Published : 14 Mar 2022, 06:48 PM
ছোটদের জন্য লেখালেখির জগৎ যতটা অবারিত ও প্রসারিত, সেই অনুযায়ী কম দেশেই বিষয়টাকে ততটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়ে থাকে। ছোটদের জন্যে লেখালেখির জগতকে আমরা অনেকটা ছোট করে দেখি নাকি? ছোটদের জন্যে লেখালেখি প্রসঙ্গে আমার সামনে আরো একটি প্রশ্ন। ছোটদের বা শিশুকিশোরদের লেখাগুলোকে আমরা কি ছোটদের জন্যে লেখালেখি হিসেবে গণ্য করি? নাকি ছোটদের জন্যে বড়দের লেখাগুলোই কেবল ছোটদের জন্যে লেখা হিসেবে আখেরে বিবেচিত হবে?
এ প্রশ্নগুলো মাথায় রেখে আমি আমার কয়েকটি গল্প বলতে চাই। একই সঙ্গে কিছু পর্যবেক্ষণও তুলে ধরতে চাই।
২০১১ সালের ঘটনা। ওই বছর প্যারিস আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলায় আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেবার সুযোগ হয়েছিল আমার। প্যারিসের বইমেলা চলাকালীন একদিন সন্ধ্যায় লেখকদের জন্যে আয়োজিত এক পানাহার অনুষ্ঠানে সুইডেনের এক বহুলপঠিত একজন শিশুসাহিত্যিকের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলাপ করছিলাম। আমি নিজে তখনও ছোটদের জন্যে লেখালেখিতে হাত দেবার মতো মনের জোর অর্জন করতে পারিনি। মোদ্দাকথা ছোটদের জন্যে আমার লেখাজোকা শূন্যের ঘরে।
ওই জনপ্রিয় লেখককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, "আচ্ছা তুমি যে ছোটদের জন্যে লিখো, নানা বয়সের উপযোগী করে লিখতে গিয়ে ছোটদের বয়স উপযোগী লেখাজোকার সামঞ্জস্য নির্ধারণ করো কিভাবে? এর মাপকাঠি কী?"
লেখকের উত্তরটা ছিল এরকম, "তুমি যখন বড়দের জন্যে লিখো তখন তুমি তোমার মনের ভেতরে একজন বড় মানুষের মন ধারণ করো। ঠিক একইভাবে তুমি যেই বয়সের উপযোগী করে লিখতে চাও, ওই বয়সের একটা মন নিজের মনের মধ্যে জায়গা করে দাও, তাহলেই হয়ে যাবে। তুমি ছোটদের বয়সের ওই ধাপগুলো পার করে এসেছো। এটা বাতলে নেবার জন্যে পণ্ডিতি রেফারেন্স বা সূত্র ঘাঁটাঘাঁটির কোনোই আবশ্যকতা নাই।"
তারপরও ছোটদের জন্যে লেখালেখি করার জন্যে স্বতঃস্ফূর্ত কোনও গতি আমি পাইনি দীর্ঘ একটা সময়। সবসময় ভাবনায় রাখি, ছোটদের জন্যে একটা কিছু লিখবো। এর বছর কয়েক পরে আমার মেয়ের বয়স তখন পাঁচ-ছয়ের ঘরে, একদিন রাতে ওর মা ওকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে বলছে, "অতসী, কথা বন্ধ করো, চোখ বন্ধ করে ঘুমাও। তা না হলে আল্লাহ রাগ করবেন।" অতসীর উত্তর, "আল্লাহর কি খেয়ে আর কোনো কাজ নাই, সে কেবল আমার দিকেই চোখ দিয়ে রাখবে, আমি ঘুমালাম কি ঘুমালাম না, খেলাম কি খেলাম না?"
এর বছর এক বা দুই পরে, একবার যাত্রাপথে গাড়িতে ওর মা, আমি আর আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ আরও দুইজন। মেয়েটি আমাদের দুজনের মাঝখানে বসা। হঠাৎ জানালা দিয়ে আকাশের দিকে আঙুল তাক করে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, "আচ্ছা আমরা আকাশে উঠতে পারি না কেন?"
