শিক্ষায়-চাকরিতে প্রবেশগম্যতার অভাবে পিছিয়ে থাকা প্রায় আড়াই কোটি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিয়ে কোটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে করে শুধু যে প্রতিবন্ধী মানুষ বৈষম্যের শিকার হবে তা নয়, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
Published : 01 Aug 2024, 07:20 PM
এদেশে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম অংশগ্রহণে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী আমরা প্রতিবন্ধী মানুষ। সরকারি চাকরিতে বিপুল এ জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা বরাদ্দ হয়েছে তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিয়ে ১ শতাংশ। পরিসংখ্যান, আর্থসামাজিক অবস্থান বিশ্লেষণ না করে এই সংরক্ষণ আমাদের কাছে কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যন্ত্রণার জায়গাটা হলো কোটা সংস্কার বিষয়ক রায় প্রদানের পূর্বে সংশ্লিষ্ট অংশীজন হিসেবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি, নারী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিদের ডাকা হলেও প্রতিবন্ধী মানুষের খাতে কর্মরত প্রতিনিধিদের ডাকা হয়নি।
প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে নেতিবাচক ও দান-দাক্ষিণ্যের দৃষ্টিভঙ্গী আবারও সামনে চলে এলো এতে করে। আমাদের গণনায় ধরবে কবে এদেশ!
প্রথমত শিক্ষায় চাকরিতে প্রবেশগম্যতার অভাবে পিছিয়ে থাকা প্রায় আড়াই কোটি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিয়ে কোটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে করে শুধু যে প্রতিবন্ধী মানুষ বৈষম্যের শিকার হবে তা নয়, তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দ্বিতীয়ত ২৩ জুলাই, ২০২৪ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপনটিতে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’-এর পরিবর্তে শুধু ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী’ উল্লেখ করায় সরকারেরই স্বাক্ষরকৃত আন্তর্জাতিক সনদ সিআরপিডি এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-এর সরাসরি লঙ্ঘন হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। অতীতে মাঠপর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি শুধু ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী’ উল্লেখ করায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তিতে কী নিদারুণ বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ অন্যদের। ইতোমধ্যে আমাদের অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, কেউ এই প্রজ্ঞাপন দেখিয়ে শারীরিক বাদে অন্যান্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাদ করে দিতে পারবেন। কারণ এই কোটা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। প্রতিবন্ধিতার মধ্যকার আন্তঃবৈষম্য আগেও ছিল। এই প্রজ্ঞাপন থেকে এটি আরও তীব্রতর হবে। সমাজ কাঠামো তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতার অভাবই এর মূল কারণ বলে মনে করি।
প্রসঙ্গত, গত ১১ জুলাই ২০২৩-এ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে শ্রুতিলেখক নীতিমালা প্রণয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উদ্বেগ ও পরামর্শকে আমলে না নেওয়ায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে আন্তঃবৈষম্য বৃদ্ধির প্রবণতা বাস্তবে দেখা গিয়েছে।
প্রেক্ষাপট
একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকের মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষায় আইন যুগোপযোগী আধুনিকায়ন ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। নাগরিকদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চলাফেরা, নিরাপত্তা ও যোগাযোগ সহজ করা এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এদেশের প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এ অধিকারসমূহ আদৌ কি বাস্তবায়ন হয়েছে? মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা ভিন্ন চিত্র দেখায়। তাই প্রশ্ন আসে প্রতিবন্ধী মানুষের খাত কেন এতটা বৈষম্যপীড়িত এবং এ নিয়ে পর্যাপ্ত অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের দায়িত্ব কার ওপর বর্তায়? এই দায়িত্ব যাদের তারা কী করছেন?
