সে এক মুশতাক ছিল, বিষণ্ণতা ছিল যার অলংকার…

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 25 Feb 2022, 01:10 PM
Updated : 25 Feb 2022, 01:10 PM

'সেই এক মুশতাক ছিল। বড় সাধ ছিল তার মানুষ হবার।

সেই এক মুশতাক ছিল। বড় সাধ ছিল তার লেখক হবার।

সেই এক মুশতাক ছিল, বিষণ্ণতা ছিল যার অলংকার

সেই এক মুশতাক ছিল। বড় সাধ ছিল তার হারিয়ে যাওয়া কয়েক প্রজাতির কুমিরের জন্য মানুষের মতো পৃথিবী গড়ার'!

মুশতাক 'ছিল'! এখন আর পৃথিবীতে নেই। জন্মের পর থেকে একা থাকতে পারতো না। এখনও একা নেই। আজিমপুরে অনেকের সাথে মাটির নীচের এক 'অদেখা বা অচেনা' ভূবনে আছে। তাতেও শান্তি পায় নি মুশতাক। জন্মদাতা পিতাকেও চলে যেতে হয়েছে মুশতাক চলে যাবার উনচল্লিশ দিন পর।জানি না আমাদের এই অদেখা ভূবনে পিতা ও পুত্রের দেখা হয়েছে কিনা!

মুশতাকের বাবা আব্দুর রাজ্জাক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (পাকিস্তান আমলে তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হয় নি) থেকে পাশ করার পর চাকরি নিয়ে চলে আসেন দর্শনাতে। স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশানের চাকরিতে ((এখন বিএসইসি) ফ্যাক্টরি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান করে দর্শনা চিনি কলে বহুদিন চাকরি করেছেন। স্বাধীনতার চার বছর আগেই মুশতাকের জন্ম। ১৯৮০ সালে মুশতাক ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে চান্স পাওয়ার আগেই আব্দুর রাজ্জাক সাহেব বদলি হয়ে চিটাগং এ এসেছিলেন ইস্টার্ন ক্যাবলসে, পরে বদলি হন জিইএম প্ল্যান্টে। বড় এবং ছোট বোনের মাঝখানে জন্ম নেয়া মুশতাক কখনো 'মাঝখানে' থাকতে চায় নি। ঘরের মাঝখানে তার মন টিকতো না। মুশতাক কয়েকবার বলেছে ঘর থেকে পালানোর জন্য ক্যাডেট কলেজকেই তার উপযুক্ত মনে হয়েছিল। ফৌজদারহাটে ভর্তি হবার পর সে বুঝতে পেরেছিল সংসার বা পরিবার যদি 'শঙ্খনীল কারাগার' হয় তাহলে ক্যাডেট কলেজটা তার জন্য 'ঘরহীন এক ঘর'! কোন কিছুর মাঝখানেই সে আর থাকতে চাইতো না।

ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ মুশতাকের জীবনের আরেক গল্প।সেটি অন্য কোন সময় বলা যাবে। মুশতাকের সহপাঠিদের কাছে ওর জীবনের অনেক গল্প জমা আছে। ন্যাপথলিনের ঘ্রাণে আনন্দ বেদনার সেসব গল্প জমাই থাকুক আপাতত। পাঁজর খুলে কেউ আর এখন সেসব ফিরিয়ে না আনুক। কিন্তু কলেজের চারদেয়ালের বন্দি জীবনের চেয়ে কলেজের পেছনের পাহাড় কিংবা সামান্য দূরের সমুদ্র ডাকতো মুশতাককে। সামরিক চৌহদ্দির 'কমান্ড' শোনার চেয়ে সে ভালোবেসে ফেললো পাহাড় ও সাগরের ডাককে। ফলাফল ভয়াবহ। বাবা আব্দুর রাজ্জাককে কয়েকবার যেতে হলো ফৌজদারহাটে। কিন্তু মুশতাক তখন প্রকৃতির মুক্ত পাখিটার মতো বাড়ি বদল করার অভিপ্রায়ে অস্থির। ইলেভেন ক্লাসে অর্থাৎ ১৯৮৪-তে এসএসসি পাশের পর ১৯৮৫ সালেই কলেজ ছাড়লো সে। ফৌজদারহাট ছাড়ার বহুদিন পর সে বুঝেছিল সে আসলে 'কলেজের স্মৃতি আর তার বন্ধুদের' ছাড়তে পারেনি। জীবনের অনেক ঘটনায় সে আসলে ফিরে ফিরে আসতো তার বন্ধুদের কাছেই। জীবনের প্রথম গ্রেপ্তার কিংবা ২০২০ এর মে মাসে ওকে তুলে নেয়া এবং ওর মৃত্যুর পরেও  মুশতাকের ক্যাডেট কলেজের বন্ধুদের দেখা গেছে মুশতাকের পাশেই।

