মন্দাক্রান্ত অর্থনীতি

অর্থনীতির নিজস্ব কিছু নিয়ম আছে এবং ওইসব নিয়মের ব্যত্যয় হলে গোঁজামিল দিয়ে শেষ রক্ষা হয় না, আখেরে মানুষকেই ভুগতে হয়।

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 13 Jan 2023, 03:26 PM
Updated : 13 Jan 2023, 03:26 PM

এক। মন্দাকালে কী করণীয়?

২০২০-২১ সালে করোনাকাল এবং তারপর ২০২২ সালে ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে সারা পৃথিবীতে বর্তমানে মন্দাকাল চলছে। মন্দাকালের অর্থনীতি কেমন হওয়া উচিত? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের দেখতে হবে, এর আগের মন্দাকালে অর্থনীতিবিদেরা কী কী নিদান দিয়েছিলেন এবং তাতে বিশ্ব, আঞ্চলিক বা দেশীয় অর্থনীতির কী কী উপকার বা অপকার হয়েছিল।

স্মরণকালের বিখ্যাত মন্দাটি হয়েছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তী সময়ে ১৯২৯-১৯৩৯ সালে। ১৯১৮ সালে চার বছর ব্যাপী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর স্বল্পস্থায়ী কয়েকটি মন্দা হয়েছিল, ঠিক যেমন বড়সড় ভূমিকম্পের আগে ছোটখাটো কয়েকটি ভূমিকম্প হয়। আমরা সবাই জানি, যুদ্ধের আগের অর্থনীতি আর পরের অর্থনীতি কখনোই এক থাকে না। যুদ্ধে শিল্পকারখানা ধ্বংস হয়ে যায়, কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। সুতরাং পণ্যের পরিমাণ বা কোয়ানটিটি Q কম থাকে এবং এর ফলে পণ্যের মূল্য বা প্রাইস P বেড়ে যায়। যুদ্ধের পর বেশির ভাগ মানুষ বেকার, তাদের হাতে টাকা থাকে না। আবার যাদের হাতে টাকা থাকে, তারাও সতর্কভাবে খরচ করে, টাকা ধরে রাখে, কারণ তাদের মনে ভয়, কখন না আবার কী হয়! টাকার হাতবদল না হওয়ার ফলে টাকার ভেলোসিটি বা V-ও কম হয়। সব মিলিয়ে যুদ্ধপূর্ব অর্থনীতি আর যুদ্ধপরবর্তী অর্থনীতিতে স্বাভাবিকভাবেই আকাশ-পাতাল তফাৎ থাকে। কিন্তু জগদ্বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন ম্যানার্ড কিনসের (১৮৮৩-১৯৪৬) বুদ্ধিতে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার নীতিনির্ধারকেরা এই বাস্তবতাটা মানতে চাইলেন না। কিংবা তারা হয়তো ভেবেছিলেন, কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

১৯২২ সালের জেনোয়া চুক্তিতে বলা হয়েছিল, পাউন্ড স্ট্যার্লিং এবং মার্কিন ডলারকে স্বর্ণের মতোই রিজার্ভ হিসেবে গণ্য করতে হবে। ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার নীতিনির্ধারকেরা ভেবেছিলেন, এর ফলে একাধিক সুবিধা হবে। প্রথমত, পাউন্ড এবং ডলার উভয়েরই চাহিদা বাড়বে, সুতরাং দামও বাড়বে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু বিদেশি সরকার এবং জনগণ ডলার/পাউন্ড কিনবে নিজেদের প্রয়োজনে, সেহেতু অনেকখানি ডলার নিজে থেকেই দেশের বাইরে চলে যাবে।

এতে করে ডলার-পাউন্ডের পরিমাণ কমবে এবং খেয়ালখুশিমতো ডলার-পাউন্ড ছাপালেও তার প্রভাব নিজেদের অর্থনীতিতে অন্তত পড়বে না। মুদ্রাস্ফীতি যদি থাকেও, সেটা বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয়ে যাবে। পাউন্ড-স্ট্যার্লিং ও মার্কিন ডলারকে রিজার্ভ মুদ্রা করা হয়েছিল মূলত ইংল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতিকে বিদেশে রপ্তানি করার জন্যেই। উপনিবেশক জাতির উদোর পিণ্ডি উপনিবেশিত জাতির বুধোর ঘাড়ে চলে যাবে, বরাবরের মতোই। কাকের বাসায় কোকিলের ডিম। আজ বিশ্বের দেশে দেশে যে মুদ্রাষ্ফীতি, তার জন্য মার্কিন ডলার কিছুটা দায়ী তো বটেই। ওরা ওদিকে নিজেদের প্রয়োজন, সুবিধা কিংবা খেয়ালখুশিমতো ডলার ছাপাবে, ফলে ডলারের দাম কমবে। এদিকে আপনার টাকার দামও কমবে, কারণ আপনার টাকার অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে মার্কিন ডলার। এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর উন্নয়ন যে ত্বরান্বিত হয় না, সেকি এমনি এমনি?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ইংল্যান্ড পাউন্ড-স্ট্যালিং-এর অবমূল্যায়ন করেনি। পাউন্ডকে যুদ্ধপূর্ব যুগের মূল্যমানে স্থির করে রাখা হয়েছিল, কৃত্রিমভাবে, গায়ের জোরে, ফিয়াট মানির ক্ষেত্রে প্রায়ই যা করা হয়। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। যুদ্ধপরবর্তী বাজারে প্রকৃতপক্ষে পাউন্ডের দাম কমে গিয়েছিল। স্বর্ণের যে দাম পাউন্ডে পাওয়া যাচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছিল ডলার, ফ্রাঁ বা মার্কে অর্থাৎ সেই সব দেশে যারা নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছিল। এর ফলে ইংল্যান্ডের স্বর্ণ বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয়ে যাচ্ছিল। ইংল্যান্ডে কম দামে স্বর্ণ কিনে ওই স্বর্ণ আমেরিকা-ফ্রান্স-জার্মানিতে বেশি দামে বিক্রি করতে কোন বোকা না চাইবে?

