Published : 25 Jan 2022, 05:19 PM
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সেখানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা না করে প্রথমে ছাত্রলীগ, পরে পুলিশ দিয়ে তাদের শায়েস্তা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে অত্যন্ত স্থুল, অশোভন ও আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে যখন সারা দেশে ক্ষোভ ও সমালোচনা ছড়িয়ে পড়েছে, ঠিক তখন সেই ঘটনার নিন্দা-প্রতিবাদ না করে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ জন ভিসি এক অনলাইন সভা করে তাকে সমর্থন জানিয়েছেন। তারা একযোগে পদত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন। ভিসিদের এমন কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট ভিসিদের বিরুদ্ধে 'ছি ছি' রব উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান ব্যক্তিকে বলা হয় উপাচার্য। ইংরেজিতে বলা হয় ভাইস চ্যান্সেলর বা ভিসি। মূলত উপাচার্য হচ্ছেন আচার্যর সহযোগী। সাধারণত আচার্য হিসেবে দায়িত্বপালন করেন দেশের রাষ্ট্রপতি বা রাষ্ট্রপ্রধান। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের উপহাস করে বলতেন 'উপাশ্চার্য'! আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কার্যকলাপ 'আশ্চর্য'ই বটে। যাদের কাজ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন মানা এবং সবাইকে মানানো, তারা নিজেরাই নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। তাদের বিরুদ্ধে উঠছে নানা অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি যখন নিজেই নীতিনৈতিকতার বাইরে চলে গিয়ে খবরের শিরোনাম হন, তখন তিনি উপাচার্য না হয়ে 'উপাশ্চার্য'ই হয়ে ওঠেন বটে!
বাংলাদেশের মতো ছাত্ররাজনীতির স্বর্গভূমিতে ছাত্ররা বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে যত ন্যায্য দাবিতেই কোনো আন্দোলন হোক না কেন, ক্ষমতাসীন দল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। কখনও পুলিশ দিয়ে, কখনও ছাত্রলীগ দিয়ে আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোথাও কোনো আন্দোলন শুরু হলে সেই আন্দোলন নিয়ে প্রক্টর, ভিসি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কখনই এগিয়ে আসেন না। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন না। যেন তারা অচ্ছুৎ, অবাঞ্ছিত। তাদের সামনে দাঁড়ানো যাবে না, তাদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। তারা শত্রুপক্ষ। আর শত্রুদের মোকাবিলা করতে ডেকে আনা হয় 'লাঠিয়াল বাহিনী।'
একজন উপাচার্যকে সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল হতে হয়। নীতিনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল হতে হয়। শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের সব অভাব অভিযোগ তিনি শুনবেন। নিদান দেবেন। তার কাজ কেবল শাসন করাই নয়, সহানুভূতি প্রকাশও বটে। কিন্তু সেই জায়গাটায় আমাদের দেশের উপচার্যদের ভূমিকা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেই যেন তারা কালা হয়ে যান। অন্ধ হয়ে যান। কিছুই শোনেন না, কিছুই দেখেন না। তদ্বির ও দলবাজির জোরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একবার উপাচার্য হয়ে গেলে খুব দ্রুতই দুর্নীতিবাজ ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। তখন তারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে মিলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন। এ ব্যাপারে, নীতি, আদর্শ, বিবেক, শিক্ষকের মর্যাদা কোনো কিছুই কাজ করে না।
আমাদের দেশে যখন যে দল ক্ষমতাসীন হয়, তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, শাখা-প্রশাখার বিস্ফোরণ ঘটে। বিচিত্র নামে ও রূপে তাদের অসুরিক আবির্ভাব লক্ষ করা যায়। সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন পুরোপুরি 'ন্যাটো-বাহিনী' হিসেবে আবির্ভুত হয়। নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে প্রতিপক্ষ কিংবা তাদের 'বশ্যতা স্বীকারে অনিচ্ছুক' সবাইকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার আয়োজন চলতে থাকে। গত তিন দশকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল-শিবিরের বাড়াবাড়ি এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগের তাণ্ডব আমরা দেখে এসেছি।
আমাদের অর্থনীতিতে পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) তেমন সফল না হলেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অঙ্গসংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে এই কৌশলের সফল প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। প্রতিপক্ষ দমন, নিজেদের মধ্যে 'বীরত্ব চর্চা', নিজেদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা নিজেরা করা, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসনকে 'সহায়তা' করা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে ছাত্রলীগ দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করছে। তারা এখন দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, হত্যা, দখলদারীসহ নানারকম বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। আর তাদের দোসর হিসেবে ভূমিকা পালন করছে প্রশাসন ও পুলিশ। সরকার, পুলিশ, প্রশাসন, সরকারি দল, ছাত্রলীগ– সব এখন মিলেমিশে একাকার!