সরকারি-বেসরকারি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হওয়ার পরেও প্রতিবন্ধী মানুষ সম্পর্কে রাষ্ট্র তথা সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিবেশগত বাধার ফলে শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সম্পত্তি, পরিবার গঠন, সরকারের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিবন্ধন কার্যক্রম প্রক্রিয়াসহ নানা বিষয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছি আমরা। বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সভা, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদানসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সমস্যাসমূহ তুলে ধরা হচ্ছে। তবুও আমাদের জীবনমান উন্নয়ন হচ্ছে না।
পরিসংখ্যান বিভ্রাট
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তথ্য ও পরিসংখ্যানের বিভ্রাট যেন আরেক রূঢ় বাস্তবতা। ২০১১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের হার ১৫ শতাংশ উল্লেখ করলেও ২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই হার ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন। যদিও সমাজসেবা অধিদফতর পরিচালিত প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ ২০১৩ সালে শুরু হয়ে বিগত এক দশকে চলমান এই কর্মসূচিতে পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে ২ শতাংশের আশেপাশে অর্থাৎ মাত্র ৩৩ লাখের কিছু বেশি।
অথচ বিবিএস পরিচালিত খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০ মতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ৯.০৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি। এছাড়া অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত তার ‘বড় পর্দায় সমাজ অর্থনীতি রাষ্ট্র’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এদেশে এক কোটি ৮০ লাখ মানুষই (অর্থাৎ জনসংখ্যার ১০ দশমিক ছয় শতাংশ) প্রতিবন্ধী মানুষ। বর্তমান প্রতিবন্ধিতার হার যদি হ্রাস না পায়, সেক্ষেত্রে ২০৩০ সালের শেষ নাগাদ এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে আনুমানিক চার কোটি ৫০ লাখে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ (এনএসপিডি)-২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ৪৬ লাখ। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ২.৮ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।
আগে যেমন পরিবার প্রতিবন্ধী মানুষদের লুকিয়ে রাখত, তেমনি মনে হয় রাষ্ট্রও এই লুকিয়ে রাখার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রতি বছর সরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত নারীদের তথ্য প্রকাশ করছে সরকার। কিন্তু কতজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিয়োগ পেয়েছে তার কোনো তথ্য আমরা পাই না। ঋণ প্রদান, দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের হার ইত্যাদি তথ্য প্রাপ্তি একটি বিরাট প্রশ্ন আমাদের কাছে।
ভাতা বৈষম্য
সবক্ষেত্রে বৈষম্য এবং অবহেলিত হয়ে অধিকাংশ দারিদ্র্যপীড়িত তৃণমূলের প্রতিবন্ধী মানুষেরা প্রতিবন্ধী ভাতা ৫০০০ টাকায় উন্নীত করার দাবি জানানো শুরু করে ২০২২ সাল থেকে। বলা বাহুল্য, এই দাবিতে কেউ কর্ণপাত করেনি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাতা ২০০৫ সালে ২০০ টাকা থেকে শুরু হলেও গত ১৮ বছরে ভাতা প্রতি বছর গড়ে ৩৬ টাকা বেড়ে ৮৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ৫০০০ টাকায় পৌঁছুতে আমাদের লাগবে আরও ১১৫ বছর। অথচ বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একজন মানুষের পক্ষে এমনকি ৫০০০ টাকায়ও ন্যূনতম মানবিক জীবনধারণ করা মুশকিল। অন্যদিকে ২০২১ সালে গৃহীত ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র বাস্তবায়নে দ্বিতীয় কর্মপরিকল্পনা মতে ২০২১-২৫-এর মধ্যেও এই ভাতা মাসিক ৩০০০ (তিন হাজার) টাকায় উত্তীর্ণ করার অঙ্গীকার ছিলে। কিন্তু হাজারও অঙ্গীকারের মতোই লাল ফিতায় বন্দী এই অঙ্গীকারনামাটিও।
শিক্ষা ও যাতায়াত সংকট
শারীরিক ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষেরা সমাজের বিরুদ্ধ স্রোতে দাঁড়িয়ে শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংগ্রাম নানাভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মানুষ, অটিস্টিক প্রতিবন্ধী মানুষ, ডাউন সিন্ড্রোম প্রতিবন্ধী মানুষ, মস্তিষ্ক পক্ষাঘাত প্রতিবন্ধী মানুষ, গুরুতর মাস্কুলার ডিস্ট্রফি প্রতিবন্ধী মানুষ, শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষসহ শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের বিচ্ছিন্নতা এত বেশি যে, কর্ম দূরে থাক শিক্ষা গ্রহণের কার্যক্রমগুলো চাহিদার ভিন্নতা বিবেচনায়ও নেওয়া হয় না।
উদাহরণস্বরূপ বিপুলসংখ্যক শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা কেবল ৭টি বিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ। সাধারণ বিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলা ইশারা ভাষার ব্যবস্থাপনাসহ সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার দাবি জানিয়ে আসছে তারা দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু উদ্যোগের অভাবে লাখ লাখ শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শিক্ষার অধিকার থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। এমনকি বাংলা ইশারা ভাষার দোভাষী প্রশিক্ষণে রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগ তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন সরকারি পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না তারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার অভাবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য ব্রেইল বই সরবরাহ করা হলেও তা ঠিকমতো পৌঁছে না। বাংলাদেশে কোনো প্রমিত ব্রেইল নির্দেশিকা নেই। তারা বিজ্ঞান গণিত পড়তে পারেন না। পর্যাপ্ত শিক্ষা সহায়ক উপকরণ নেই। যেমন স্বল্পদৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র কীভাবে প্রবেশগম্য করা যায় তা কারও বিবেচনা নেই যদিও প্রযুক্তিতে অনেকখানি এগিয়েছে এদেশ।
এখনও বিদ্যালয়সমূহ সার্বজনীন প্রবেশগম্য করে গড়ে তোলা যায়নি। এমনকি শিক্ষক প্রশিক্ষণে বুনিয়াদি কোর্সে প্রতিবন্ধিতাকে আলাদা বিষয় হিসেবে পাঠ করানো হচ্ছে না। সরকারি নির্দেশনা আইন থাকা সত্ত্বেও সাধারণ বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম চালানো এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিরাজ করছে।
