Published : 11 Jul 2021, 09:28 PM
'বিশ্ববিদ্যালয়' একটি কৃতঋণ অনুবাদ শব্দ, বাংলায় কিংবা বিশ্বের যে কোনও ভাষায়। যে লাতিন শব্দের অনুকরণে সংস্কৃত ভাষায় 'বিশ্ববিদ্যালয়' শব্দটি গঠিত হয়েছিল, সেই 'ইউনিভার্সিটি' শব্দের অর্থ ছিল 'গিল্ড', 'সমিতি' বা 'সংঘ'। নাপিত, কামার, কুমার, ছাত্র, শিক্ষক সব পেশাদার বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের সমিতি গড়ে উঠছিল ইউরোপে, মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বে, দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে, বিশেষ করে ইতালিতে এবং ফ্রান্সে। বিভিন্ন গিল্ডের মধ্যে ছাত্র-সমিতি এবং শিক্ষক-সমিতির নাম হিসেবে 'ইউনিভার্সিটি' শব্দটি স্থায়ী হয়েছিল অজানা কোনও ভাষাতাত্ত্বিক কারণে। ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল দুই প্রকার: ছাত্রপরিচালিত এবং শিক্ষক পরিচালিত। প্রথম দুই বিশ্ববিদ্যালয়: বোলোনিয়া এবং প্যারিস। প্রথমটি ছিল নিছকই এক ছাত্র-সমিতি, দ্বিতীয়টি শিক্ষক-সমিতি।
মধ্যযুগের ইউরোপে ছাত্র ও শিক্ষক সমিতি গড়ে ওঠার কমপক্ষে ১৩টি কারণ রয়েছে এবং 'বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস: আদিপর্ব' পুস্তকের (প্রকাশক: প্রথমা, ২০১৮) দ্বিতীয় ও সর্বশেষ অধ্যায়ে এ কারণগুলো সবিস্তারে বলা হয়েছে। অনুরূপ কারণ পৃথিবীর আর কোথাও, কখনও সৃষ্টি হয়নি, সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ও পৃথিবীর আর কোথাও, কখনও গড়ে ওঠেনি। ভারতের তক্ষশীলা, নালন্দা, প্লেটো-অ্যারিস্টটলের অ্যাকাডেমিয়া-লাইসিয়াম, আরব দেশের মাদ্রাসা বিদ্যায়তন অবশ্যই ছিল, হয়তো আজকের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় মহানতর ছিল, কিন্তু সেগুলো কোনোমতেই 'বিশ্ববিদ্যালয়' ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠান দূরে থাক, (ছাত্র/শিক্ষক সমিতি অর্থে) 'বিশ্ববিদ্যালয়' শব্দের প্রতিশব্দ সংস্কৃত, গ্রিক, আরবিতে ছিল না কখনই, থাকার কথা নয়, কারণ বস্তু না থাকলে শব্দ সৃষ্টি হবার কোনো কারণ নেই।
আদি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে সৃষ্টি হয়েছিল অক্সফোর্ড এবং অক্সফোর্ডের আদলে স্থাপিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আদিতম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা কলেজে ভর্তি হতো, কলেজের হলে থাকতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও হলে বা কলেজে ভর্তি হয়, হল বা কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে সনদ পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতপক্ষে শুধু পড়ানো এবং পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করে আদি প্যারিস বা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। হাউজ টিউটর, প্রভোস্ট, প্রক্টর এই সব পদ এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে, যেমন ছিল প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্ততপক্ষে কাগজে-কলমে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিরূপের সাক্ষাৎ প্রতিরূপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন একটি প্রশাসন পৃথিবীতে খুব কম দেশেই আছে। এই প্রশাসন আদৌ কাজের কিনা, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন।
