Published : 20 Mar 2013, 07:09 PM
বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটিরও বেশি লোক কোন না কোনভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি ঘন্টায় পাঁচ জন লোক অকালে মৃত্যুবরণ করছে। আমরা সবাই জানি, কিডনি রোগ অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এ রোগের চিকিৎসা এতই ব্যয়বহুল যে, এদেশে শতকরা পাঁচ ভাগ লোকেরও সাধ্য নেই এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাবার। তাই কিডনি রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় রোগের কারণ ও রোগ সনাক্ত করে এই ভয়াবহ রোগ প্রতিরোধ করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় ক্যাম্পাস।
কিডনি বিকল দুই ধরণের–
১। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি বিকল
২। আকস্মিক কিডনি বিকল
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগঃ সমীক্ষায় দেখা গেছে, শকতরা ১৬-১৮ ভাগ লোকের মাঝে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ সুপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর শেষ পরিণতি কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যুবরণ। যাদের দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ আছে তাদের কিডনি রোগের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি সাধারণ মানুষের চেয়ে দশ ভাগেরও বেশী। অন্যদিকে, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের কারণে যাদের কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায় তাদের বেঁচে থাকার উপায় হলো ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন। এদেশে প্রতিবছর চল্লিশ হাজারেরও বেশি লোক কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যুবরণ করে। অথচ কিডনি বিকলের চিকিৎসা এতই ব্যয়বহুল যে, শতকরা দশজন লোকেরও সাধ্য নেই এই ব্যয় নির্বাহের। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের প্রধান কারণ হলো – ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, গ্লুমারেলো নেফ্রাইটিস, প্রস্রাব প্রবাহে বাধাজনিত রোগ, বয়স্ক পুরুষদের প্রষ্ট্রেট বড় হয়ে যাওয়া, প্রস্রাবের নালী সরু হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন ধরনের যত্রতত্র ঔষধের ব্যবহার, যাদের ওজন বেশী, যারা ধুমপান করে, যারা কম কায়িক পরিশ্রম করে তাদের মাঝেও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের প্রবনতা অনেক বেশী। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ এর ৫টি ধাপ আছে, এর মধ্যে ৪ নং ধাপ পর্যন্ত শনাক্ত করা হলে সম্পূর্ণ নিরাময় না করা গেলেও কিডনি বিনষ্টের গতিকে অনেক বিলম্বিত করা যায়। এতে করে রোগী আরো বহুদিন ভালভাবে বেঁচে থাকতে পারেন।
আকস্মিক কিডনি বিকল : কোন সুস্থ্য মানুষের বিশেষ কতকগুলো কারণে হঠাৎ করে কিডনির কার্যকারিতা লোপ পাওয়াকে আকস্মিক কিডনি বিকল বলা হয়। এটা সাধারণত কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বা দিনের মধ্যে ঘটে থাকে। অনেক সময় প্রাথমিক অবস্থায় কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না।
একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, প্রতি বছর মার্চ মাসে বিশ্ব কিডনি দিবস পালন করা হয়। এই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য থাকে মানুষকে কিডনি রোগ সম্পর্কে সচেতন করা। প্রাথমিক অবস্থায় সচেতন করে এই রোগ প্রতিরোধ করা এবং বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশে এই রোগ প্রতিরোধের জন্য সবাই একযোগে কাজ করে থাকে। এই রোগের ভয়াবহতার কথা খেয়াল রেখেই এই বিশ্ব কিডনি দিবসের আহবান করা হয়। এ বছরের বিশ্ব কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় Kidneys for life; Stop Acute kidney injury' অর্থাৎ 'জীবনের জন্য কিডনি ঃ আকস্মিক কিডনি বিকল প্রতিরোধ করুন' কিন্তু বিশ্বব্যাপী কেন এই শ্লোগান ? কারণ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের মতো আকস্মিক কিডনি বিকলের প্রকোপও অনেক বেশী। কিডনি বিকল হওয়া একটি ভয়াবহ ব্যাধি। কিন্তু আশার কথা হলো প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্ত করা গেলে এই রোগ চিকিৎসাযোগ্য ও প্রতিরোধযোগ্য।
আকস্মিক কিডনি বিকলের কারণ ঃ উন্নত বিশ্বে সাধারণত বয়স্কলোক যাদের ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ আছে, যাদের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে এবং যারা আইসিইউ এবং সিসিইউতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন তাদের আকস্মিক কিডনি বিকল হয়। আমেরিকায় আকস্মিক কিডনি বিকলে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা শতকরা ১ ভাগ। অন্যদিকে আমাদের দেশে উপরোক্ত কারণগুলো ছাড়া আরও নানাবিধ কারণ যেমন, ডায়ারিয়া, বমি, প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ, দূর্ঘটনাজনিত কারণে রক্ষক্ষরণ, হারবাল-হোমিও-কবিরাজি ঔষধ সেবন, নিয়ন্ত্রণহীন বেদনানাশক ঔষধ সেবন, ম্যালিরিয়া, ডেঙ্গু, সাপ-বিচ্ছু-পোকা-মাকড়ের কামড় ও ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে আকস্মিক কিডনি বিকল হয়। কাজেই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই রোগের হার উন্নত বিশ্বের চেয়ে অনেক বেশী হবার আশংকা থাকে।