মেয়েটির এই দুই প্রশ্ন ছোটদের লেখালেখির জন্যে আমার মনের যে দোদুল্যমানতা তা দূর করে দিয়েছিল। ছোটদের জন্যে লেখালেখি করার আমি একটা স্বতঃস্ফূর্ত গতি পেয়ে গিয়েছিলাম। লিখেছিও ছোটদের জন্যে নাটক, কবিতা, উপন্যাস, গল্প আর অনুবাদ মিলিয়ে কয়েকটি বই। তবে হলফ করে বলতে পারি শিশুসাহিত্যিক হবার জন্যে যে যোগ্যতা, পড়াশোনা আর প্রস্তুতি তার কোনোটাই আমার নাই।
সীমিত পড়াশোনা আর উপলদ্ধি থেকে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি ছোটদের জন্যে লেখালেখির জন্যে ছোটদের বড় করে দেখতে হয়। আর নিজের মনের ভেতরে ছোটদের বড় জায়গায় স্থান দিতে হয়। এর জন্যে চাই শিশুমনের কল্পনার স্বাধীনতাকে নিজের মনে আবিষ্কার করা।
এবার অন্য একটি গল্প বলি। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে তানজানিয়ার মশি শহরে অবস্থিত কিলিমাঞ্জারো আঞ্চলিক গ্রন্থাগারের আমন্ত্রণে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্যে সৃজনশীল লেখালেখি বিষয়ক কর্মশালা পরিচালনার জন্যে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। এখানে উল্লেখ্য, কর্মশালায় অংশ নেওয়া তরুণদের কেউই এর আগে সৃজনশীল লেখালেখিতে হাত দেয়নি। দুইদিনের কর্মশালায় তারা নানা বিষয়ে অনন্য কিছু লেখা দাঁড় করিয়েছিল। তাদের কল্পনাশক্তি, চিন্তার গভীরতা আর প্রাসঙ্গিক দূরদর্শিতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
এক কথায় তাদের প্রকাশের ভঙ্গি, ভাষা আর বিষয় নতুন ও মৌলিক। তাদেরকে বলা হয়েছিল তাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যে চারপাশের যে কোনো একটা জিনিস বা বিষয় নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে চিন্তা আর কল্পনার স্বাধীনতা মিলিয়ে কবিতার অক্ষরে বা কবিতার মতো করে পাঁচ থেকে দশ লাইনের মধ্যে কিছু একটা লিখতে অথবা তাদের স্বাধীন মতো কোনো গদ্য ধরনের লেখা দাঁড় করাতে।
তাদের কেউ লিখেছে নিজের দেশ তানজানিয়া নিয়ে, কেউ কলম বিষয়ে, কেউ মাসাই আদিবাসী প্রসঙ্গে, কেউ হালকা পানীয় কোকাকোলা-পেপসি-ফান্টা-স্প্রাইট বা সোডা পানীয় নিয়ে, কেউ লিখেছে তাদের পড়াশোনার পথে বিবদমান বাধা নিয়ে, গ্রন্থাগার ব্যবহারে সংকট নিয়ে। এরকম নানা বিষয়ে তারা লিখেছে গদ্য ও পদ্য। প্রথমদিনের লেখাগুলো থেকে এখানে একটি কোনও রকম পরিবর্তন ছাড়া তুলে ধরছি:
SODA
by Innocent Gabriel
It is my pleasure to say this,
It's good in nature,
Blessings to the one, who made this,
Truly and honestly it has good taste
Try to drink it, to get nutrients contained
During dinner
Try combine your dinner with,
Likely you will get a nice taste,
And you will require more and more;
এই যে ছোটদের লেখালেখি পৃথিবীর নানা প্রান্তে, বা মহাদেশে, যা কেবল তানজানিয়া বা বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়। এরকম লেখালেখির অক্ষরে নিজের মনের প্রকাশ পৃথিবীর সবদেশের ছোটদের মাঝেই রয়েছে কম আর বেশি। কিন্তু এসব লেখালেখিকে সমসাময়িক লেখালেখির ইতিহাসে উল্লেখ করার মতো স্বীকৃতি বা গুরুত্ব কি আমরা দেই? কেবল ইউরোপ বা আফ্রিকার কথা না। আমাদের দেশের কথাই ধরি। ছোটদের পত্রিকায় এবং দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় ছোটদের নিজেদের অনেক সুন্দর লেখা ছাপা হয়। সময়ের আবর্তে সেইসব লেখা ও লেখকরা কেন এবং কোথায় হারিয়ে যায়? আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে?