মাদ্রাসার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা করে কিংবা মাদ্রাসার চেয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হীন দেখিয়ে নিজের মনের কোনও তামাদি ঘা চুলকে শান্তি পাওয়া যেতেই পারে, কিন্তু সত্য হচ্ছে, 'মাদ্রাসা', 'টোল', 'বিশ্ববিদ্যালয়'- এই প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্ম ও কর্ম দুইই আদ্যন্ত আলাদা, কী ইতিহাসে, কী বাস্তবে। 'মাদ্রাসার অনুকরণে বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি হয়েছিল ইউরোপে'- এই কথা যে বলবে সে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস জানে না, কিংবা তার মনের গোপন কুঠরিতে গোপনতর কোনো রাজনৈতিক এ্যাজেন্ডা রয়েছে। একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সাধারণত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিজেকে অবশেষে কৃতার্থ বোধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীকে কপালদোষে মাদ্রাসায় ফেরৎ গিয়ে 'আলিম' কিংবা 'ফাজিল' হতে বাধ্য করা হলে সে যে অতিমাত্রায় অসুখী হবে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কি অবনতি হয়েছে? আগেও বা কী এমন উন্নত ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়? আম গাছে কি কাঁঠাল ফলবে? যেমন দেশ, তেমন জনগণ, তেমনইতো বিশ্ববিদ্যালয় হবে। স্থান-কাল-পাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়সহ একটি দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানে সেই দেশের পাত্রসমূহের বুদ্ধিবৃত্তি ও স্বভাবের প্রতিফলন হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানের অবনমন কখনই সেই প্রতিষ্ঠানের দোষে হয় না, হয় প্রতিষ্ঠানকে যারা ধারণ করে, মুখ্যত সেই সব পাত্রের দোষে এবং গৌণত স্থান ও কালের দোষে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাদ্রাসারও অধম হয়ে গেছে, মানলাম, কিন্তু মহান সব শিক্ষকের দশকব্যাপী উপস্থিতি সত্ত্বেও আমাদের কালের একেকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কেন নিছক মুনাফাখোর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রয়ে গেছে, সেই প্রশ্ন জাতি করতেই পারে। যত দুরাবস্থাই হোক, বাঘ কখনও খাটাস হয় না, যদিও দুই প্রাণীর গায়েই বোঁটকা গন্ধ আছে। বাংলা বই যারা পড়েন, তারা দয়া করে বাংলা ভাষায় লেখা 'বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস' শীর্ষক সামান্য বইটি একবার অন্তত পড়ে নিয়ে তারপর ইচ্ছে হলে মিডিয়ায় বা অন্যত্র বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আবোল-তাবোল বকতে পারেন। যত বেশিই হোক না কেন পরিমাণে, একপেশে তথ্য ভিজা খড়ের মতো, সাবজেক্টিভ বিচারের কোমড়ভাঙা চুঙা দিয়ে যত ফুৎকারই তাতে করা হোক না কেন, ধোঁয়া আর ছাইয়ে চোখমুখ লাল হওয়াই সার হবে, কদাপি আগুন ধরবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নাকি ইংরেজি-বাংলা লিখতে-পড়তে জানেন না, সুতরাং এটা বিশ্ববিদ্যালয় নয়। যুক্তির বলিহারি যাই! কোনো কোনো শিক্ষক অবশ্যই ভালো লিখতে পারেন না, কিন্তু সবাই যে পারেন না, এমনতো নয়। যদি একজনও ভালো লিখতে সক্ষম হয়ে থাকেন, মহাকালের বিচারে সেটাও যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু মূল প্রশ্ন সেটা নয়। লিখতে জানলেই কি 'লেখক' হওয়া যায়? ভালো লিখতে কি আদৌ শেখানো যায় কাউকে? 'তিন তি বিনা নাহি গতি। সরস্বতী, প্রস্তুতি, গুরুভক্তি।' (রূপকার্থে) সরস্বতির আশীর্বাদ কিংবা (অভিধার্থে) লেখার প্রতিভা যদি আপনার না থাকে, লেখার দীর্ঘ প্রস্তুতি যদি আপনি সময় থাকতে না নিয়ে থাকেন (সময় গেলে সাধন হবে না!), আপনার কিংবা জগতের দুর্ভাগ্যক্রমে কমপ্যাটিবল গুরু কিংবা মেন্টরের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ যদি না হয়ে থাকে, তবে আপনার লেখক হবার সম্ভাবনার গুড়ে বালি। শাহ আবদুল করিম, নজরুল, লালন, রবীন্দ্রনাথ… এই লোকগুলো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিলেন যে এত ভালো বাংলা তারা লিখে গেছেন? এরা প্রত্যেকে সরস্বতীর আশীর্বাদধন্য। প্রতিভা থাকলে লেখক হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াও মাড়াতে হয় না।