খাদ্যে ভেজালের কারণে অসহায় জনগণ:আমাদের দেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো হচ্ছে বহু যুগ আগে থেকেই। তবে যত দিন যাচ্ছে ততই ভেজাল মেশানোর ব্যাপকতা বাড়ছে। আগে খাদ্যে ভেজাল বলতে দুধে পানি মেশানোকেই বুঝাতো। এ দুধে পানি মেশানোয় প্রতারণা ছিল, কিন্তু স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ছিলনা। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে অসাধু ব্যবসায়ীরা এর মধ্য থেকে অপ-বিজ্ঞানকে খুঁজে বের করছে এবং এই অপ-বিজ্ঞানকে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর কাজে ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, তারা নকল খাদ্য উপাদানও বের করছে। এগুলোতে প্রতারণাতো রয়েছেই, তার চেয়ে বেশী রয়েছে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি। আজকের বাংলাদেশে আমরা খাদ্য সামগ্রীর নকল-ভেজালের কারনে অত্যন্ত অসহায়।
খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের রকম-ফের :
ক. পচনরোধে ব্যবহৃত ফরমালিন এখন মাছ, দুধ, মিষ্টি ও ফলে;
খ. বাহারি কৃত্রিম রং সবজি, ফল ও মিষ্টিতে;
গ. গুঁড়া-মশলায় ইটের গুড়ো ও কৃত্রিম রং;
ঘ. খাদ্য ও পানীয়ে স্বাস্থ্য ক্ষতিকর কৃত্রিম রং;
ঙ. আম, পেঁপে, কলা, টমেটো প্রভৃতি কৃত্রিমভাবে পাকাতে ব্যবহার করা হয়- ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ইথ্রেল ইত্যাদি।
চ. শুটকি মাছে ক্ষতিকর কীটনাশক ডিডিটি।
খাদ্যে ভেজালের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি:
ক. ফরমালিনঃ ফরমালিন অত্যন্ত বিষাক্ত বলে নিয়মিত ফরমালিন যুক্ত খাবার খেলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিডনি, লিভার ও পাকস্থলির ক্ষতি হয়।
খ. কৃত্রিম রং ঃ কৃত্রিম রংযুক্ত খাবার গেলে ক্যান্সার হতে পারে। লিভার, কিডনি, হৃৎপিন্ড ও অস্থিমজ্জার ক্ষতি হয়।
গ. কৃত্রিমভাবে পাকানোর জন্য ব্যবহৃত কার্বাইড ও ইথ্রেলঃ এগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের লিভার, কিডনি ইত্যাদির ক্ষতি করে।
ঘ. ক্ষতিকর কীটনাশক ডি.ডি.টি ঃ ডি ডি টি একটি নিষিদ্ধ কীটনাশক, এর প্রভাবে আমাদের দেহে ক্যান্সারসহ নানা জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।
ভেজাল প্রতিরোধে যে সকল পদক্ষেপ নেয়া জরুরী:
খাদ্য ও পানীয়তে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার আজ সর্বগ্রাসী জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তবে এ সমস্যা সমাধান করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই খাদ্যদ্রব্যে ভেজালকে কঠোর হাতে দমন করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশেও তা সম্ভব। একাজে সরকারকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে সৎ ব্যবসায়ী ও জনগণকে।
সরকার পর্যায়ে করণীয়:
১. দেশের বিদ্যমান আইনগুলোকে যুগোপযোগী ও আরো কঠিন শাস্তির বিধান ও বাস্তবে তা প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
২. খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা কঠোর করা।
৩. উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্যে পৌঁছানোকে ক্রমাগত পরিদর্শনের আওতায় আনা।
৪. বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করা।
৫. ভেজাল রোধে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি স্বায়ত্বশাসিত নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
ব্যবসায়ী পর্যায়ে করণীয়:
১. সৎ খাদ্যব্যবসায়ীদেরকে অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
২. অসৎ ট্রেড ইউনিয়নসুলভ মানসিকতায় অসাধু ব্যবসায়ীদের পক্ষে সমগ্র ব্যবসায়ী সমাজের এক হয়ে কথা বলা বন্ধ করতে হবে।
ভোক্তা পর্যায়ে করণীয়:
১. ভোক্তাদেরকে সংগঠিত হয়ে খাদ্যসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
২. ভোক্তাদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. ভেজালযুক্ত খাদ্যদ্রব্য বয়কট করতে হবে।
অন্যান্য কারণে আকস্মিক কিডনী বিকল প্রতিরোধে করণীয়:
১. ডায়রিয়া ও বমিজনিত পানিশূন্যতা রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নিন।
২. প্রসবকালীন ও দূর্ঘটনাজনিত রক্তক্ষরণ রোধ করুন।
৩. চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যাতীত ব্যাথা ও জীবাণুনাশক ঔষধ সেবন করবেন না।
৪. ভেজাল খাদ্য পরিহার করুন।
৫. সাপে কাটা ও পোকা-মাকড়ের কামড়ে আধুনিক চিকিৎসা নিন।
৬. প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে তরিৎ চিকিৎসা নিন।
৭. বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
আসুন, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে আমরা প্রতিবাদি হই, প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সচেতন হয়ে আকস্মিক কিডনী বিকলের হাত থেকে নিজে বাঁচি এবং আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মকে বাঁচাই।
এম এ সামাদ:সভাপতি, কিডনী এ্যাওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি।