Published : 22 Mar 2021, 07:36 PM
২০২০ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের জরিপের তথ্য অনুসারে, এখন রাজধানীর বায়ুদূষণের উৎসের ক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত (মার্চ, ২০২১) এই জরিপের তথ্য অনুসারে বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটার দায় মাত্র ১০%। ঢাকার বাতাসে দূষিত বস্তুর উৎস হিসেবে ইটভাটার স্থান এখন দখল করেছে যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া (৫০%)। অথচ, এক যুগ ধরে ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হিসেবে ইটভাটাকেই দায়ী করা হতো। ২০১২ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপের তথ্য অনুসারে বায়ুদূষণের জন্য ৫৮% দায়ই ছিল মূলত ইটভাটার ধোঁয়ার।
সঙ্গত কারণেই অনেকগুলি প্রশ্ন ভেতরে জন্ম নেয়- এক) আমরা কি প্রকৃত অর্থেই এমন কিছু করেছি যাতে ইটভাটার দায় একেবারে এতটা কমে আসে? দুই) অন্য দূষণের পরিমাণ লাগামহীনভাবে কি সত্যিই বেড়ে গেছে যে, সেখানে ইটভাটার দূষণ বেশি হলেও এখন তুচ্ছ বলে মনে হয়? তিন) ইটভাটাগুলি কি তবে ঢাকার বাইরের দূষণ বাড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা রাখছে? চার) এসডিজি অর্জনে ইটভাটা বন্ধ করার পরিকল্পনা থাকলেও সেটার বাস্তবায়নে আদৌ কি কোনো অগ্রগতি হয়েছে?
ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করে তোলার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও প্রস্তাব রাখা হয়েছে। যে সকল বিষয় নিয়ে প্রায় এক যুগ সময় ধরে জোরালোভাবে আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল- বায়ুদূষণমুক্ত ইট তৈরির প্রযুক্তি ব্যবহার সুনিশ্চিত করা; মাটি দিয়ে ইট তৈরি না করে বিকল্প হিসেবে বালিসহ অন্যান্য উপাদান দিয়ে ইট তৈরি করা; ইটের পরিবর্তে হলোগ্রাম বা ব্লক বা কংক্রিটের ব্যবহার বাড়ানো; পরিবেশবান্ধব এসব প্রযুক্তির ব্যবহার যে গুণ, মান এবং দাম প্রতিটি দৃষ্টিকোণ থেকেই ভাল, এ সম্পর্কিত ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসবের কিছুই আমরা সুনিশ্চিত করতে পারিনি। তাই ইটভাটাজনিত দূষণ কমিয়ে আনতে সত্যিকারার্থেই কি বা কতটুকু করেছি আমরা, সে প্রশ্নটি এখনো থেকেই যায়।
সচেতনতা সৃষ্টি:
ইটভাটার দূষণ যে অনেকভাবে ক্ষতি করছে একথা অনস্বীকার্য এবং একাধিক গবেষণাতেও প্রমাণিত। ইটভাটার দূষণে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি, মাটির ক্ষতি, আবাদি জমির স্বল্পতা সৃষ্টি, উৎপাদন হ্রাস এবং সার্বিকভাবে কৃষির ক্ষতি, পরিবেশের ক্ষতি, ভবিষ্যত প্রজন্মের ক্ষতি, সৌন্দর্য ও বিনোদনের ক্ষতিসহ মারাত্মক অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। এ নিয়ে প্রচুর তথ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে মিডিয়াতে উঠে এসেছে। তারপরও এসব নিয়ে জাতীয়ভাবে জনসচেতনতামূলত লক্ষ্যণীয় কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
আইন অনুসারে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের যে কোনো ধরনের কাজে নিয়োগ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধিত শ্রম আইন অনুসারে ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোররা হালকা কাজ করতে পারবে। কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে ঝঁকিপূর্ণ কাজের ধরন ও ঘণ্টা নিয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে- কিন্তু অসংখ্য ইটভাটাতেই তা মানা হয় না। এ বিষয়েও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে।
মাটি দিয়ে ইট তৈরি না করে বিকল্প হিসেবে বালি ও তুষের ছাইসহ অন্যান্য উপাদান দিয়ে ইট তৈরি করা কিংবা ইটের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ব্লক যেমন- হলো ব্লক, সলিড ব্লক, থার্মাল ব্লক ইত্যাদি জনপ্রিয় করে তুলতে সচেতনতা ও উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। পরিলক্ষিত হয় না জ্বালানী সাশ্রয়ী ও কম ধোঁয়া নির্গতকারী চুল্লী ব্যবহার করার কোনো উদ্যোগ। তাই এ সকল বিষয়েও ব্যাপক প্রচার ও সচেতনতা সৃষ্টি বিশেষভাবে জরুরি। জরুরি যে আইনটি হয়েছে সেটি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির এবং তা মেনে চলতে উৎসাহিতকরণ কর্মসূচির।