ছোটরা অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকে। আমাদের বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হাজার হাজার বইয়ের প্রচ্ছদপটে ওইসব ছবি কি খুব একটা কাজে লাগানো হয়? আদতে আমরা কি ছোটদের ছোট করে দেখার মানসিকতা থেকে কি মুক্ত হতে পেরেছি? ছোটদের জন্যে লেখালেখির বড় উদ্দেশ্য হলো ছোটদের ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বকে উদযাপন করা বা স্বীকার করে নেওয়া।
আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন ছোটদের জন্যে লেখালেখির গোড়ার উদ্দেশ্য ছিল ছোটদের শেখানো বা জ্ঞান দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ তারা কতটা ছোট সেটা মনে করিয়ে দেওয়া আর ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া বড় হতে তাদের আর কত দেরি। অনন্তকাল ধরে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র চলেছে এই একই প্রবণতায়, এমনকি ছোটদের জন্যে লেখালেখিও।
তবে সত্যিকার অর্থে ছোটদের জন্যে সাহিত্য বা গল্প নতুন কিছু না; তা মানুষের মুখে মুখে নিজ নিজ মায়ের ভাষায় মানুষের ইতিহাসের গোড়া থেকেই ছিল, এমনটা আমি মনে করি। কেননা শিশুকে গড়ে তোলার জন্যে ঘুম পাড়ানোর জন্যে যেমন দরকার অনেক গল্প কল্পনা আর বাস্তবের; তেমনি ছড়াকাটুনি বা ঘুমপাড়ানি গান একজন মাকে খুঁজতে হতো বা সৃষ্টি করতে হতো নিজের মতো করে। সেটা যেমন আজকের জন্যে সত্য, আদিকালের বেলাতেও সত্য। এমনকি ভবিষ্যতেও কি এর ব্যতিক্রম হবে?
একটা সময় ছিল কালে কালে দেশে দেশে ছোটদের জন্যে আলাদা করে না লিখে বড়দের লেখাগুলোই ছোটদের উপযোগী করে লেখার চল ছিল। সেই চল এখন প্রয়োজন সাপেক্ষে কিছুটা এখনো রয়েছে। তবে ছোটদের জন্যে লেখালেখি এখন একটা স্বতন্ত্র এবং মর্যাদার জায়গা করে নিয়েছে অনেকে দেশেই। তা কেবল ইউরোপ বা আমেরিকাতে নয়। বেশি দূরে যাবো না, পাশের দেশ নেপালের উদাহরণ টানতে চাই।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সপ্তাহখানেকের জন্য নেপালে গিয়েছিলাম ওয়ান ওয়ার্ল্ড নাট্যশালা এবং আন্তর্জাতিক পেন নেপাল কেন্দ্রের আমন্ত্রণে। ওই সময় কাঠমান্ডুর শিশুসাহিত্য এবং গবেষণা কেন্দ্রের আয়োজনে একটা মতবিনিময় সভায় যোগ দিয়েছিলাম একদল নেপালি লেখকের সঙ্গে; যারা ছোটদের জন্যে লেখালেখি করেন। শিশুসাহিত্য কতটা মর্যাদার আসনে এবং উচ্চভিলাষী অবস্থানে তা তারা আমাকে নানাভাবে জানালেন। তাদের রয়েছে নানা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও সাহিত্য বিনিময়। মোটকথা তাদের দেশে শিশুসাহিত্য অনেকটা পেশাদারি মর্যাদার জায়গাও দখল করতে পেরেছে।
এই পর্যায়ে আরো একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চাই। কাঠমান্ডুর বাইরে এর পাশের একটি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে তরুণদের লেখালেখির একটা কর্মশালা পরিচালনা করার সুযোগ হয়েছিল আমার।
ওই কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ বিজয় রাজ আচার্য একজন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক। তিনি তার কলেজে দুইদিনব্যাপী শিশুসাহিত্যের এক উৎসবের আয়োজন করেছেন। তার অংশ হিসেবে লেখালেখি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ওই পুরসভার উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এই উৎসবে এবং লেখালেখি কর্মশালায় অংশ নেবার জন্যে নির্বাচিত হয়ে এসেছিল। শহরের বাইরে পাহাড় আর পর্বতের পাদদেশে অনেকটা নির্গম এলাকায় অবস্থিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্যান্য দেশের শিক্ষকরা স্বল্প মেয়াদের জন্যে অতিথি শিক্ষক হিসেবে আসেন, যাদের অনেকের আগ্রহ বা অভিজ্ঞতা থাকে শিশুসাহিত্য নিয়ে কাজ করার।
