তারায় তারায় রটে গেল বিজ্ঞান

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 16 July 2022, 02:10 PM
Updated : 16 July 2022, 02:10 PM

সাপোজ মানে লেট মানে ধরি, আপনার দাদুর বয়স এখন ৭৫ বছর। তো আজকের তিনি যখন স্কুল পর্ব শেষের দিকে লিকলিকে গড়নের চপচপে তেল দিয়ে চুল আঁচড়ানো ১৫ বছরের ছাত্র, সেই সময়ে স্টুডিওতে গিয়ে তাদের ক্যামেরায় তোলা একটি ছবি ২০২২ সালে গল্পে গল্পে আপনাকে দেখালেন। ছবিটি সাদাকালো, বেশি পুরনো হওয়ার কারণে ঘিয়ে রঙ হয়ে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় সাদা ছোপ পড়েছে যে স্পষ্ট দেখা যায় না। দাদুর এই ছবি আপনি নতুন করে প্রিন্ট করালেন। উন্নত কারিগরির যুগ হওয়াতে ছবির ছোপ ছোপ কেটে গেল, উপরন্তু ছবি হলো রঙিন। ছবি নতুন করে প্রিন্ট করা, কিন্তু আপনি যখনই বন্ধুদের বাড়ি ডেকে এনে দেখাবেন, নিশ্চয়ই বলবেন দাদুর পুরনো দিনের ছবি, তা ৬০ বছর আগের তো হবেই।

এই ঘটনার সাথে নাসার জেমস ওয়েব স্পেস ক্যামেরায় ১৩শ কোটি বছর আগের ছবি তুলে আনার মিল দেখানো যায় কি কোনোভাবে?

১৯৯০ সাল থেকে শুরু করে আজ ৩০ বছর পেরিয়েও মহাকাশে আসন পেতে বসে আছে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। আজ থেকে এক দশক আগে অর্থ্যাৎ ২০১২ সালে মহাবিশ্বের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ১৩২০ কোটি বছর আগের হাজার হাজার ছায়াপথের ছবি তুলেছিল হাবলের এক্সট্রিম ডিপ ফিল্ড (এক্সডিএফ) সংস্করণ। এবার মহাজগতের ওই চেনা চেহারাকে আরও ঝকঝকে যাকে বলে হাই ডেফিনেশন কোয়ালিটিতে সামনে তুলে ধরেছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে তোলা ছবি কি আজকের নাকি পুরনো?

এর সহজ সরল উত্তর- ছবি আজকের তোলা, কিন্তু ছবিতে যে ‍মুহূর্ত ধরা পড়েছে সেটি বহু কোটি বছর পুরনো। ওই তারারা মরে গেছে, ছায়াপথ বিলীন হয়ে গেছে, নীহারিকা অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে এতদিনে।

তাহলে পুরনো সময়কেও বর্তমানে বসে দেখতে পাচ্ছি আমরা?

বিজ্ঞান থেকে নেওয়া উদাহরণই সহজপাঠ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যাক। এসব সবার স্কুলবেলাতেই শেখা। এবং সেই সময়ের শেখা যখন সন্তান সায়েন্স নিয়ে পড়ার সুযোগ পেলে পাড়ায় বুক-পেট ফুলিয়ে ঢেঁড়া পেটাতেন বাবা-মায়েরা।

আলো সেকেন্ডে এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল পাড়ি দিতে পারে; এই দূরত্ব সমান হচ্ছে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার (প্রতি সেকেন্ডে)। এদিকে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব ১৫০.৬৯ মিলিয়ন কিলোমিটার; মানে ১৫ কোটি কিলোমিটারের কিছু বেশি।

ঐকিক নিয়মের অংকেই বেরিয়ে যাবে সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে সময় লাগে ৫০০ সেকেন্ড; যা ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ডের কাছাকাছি।