লিখতে শেখানো বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এ কাজতো প্রাথমিক, উচ্চ ও মহাবিদ্যালয় পর্যায়ে হয়ে যাওয়ার কথা। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে যে লিখতে শিখবে না, জীবনেও সে লিখতে শিখবে না। যার হয় না ন-য়ে, তার হয় না নব্বইয়ে। আহমদ ছফা যে এত উত্তম বাংলা লিখতেন, তার সেই গুণ কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে হয়েছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছফার সব সতীর্থ কি তার মতো বাংলা লিখতে পারতেন, লিখেছেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে মাদ্রাসা কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যদি উন্নততর প্রতিষ্ঠানই হবে, তবে সেখানকার শিক্ষক-ছাত্ররাই বা কেন ইংরেজি-বাংলা-আরবিতে লিখেটিখে তুলকালাম করছেন না? যিনি বা যারা এই অভিযোগগুলো তুলছেন, তারা বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সহকর্মীরাইবা কী এমন লিখে উদ্ধার করেছেন, এ যাবৎ, বাংলা কিংবা ইংরেজিতে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী করতে পেরেছে কিংবা পারেনি, দেশেবিদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কার্যক্রম, অর্জনই তার প্রমাণ দেবে। বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়! ফলের জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের FALL হয়েছে বলে যারা দাবি করেন, তাদের মুখ বন্ধ করার জন্যে অতি সহজ একটি গবেষণার প্রস্তাব করছি। যত নৈর্ব্যক্তিক চিন্তক, প্রশ্নক, ছিদ্রান্বেষক, নিন্দক আছেন বাংলাদেশে, তাদের শতকরা কত ভাগ ঢাকা কিংবা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, কত ভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, আর কত ভাগ মাদ্রাসার প্রাক্তনী, গবেষণা করে বের করা হোক। বাংলাদেশের কমপক্ষে এক শ চিন্তক-প্রশ্নক মোল্লার ('জ্ঞানী' অর্থে) উপর একটি কোয়ান্টিট্যাটিভ-কোয়ালিট্যাটিভ গবেষণা করলেইতো এই প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে। খামাখা ফাঁকা আওয়াজ করে লাভ আছে কোনো?
মুদ্রার অপর পিঠে তাকানো যাক। তালিতো এক হাতে বাজে না। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ হয় কলেজের মতো করে, পড়ানো হয় কলেজের মতো করে, পরীক্ষা নেওয়া হয় কলেজের মতো করে। ইউজিসি (you-জি see) সম্প্রতি যে নিয়োগনীতি রচনা করেছে, সেটিও 'কলেজ-কিসিমের'। জন্মগতভাবে প্যারিস, অক্সফোর্ড ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ কিংবা কলেজের সমষ্টি ছিল বটে, কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। বিশ্ববিদ্যালয় যারা চালান এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালানেওয়ালারা যাদের কথায় চলে, সেই সরকারি লোকজন, এদের প্রত্যেকের মানসিকতা একেক জন কলেজের প্রিন্সিপাল বা উচ্চবিদ্যালয়ের এক্সপার্ট হেডমাস্টারের মতো। পরিচালকের মানসিকতা, কর্মকাণ্ড সবই যখন কলেজ-সুলভ, তবে প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হয় কী করে? টেম্পো ড্রাইভারের পক্ষে হেলিকপ্টার চালানো সম্ভব হবার কথা নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত দায়িত্ব: চিন্তা করতে শেখানো, প্রশ্ন করতে শেখানো। ধর্মীয় বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, টোল বা কনভেন্ট বিনা প্রশ্নে মান্য করতে শেখাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মাদ্রাসার পার্থক্যটা এখানেই। যজন-যাজন-অধ্যাপন- প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণের এই তিনটি কাজ ছিল- নিজে প্রার্থনা করা, অন্যের প্রার্থনায় সহায়তা করা এবং অধ্যাপনা করা। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরও তিনটি কাজ: নিজে গবেষণা করা, অন্যকে দিয়ে গবেষণা করানো এবং অধ্যাপনা করা। কলেজ শিক্ষকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের পার্থক্য হচ্ছে, প্রথম দুটি কাজ করতে তিনি বাধ্য নন। গবেষণা করা যদি সম্ভব নাই হয়, তবে একজন পেশাদার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অন্য দেশে, অন্য ভাষায় যে গবেষণা হয়েছে, সেটার নির্যাস জনজ্ঞাতার্থে সরল বাংলায় প্রকাশ করবেন। উদ্ভাবন বিলম্বিত হতে পারে, জ্ঞানার্জন কদাপি নয়। থাইল্যান্ডে শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক থাই ভাষায় বিদেশের টেক্সটবই অনুবাদ না করলে তার প্রমোশন হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমবয়সী চীনের অতি সাধারণ একটি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনার সংখ্যা ৫,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুদ্রিত গ্রন্থের সংখ্যা কি ১০০ ছাড়িয়েছে? আশ্চর্য কী যে চীন সম্প্রতি মঙ্গলে রোবোট নামিয়েছে, আর বাংলাদেশ ভাসানচরে পাঠিয়েছে রোহিঙ্গাদের। চীনা রোবটের 'নাম' থেকে শুরু করে 'কাম', অর্থাৎ রোবট পাঠানোর পিছনে নির্মাণপ্রকৌশল, বিজ্ঞান সব চর্চিত হয়েছে চীনা ভাষায়, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এখনও দ্বিধায় থাকেন, বাংলায় পড়ানো আদৌ উচিত হবে কিনা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রধানও (ব্যক্তিগত আলাপ) মনে করেন, উচ্চশিক্ষার মাধ্যম ইংরেজিই হওয়া উচিত। অথচ অর্ধ দশক আগে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা বলেছিলেন, যে লোক বাংলায় বিজ্ঞান পড়াতে জানে না, সে বাংলা জানে না, বিজ্ঞানতো জানেই না। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে যাবতীয় সুস্থির মস্তিষ্কের পণ্ডিত বলেছেন, উচ্চ-মধ্য-নিম্ন, যাবতীয় শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত তিনটি ভাষা: বাংলা, বাংলা এবং বাংলা। আমরা কার কথা বিশ্বাস করবো?
বিশ্বের জ্ঞান বাংলায় প্রকাশ করাটা ঢাকা (এবং অন্য সব পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আদৌ মাথাব্যথা নয়। এরা যে বাংলা জানেন না, তার প্রমাণ, এরা বাংলায় পড়ান না, লিখেন না। ইংরেজিও জানেন না, তার প্রমাণ, ইংরেজিতেও তাঁদের বইপত্র খুব একটা লিখতে দেখা যায় না। দুই একজন লিখেন বৈকি, কিন্তু ব্যতিক্রম কখনই নিয়ম নয়। করোনাকালের তুলনামূলক অবসরে বাংলাদেশের কতজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কয়টি পাঠ্যবই (অন্ততপক্ষে 'অপাঠ্য' নয়!) লিখে নিজের বেতনটি অন্তত হালাল করেছেন?
'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ-সুখ ও প্রতিকার' পুস্তকটি (প্রকাশক: প্রথমা, ২০২১) ঢাকাসহ বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কমবেশি ত্রিশটি অ-সুখ এবং এর প্রতিকারের ব্যবস্থাপত্র। সরল বাংলায় লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রোগের বিবরণ আর ব্যবস্থাপত্রটা কি কর্তাব্যক্তিরা কেউ পড়ে দেখেছেন? রোগী এবং অভিভাবক যখন ঔষধ সেবন দূরে থাক, প্রেসক্রিপশনটাও পড়ে দেখে না, তখন মনে হয়, রোগটাকে দুধ-কলা খাইয়ে পোষাতেই তার নিত্যানন্দ হচ্ছে এবং নিজস্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে। অথচ শতবর্ষ পূর্তিতে ওয়েবিনারের পর ওয়েবিনারের হুজ্জত করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং তার অ্যালামনাইয়েরা। হুজ্জতে বঙ্গাল, হিকমতে চীন।
শতবর্ষ পূর্তিতে অভিযোগের যে তীরগুলো এসে লাগছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদোম শরীরে (কারণ কিছুই তার লুকানোর নেই!), সেগুলো যদি 'কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা' মনে হয়, তবে বেচারা মোল্লা সল্টকে দোষ না দিয়ে প্রথমে ঘা-টা সারানোর চেষ্টা করা উচিত। 'উপদেশে হি মূর্খানাম প্রকোপায় ন শান্তয়ে!'- সংস্কৃত প্রবাদ, যার অর্থ: 'মূর্খকে উপদেশ দিলে তার রাগ হয়, মন শান্ত হয় না।' প্রথমত, মোল্লা সল্টে আয়োডিন আছে এবং সেই লবণ গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বুদ্ধির জড়তা কমলেও কমতে পারে; দ্বিতীয়ত অচিকিৎসিত ক্ষত মারাত্মক প্রমাণিত হতে পারে এবং মরা একটি বাঘ কোনো বিচারেই জীবিত কোনো খাটাসের চেয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।