এর সঙ্গে বাংলাদেশের একটা ঘটনার তুলনা করা যায়। জিয়াউর রহমানের আমলে গৃহনির্মাণ ঋণের সুদের হার সঞ্চয়পত্রের চেয়ে অনেক কম ছিল। লোকজন রাজউক থেকে ঋণ নিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনত। এর ফলে সরকারকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছিল। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন সাইফুর রহমান। কাকতালীয়ভাবে কিনস এবং সাইফুর রহমান দুজনের কারোরই অর্থনীতির ডিগ্রি ছিল না। কিনস ছিলেন অংকবিদ, সাইফুর রহমান ছিলেন হিসাবরক্ষক।

মুনীনাঞ্চ মতিভ্রমঃ! জ্ঞানীদেরও মতিভ্রম হয়! তখনও পর্যন্ত না অর্থনীতিবিদ, না নীতিনির্ধারক, দুই পক্ষের কেউই বুঝতে পারছিল না, বুঝতে চাইছিল না, আসল সমস্যাটা কোথায়। ফ্রান্স, জার্মানি এবং আমেরিকাকে ইংল্যান্ড অনুরোধ করল, বেশি করে টাকা ছাপিয়ে নিজেদের মুদ্রার দামও কমিয়ে ফেলতে, যাতে করে ইংল্যান্ড থেকে স্বর্ণপাচার বন্ধ হয়। ফ্রান্স আর জার্মানি এই অনুরোধে কান দেয়নি, কিন্তু আমেরিকা বিশের দশকে ব্রিটিশ বুদ্ধিতে একটানা ডলার ছাপিয়ে গেছে। এর ফলে ব্রিটেন থেকে আমেরিকায় স্বর্ণপাচার বন্ধ হয়েছিল বটে, কিন্তু বিপুল ক্ষতি হয়েছিল আমেরিকার। ১৯২৮ সালে বাড়ি এবং শেয়ারের মূল্য মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছিল এবং ১৯২৯ সালে শুরু হয়েছিল স্মরণকালের ভয়াবহতম মন্দা এবং এই মন্দার ফলশ্রুতি হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

জার্মানির পক্ষে ইংল্যান্ডের মামার বাড়ির আবদারে কান দেওয়া সম্ভবও ছিল না। ১৯১৯ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ভার্সাই চুক্তি। ওই চুক্তিতে জার্মানির ওপর ক্ষতিপূরণের এক পাহাড় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধপরবর্তী অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং চরম মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে জার্মানিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের তথাকথিত ‘বেয়াদবী’-র ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছিল স্বর্ণমুদ্রায়, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ বিজয়ী দেশগুলোকে, ত্রিশের দশকের চরম মন্দার মধ্যে। কিনস অবশ্য জার্মান জনগণকে এতটা শাস্তি দিতে রাজী ছিলেন না, কিন্তু তার কথায় কান দেয়নি কোনো সরকার।

কিছু দিন পর বাধ্য হয়ে জার্মানিও মার্ক ছাপাচ্ছিল দেদার, খরচ চালাবার জন্যেই অবশ্য, কিন্তু এর ফলে জার্মানিতেও শুরু হয়ে যায় মুদ্রাস্ফীতি। অচিরেই জার্মান জনগণের অর্থনৈতিক দুরবস্থা চরমে পৌঁছেছিল, যার বর্ণনা আপনারা হিটলারের জ্বালাময়ী বক্তৃতাগুলোতে পাবেন। এই দুরবস্থার পটভূমিতে জার্মান জনগণের অসন্তুষ্টিকে পুঁজি করে উদ্ভব হয়েছিল হিটলারের নাৎসী দলের। এর পরবর্তী অধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ– মানব ও অন্যান্য সম্পদের নিরিখে যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কারও অজানা নয়।