ফৌজদারহাট থেকে বেরিয়ে মুক্ত জীবনের মুক্ততা কতখানি প্রভাবিত করেছিল মুশতাককে? মুশতাক ভর্তি হয়েছিল চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে। লেখালেখির পোকা মাথায় ভর করার সাথে সাথে হতাশাও গ্রাস করেছিল তাকে। বিষণ্ণতার ঘোর থেকে বের হতে সময় লেগেছিল মুশতাকের। সেই বিষণ্ণতা আজও অজানা। জীবনের চাওয়া না পাওয়ার সাথে কখনো-সখনো যুক্ত হয়েছে এই বিষণ্ণতা। এই ঘোর কাটাতে তাকে চট্গ্রাম থেকে যেতে হয়েছে রাজশাহী। খালাবাড়ির এই দিনগুলো ভুলতে পারেনি মুশতাক। তার খালাতো এবং চাচাতো ভাই (মুশতাকের চাচা বিয়ে করেছিলেন মুশতাকের খালাকে) ডা. নাফিজ ছায়া হয়ে ছিলেন মুশতাকের সাথে। আমার সাথে জীবিত মুশতাকের শেষ দেখার সময়েও উপস্থিত ছিলেন ডা. নাফিজ।

কলেজ জীবন শেষে মুশতাক তার বাবার সাহায্য নিয়ে ভর্তি হয় 'সিএ' (আইসিএমএ)-তে এবং মোটামুটি সার্বক্ষণিক হয় প্রসিদ্ধ সিএ ফার্ম 'রহমান অ্যান্ড রহমান হক'- এ। ১৯৯০ সালে অডিট করতে এই ফার্মের লোকজনের সাথে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের ডানকান কোম্পানির চা বাগানে যায় মুশতাক এবং আবারও তার জীবনের বাঁকবদল হয়।

ডানকানের চা বাগানে তার সাথে দেখা হয়ে যায় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের এই বড় ভাইয়ের সাথে। কয়েক বছর পর পর হওয়া 'টি টেস্টিং অ্যান্ড প্লান্টেশেন কোর্স' এ অংশ নিতে মুশতাক থেকে যায় সিলেট, তার আর ফেরা হয় না 'রহমান এন্ড রহমান হকে'র ফার্মে। বাবা আব্দুর রাজ্জাক খোঁজ নিতে ছুটে যান 'রহমান অ্যান্ড রহমান হক'-এ এবং জানতে পারেন মুশতাক ফেরেনি। সে রয়ে গেছে সিলেটেই! জীবনে বারবার মুশতাক চেষ্টা করেছে কিন্তু তার কখনো জীবনে ফেরা হয় নি।

