মোদী ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ২০১৭ সালে ইসরায়েল ভ্রমণ করেন আর নেতানিয়াহু ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি পরের বছর প্রতিদান হিসেবে ভারত ভ্রমণ করেছেন। অথচ স্বাধীন ভারতের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরু উভয়েই ছিলেন ফিলিস্তিনের অকৃত্রিম বন্ধু এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী।
Published : 25 Feb 2025, 05:14 PM
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার নেতা ইয়াসির আরাফাতের ভাইবোনতুল্য সম্পর্ক থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যকার দোস্তি— ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি আদর্শগত টেকটনিক বদল; যা এক ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদী অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাবের ইঙ্গিত বহন করছে।
১৯৮৩ সালে নয়াদিল্লিতে আয়োজিত তৎকালীন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলন থেকে ফিলিস্তিনি নেতা আরাফাত যখন ক্ষুব্ধ হয়ে বক্তৃতা না করেই ফিরে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিয়েছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা তখন ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে অনুরোধ করেন তাকে ঠেকাতে। ক্যাস্ত্রো খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আরাফাতকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি ইন্দিরার বন্ধু কিনা। উত্তরে আরাফাত বলেন, ‘বন্ধু, বন্ধু! সে আমার বড় বোন। তার জন্য আমি যে কোনো কিছু করব।’ ক্যাস্ত্রো বলেন, ‘তাহলে ছোট ভাইয়ের মতো কাজ করুন, বিকেলের অধিবেশনে থাকুন।’
এভাবেই কাজ হাসিল করেন ক্যাস্ত্রো, বোন ইন্দিরার অনুরোধে সম্মেলনে থেকে যান ভাই আরাফাত। বিংশ শতাব্দী ছিল এমনই সব বিরাটকায় নেতানেত্রীদের কাল। যাদের বিরাট হৃদয়ের ছোট ছোট কাহিনিগুলো গল্পের মতো বইপত্রে ও মুখেমুখে ছড়ানো। এখন বড় বড় দেশের সংকীর্ণমনা নেতাদের বড় বড় কুকাহিনিতে ভরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। এখনকার বড় নেতাদের মধ্যে ট্রাম্প, মোদী ও নেতানিয়াহুর কথা বলতেই হয়। আমাদের শেখ হাসিনাও ওই বড় নেতাদের একজন বলে কথিত ছিলেন কিছুদিন আগপর্যন্ত। এদের কথা ও অঙ্গভঙ্গি শিশুদের শুনতে ও দেখতে না দেয়াই ভালো। কিন্তু না দেয়ার তো উপায় নেই, মোদী যখন নেতানিয়াহুকে ‘বন্ধু’ বলে জড়িয়ে ধরেন তা তো এখন কাগজের পাতার আগেই হাতের মুঠোতে চলে আসে— তাই নিয়ে এ আলোচনা।
গুজরাটে দুই হাজার মানুষ হত্যার দায় আছে মোদীর কাঁধে। আর নেতানিয়াহু তো পঁয়তাল্লিশ হাজার ফিলিস্তিনি হত্যার দায় নিয়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী অভিহিত হয়েছেন। এই দুই বন্ধুই ইতিহাসে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন এভাবে— মোদী ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ২০১৭ সালে ইসরায়েল ভ্রমণ করেন আর নেতানিয়াহু ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি পরের বছর প্রতিদান হিসেবে ভারত ভ্রমণ করেছেন। অথচ স্বাধীন ভারতের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরু উভয়েই ছিলেন ফিলিস্তিনের অকৃত্রিম বন্ধু এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী। ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে তাদের উত্তরসূরিরা সবাই সেই রীতি বজায় রেখেছিলেন।
মহাত্মা গান্ধী ১৯৩৮ সালে দ্য জু’জ শীর্ষক লেখাটিতে ইহুদি প্রশ্নে জোর দিয়ে বলেছেন, “তারা কেন যেসব দেশে তাদের জন্ম ও যেখানে তারা আয়-রোজগার করে সেসব দেশকেই নিজেদের দেশ বলে মনে করতে পারছে না? ফিলিস্তিন তো আরবদের যে অর্থে ইংল্যান্ড ইংরেজদের অথবা ফ্রান্স ফ্রেঞ্চদের। আরবদের ঘাড়ের ওপর ইহুদিদেরকে চাপিয়ে দেয়া তো অন্যায় ও অমানবিক।”
১৯৪৭ সালে ভারত প্রস্তাব দিয়েছিল একটি অখণ্ড ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের যেখানে ইহুদি জনগোষ্ঠীও তাদের নাগরিক সমঅধিকার নিয়ে বসবাস করবে। ওই বছর জাতিসংঘে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ভোট দেয় দেশটি। নিজের উপনিবেশবিরোধী দীর্ঘ সংগ্রামের আদর্শের আলোকে ভারত সহজেই অনুধাবন করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনের ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী দখলদারি চরিত্রটি। ওইসময় ফিলিস্তিনকে সমর্থনের দিক থেকে ভারত প্রথম ছিল নানাভাবে। ১৯৭৪ সালে ভারত প্রথম অনারব দেশ যে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থাকে (পিএলও) ফিলিস্তিন জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আবার প্রথম অনারব দেশ হিসেবে ভারত ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রেরও স্বীকৃতি দেয়। যদিও ১৯৫০ সালে তারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল, তবে দেশটির সঙ্গে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। ১৯৯২-এর আগে তারা দিল্লিতে ইসরায়েলি দূতাবাস স্থাপনের অনুমতি দেয়নি।