সূর্যের দিকে যদিও সরাসারি তাকানোর জো নেই। তবে কপাল আর ভ্রু কুঁচকে, চোখ সরু করে এবং সানগ্লাস চাপিয়ে যদি কোনোমতে এক ঝলক সূর্যকে দেখে নেওয়া যায়, তো ওই ক্ষণের দেখা সূর্য আসলে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড আগের।

এরমধ্যে যদি সূর্য দুম করে আলো দেওয়া বন্ধ করে তো সেটা পৃথিবী থেকে বুঝতে আমাদের পার করতে হবে ওই ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড।

সূর্যের দিকে সরাসরি তাকিয়ে দেখা না গেলেও চাঁদের আলো বাঁধ ভাঙলে দু'চোখ মেলে আকাশে তাকিয়ে দেখা যায়। কিন্তু ঠিক যে মুহূর্তে কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা, কোনো কবি, এমনকি হতাশাগ্রস্ত কেউ মুগ্ধ চোখে, কাব্যিক চোখে, অশ্রুসজল চোখে, বিষণ্ন চোখে তাকিয়ে চাঁদটাকে দেখছে সেই চাঁদ তো আসলে ১.৩ সেকেন্ড আগের চাঁদ।

কেমন করে?

পৃথিবী ও এর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের মাঝের দূরত্ব ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪শ কিলোমিটার। এই দূরত্ব অতিক্রম করে পৃথিবীতে চাঁদের আলো আসতে সময় লাগছে ১.৩ সেকেন্ড। ঠিক এরপর চাঁদ যদি টুকরো টুকরো হয়ে যায় তো সেই খবর পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমাদের বুঝতে অন্তত ১.৩ সেকেন্ড পার করতে হবে।

অর্থ্যাৎ আমরা যে মুহূর্তে যেরকম দেখছি ওই মুহূর্তে চাঁদ বা সূর্য ওই দশায় আর নেই। ঠিক এরকমটা ঘটেছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের বেলাতেও।

বলা যায়, এতক্ষণের চন্দ্র-সুরুজ আলাপে আমাদের চোখ ছিল হয় হাবল টেলিস্কোপ নয়তো জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ।

তবে বাস্তবে আমাদের চোখের দেখার ক্ষমতা সীমিত। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে না হলে তা মানুষের চোখে দৃশ্যমান হয় না। মানুষ আলট্রাভায়োলেট (অতিবেগুনি রশ্মি) অথবা ইনফ্রারেড (অবলোহিত রশ্মি) আলো দেখতে পায় না। কিন্তু হাবলের চোখ দৃশ্যমান আলো তো বটেই সেই সাথে নিয়ার আলট্রাভায়োলেট (ইউভিএ) ও নিয়ার ইনফ্রারেড আলোও দেখতে পায়। এদিকে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আবার মিড ইনফ্রারেড আলোও দেখতে পারে।

ব্রহ্মাণ্ডের বয়স প্রায় ১৩৭০ কোটি কি ১৩৮০ কোটি বছর। সেখানে হাবল টেলিস্কোপে ১৩২০ কোটি বছর আগের ছায়াপথ দেখা গেছে। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ওই সময়ের আরও ঝলমলে আরও রঙিন ছবি দিয়েছে। এই টেলিস্কোপ দিয়ে নাকি ১৩৫০ কোটি বছর আগের মহাজাগত কেমন ছিল তাও দেখা সম্ভব।

তাহলে কি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ সেই কাঙ্খিত টাইম মেশিন?