ইটভাটার সঠিক সংখ্যা নির্দিষ্টকরণ:
গত ২২ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখের প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নিবন্ধ অনুসারে ঠাকুরগাঁও "জেলায় ইটভাটার সংখ্যা ১১৯টি এবং এর মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত স্থায়ী চিমনিবিশিষ্ট ভাটা ৭০টি। এ ভাটাগুলোর কোনোটিরই জেলা প্রশাসনের অনুমতি সনদ (লাইসেন্স) নেই। আর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে মাত্র তিনটির। এর মধ্যেও দুটি নবায়ন করা হয়নি। পরিবেশের ছাড়পত্র বা লাইসেন্সের তোয়াক্কা না করে ভাটাগুলোতে ইট পোড়ানো শুরু হয়েছে।" অন্যদিকে গত ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, চট্টগ্রাম জেলার "বৈধ-অবৈধ মোট কতটি ইটভাটা রয়েছে তার হালনাগাদ হিসাব নেই সরকারি কোনো সংস্থার কাছে"। এছাড়া জেলার মোট ভাটার ৮০ শতাংশই অবৈধ।
ফলে ইটভাটাসমূহের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ হওয়াটা সবার আগে জরুরি। সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাপকাঠি সুনির্দিষ্ট করে সেটা করা যেতে পারে। দ্রুততার সাথে, সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় এই কাজটি সম্পন্ন করার করার জন্য এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রয়োজনীয় তথ্য হালনাগাদ রাখার জন্য, এক্ষেত্রে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার কীভাবে সুনিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ও আলাদাভাবে আলোচনা এবং ভাবার অবকাশ আছে বলেই আমার কাছে মনে হয়।
সরকারিভাবে দেশে বর্তমানে ইটভাটার সংখ্যা প্রকৃত অর্থেই কত, তা সুনির্দিষ্টভাবে বের করাটা খুবই জরুরি হবে। তা না হলে পূর্বের বছরের তুলনায় চাহিদা বাড়ছে না কমছে, বাড়লে সেটি কারা (কোন ধরনের ভোক্তা) গ্রহণ করছেন- সেক্ষেত্রে ইটের বিকল্প ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে, কৃষিজমির উপরিভাগ (টপ সয়েল) থেকে আসলেও কতটুকু মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে, এসব তথ্যও সহজেই বের করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটা সম্ভব হবে।
আইনের সফল প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ:
আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমরাই (বাংলাদেশ) প্রথম ইটভাটা আইন করেছি। ইট তৈরির জন্য ভাটা স্থাপনসংক্রান্ত একটি আইনই দেশে কার্যকর আছে। সেটির নাম ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ২০১৯ সালে ইটভাটায় মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিশেষ করে টপ সয়েলের ব্যবহার বন্ধ করা, ইটভাটার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা, নির্দিষ্ট এলাকায় ইটভাটার জায়গা ও ভাটার সংখ্যা নির্ধারণ, লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা চালালে দুই বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয়দণ্ডের বিধান সংযোজন করে 'ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৯' নামে আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আইনটি কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে নানান প্রশ্ন ও সমালোচনা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
এই আইন অনুযায়ী, লাইসেন্স ছাড়া ইট তৈরি করার সুযোগ নেই। লাইসেন্স ছাড়া কেউ ইটভাটা চালু করলে আইনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত)-এর ৮ ধারা অনুযায়ী, বছরে একাধিক ফসল উৎপাদিত হয়, এমন কৃষি জমিতে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। এছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়েই দেশের অনেক স্থানে আমরা এই আইনের লঙ্ঘন হতে দেখেছি। যেমন, গত ৩০ জানুয়ারি, ২০২১ তারিখে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল- মানিকগঞ্জ জেলার "শিবালয়ে তিন ফসলি জমিকে এক ফসলি দেখিয়ে ইট ভাটার অনুমোদন!"
এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে রাজধানীর চারপাশের সকল অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল উচ্চ আদালত থেকে। ৩০ জানুয়ারি, ২০২১ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, "পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এই আদেশের পর দুই বছরে রাজধানীর আশ-পাশের ১০২টি ইটভাটা অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে সরেজমিনে এমন অনেক 'বন্ধ' ইটভাটা পাওয়া গেছে, যেগুলোতে প্রকাশ্যে ইট পোড়ানোর কাজ চলছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অবৈধ ইটভাটা বন্ধে একাধিকবার অভিযান চালায় পরিবেশ অধিদপ্তর। অভিযানের তথ্যও অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আদালতকে অবহিত করা হয়। তবে অভিযানের পরও অবৈধ ইটভাটা চালানোর অভিযোগ আসে।" প্রতিবেদনটিতে এমন অভিযোগের বেশ কয়েকটি গুরুত্ব সহকারে তুলেও ধরা হয়। প্রতিবেদনটি অনুসারে এটাও খুব সুস্পষ্ট যে, পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া অনেক ইটভাটায় প্রকাশ্যে ইট পোড়ানো হচ্ছে। ফলে আইন যতটুকু আছে তার সুষ্ঠু প্রয়োগ হচ্ছে না, এটা সুস্পষ্ট।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ এর ১৯(২) উপ-ধারা (১) এর বিধান সাপেক্ষে, "পরিবেশ আদালত আইনের অধীন প্রতিষ্ঠিত পরিবেশ আদালত বা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত ব্যতীত অন্য কোনো আদালত এই আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ আমলে গ্রহণ ও উহার বিচার করিতে পারিবে না।"
সঙ্গত কারণেই পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০-এর প্রসঙ্গ চলে আসে। সেই আইনের সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও প্রবর্তন অংশে অর্থাৎ একেবারে শুরুতেই উল্লেখ করা আছে "এই আইন পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০ নামে অভিহিত হইবে এবং ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে"। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এতবছরেও সব জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপন করতে পারিনি আমরা। তবে অতি সম্প্রতি (গত ১০ মার্চ, ২০২১ তারিখে) পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশের সকল জেলায় পরিবেশ আদালত প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যা নিঃসন্দেহে কিছুটা হলেও মনে আশার সঞ্চার করে।
প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ থাকে যে, ২০০০ সালে মূলত পরিবেশ আদালত আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল, তারপর ২০১০ সালে এই আইনটি সংশোধন করা হয়। আইনটিকে যুগোপযোগী করে তোলাটাও এখন খুবই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এক্ষেত্রে পরিবেশবিষয়ক গবেষণা সংস্থা, বিজ্ঞানী ও নাগরিক সংগঠনসমূহকে যুক্ত করে যদি কাজটি করা হয়, তাহলে তার সুফল অনেকাংশে বেশি হবে বলেই আমার কাছে মনে হয়।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ইটভাটা মারাত্মক পরিবেশ দূষণকারী বা লাল ক্যাটাগরির শিল্প হিসেবে চিহ্নিত। সেখানে ইটভাটার জন্য মাটি তুলতে হলে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হয়। বাংলাদেশে এখনো তা কমদূষণকারী হিসেবে চিহ্নিত এবং মাটি তুলতে কোনো সমীক্ষা করতে হয় না। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের জরিপের তথ্য অনুসারে, যা এই লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীর বায়ুদূষণের উৎসের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছে, তাতে সনাতনী ইটভাটা কার্যক্রম আরও উৎসাহিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
প্রসঙ্গত, আরেকটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। সেটি হলো- বাংলাদেশ থেকে ভারতে যে সকল পণ্য রপ্তানি হয়, তার মধ্যে একটি পণ্য হলো ইট। বাংলাদেশের আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের ত্রিপুরাতে ইট রপ্তানি হয়। অবিলম্বে এই সর্বনাশী বাণিজ্য বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব ইট রপ্তানি করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়াটাও একান্ত জরুরি হবে।
ভাটা ইস্যু যেন ভাটা না পড়ে
একথা বলা বাহুল্য যে, দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়নসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে নির্মাণশিল্পে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে। আর নির্মাণ শিল্পের অন্যতম উপাদান ইট। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই ইট প্রস্তুতিতে এখনও পুরাতন অর্থাৎ সনাতনী পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সকল ইটভাটায় অধিক হারে নিম্নমানের জ্বালানী ব্যবহারের কারণে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসসহ নানা ধরনের বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হচ্ছে।
শুধু দূষণের ক্ষেত্রেই নয়- পরিবেশ, স্বাস্থ্য, কৃষি, ভবিষ্যতসহ সামগ্রিকভাবে সবদিক বিবেচনায় সনাতনী পদ্ধতির ইটভাটাসমূহ অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করছে। আর সেই গুরুত্ব অনুধাবণ করেই সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী ইট তৈরিতে মাটির ব্যবহার ২০২০ সালের মধ্যে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু সেই অঙ্গীকার অর্জন করতে সরকার ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে ইটের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। যদিও সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের কর্মকাণ্ড প্রয়োজন তা এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যেমন, ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক শিল্প উৎপাদন ও বিকাশে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই, আইনে বিধি-নিষেধ থাকলেও সেসব লঙ্ঘন করেই কৃষিজমি, জলাশয় এবং নদী থেকে নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ মাটি।
সভ্য দেশসমূহে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে নির্মাণকাজে পোড়া ইট ব্যবহার করা হয় না। অথচ আমাদের দেশে আইন থেকেও যেন আইন নেই- এ বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। সময়ের সাথে সাথে আইন পরিবর্তন করা যেমন জরুরি, তেমনিভাবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতেও সক্রিয়তা আনার জন্য শিক্ষণীয় চিহ্নিত করে, প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা দরকার। ইটভাটার কারণে যেসব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তা কখনোই এবং ক্ষেত্রবিশেষে খুব সহজে পূরণ করা যাবে না কখনোই। তাই সামগ্রিক প্রেক্ষিত চিন্তা করে ভাটা ইস্যুটি যেন কোনোভাবেই ভাটা না পড়ে- সেদিকে সবার সজাগ ও সচেতন দৃষ্টি রাখাটা খুবই জরুরি হবে।