এই কোর্স করার পর 'সোনারূপা' টি গার্ডেনের এক সার্কুলার দেখতে পেয়ে সেখানে আবেদন করে মুশতাক এবং টি টেস্টিং কোর্স করার কারণে সে সবচেয়ে অল্প বয়সে ওই চা বাগানের সহকারি ম্যানেজারের চাকরিটা পায়। ছয়মাস পরে সে স্থায়ী হলে সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে সে পায় একটা মোটর সাইকেল এবং আবারও তার জীবনের বাকবদল হয়। মুশতাকের মতো দ্রুতগতির মোটর সাইকেল খুব কম মানুষই চালিয়েছে। সিলেট শহর আর চা বাগানের ভেতর দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয় সেই মোটর সাইকেল আর মুশতাক হয়ে উঠতে থাকে দ্রুতগতির 'পরিব্রাজক'। রাত হলে লেখা, সেই পুরোনো বিষণ্ণতার হাত ধরে আসা হতাশা পান, ছবি আঁকা আর চট্টগ্রামে ফেলে আসা কোন এক সোনালী অতীতকে চিঠি আর কবিতা লেখা হয়ে যায় তার জীবনের অংশ।

কিন্তু আবারও বাঁকবদল। সোনারূপা চা বাগান নতুন একটা চা বাগানের গোড়াপত্তন করে যার ভার নেয় মুশতাক। সোনারূপা চা বাগানে একবার শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছিল এবং মারা গিয়েছিলেন সেই বাগানের মালিক। এরপর এটা দেখভাল করতেন তার স্ত্রী। নতুন চা বাগান, বন্ধু-বান্ধবদের দেখাতে একদিন সিলেট আসেন মালিকের মেয়ে এবং মুশতাকের একা একা থাকা বাংলো কিংবা সৃষ্টিশীলতায় ব্যাঘাত ঘটে। একরাতের ব্যবধানে মুশতাক চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসে ঢাকায়। সঙ্গী সেই পুরোনো বিষণ্ণতা আর হতাশার নতুন চাঁদর। জীবনের বাঁকবদল বহুবার হয়েছে, মুশতাক কিংবা বিষণ্ণতা কেউ কাউকে ছাড়ে নি।

এরপর আবারও ভাবুক মুশতাক। কী করা যায় এমন ভাবতে ভাবতে একদিন দুরন্ত গতির পরিব্রাজক মুশতাক হয়ে যায় ধার গতির এবং দেশের প্রথম খ্যাতি পাওয়া ভ্রমণ কোম্পানি 'গাইড ট্যুর' এর চাকরিতে জড়ায় ১৯৯৫-৯৬তে। সুন্দরবন আর কুমিরের জীবনের সাথে সেই প্রথম মুখোমুখি হয় মুশতাক। কিছুদিন পর বিয়ে করে সে। এর পরেও নীরবে ঘটতে থাকে বাঁকবদল। এসময়ে সুন্দরবনে কুমিরদের অভয়ারণ্য ও নিশ্চিন্ত প্রজননের ক্ষেত্র তৈরিতে উদ্যোগ নেয় সরকার। খ্যাতনামা একজন কুমির বিশেষজ্ঞের সংস্পর্শে আসে মুশতাক। এরপর একদিন গাইড ট্যুর ছেড়ে দিলেও কুমিরের চিন্তাটা তার মাথা থেকে নামেনি।

গাইড ট্যুর ছেড়ে আসার পর আর্কিটেক্ট এবং ব্রডকাস্ট জার্নালিজমের সাথে জড়িত ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের এক্স ক্যাডেট রম্য রহিম চৌধুরীর সাথে কিছুদিন থেকে যায় মুশতাক। কুমিরের চিন্তাটা এসময়ে আবারও মাথায় আসে এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও ইউএন এউডের এক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মুশতাক। কৃষি নির্ভর আইডিয়া ও ব্যবসা পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের সেই প্রতিযোগিতায় কৃষি নির্ভর না হলেও মুশতাকের 'কুমির পরিকল্পনা' প্রথম দশটি পরিকল্পনার সাত নম্বরে স্থান পায়। এরপর ২০০৪ এর ডিসেম্বরে ভালুকায় মামাকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষের এক তীর্থ খোলে মুশতাক। সেখানেও থাকে নি মুশতাক। চলে আসে কয়েক বছর পর।