কিনস নিদান দিয়েছেন, মন্দা যখন শুরু হয়, তখন অবকাঠামো নির্মাণে সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে দিলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসে। এই নীতি অদ্যাবধি দেশে দেশে অনুসরণ করা হয়। মার্কিন সরকার এই নিদান অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছিল, কিন্তু কাজ হয়নি, দুটি কারণে। প্রথমত, মন্দায় মানুষ বেকার হয়ে যায়, জানা কথা। যেহেতু শ্রমিকের সরবরাহ বেশি, সেহেতু মজুরিও কমার কথা। টাকার দাম যেহেতু কমে গেছে, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবার কথা।

অর্থনীতির চাহিদা ও সরবরাহের অমোঘ নিয়ম মার্কিন সরকার মানতে চাইল না। তারা মজুরি বাড়িয়ে রাখল এবং একবারও ভাবল না, মিল কারখানার মালিকদের অত মজুরি দেবার ক্ষমতা আদৌ আছে কিনা। মালিকেরা খরচ চালাতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো। আরও মানুষ বেকার হয়ে পড়ল। অথচ শ্রমিকেরা কম মজুরিতেও কাজ করতে রাজি ছিল, কারণ একেবারে বেকার হওয়ার চেয়ে কম মজুরি মন্দের ভালো। মজুরি নির্ধারণের ব্যাপারটা বাজারের ওপর ছেড়ে দিলেই ভালো হতো।

দ্বিতীয় যে বোকামোটি করেছিল সেবার ব্রিটিশ ও মার্কিন সরকার, সেটি হচ্ছে, তারা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিল। যে কোনো সরকার এটা করার চেষ্টা করে। প্রতি রোজার ঈদের অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশ সরকার পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে না কি? চাহিদা ও সরবরাহের নিয়মে যে পেঁয়াজের দাম হওয়া উচিত ৪০ টাকা, বাজারের নিয়মের তোয়াক্কা না করে সরকার ওই পেঁয়াজের মনগড়া দাম ধরে দেয়, ধরা যাক, ২০ টাকা। ব্যবসায়ীরা কি লোকসান দিয়ে পেঁয়াজ বিক্রি করবে? গুদামজাত হয়ে বা পাচার হয়ে সরবরাহ কমে গিয়ে পেঁয়াজের দাম আরও বেড়ে যায়। সরকার লোকসান দিয়ে বাজারে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করে, পেঁয়াজের দাম কমিয়ে জনগণকে খুশি রাখতে। কিন্তু লোকসানটা সরকার দিচ্ছে কোন বাপের পকেট থেকে, সেই জনগণেরই তো, নাকি?

ত্রিশের দশকের মন্দার সময় ভালো ফসল হয়ে কোনো কোনো কৃষিপণ্যের দাম যখন পড়তে শুরু করেছিল, সেই পণ্য ক্ষেতেই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল কিংবা ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাগরে। কারণ পণ্যের সরবরাহ বা কোয়ানটিটি Q বাড়লে পণ্যের দাম বা প্রাইস P অতিরিক্ত পড়ে যাবে। এর ফলে মালিকদের ক্ষতি হবে এবং তাদের কোম্পানির শেয়ারের দামও পড়ে যাবে। সুতরাং যে খাদ্যের অভাবে একদিকে মানুষ কষ্ট পাচ্ছিল, অন্যদিকে ওই খাদ্যই নষ্ট করা হচ্ছিল। চিন্তা করতে সক্ষম, এমন যে কেউ স্বীকার করবেন, এমন অমানবিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কোনো সমাধান হতে পারে না। কিন্তু এই ব্যবস্থাই চলছে, চালানো হচ্ছে, পাখিপড়ার মতো পড়ানো হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে।

কিনসীয় অর্থনীতিবিদেরা বলে থাকেন, অর্থনীতির টেক্সটবইগুলোতেও এই মিথ্যা কথা লেখা থাকে যে, স্বর্ণমুদ্রামান কিংবা ১০০% ভাগ ফিয়াট মানির অনুপস্থিতিই ত্রিশের মন্দার মূল কারণ। অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি স্বর্ণ মজুত রাখা বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল। (অনেকটা কুবলাই খানের মতো), মার্কিন সরকার নাগরিকদের বাধ্য করল প্রত্যেকের ব্যক্তিগত স্বর্ণ সরকারের কাছে বিক্রি করে দিতে।

স্বর্ণের মূল্য স্থির হলো প্রতি আউন্স ২০.৬৭ ডলার। জনগণের কাছ থেকে প্রায় সব স্বর্ণ কেড়ে নেবার পর সরকার ডলারের দাম প্রায় ৪১% কমিয়ে দিল। প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম বেড়ে হলো ৩৫ ডলার। সব লেনদেন তখন থেকে ডলারেই করতে বাধ্য হচ্ছে সবাই। মার্কিন সরকারের হাতে যথেচ্ছ টাকা ছাপানোর স্বাধীনতা এসে গিয়েছিল, যার বদৌলতে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিতে পেরেছিল।

