্ত আসতে তৈরি হচ্ছে অনেকগুলো কিবোর্ড লেআউট বা নকশা। এর মধ্যে শহীদ-লিপি, মাইনুলিপি, বিজয়, অভ্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সরকারিভাবে প্রমিত কিবোর্ড লেআউট তৈরির লক্ষ্যে সংযুক্ত হয় ‘জাতীয় কিবোর্ড’। এসব কিবোর্ড (বা লেআউট) নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকেলেও উন্নয়ন ও প্রয়োগের পরিমাণ কম না। মোবাইল ডিভাইস ও অফিস-আদালতের কম্পিউটার মিলে এখন দেশে কয়েক কোটি কিবোর্ড আছে বলে ধারণা করা হয়।
হতাশার জায়গা হচ্ছে, প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলো যেখানে কিবোর্ডকে পেছনে ফেলে শব্দ আর ছবিকে (ভয়েস ও অপটিক্যাল) ইনপুট নিয়ে কাজ করছে; আমরা আজও কিবোর্ডের তর্কে নিজেদের আটকে রেখেছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গুগোল লেন্সসহ বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভাষা অনুবাদের ক্ষেত্রে এখনও পিছিয়ে আছি আমরা। এখন পর্যন্ত স্বীকৃত কোনো সফটওয়ার (অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিডার) তৈরি হয়নি, যা দিয়ে হাজার বাংলা লেখা পৃষ্ঠা দ্রুত ও নির্ভুলভাবে কম্পিউটারে নেওয়া যায়।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সরকারি অফিসসমূহে শতাব্দী পুরনো অনেক নথিপত্র আছে। পুরাতন হয়ে যাবার কারণে এসব নথিপত্রের লেখা অনেক ক্ষেত্রেই ঝাপসা হয়ে এসেছে, আবার কাগজও অনেক ক্ষেত্রে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। এসব কাগজপত্র নাড়াচাড়া করা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। সেই ধারণা থেকে পুরাতন অনেক নথিকে স্ক্যান করে ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু এটাকে ডিজিটাল বললে আসলে বেশি বলা হবে। কারণ স্ক্যান করে কম্পিউটারে নেওয়া ওই ফাইল থেকে এখনও তেমন কোনো রিপোর্ট বা প্রতিবেদন তৈরি করা যাবে না। তবে স্বীকার করতে হয়, কিছু কিছু দপ্তর-সংস্থা কিছু কিছু উন্নতি করেছে।
তবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ধ্বজাধারী সংস্থা ‘বাংলা একাডেমি’ বোধ করি বাংলা ভাষার ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে সবথেকে পিছিয়ে আছে। এখন পর্যন্ত বাংলা কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির নেতৃস্থানীয় ভূমিকা চোখে পড়েনি। বিশেষ করে জাতীয় কিবোর্ড প্রণয়নের সময় নিশ্চুপ ছিল একাডেমি, যেখানে যেকোনো ভাষার কিবোর্ডের লে-আউট তৈরির ক্ষেত্রে ওই ভাষার বর্ণমালার গঠন, বর্ণসমূহের পারস্পরিক অবস্থানের পরিসংখ্যান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলা একাডেমির অন্যতম দৃশ্যমান কাজ হচ্ছে বিভিন্ন পদক প্রদান ও বইমেলার আয়োজন। বাংলা একাডেমির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞ হচ্ছে প্রকাশনা কার্যক্রম। প্রতি বছর বেশ কিছু নতুন বই ছাড়াও পুরানো প্রকাশনার পুনর্মুদ্রণ করে তারা। অন্যদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশে যখন ই-বুক দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে, তখনও বাংলা একাডেমি ওই পথে হাঁটেনি। এমনকি প্রমিত বাংলা প্রচলনের অন্যতম পূর্বশর্ত অভিধানগুলোকেও ডিজিটাল করেনি বাংলা একাডেমি। ডিজিটালাইজেশনের জন্য সরকার যেখানে বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থাকে দিয়ে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরির চেষ্টা করছে, সেখানে বাংলা একাডেমি রিক্ত হস্তে দাঁড়িয়ে আছে।
মোটাদাগে বললে, বেশকিছু বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া বাংলা ভাষার ডিজিটালাইজেশনে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। জাপান বা চীনের মতো দেশগুলো নিজেদের ভাষায় তাদের সকল সেবাই ডিজিটাল মাধ্যমে জনগণকে দিচ্ছে। একইরকম অনুশীলন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে ওই দেশগুলো ডিজিটালি নিজ নিজ ভাষার তথ্য, উপাত্ত ও উপকরণকে সহজলভ্য করেছে। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল পাঠ্যপুস্তকের ডিজিটাল প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেছে তারা।
কষ্টার্জিত স্বাধীনতা আর ভাষা আন্দোলনের গৌরবকে সঙ্গী করে তরুণ তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা সাইবার স্পেসে বাংলা ও বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলা ভাষায় লেখা, বাংলায় ওয়েব অ্যাড্রেস তৈরিসহ সবদিকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু পিছিয়ে আছে ভাষার নিজের ডিজিটালাইজেশনে। বাংলা ভাষার ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিতে বাংলা একাডেমি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটসহ অন্যান্য দপ্তর এবং সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।