তারপর মুশতাক যেমন ছিল আবার তেমনই হয়ে যায়। সেই পুরোনো বিষণ্ণতা এবং লেখালেখির ঝোঁক। মুশতাকের মনে হয় সে চা বাগানের সেইসব দিনগুলো আর কুমির চাষের কথা লিখবে। এই সব লেখালেখির এক পর্যায়ে তার সাথে পরিচয় হয় কার্টুনিস্ট কিশোর এর। এক ব্যাংকের মালিককে নিয়ে কিশোর একটা কার্টুন আঁকে যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয় ২৯ এপ্রিল ২০২০। কিশোর ও মুশতাকের সাথে কথা বলে জানতে পারি ২০২০ এর ২ এবং ৩ মে তাদের বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়। র‌্যাব-৩ তাদের রমনা থানায় সোপর্দ করে ৬ মে এবং একই দিন তাদের জেলে পাঠানো হয়। করোনা অতিমারির কারণে ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কিশোর আর মুশতাকের সাথে দেখা করা সম্ভব হয় নি। মুশতাকের সাথে সর্বশেষ দেখা ২৩ ফেব্রুয়ারিতেই, পুরান ঢাকার কোর্ট কাচারিতে। মুশতাকের তখন পাকানো গোঁফ, দাড়ি আর বাহারি চুল। চিকন শরীর। হাত ও কোমরে দড়ি বাঁধা। কিশোরের কান দিয়ে পুঁজ পড়ছে। চোখে ঠিকমতো দেখতে পায় না, খুঁড়িয়ে হাটে। মুশতাককে চিনতে পারলেও কিশোরকে আমি বড় ভাই হয়ে চিনতে পারি নি! সেই ব্যর্থতা একান্ত আমার। ডা. নাফিজ আর আমি কিশোর-মুশতাকের সাথে খানিক পথ পায়ে হেঁটে তাদের আসামীর গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। মুশতাক বলেছিল- 'বড় ভাই কিশোরকে নিয়ে ভয় হয় খুব। নির্যাতনটা  সে নিতে পারে নি। একটু দোয়া কইরেন যেন ও বেঁচে থাকে। আমিও নিরন্তর ওর জন্য দোয়া করি'।

মুশতাকের দোয়া কবুল হয়েছে। কিশোর জামিন পেয়ে বেঁচে আছে। আর জেলের ভেতর পুরোনো বিষণ্ণতা নিয়ে সবার স্মৃতি পাজরবন্দি করে একা একা চলে গেছে মুশতাক। হার্টফেল করার পর নাকি প্রথমে ভাবা হয়েছিল 'ভান'! তারপর কাশিমপুরের জেল ডাক্তারের দেখাদেখির পর তাকে পাঠানো হয়েছিল শহীদ তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জেল থেকে শেষবার বেরিয়ে আসার সময়েও হয়তো হাত বাঁধা ছিল মুশতাকের। হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। হয়তো এরপরই খোলা হয় তার হাতের বাঁধন। পরদিন মুশতাকের মৃতদেহ আনা হয় লালমাটিয়ার বাসায়, আমিও ওর বিষণ্ণ মুখ দেখতে যাই, তারপর রেখে আসি আজিমপুরে। ৩৯ দিন পর ওর বাবাও মারা যান। মুশতাকের স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন তার মা আর স্ত্রী লিপা।

কিশোর জেলে থাকার সময় কার্টুনিস্ট কিশোর এর জন্য অনেক করেছে মুশতাক। এই ঋণ কখনো শোধ করা সম্ভব না। মুশতাক যেখানে গিয়েছে সেখানে ও যেন আর বিষণ্ণ না থাকে সে কারণে আমার এবছরের বইমেলাতে প্রকাশিত একটা বই ওকে উৎসর্গ করেছি। নাম- 'চোখে রাজার ভালো সাজার রোগ যে এলো দেশে'।

মুশতাক বইটা তোকে পাঠাবো। তোর ঠিকানাটা একটু দিবি ভাই?