যাতায়াতের ক্ষেত্রে দেশে এখনও কোনো প্রবেশগম্য গণপরিবহন নেই। মেট্রোরেল চালু হলেও সেখানে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ফ্রি পাসের ব্যবস্থা নেই। এমনকি সড়ক পরিবহনে শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়া (হাফ টিকেট) পেলেও প্রতিবন্ধী মানুষেরা এই সুবিধার আওতায় নেই। আইনে গণপরিবহনে সংরক্ষিত আসনের কথা থাকলেও বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই।
স্বনির্ভরতা বা অর্থনৈতিক মুক্তি
শিক্ষার সঙ্গে কর্মের একটি ওতপ্রোত সর্ম্পক রয়েছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যেন পাহাড় সমান বাধা বিরাজমান। রাষ্ট্র তথা সমাজ কেউই প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য আর্থিক, নীতিগত বা পরিবেশগত ইতিবাচক অবস্থা গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় সাধারণ নাগরিকের জন্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সংক্রান্ত গৃহীত ব্যাংক ও অন্যান্য প্রকল্পসমূহতে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ ব্যবস্থার উল্লেখ নেই। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পূর্ণ কল্যাণভিত্তিক। ফলে এই মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাবলম্বীতার জন্য কার্যক্রম দেখা যায় না। এই মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত ২০ হাজার টাকা সুদ মুক্ত ঋণের কার্যক্রমটির সুবিধাভোগী মূলত দুস্থ, এতিম, দরিদ্র বিধবারাই পায়।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বৃদ্ধি পেলেও তার আনুপাতিক হার আশানুরূপ হয়নি। ৯০ দশকের শুরুতেই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে ১০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ হলেও তা ভাগ হয়ে যায় এতিমদের সঙ্গে। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি যে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে ১০% কোটা থাকা সত্ত্বেও ১-৬০/৭০ জন নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থীকে বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাহলে ভাগাভাগির এই ১% কোটার বেলায় কতজন নিয়োগ পাবে এও এক বিরাট প্রশ্ন! গত ৩৫ বছরে বরাবরই এই কোটায় এতিমদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে আজও অনগ্রসর গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের মুখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগে সকল কোটার সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য নামমাত্র ১ শতাংশ শূন্য কোটারও বিলোপ ঘটে। এবার যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলো যৌক্তিকভাবেই আমরা ভেবেছিলাম প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠনের প্রতিনিধিরা ডাক পাবে। কিন্তু অংশীজনের মতামত না নিয়ে অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে দুটি গোষ্ঠীর মধ্য ১ শতাংশ কোটা ভাগ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দুই গোষ্ঠীকেই আরও বেশি বৈষম্যের দিকে ঠেলে দেওয়া হলো।
এখানে একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, প্রান্তিক ও অনগ্রসর গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষের জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি বৈষম্যপীড়িত। যেখানে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য সুযোগ বেশি থাকা উচিৎ সেখানে তাদেরই সবচেয়ে কম দেওয়া হলো কেন? অন্যদিকে বেসরকারি চাকরিতেও প্রতিবন্ধিতার অজুহাতে বাদ দেওয়া হয়। ফলে বাধ্য হয়েই অনেক উচ্চশিক্ষিত প্রতিবন্ধী মানুষকেও পেটের দায়ে শ্রমিক পেশা বেছে নিতে হয়। এই পেশাটি অসম্মানের নয়। কিন্তু যোগ্যতা অনুযায়ি চাকরি পায় না পেয়ে একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায় সরকারি চাকরি। সেখানেও কেন আমাদের বঞ্চিত করা হবে?
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, এদেশে আমাদের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা সহায়ক উপকরণের অভাব এবং ওই পরিবেশ নেই। যারা অগ্রসর তারা চাকরির পরীক্ষায় প্রস্তুতির জন্য সব ধরনের বই ও তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ বা শিক্ষা গ্রহণের সকল সুযোগ পাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বসতে হয় অসম পরিবেশে বেড়ে ওঠা এবং সকল ক্ষেত্রে সুযোগবঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের। কোটা পদ্ধতি কিন্তু বাস্তবায়ন হয় লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, যতক্ষণ সমতা বা প্রতিবন্ধিতার চাহিদার ভিত্তিতে উপযোগী পরিবেশ তৈরি না হবে তাদের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
আমরা মনে করি, শুধু প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য পৃথক কোটা সংরক্ষণ করে অন্যান্য অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য তাদের চাহিদার ভিত্তিতে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান এবং পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে আলাদা কোটা প্রদান করা দরকার। প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য গ্রেড ৯ থেকে ১৩ (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) এর ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২ শতাংশ কোটা এবং গ্রেড ১৩ থেকে ২০ (তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) এর ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা দরকার। কারণ আমরা দেখতে পাই, ১৩-২০ গ্রেড (তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) পর্যায়েই সবচেয়ে বেশি নিয়োগ প্রদান করা হয়। তৃতীয় লিঙ্গসহ অন্যান্য অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্যেও তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিশ্লেষণপূর্বক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এছাড়াও প্রতিবন্ধিতার ভিত্তিতে আন্তঃবৈষম্যমূলক সমাজের যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী তা পরিবর্তন করতে হলে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষদের চাহিদার ভিত্তিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবন্ধী মানুষদের অনেক বেশি সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও নিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।