অর্থনীতি কী অবস্থায় আছে, সেটা জানার জন্যে, কিনসের মতে, গবেষককে দেখাতে হবে, সমাজে খরচ কী পরিমাণ হচ্ছে। সমাজে খরচ যদি বাড়ে, তবে উৎপাদনও বাড়বে, উৎপাদন বাড়লে সমাজে পূর্ণ কর্মসংস্থানের ভারসাম্য চলে আসবে। সমাজে পণ্যের চাহিদা যদি অনেক বেশি বেড়ে যায়, সরবরাহ যদি ওই পরিমাণে না বাড়ে, তবে পণ্যের দাম বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি হবে। আবার সমাজ যদি খরচ কম করে, তবে উৎপাদকেরা বিক্রি করতে না পেরে বাধ্য হয়ে তাদের উৎপাদন কমিয়ে দেবে। এর ফলে কর্মসংস্থান কমে যাবে, কর্মসংস্থান কমে গেলে পণ্যের চাহিদা আরও কমে যাবে এবং মন্দা শুরু হবে।

কিনসের মতে, ‘মন্দা’ ব্যাপারটা মূলত সমাজের ‘ব্যয়সংকোচ’ নামক পাপের প্রায়শ্চিত্ব। কিন্তু কিনস কখনও ভেবে দেখেননি যে মানুষ কেন হঠাৎ করে কম খরচ করতে শুরু করে। এই প্রশ্ন যখনই উঠেছে, কিনস উত্তর দিয়েছেন, মানুষ হচ্ছে মূলত একটি ‘পশু’ এবং কম খরচ করাও একটা পাশবিক প্রবৃত্তি, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। কিনসের মতে, যখনই কোনো বাজারে মন্দাভাব দেখা দেবে, জানবে, এর মূলে আছে, কম খরচ করে অর্থ সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি। অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদেরা বলেন, কিনস রোগের প্রকৃত কারণ জানেন না, কিন্তু হাঁতুড়ে ডাক্তারের মতো রোগের চিকিৎসা করার চেষ্টা করেন।

মানুষকে তো আর জোর করে খরচ করানো যাবে না, সুতরাং শুরুতে সরকারকেই খরচে নামতে হবে। ‘লাগে টাকা দিবে গৌরী সেন!’ সরকারের ভাণ্ডার তো সব সময়ই ঢুঁঢুঁ, সে যে দেশের সরকারই হোক না কেন। সুতরাং টাকা ছাপিয়ে নেয়া ছাড়া হাতে টাকা পাবার দ্বিতীয় কোনো উপায় কোনো সরকারের জানা নেই। জনগণকে খরচের প্রণোদনা দিতে করের পরিমাণ কমাতে হয়। ঋণের সুদও কমাতে হয়, যাতে জনগণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দরকারি-বেদরকারি জিনিসপত্র কিনতে থাকে।

তবে কিনস মনে করেন, মন্দা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কর এবং সুদের হার কমানো সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি এবং টাকা ছাপানোর মতো কার্যকর পদ্ধতি নয়। ট্যাক্স কম দিতে হলে মানুষ যে বেঁচে যাওয়া টাকা ভোগে ব্যয় করবেই করবে, তার নিশ্চয়তা কী? ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যে (বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী যেমন করে থাকেন) তারা লোকদেখানো ব্যবসা করে, বেশিরভাগ টাকা দিয়ে ভিতরে ভিতরে কোথাও জমি কেনার মতো অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করবে না, তাই বা কে বলতে পারে। হতে পারে, তারা ঋণ নিয়ে সঞ্চয় করবে, দেশে কিংবা বিদেশে। ঋণের টাকা দিয়ে বউয়ের জন্যে অলঙ্কারও যে কিনবে না, চুরি বা ঋণের টাকার বোঁচকা হাতে দিয়ে বউকে যে কানাডার বেগমপাড়ায় পাঠাবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী?

লুদভিগ ফন মিজ (১৮৮১-১৯৭৩) ফ্রিডরিখ হায়েক (১৮৯৯-১৯৯২) প্রমুখ অস্ট্রীয় স্কুলের অর্থনীতিবিদেরা দাবি করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ত্রিশের মন্দা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ... এই সবের পিছনে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে স্বর্ণমুদ্রামান বাতিল করে তার পরিবর্তে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ফিয়াট মানি মুদ্রণ করা। স্বর্ণমুদ্রামান বজায় থাকা কিংবা ফিয়াট মানির অনুপস্থিতি নয় বরং যুদ্ধপূর্ব যুগের দামে পাউন্ড এবং ডলারকে স্থির রাখার একরোখা, ভুল সিদ্ধান্তই ত্রিশের মন্দার মূল কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন যদি বাজারের নিয়ম মেনে পাউন্ডকে অবমূল্যায়িত করত, সেক্ষেত্রেও একটা ধস নামত বটে, কিন্তু সে ধস হতো অল্পদিনের। কিছু দিনের মধ্যে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হতো। অর্থনীতি যদি সুস্থির থাকত, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘঠিত হবার সম্ভাবনাও হয়তো কমে যেত।