সাই-ফাই গল্প আর সিনেমা আমাদের সময় পরিভ্রমণ করার ইচ্ছেকে চাঙ্গা রেখেছে বরাবর। একটা যন্ত্র যাতে করে চাইলেই বর্তমানে থেকে অতীতের সময়ে ঢুকে পড়া যায় কিংবা ভবিষ্যতে গিয়ে কী ঘটবে জেনে আসা যায়, সেটাই টাইম মেশিন।

২০১৫ সালে হাবল টেলিস্কোপের ২৫তম বর্ষপূর্তিতে খোদ নাসা এই টেলিস্কোপকে 'ইনক্রেডিবল টাইম মেশিন' বলেছিল।

জ্যোতির্বিদ অ্যালান ড্রেসলার তখন বলেছিলেন, "টেলিস্কোপকে এক ধরনের টাইম মেশিন বলা চলে। কারণ তারা পেছনের সময়ে ফিরে দেখতে পায় সেই আলোকে যা বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছেছে।"

২০২০ সালে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে 'কসমিক টাইম মেশিন' বলেছিল নাসা।

গত ১১ জুলাই তারিখের পর থেকে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ নিয়ে আবারও সেই শোরগোল উঠেছে। ভারত থেকে শুরু করে বিদেশি অনেক পত্রিকা, সায়েন্স ভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলো এই কদিন টাইম মেশিন আর টাইম ট্রাভেলার বলতে বলতে ফেনা তুলে ফেলেছে।

যদিও পৃথিবীর কক্ষপথে বসানো হাবল এবং সূর্যর কক্ষপথে বসানো ওয়েব টেলিস্কোপ দুটো নিজ অবস্থানেই রয়েছে। এই যন্ত্র সরাসরি অতীত সময়ে হাজির হচ্ছে না। তবে অতীতে দৃষ্টিপাত করতে পারছে অর্থ্যাৎ বর্তমানে বসে অতীতের দৃশ্যপট, যার এখন কোনোরকম অস্তিত্ব নেই, দেখতে পাচ্ছে টেলিস্কোপ দুটো। তাই কাব্য করে টাইম মেশিন বলাই যায়। এরপরও টেলিস্কোপকে আসলেই টাইম মেশিন বলব কিনা তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক একটা তর্ক হওয়ার বিস্তর সুযোগ তো রয়ে গেলই।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে তোলা ছবিতে নক্ষত্র, ছায়াপথ, নীহারিকা কত বছরের পুরনো– ৪৬০ কোটি নাকি ১৩০০ কোটি?

ওয়েবের তোলা প্রথম ডিপ ফিল্ড ছবি ছিল ছায়াপথগুচ্ছ এসএমএসিএস ০৭২৩-এর; যার অস্তিত্ব ছিল ৪৬০ কোটি বছর আগে। এই গুচ্ছের সামনে ও পেছনে আরও অসংখ্য গ্যালাক্সি রয়েছে। ওয়েবের নিয়ার ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ (সাদামাটা কথায়, আলোকে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে রূপান্তরিত করতে পারে এই প্রযুক্তি) মাইক্রোশাটার দিয়ে ৪৮টির মতো গ্যালাক্সিও এক সাথে দেখা গেছে। এসব গ্যালাক্সির কোনো একটি থেকে আলো এসে পৌঁছেছে ওয়েবে; যে আলোর উৎস ১৩১০ কোটি বছর পুরনো।

নাসা ওয়েব টেলিস্কোপে তোলা কাছাকাছি থাকা পাঁচটি গ্যালাক্সির ছবি প্রকাশ করেছে যাকে স্টেফানস কুইন্টেট ডাকা হচ্ছে। যে চারটি গ্যালাক্সি প্রায় গায়ে গায়ে লাগা সেগুলো ২৯ কোটি বছর আগের। পঞ্চম ছায়াপথটির আলো এসে পৌঁছতে সময় লেগেছে আবার চার কোটি বছর।

নাসা কি একটু তাড়াহুড়ো করেই ছবিগুলো প্রকাশ করে দিল? এদিকে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং নিয়ে তো কিছু বললই না!