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ডিগবাজি খায় ভারত। তার আদর্শিক পল্টি চোখে পড়বার মতো। ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠতে থাকে ইসরায়েলের অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র। নিকোলাস ব্ল্যারেল আন্তর্জাতিক ‘টাইম’ সাময়িকীতে (হাউ ইন্ডিয়া বিকেইম প্রো-ইসরায়েল, নভেম্বর ১৭, ২০২৩) লিখেছেন, “ডিগবাজির শুরু হয় ১৯৯৯ সালে যখন ভারত বিতর্কিত কাশ্মীর এলাকা নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আর ইসরায়েল ভারতকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারত ইসরায়েল থেকে প্রতিবছর ২০০ কোটি ডলারের অস্ত্র কিনেছে। এর মধ্যে আছে মিসাইল, ড্রোন, বোমা, সীমান্ত নিরাপত্তার যন্ত্রপাতি। এখন সে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা শিল্পের সবচেয়ে বড় বিদেশি খরিদ্দার।”
শুধু তাই নয়, ভারতও তার তৈরি অস্ত্র গোপনে ইসরায়েলের কাছে বিক্রি করছে যা ব্যবহৃত হচ্ছে ফিলিস্তিনে সংঘটিত গণহত্যায়। লন্ডনের প্লুটো প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত আজাদ এশার সাম্প্রতিক বই ‘হোস্টাইল হোমল্যান্ডস: দ্য নিউ অ্যালায়েন্স বিটুইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইসরায়েল’ ভারত-ইসরায়েল সম্পর্কের এই দীর্ঘমেয়াদী মেরুকরণ বিষয়ে আলোকপাত করেছে। এশা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক ‘মিডল ইস্ট আই’ পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। তিনি এ বইটি ছাড়াও ‘দ্য মোসলেমস আর কামিং’ ও ‘জুমাস বাস্টার্ড’ বইয়ের লেখক।
শত্রুভাবাপন্ন স্বদেশ বা হোস্টাইল হোমল্যান্ডস বইটি ভারত ও ইসরায়েলের আদর্শিক নৈকট্য লাভের নাটকীয় ছবি তুলে ধরেছে। এ দুটি দেশই আপন ভূরাজনৈতিক সীমানায় নিজেদের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। অথচ তারাই আবার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বর্ণবাদী ও জাতিগত নিপীড়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আদর্শিকভাবে তাদের এ কাছাকাছি আসা বর্তমান রাজনৈতিক বিশ্বে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রিয়া অরবিন্দন ওয়াশিংটন রিপোর্ট অন মিডল ইস্ট অ্যাফেয়ার্সে (জুন/জুলাই ২০২৩) এ বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, “এশা গুরুত্বের সঙ্গে দেখিয়েছেন যে ইসরায়েল ও ভারতের আদর্শিক একাত্মতা তাদের রাজনৈতিক সৌহার্দ্যের অনুগামী হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ডানপন্থী হিন্দুদের রাজনৈতিক মতাদর্শের জনক বিনায়ক সাভারকার ১৯২৩ সালে তার হিন্দুত্ববাদের ঘোষণাপত্র লিখেছিলেন, আর সে বছরই জায়নবাদের জনক জেভ জাবোতিনস্কি লেখেন ‘আয়রন ওয়াল’ রচনাটি যেখানে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের সাফাই গাওয়া হয়েছে।”
আজাদ এশাকে উদ্ধৃত করে তিনি আরও লিখেছেন, “২০০৩ থেকে ২০১৩-এর মাঝে ভারত হয়েছে ইসরায়েলি অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা।” প্রিয়া বলেছেন, এশার কথায় এ দুই নেতা “একে অপরের মাঝে খুঁজে পেয়েছেন মনের ঐক্য— এক সংস্কৃতি, এক বর্ণ ও এক জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে তোলার মানসিক শক্তি।”
ভারতের এই আদর্শিক বিচ্যুতি বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করছে ও করবে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী একটি বড় দেশের আদর্শিক সংকট ও অবনতি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর রাজনীতিকেও ঠেলে দিবে ‘এক সংস্কৃতি, এক বর্ণ ও এক জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে তোলার’ লক্ষ্যের দিকে। ফল হিসেবে তৈরি হবে দেশে দেশে সংঘর্ষের পরিস্থিতি, পারস্পরিক অবিশ্বাস, অস্থিতিশীলতা, সীমান্ত সংঘর্ষ এবং এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব। বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধের আদর্শিক নেতা হওয়ার সমস্ত সুযোগ ছুঁড়ে ফেলে ধর্মীয় উগ্রবাদী মোদীর নেতৃত্বে আজকের ভারত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহুর বন্ধু হওয়ার মাঝে এই যে সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে এর ফল হবে অনাকাঙ্ক্ষিত। এমন সংকীর্ণ সার্থকতা অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টাই হবে আগামী দিনের ছোট-বড় অনেক দেশের জাতীয় রাজনৈতিক চরিত্র। বিশ্ব যখন পুড়বে ট্রাম্প আর ইলন মাস্কের বাঁশি বাজতে থাকবে— বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ, সংস্কৃতিবিদ্বেষ, ভাষাবিদ্বেষ ও জাতিবিদ্বেষের ভূতুড়ে সুরে।
মুক্তির একটাই পথ খোলা— দেশে দেশে জনগণের বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের মাঝে ঐক্য। এর নজির আছে— ইসরায়েলে অস্ত্র ও শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করতে ইতালি, কানাডা, ভারত, বেলজিয়াম, স্পেন ও যুক্তরাজ্যের শ্রমিকদের মাঝে সংগঠিত প্রতিরোধে।