দুই। ব্রিটন উডস সম্মেলন

ত্রিশের দশকে মন্দা চলছিল, মন্দা কাটাতে সরকারগুলো কিনসের নিদান মেনে প্রচুর টাকা ছাপাল এবং সেই টাকা বিনিয়োগ করল অস্ত্রশিল্পে। ‘রোম যখন জ্বলিতেছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাইতেছিল!’ মানুষ যখন ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছিল, তখন সরকারগুলো দেদার টাকা ছাপিয়ে অস্ত্র তৈরি করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্যে হিটলারকে দোষ দেওয়া হয় বটে, কিন্তু বাকি বিশ্বনেতৃবৃন্দও ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী পরিমাণ সম্পদ ও জীবন নষ্ট হয়েছে, সে কথা না হয় নাই বা তুললাম। ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ যুদ্ধশেষে ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রিটন উডস নামক স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক সম্মেলন। আলোচনার বিষয়: পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অর্থব্যবস্থা নির্ধারণ। ওই সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি ছিলেন, আর কেউ নন, স্বয়ং জন ম্যানার্ড কিনস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি ছিলেন হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইট (১৮৯২-১৯৪৮)। পরবর্তী সময়ে ডেক্সটার সোভিয়েত গুপ্তচর প্রমাণিত হয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন কিংবা তাকে হত্যা করা হয়েছিল– এই প্রশ্নের উত্তর অধ্যাবধি মেলেনি। দরকারি প্রশ্নগুলোর উত্তর আমেরিকায় কখনোই পাওয়া যায় না, যেমন সঠিকভাবে এখনও জানা যায়নি, ‘টুইন টাওয়ার’ আসলে কারা, কেন ধ্বংস করেছিল।

ব্রিটন উডস সম্মেলনে জন কিনসের নয় বরং হ্যারি হোয়াইটের আইডিয়াগুলোই গৃহীত হয়েছিল। এই সম্মেলনে স্থির হয়েছিল, বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আই.এম.এফ.)– নতুন এই দুই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হবে বিশ্ব অর্থব্যবস্থার কেন্দ্র, ডলার হবে পৃথিবীর একমাত্র রিজার্ভ মুদ্রা। বাকি পৃথিবীর সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশ্ব ব্যাংকে জমা থাকা তাদের ডলারের বিপরীতে নিজ নিজ মুদ্রা বাজারে ছাড়বে, স্বর্ণ রিজার্ভ রেখে নয়। বাকি সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সব জমা স্বর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র ওই স্বর্ণ ৩৫ ডলার আউন্স দরে কিনে নিয়েছিল।

ওই স্বর্ণের মূল্য এখন প্রতি আউন্স ১,২০০ ডলারের ওপরে। বলা হয়েছিল, সেই স্বর্ণের বিপরীতে বাজারে ডলার ছাড়বে যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু টাকার গাছ যখন আপনার নিজেরই উঠানে, তখন কতগুলো পাতা সেই গাছ থেকে আপনি ছিঁড়বেন বা ছিঁড়বেন না, সেই হিসাব কে নিতে যাবে। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন, য়াপ দ্বীপবাসীদের রাইপাথর, আমেরিকার আদিবাসীদের ঝিনুক কিংবা আফ্রিকার অধিবাসীদের হাতে কাচের পুঁতি তুলে দিয়ে, তাদের সম্মতিতেই তাদের দেশের সমস্ত সম্পদ শোষণ করার চেয়ে আলাদা কোনো ঘটনা এটা নয়।

ব্রিটন উডস সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কয়েকটি দায়িত্ব পালন করবে। প্রথমত, ডলারের সঙ্গে প্রতিটি দেশের মুদ্রা বিনিময়ের একটি হার নির্ধারণ করবে, দ্বিতীয়ত দুটি দেশের মুদ্রা, যেমন রুপি এবং টাকার মধ্যেও বিনিময় হার নির্ধারণ করবে, ডলারের ভিত্তিতে অবশ্যই। এ কাজটা আইএমএফ করবে দুই দেশের মধ্যে ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ বা বাণিজ্যিক ভারসাম্যের ভিত্তিতে।

বাণিজ্যিক ভারসাম্য কী? এক কথায় বলতে গেলে, একটি দেশের বাৎসরিক রপ্তানি ও আমদানির পরিমাণের তুলনা হচ্ছে ‘বাণিজ্যিক ভারসাম্য’। দুই দেশের মধ্যে, ধরা যাক, বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্য ঋণাত্মক, কারণ ভারত বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, বাংলাদেশ ভারত থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, এর পেছনে কারণ যাই থাকুক না কেন।