কাঠমান্ডুর শিশুসাহিত্য এবং গবেষণা কেন্দ্র ওই দেশের গ্রন্থাগারিক, শিক্ষক, চিত্রশিল্পী, অনুবাদক আর শিশুসাহিত্যিকদের একটা সম্মিলিত জায়গা। এর মাধ্যমে তাদের একটা পারস্পারিক অভিজ্ঞতা আর ধারণা বিনিময়ের সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে ছোটদের জন্যে লেখালেখির নিমিত্তে যৌথ প্রকল্প বা কর্মসূচিও বাস্তবায়ন তারা করা করে থাকেন। নেপাল থেকে ফিরে আসার এক বছরের মাথায় বিজয় আচার্য আমাকে জানালেন, তিনি অধ্যক্ষের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন, তার পুরোটা সময় ছোটদের জন্যে লেখালেখিতে দেবার জন্যে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তাতে তোমার নিয়মিত আয় রোজগারে কোন সমস্যা হবে না?" উত্তরে তিনি বললেন, "একেবারেই না, বরং আমার আর্থিক অবস্থা আরো ভালো হবে, লেখালেখিও ভালো চলবে।"
এবারের ইউরোপের একটা উদাহরণ দেব। ইউরোপের একটি দেশে আমার এক লেখক বন্ধু মারিয়া ফ্রেন্সবারি, যিনি মূলত কলেজ শিক্ষিকা। প্রথম বই প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিকভাবে নামকরা বড় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে, তার বয়স যখন চল্লিশের কোঠায়। এরপরের বই প্রকাশ করেন একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে। এরপর আর তাকে থেমে থাকতে হয়নি। লেখালেখির ব্যস্ততা আর নানা লেখক সংলাপ, কোর্স, কর্মশালায় আমন্ত্রণ পেতে থাকেন নিয়মিত এবং অবশ্যই সম্মানীর বিনিময়ে। যে কারণে তাকে কলেজের চাকরি ছাড়তে হয়। আমি তাকেও জিজ্ঞেস করলাম- এসবে কি তোমার নিয়মিত আয়-রোজগার চলে যায়! তিনি বললেন, "আলবৎ চলে যায়, বরং ভালোই চলে।"
এশিয়ার আরও কিছু দেশে এরকম আরও অনেক ভালো দৃষ্টান্ত রয়েছে, বিশেষ করে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায়। এবার নজর বুলিয়ে দেখতে পারি আর মিলিয়ে নিতে পারি আমাদের অবস্থান কোথায়।
একবার স্টকহোমে লেখক ভবনে শিশুসাহিত্য বিষয়ে লেখকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের বিবেচ্য বিষয় নিয়ে আমাদের কতগুলো প্রশ্ন করেছিলেন। এই সভায় আমার সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক সুজন বড়ুয়াও যোগ দিয়েছিলেন। প্রশ্নগুলো ছিল মোটামুটি এরকম।
১. বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে যৌনতা প্রসঙ্গ কিভাবে তুলে ধরা হয়?
২. ধর্মীয় বিষয়গুলো কিভাবে বিবৃত করা হয়?
৩. নৌতিক মূল্যবোধের ব্যাপারগুলো কিভাবে বিবেচনা করা হয়?
৪. সামাজিক বৌষম্যের বিষয়গুলো কতটা উঠে আসে শিশুসাহিত্যে?
প্রশ্নগুলো বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে দুটো গল্প বলে লেখাটার সমাপ্তি টানতে চাই।
প্রথমটি একটি বই নিয়ে। বাংলাদেশের একটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক যিনি ছোটদের জন্যে লেখালেখিও করেন। তার একটি বই আমাকে একবার পড়তে দিয়েছিলেন। বইটি পড়ে আমার মন খারাপ হয়েছিল। এরপর ওই সম্পাদকের সামনে আর কোনোদিন যাইনি। ওই বইয়ের একটি গল্প একটা বাচ্চাশিশুকে বোঝানো হচ্ছে ময়লা ছেঁড়া-কাপড়চোপড় পরা কাউকে দেখলে তার কাছে না ভিড়তে। কারণ এরকম লোকগুলো 'ছেলেধরা' হয়।
একবার বিদেশের কয়েকজন লেখক-লেখিকা আমাদের একুশে গ্রন্থমেলা ঘুরে ঘুরে দেখেছেন কয়েকদিন। কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগও দিয়েছিলেন তারা। এদের একজন ছিলেন ভিভেকা খৌগ্রেন। ইউরোপীয় সাহিত্য সংসদের পরিচালনা পরিষদের সদস্য তিনি। নিজ দেশে ফিরে গিয়ে তিনি আমাকে বললেন, "তোমাদের বইমেলা, প্রকাশনা জগৎ আর সাহিত্যের আয়োজন সবকিছু চমৎকার। শিশুদের জন্যে লেখালেখি ও প্রকাশিত বইও চোখে পড়ার মতো। কিন্তু একই সঙ্গে অসংখ্য ছিন্নমূল শিশু, পথশিশু, টোকাই যাদের থাকার, খাবার, আর পড়াশোনার মতো মৌলিক অধিকারের আওতার বাইরে। তারাও বইমেলার আশেপাশেই হাঁটাহাঁটি করছে অথচ বইয়ের জগৎ তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিষয়টা আমার খটকা লেগেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেছে।"
কী আর বলি! মন আমারও খারাপ। এই মন খারাপের শেষ কতদূর?