হাবলের ছবিগুলোও এভাবেই একে একে প্রকাশ করা হয়েছিল। পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক টার্ম ব্যবহারে সাধারণ মানুষের বুঝতে অসুবিধে হবে, তাহলে আগ্রহ মিইয়ে যেতে পারে। ফলে গভীর ব্যাখ্যা চটজলদি সামনে না আসাই স্বাভাবিক। হাবল ও এর তোলা ছবি নিয়ে অসংখ্য গবেষণাপত্র হয়েছে। ওয়েব টেলিস্কোপ নিয়েও হচ্ছে এবং হবে। এখন তো প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য প্রকাশ হচ্ছে। আর নাসা এখনও উপাত্ত বিশ্লেষণ চালিয়ে যাচ্ছে; এ তো বড় লম্বা সময়ের কাজ।

গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের কারণে ডার্ক ম্যাটার নিয়ে জানা সহজ হয়েছিল। মহাকাশে ন্যাচারাল এই লেন্সিং তৈরি হওয়ার কারণে বিজ্ঞানিদের পক্ষে অজানা নক্ষত্র, নীহারিকা, ছায়াপথ নিয়ে গবেষণা করা সহজ হয়ে ওঠে। হাবলের সময় নাসার ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলে এই গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং নিয়ে আলাপ রয়েছে। এবারও নাসা ছবিতে থাকা গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং নিয়ে ‍উল্লেখ রেখেছে। সুতরাং গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং আড়াল করে কিছুই হচ্ছে না।

বিজ্ঞানী লামীয়া আশরাফ মওলা তার একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, দেশের সংবাদমাধ্যমে বহুবার তাকে একটি বিশেষ প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে– মেয়েদের বিজ্ঞানী হতে হলে কী করতে হবে? এর উত্তরে তার বক্তব্য হচ্ছে, দেশের মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে হবে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ প্রকল্পে কাজ করা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই বিজ্ঞানীর সঙ্গে যোগ করে বলতে চাই, ছেলে হোক অথবা মেয়ে, বিজ্ঞানী হতে হলে ভীষণ কল্পনাপ্রবণ মন থাকতে হবে। এই যেমন চাঁদে প্রথম মানুষ পা রাখার আগে নিশ্চয়ই মানুষ মুগ্ধ চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখেছে চাঁদের কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে থাকার। তারপর একদিন মানুষ সত্যিই চাঁদে গেল তো! এই যেমন টাইম মেশিন নিয়ে কত কত সাই-ফাই গল্প লেখা হয়ে গেল, বিগ বাজেটের সিনেমা হয়ে গেল, আজকে সত্যি সত্যি হাবল ও ওয়েবকে টাইম মেশিনের সাথে তুলনা করছেন বিজ্ঞানীরাই।

জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, "আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের"। অথবা ওপার বাংলার অন্তহীন সিনেমার একটা গানের ভেতরের সেই লাইনটা– "কথা ছিল হেঁটে যাব ছায়াপথ"।মানুষের মনে মহাকাশ-কুসুম কল্পনার তারারা ফুটে উঠলে সেসব কল্পনা বিজ্ঞানের সূত্রে মাপতোল করে ঠিকই ব্রহ্মাণ্ডের জন্মকথা টের পেয়ে যাবেন বিজ্ঞানীরা।

বলা হচ্ছে, মহাবিশ্বে ফোটনের জন্ম হওয়ার আগের অবস্থাকে দেখা সম্ভব হবে না ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে। ওদিকে আমার কল্পনা বলছে, ফোটনের জন্মের আগের মহাবিশ্ব থেকে টেলিস্কোপে আলো এসে না পড়লেও কী এসে যায়! এমন একটা প্রযুক্তি আবিষ্কার হবে যাতে কোনো যন্ত্র থেকেই বরং আলো পাঠানো যাবে বিগ ব্যাং ঘটনার সময় পর্যন্ত। খুব হেঁয়ালি মনে হচ্ছে কি? কিন্তু বিজ্ঞান নিশ্চয়ই কোনো একটা ছায়াপথ ধরে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছে যাবেই…।