কাজটা ‘সহজ নয়’ বলার চেয়ে এটা বললে ভালো হবে যে কাজটা মনুষ্যের সাধ্যায়ত্ত্ব নয়। ‘কাজীর গরু কাগজে আছে, গোয়ালে নেই।’ প্রতিটি দেশেরই অনেক লেনদেনের (গরুর) হিসাব ‘কাগজে থাকে না, কিন্তু গোয়ালে থাকে’। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে যে চোরা কারবার হয়, নিঃসন্দেহে ভারত-বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির একটা বড় অংশ সেটা, কিন্তু কখনোই এই লেনদেন কাগজে থাকে না। বাংলাদেশ কিংবা ভারত– দুই দেশের কোনোটিই কি চোরা কারবারে হওয়া পণ্য ও অর্থ লেনদেনের অস্তিত্ব স্বীকার করে? পিতামাতা স্বীকার না করলে সন্তান ‘জারজ’ হয়, কিন্তু মরে তো যায় না! আইএমএফ কাগজের গরু দেখে সিদ্ধান্ত নেয় বা নিদান দেয়। যে লেনদেন দেশেই স্বীকৃত নয়, সেই লেনদেন বা গোয়ালের গরুর খবর আইএমএফ পাবে কীভাবে?

স্বর্ণমুদ্রার যুগে সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের খবরদারি ছাড়াই আমদানি-রপ্তানি হতো, কোনো সমস্যা কদাপি হয়নি। অনেক হিসাব-কিতাব, অনেক যুক্তি-পরামর্শ করেও আইএমএফ যা অর্জন করতে পারেনি, স্বর্ণমুদ্রার যুগে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা অর্জিত হয়ে যেত। আইএমএফ কিংবা বিশ্ব ব্যাংকের ব্যর্থতার কথা ‘ওপেন-সিক্রেট’ হবার পর যে বিশ্বায়ন বা গোলোকায়নের ধুয়া তোলা হয়েছে একবিংশ শতকের শুরুতে, সেই বিশ্বায়ন ছিল স্বর্ণমুদ্রার যুগের একান্ত স্বাভাবিক বাস্তবতা।

তখন স্বর্ণমুদ্রার ভিত্তিতে আমদানি-রপ্তানি হতো এবং কোন দেশের স্বর্ণমুদ্রায় কতটুকু স্বর্ণ আছে জানত সবাই। দুই মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করতে (‘ঢাকা’ কিংবা ‘খোলা’) কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিওয়ালা অর্থনীতিবিদের প্রয়োজন পড়ত না, (‘ঢাকা’ এবং ‘খোলা’) নিউমার্কেটের একজন সাধারণ দোকানদারই এই হিসাব করতে সক্ষম ছিল। তৃতীয় কোনো পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াই যাবতীয় লেনদেন স্বাভাবিকভাবেই চলতে পারত। পণ্য এবং পুঁজি স্বাধীনভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আসা-যাওয়া করত এবং বাণিজ্যিক ভারসাম্য নিজে থেকেই সৃষ্টি হতো। চট্টগ্রাম-ঢাকা-রংপুরের মধ্যে যদি বাণিজ্যিক ভারসাম্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হতে পারে, তবে ঢাকা-দিল্লি-কাটমান্ডুর মধ্যেও সৃষ্টি হতে সমস্যা কী?

নিয়ন্ত্রণের ফলে ক্ষতিটা কী হচ্ছে, একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলি। ধরা যাক, ভারতের কেরালায় পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে এবং একই সময়ে বাংলাদেশে পেঁয়াজের ফলন নষ্ট হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে কোনো কারণে পেঁয়াজের চাহিদা বেড়েছে, ধরা যাক, রোজার ঈদের সময়ে। কেরালার চাষিরা চাইছে, বাংলাদেশে ৪০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি করতে, কিন্তু সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণে পারছে না। তাদেরকে ভারতে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হচ্ছে ২৫ টাকায়। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনে জনগণের কাছে ন্যায্যমূল্যে ৪০ টাকা দরে বিক্রি করছে, যখন কিনা বাজারে পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দর উঠে গেছে ১০০ টাকা। এতে ঠকছে কেরালার কৃষক। বাংলাদেশের জনগণও ঠকছে, কারণ প্রথমত, ভর্তুকির টাকাটা তো সরকারি অর্থাৎ জনগণের তহবিল থেকেই আসছে এবং দ্বিতীয়ত, পেঁয়াজ বিতরণের কাজটা বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত, উভয় সরকার সেই অবসরে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারত।