এখন অনেক ছাত্রের মূল ধান্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের লাঠিয়াল বা ক্যাডার হওয়া। কারণ সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনে নাম লেখাতে পারলে জীবন একেবারে ফকফকা। তাদের কোনও অভাব থাকে না। পাওয়া যায় যা খুশি তাই করার অবাধ স্বাধীনতা। যেভাবে খুশি টাকা উপার্জনের সুযোগ। অস্ত্রবাজি, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ডাকাতি করার লাইসেন্স। এ দুর্বৃত্তরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জিম্মি করে রাখবে আর অন্য সবাই তাদের দয়া বা মর্জির দিকে তাকিয়ে থাকবে। এটাই অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।
সরকারি দলের অনুগত ক্যাডার বাহিনী শিক্ষাকে লাটে ওঠানোর চূড়ান্ত আয়োজনে ব্যস্ত। অথচ এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের তেমন কোনও ভাবনা-চিন্তা-অনুশোচনা নেই, নেই কোনও বিকার। তারা বসে বসে যেন মজা দেখছেন। আর মাঝে মাঝে বায়বীয় হুঙ্কার ছাড়ছেন। কিন্তু এই গুণ্ডাদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর কোনও উদ্যোগ বা সংকল্প এখনও দেখা যাচ্ছে না। তবে কি শিক্ষাকে ধ্বংস করে, শিক্ষাঙ্গনকে অচল করে বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ক্ষমতায় থাকতে চান? দেশ-জাতির কল্যাণ করতে চান? এটাই কি বর্তমান সরকারের 'উন্নয়নের রাজনীতি'র নমুনা?
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে যারা আছেন, তারাও যেন ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারে পরিণত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রক্টোরের ভূমিকা দেখলে মনে হয়, তারা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক! ক্ষমতাসীন দলের নির্লজ্জ দালালি করা ছাড়া তাদের কোনও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। ক্ষমতাসীন দলের অশিক্ষিত কিছু দুর্বৃত্তের পায়ের নিচে বসে, তাদের ইচ্ছের দাস হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব নিতে এসব শ্রদ্ধেয় 'শিক্ষাবিদ' ও সম্মানিত ভিসিদের কোনও আপত্তি দেখা যায় না। এটাকে আমরা কী বলব, দায়িত্ব গ্রহণের, দায়িত্ব পালনের অসীম আগ্রহ? নাকি পদ ও ক্ষমতার প্রতি অসীম লোভ? দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা?
বিশ্বদ্যিালয়ের আজকের এই অধঃপতনের জন্য বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির উত্তরোত্তর প্রসারই সরাসরি দায়ী, সন্দেহ নেই। ছাত্র আর শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরম সর্বনাশের পথে এগিয়ে গেছে। শিক্ষকদের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল সব সময়ে ছিল, কিন্তু এতে উচ্চফলনের সার দেওয়া হয় ১৯৭০-এর গোড়ায়, তথাকথিত স্বায়ত্তশাসন আইন পাস করে। ধারণাটা প্রগতিশীল ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু নিষ্পাপ শিশু যেমন বড় হয়ে একদিন খুনিতে পরিণত হতে পারে, এই আইন থেকে তেমনি বিশ্ববিদ্যা চর্চার ধারাটাই লুপ্ত হয়েছে। প্রথম কয়েক বছর এই বিষবৃক্ষে ফল ধরেনি। কিন্তু বিভাগীয় কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করার জন্য, ডিন হওয়ার জন্য, উপাচার্য হওয়ার জন্য দলীয় সমর্থক বাড়ানোর প্রয়াস যখন বেড়ে গেল, তখন এই বিষবৃক্ষে ফল ধরতে আরম্ভ করল। ফলের ভারে বৃক্ষটিই এখন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে বেশির ভাগ শিক্ষকই নিযুক্ত হন বিভাগের সদ্য পাস করা ছাত্রদের মধ্য থেকে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি যে নিজের দলের সমর্থক হবে– এমন গ্যারান্টি তো নেই। কাজেই নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় অনেক ভালো ছাত্র বাদ পড়লেন। নিযুক্ত হলেন দলীয় সমর্থকেরা। এই সমর্থকেরা বেশির ভাগই কম যোগ্যতাসম্পন্ন। কেউ কেউ রীতিমতো অযোগ্য। তাদের ছাত্ররা লেখাপড়া শিখল তাদের থেকেও কম। তাদের ছাত্ররা তাদের থেকেও কম। এখন সদ্য পাস করে যারা শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হচ্ছে, তারা প্রথম যারা দলীয় বিবেচনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন সত্তরের দশকে, তাদেরই নাতি-নাতনি– তৃতীয় প্রজন্মের খারাপ ছাত্র। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছে দলাদলির আখড়ায়। দলাদলি বিভাগে, ফ্যাকাল্টিতে, শিক্ষক সমিতিতে, সিনেট নির্বাচনে। এমনকি ছাত্রদের ফলাফল নিয়েও দলাদলি। কারণ, অনুগত ছাত্রকে প্রথম শ্রেণি দিয়ে দিতে পারলে তাকেই আবার বিভাগে নিয়োগ দিয়ে নিজের দল ভারী করা যায়। শিক্ষকদের অনেকেই শ্রেণিকক্ষে গিয়ে লেখাপড়া শেখাতে চান না, অথবা শেখাতে পারেন না।
এখন তো ক্ষমতাসীন দল, তাদের ছাত্র সংগঠন আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একাকার হয়ে গেছে!
কবি বলেছিলেন, স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়? হ্যাঁ চায়, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দলবাজ ভিসি-প্রোভিসি-প্রক্টরসহ শিক্ষকদের অনেকেই চায়!