সামষ্টিক অর্থনীতির সিলেবাসের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মূলত ফিয়াট মানি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর সরকারের অনর্থক খবরদারি ও নজরদারির সমস্যা। ভবিষ্যতে কোনো একদিন টেক্সটবুকের খপ্পর থেকে মুক্ত হয়ে বুদ্ধিমান শিক্ষার্থীরা যখন নৈর্ব্যক্তিকভাবে, অর্থনীতির নির্দিষ্ট একটি মডেলের উর্ধ্বে উঠে প্রশ্ন করতে শিখবে, সেদিন বাণিজ্যিক ভারসাম্যের অস্বাভাবিক ওঠানামা আইএমএফ পরবর্তী যুগে সৃষ্ট একটি সমস্যা বলে প্রমাণিত হলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। ব্রিটন উডস সম্মেলনের পর থেকে স্বাধীন বাজার নয় বরং প্রতিটি দেশের সরকার সেই দেশের অর্থব্যবস্থার ধারক, বাহক এবং নীতিনির্ধারক হওয়াতে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার যত সমস্যার সূত্রপাত।

ধরা যাক, আপনি এক হাঁতুড়ে ডাক্তার। আপনি ঠিক জানেন না, কোন রোগ কী কারণে হয় এবং এটা-ওটা ওষধ দিয়ে আপনি রোগী সুস্থ করতে চেষ্টা করেন। সাধারণ সর্দিজ্বর হলেও আপনি মুড়ির মতো অ্যান্টিবায়োটিক তুলে দেন রোগীর হাতে, কারণ আপনি দেখেছেন, এতে রোগী প্রায়ই সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু যেটা আপনি জানেন না, সেটা হচ্ছে, মৌসুমী সর্দিজ্বর এমনিতেও আরোগ্য হয়, সর্দিজ্বর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যেই হওয়া দরকার এবং যখন তখন অ্যান্টিবায়োটিক খেলে লাভের চেয়ে শরীরের ক্ষতিই বেশি হয়।

আইএমএফ এবং বেশিরভাগ পেশাদার অর্থনীতিবিদ অনেক ক্ষেত্রেই উপরোক্ত হাতুড়ে ডাক্তারের মতো ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। এদের উল্টাপাল্টা ব্যবস্থাপত্রের কারণে প্রায়ই টাকার দাম কমে যায়, বাণিজ্যিক ভারসাম্য দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে যায়। অবস্থা যখন একেবারেই সামাল দেওয়া যায় না, তখন ঋণের মুলা ঝুলিয়ে গরীব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আইএমএফ বাধ্য করে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে। অবশ্য আইএমএফ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও নিজেদের মুদ্রা অবমূল্যায়িত করতে পারে আমদানি বৃদ্ধির আশায়।

পাকিস্তানে ঠিক এটাই ঘটেছে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত। বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণের টাকা দেশের নীতিনির্ধারকেরা, যেমন পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী এবং একটি স্বার্থন্বেষী মহল দেদার অপচয় করে কিংবা বিদেশে পাচার করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এবং এখনও যে হচ্ছে না, তাই বা কে বলবে? বাংলাদেশের উন্নতি পাকিস্তানের চেয়ে বেশি মনে করছে এমনকি পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরাও, কারণ বাংলাদেশের চুরির চালুনির ছেঁদাগুলো পাকিস্তানের চেয়ে ক্ষুদ্রতর। পাকিস্তানের মানুষগুলোও তো বাঙালির চেয়ে গায়ে-গতরে বড়, সুতরাং তাদের ছেঁদাও বড় হওয়াটাই স্বাভাবিক।

যখন কোনো দেশের মুদ্রা অবমূল্যায়িত হয়, তখন স্থানীয় পণ্যের দাম দেশের লোকের কাছে বেশি মনে হয় বটে, কিন্তু বিদেশিদের কাছে, বিশেষ করে যে সব দেশের মুদ্রা অবমূল্যায়িত হয়নি, তাদের কাছে সস্তা বলে মনে হয়। এ কারণে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে রপ্তানি বেড়ে যায়। কিন্তু যে দেশের মুদ্রা অবমূল্যায়িত হয়, সেই দেশের টাকাওয়ালারা বিদেশি মুদ্রা কিনতে থাকে, কারণ তারা মনে করে, তাদের দেশের টাকা হয়তো আরও অবমূল্যায়িত হবে। এতে বিদেশের লাভ, কারণ তাদের মুদ্রার পরিমাণ কমছে, কিন্তু দেশের ক্ষতি, কারণ টাকাটা দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটছে বর্তমানে (২০২২-২৩) বাংলাদেশে কিংবা পাকিস্তানে।

কোনো সরকার যখন টাকার অবমূল্যায়ন করে, বোঝার উপর শাকের আঁটি কিংবা বেতনের সঙ্গে বোনাসের মতো, সুদের হারও কমিয়ে দেয়। সুদের হার কমে গেলে মানুষ তার মূলধনের জন্যে বিকল্প খোঁজে। পুঁজি দেশের বাইরে চলে যায়, ঠিক যেমন বাংলাদেশের টাকা প্রশান্ত হালদারদের হাতে চলে যাচ্ছে কানাডার বেগমপাড়ায়, মালয়েশিয়ায়, কোথায় নয়? ধরা যাক, পাশাপাশি দুটি দেশ, একটি নিজের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে, অন্যটি করেনি– এক্ষেত্রে অবমূল্যায়িত মুদ্রার দেশের পুঁজি পাশের দেশে রওয়ানা হবে নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে।

অনেক দেশ ইচ্ছে করেই নিজের টাকা অবমূল্যায়িত করে রাখে, রপ্তানি বাড়ানোর জন্যে। চীন এটা করে বলে শুনেছি, বাংলাদেশও হয়তো করে। অনেক সময় এমনও ঘটে, সরকার টাকাকে যতটা অবমূল্যায়িত করেছে, বাজারে টাকার তার চেয়ে বেশি অবমূল্যায়ন ঘটেছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এমন ব্যাপার ঘটেছে বাংলাদেশে ২০২২ সালের মে মাসের শেষে। যে ভাবেই অবমূল্যায়িত হোক, অবমূল্যায়িত মুদ্রার কারণে রপ্তানি বাড়ার ফলে Q-এর পরিমাণ বাড়ে কিংবা বাণিজ্যিক ভারসাম্য কমে– এসব তো ঠিকই আছে। কিন্ত অবমূল্যায়নের ফলে আভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের দাম অর্থাৎ P বেড়ে যায়। P বাড়লে V কমার কথা। সব মিলিয়ে মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে অর্থনীতির আসলেই কতটা লাভ হয়, সেটাও একটা প্রশ্ন।

খুব বেশি লাভ নিশ্চয়ই হয় না, কারণ অবমূল্যায়নের কোনো শেষ তো দেখি না কোথাও। এমন কোনো দেশ কি আছে, যে কিনা অর্থনীতি সুস্থির হবার পর নিজের মুদ্রাকে অতিমূল্যায়িত করেছে? যে সব দেশের মুদ্রার দাম বেশি, যারা নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে না, তাদের মুদ্রার দাম তো কখনও খুব বেশি কমতে দেখি না। টাকার বিপরীতে, চীনা মুদ্রার বিপরীতে ডলার বা ইউরোর দাম কখনও কমে না কেন? ১ ডলারের দাম আজ ২০২২ সালে ১০০ টাকার কাছাকাছি, ২০০০ সালে হয়তো ৬০ টাকা ছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতি কি গত দুই দশকে ১০গুণ বেশি শক্তিশালী হয়নি? যদি তাই হয়ে থাকে, ডলারের বিনিময়মূল্য, খুব বেশি না হোক, অন্ততপক্ষে ৭০ টাকায় কেন নেমে আসে না?

বাংলাদেশে ১ ডলার কিনতে এখন (২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে) ১০০ টাকার বেশি লাগে। আমি যখন উচ্চশিক্ষার্থে প্যারিস গিয়েছিলাম, ১৯৮৩ সলে তখন এক ডলারের দাম ছিল, যতদূর মনে পড়ে, ২০ টাকার মতো। টাকার দাম গত চার দশকে এভাবে পাঁচগুণ কমে যাওয়ার পেছনে M (১-২-৩) এর পরিমাণ বৃদ্ধি অবশ্যই একটা কারণ, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। Q, P, V ইত্যাদির পরিমাণও হিসাবের মধ্যে নিতে হবে। Q, P, V ইত্যাদির তুলনায় সরকার যেকোনো কারণেই হোক টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে ফেলেছে গত চল্লিশ বছরে। যেসব দেশের টাকার দাম বেশি, প্রথমত, ওইসব দেশের Q x P এবং M x V এর মধ্যে সাধারণত একটা সামঞ্জস্য থাকে এবং দ্বিতীয়ত সেসব দেশে টাকার স্টক টু ফ্লো বছরে কয়েক শতাংশের বেশি বাড়ে না অর্থাৎ প্রতি বছর বাজারে চলমান টাকার বিপরীতে মুদ্রিত টাকার পরিমাণ অতি সামান্যই বৃদ্ধি পায়।

চট্টগ্রামের ভাষায় একটা প্রবাদ আছে: ‘সাত পাঁচ চৌদ্দ, বেয়াই দুই ট্যাঁয়া নইদ্দ!’ (অনুবাদ: ‘সাত আর পাঁচ যোগ হয়ে চৌদ্দ, বেয়াই, তুমি দুই টাকা না হয় দিও না!’)। সমস্যা হচ্ছে, অর্থনীতি চট্টগ্রামের বেয়াই নয় হিসাবের বা নিয়মের গোঁজামিল আত্মীয়তার খাতিরে সে মেনে নেবে। তার নিজস্ব কিছু নিয়ম আছে এবং সেই সব নিয়মের ব্যত্যয় হলে গোঁজামিল দিয়ে শেষ রক্ষা হয় না, আখেরে মানুষকেই ভুগতে হয়। ‘আমি স্বখাত সলিলে ডুবি মরি শ্যামা, দোষ কারও নয় গো মা!’ বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীত।